যিলহজ্ব ১৪৪০   ||   আগস্ট ২০১৯

ছোট্ট সা‘দের কুরবানী ঈদ

উম্মে হাবীবা তামান্না

আব্বুর সাথে ফজরের নামায পড়ে ঘরে ঢুকল সা‘দ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ক’দিন হল জামগাছটাতে এক জোড়া শালিক বাসা বেঁধেছে। ডিম পেড়েছে। সেখান থেকে এখন চিঁচিঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দুটো বাচ্চা ফুটেছে! কী মজা!

দৌড়ে গেল দাদুর কাছে। দাদু কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে সা‘দ বলল, দাদু জানো, ঐ জামগাছটাতে না শালিকের বাসা আছে। ছোট্ট দুটো বাচ্চা ফুটেছে ডিম থেকে। কী সুন্দর!

আচ্ছা দাদু! কুরবানীর ঈদ কবে? আমি না স্বপ্নে দেখেছি, আজ কুরবানীর ঈদ! বলুন না দাদু, ঈদ কবে? দাদু বললেন, এই তো দাদু ভাই। সবে তো জিলকদের বিশ দিন গেল। আরো দশ দিন পর আসবে যিলহজ্ব মাস। যিলহজ্ব মাসে ঈদ হবে। উফ! কবে আসবে যিলহজ্ব মাস! তার যে আর তর সইছে না।

নাশতা খেয়ে সা‘দ মাদরাসায় গেল। শুরু হয়ে গেল তার প্রতীক্ষার প্রহর। প্রতিদিন সে দিন গুণতে থাকে। ত্রিশ যিলকদে তার খুশীর শেষ নেই। আজ যিলহজে¦র চাঁদ উঠবে, কাল ঈদ হবে, কী মজা! কী মজা!

সন্ধ্যায় আব্বুর সাথে ছাদে গিয়ে চাঁদ দেখল সে। চাঁদ দেখে এসে তার কী আনন্দ! কাল ঈদ, কাল ঈদ বলে লাফালাফি শুরু করে দিল। তার কথা শুনে তো আপু আর ভাইয়া হাসতে লাগলেন। আব্বু-আম্মুও মিটমিট হাসছেন। সবার হাসি দেখে সে যেন বোকা হয়ে গেল। কী এমন বলল সে, যার জন্য সবাইকে হাসতে হবে! কেন হাসছ তোমরা? বলে কান্না জুড়ে দিল সে।

দাদুমণি আদর করে সা‘দকে কোলে টেনে নিলেন। চিবুকটা ধরে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, দাদুভাই! যিলহজে¦র ১০ তারিখে কুরবানীর ঈদ হয়। কাল তো এক তারিখ। আর নয় দিন পরে ঈদ হবে। শুনে সা‘দের যেন আরো কান্না পেল। তার এতদিনের প্রতীক্ষা...!

কী আর করা, যা বাস্তব তা তো মেনে নিতেই হবে। কষ্ট করে না হয় আরো কটা দিন অপেক্ষা করবে। দিন তো নয়, যেন একেকটি বছর। একেকটা দিন পার হয় আর সা‘দ গুণতে থাকে এক, দুই, তিন...।

আট তারিখ তাদের মাদরাসা ছুটি হল।

উস্তাদজী বললেন, নয় যিলহজ্ব ফজর থেকে তের যিলহজ্ব আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাযের সালাম ফিরিয়েই সবাইকে একবার করে তাকবীরে তাশরীক পড়তে হবে। তাকবীরে তাশরীক হল-

اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، وَلِلهِ الْحَمْدُ.

এই দিনগুলোকে ‘আইয়ামুত তাশরীক’ বলে।

বাসায় ফেরার পথে দেখল তার প্রতিবেশীদের অনেকেই কুরবানীর পশু কিনেছে। কেউ কিনেছে গরু, কেউবা খাসী। কামাল চাচারা বড় একটি ষাঁড় কিনেছেন। বাসায় এসে সে আব্বুকে বলল, আব্বু আমাদের গরু কিনতে কবে যাবেন? আব্বু বললেন, ইনশাআল্লাহ আজই হাটে যাব।

বিকেলে সা‘দ কামরায় জানালায় দাঁড়িয়ে শালিকের ছানাদুটো দেখছিল। তখনই আব্বুর ডাক শুনতে পেল, সা‘দ, সা‘দ দেখে যাও। সা‘দ বাইরে যেতেই দেখতে পেল খুব সুন্দর সাদাকালো একটা গরুর রশি হাতে আব্বু আর ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। সা‘দ খুশীতে আটখানা। ‘আব্বু! এটা আমাদের কুরাবানীর গরু!’ খুশীভরা গলায় বলল সে। আব্বু বললেন, হাঁ, বাবা, আলহামদু লিল্লাহ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এটা কেনার তাওফীক দিয়েছেন। গরুটা খুব সুন্দর। পুরো শরীর সাদা-কালো। কপালের অংশটুকু সাদা। খুব ভালো লাগল সা‘দের। দৌড়ে বাড়ির ভিতরে গিয়ে আম্মু, দাদু, আপুকে নিয়ে আসল। সবাই তো এত সুন্দর গরু দেখে খুব খুশী। আল্লাহর শোকর আদায় করল।

ভাইয়া অনেকগুলো ঘাস আর লতাপাতা নিয়ে আসলেন। সা‘দ আর ভাইয়া মিলে গরুকে সেগুলো খাওয়াল। রাতে আম্মু ভাতের মাড় দিলেন গরুকে খাওয়ানোর জন্য। আব্বু খাইয়ে দাইয়ে গরুটিকে সুন্দরভাবে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। একটা কয়েলও জ্বালিয়ে দিলেন, মশা যেন না ধরে।

আব্বু বললেন, কুরবানীর পশুর যত্ন করলে অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। আব্বুর কথা শুনে সা‘দ যেন তার সব ব্যস্ততা ভুলে গেল। তার সারাদিন এখন গরুর যত্ন করে কাটে। কখনো ঘাস খাওয়ায়, কখনো মাড় খাওয়ায়, কখনো পাতা দিয়ে মশা মাছি তাড়ায়।

দশ যিলহজ্ব সকালে ফজরের নামায আদায় করেই সে দৌড়ে গেল গরুর কাছে। আজ গরুটিকে কুরবানী করা হবে- একথা মনে হতেই তার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। এতদিন দশ যিলহজে¦র জন্য যে ব্যাকুল ছিল। আর আজ তার মনে হচ্ছিল, দশ যিলহজ্ব যদি আরো পরে আসত। তাহলে তো আরো কয়েকটা দিন গরুটাকে যত্ন করার সুযোগ পেত। এখন তো আর সুযোগ নেই। আজই গরুটিকে কুরবানী করা হবে। গরুটির প্রতি কেমন মায়া হয়ে গেছে তার।

আব্বু সা‘দকে ডাক দিলেন ঈদের নামাযের প্রস্তুতি নিতে। সা‘দ গোসল করল, নতুন জামা পরল। আব্বু-ভাইয়ার সাথে বের হল ঈদগাহের দিকে। সা‘দ দেখল, সবাই জোরে জোরে তাকবীর বলছে-

اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، وَلِلهِ الْحَمْدُ.

সবার সাথে সাথে সেও তাকবীর বলল। আব্বু ঈদের নামায পড়ালেন, খুতবা দিলেন, কুরবানীর আহকাম সম্পর্কে মানুষকে জানালেন আর বললেন, নামাযের পর আমরা কুরবানী করব। আল্লাহর দেয়া অর্থ দিয়ে আমরা কুরবানীর পশু ক্রয় করেছি। আজ একমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্যই আমরা কুরবানী করব।

ঈদের নামায শেষে কেউ আর দেরী করল না। কারণ, কুরবানীর পশু জবাই করতে হবে। সা‘দরা এক রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল অন্য একটি রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে ফিরল। আব্বু গরুটিকে নিয়ে আসলেন, খোলা জায়গায়। ভাইয়া ছুরি নিয়ে আসলেন।

আব্বু গরুটিকে খুব আদর করলেন। আব্বুরও মনে হয় গরুটির প্রতি খুব মায়া হয়ে গিয়েছে; মনে মনে বলল সা‘দ। আব্বু বললেন, বাবা সা‘দ! তোমার বুঝি গরুটির প্রতি খুব মায়া হয়ে গেছে! আমারও হয়েছে। কিন্তু কুরবানী মানেই প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দেওয়া। এ পশু আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। আবার আল্লাহই এটিকে কুরবানী করতে বলেছেন। তাই আমরা এটিকে কুরবানী করব। আল্লাহর দেয়া পশু আল্লাহর হুকুমে, আল্লাহর নামে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরবানী করব। তেমনিভাবে আল্লাহর হুকুমের সামনে আমাদের সব প্রিয় জিনিস বিলিয়ে দিব।

আমরা তো কুরবানী করছি আমাদের প্রিয় এ  সামান্য পশুকে; ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তো আল্লাহর হুকুমে নিজ পুত্রকেই কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন।

সাদের চাচ্চুরা মিলে গরুটিকে শোয়ালো। আব্বু বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করলেন।

বড়রা গরুটিকে নিয়ে ব্যস্ত হলেন। আম্মু গোশত রান্না করতে লাগলেন। তারপর সবাই মিলে গোশত ভাগ করতে বসল। বড় একটি অংশ গরীব-দুঃখীদের জন্য। আশপাশের প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের জন্যও এক ভাগ। আরেক ভাগ রাখা হল নিজেদের জন্য।

দাদু বললেন, আজ সবার খুশির দিন। আজকের খুশি আমরা সবাই ভাগাভাগি করে নিব। গরীব-দুঃখী কেউ বঞ্চিত হবে না এ খুশী থেকে।

আমরা আল্লাহর জন্য কুরবানী করেছি। আল্লাহর নিকট কিন্তু আমাদের এ কুরবানীর গোশত-রক্ত কিছুই পৌঁছবে না। তাঁর কাছে পৌঁছবে শুধু আমাদের নিয়ত ও তাকওয়া। আল্লাহ দেখবেন, কে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য কুরবানী করেছে। দেখ দাদু, সারা বছরই তো আমরা গরু জবাই করি, গোশত খাই। গোশত খাওয়ার জন্য সারা বিশ্বের মানুষই গরু জবাই করে। কিন্তু আজকের গরু জবাই ও কুরবানী গোশত খাওয়ার জন্য নয়; বরং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য। আল্লাহ দেখবেন আল্লাহর হুকুমের সামনে আমরা আমাদের সম্পদ খরচ করি কি না। এবং তা একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করছি, নাকি মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য। এটাই কুরবানীর আসল কথা।

আর আমরা যে কুরবানীর গোশত খাই- এটা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মেহমানদারি। সমাজের ধনী-গরিব সকলেই এ মেহমানদারি গ্রহণ করে। তাই তো আমরা এ গোস্ত একা খাই না; ধনী-গরিব সকলে মিলে খাই।

ভাইয়ার সাথে সা‘দ আশপাশের বিভিন্ন আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে গোশত দিতে গেল। পাশের বস্তিতেও গেল বেশ কিছু গোশত নিয়ে। বস্তির এক একটি ঘরে গোশত বিলিয়ে সা‘দ খুব খুশী হল আর মনে মনে বলল, প্রতিটি দিন যদি কুরবানীর দিনের মত হত!

 

 

advertisement