শাওয়াল ১৪৪০   ||   জুন ২০১৯

আ   ত্ম   স   মা  লো  চ   না

ইবনে নসীব

কওমী অঙ্গনে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা : ভাবতে হবে গোড়া থেকে

কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতির পর আলহাইআতুল উলয়া-এর অধীনে ফযীলত-তাকমীলের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। এই পরীক্ষায় যে ঘটনা ঘটল তা যেমন কওমী মাদরাসার ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্যে কলঙ্কজনক তেমনি সাধারণ তালিবানে ইলমের জন্যেও ছিল চরম পীড়াদায়ক। যে কোনো পরীক্ষাই দুই বার দেয়া কতখানি ক্লান্তি ও কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। আর এ তো ছিল কেন্দ্রীয় পরীক্ষা, যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা একটু বেশিই  থাকে।

এরকম ঘটনা অর্থাৎ প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি জেনারেল পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেকটা স্বাভাবিকের মতো ব্যাপার হলেও কওমী মাদরাসা-অঙ্গন এই উপসর্গ থেকে সাধারণভাবে মুক্ত ছিল। কিন্তু এবারের এই ঘটনা সেই ঐতিহ্যের মুখে কালিমা লেপন করল।

কওমী মাদরাসা অঙ্গনে প্রশ্নফাঁসের মতো ব্যাপারগুলো না থাকার পিছনে কার্যকর ছিল আদর্শিক ও দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু বিষয়, যা দ্বীনী পড়াশোনার ক্ষেত্রে তো বটেই যে কোনো পড়াশোনার ক্ষেত্রেই অনুসরণীয় বিষয়। আদর্শিক বিষয়টি ছিল, কওমী মাদরাসার পড়াশোনা তো জাগতিক স্বার্থ ও প্রতিষ্ঠার জন্যে নয়, এটি একান্তই দ্বীনের সংরক্ষণ ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে। আমাদের প্রবীণ উস্তাযগণ এ বিষয়টি খুব বেশি আলোচনা করে এসেছেন, দরসে, মসজিদের তালীমে, ব্যক্তিগত উপদেশ-নসীহতে এ বিষয়টি ছিল মুখ্য। আখিরাত-মুখিতা, আল্লাহ-মুখিতা, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হওয়ার শিক্ষা ও নির্দেশনাই ছিল আমাদের বৈশিষ্ট্য। এই চেতনা ও উপলব্ধিতে আমাদের অন্তরগুলো যেমন তৃপ্ত ও প্রশান্ত ছিল, আমাদের মজলিসগুলোও এরই আলোচনায় প্রাণবন্ত ছিল। বাইরের দুনিয়ার সাথে আমাদের যেমন সংযোগ ছিল না তেমনি পার্থিবতার প্রতিযোগিতায়ও আমাদের কোনো আগ্রহ ছিল না।

কওমী অঙ্গনের তালিবানে ইলমের মনে এই প্রত্যয় ছিল যে, আমাদের স্বীকৃতি মাখলুকের কাছে নয়, খালিকের কাছে। আর আমাদের ইলমের সাধনা একটি-দুটি সার্টিফিকেটের জন্যে নয়, দ্বীনী উলূম ও ফুনূনে মাহারাত অর্জনের জন্য। এ অঙ্গনে সার্টিফিকেট কোনো কালেই মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল বিষয়বস্তুর পারদর্শিতা ও উন্নত নীতি-নৈতিকতা। এই চেতনাগত, দৃষ্টিভঙ্গিগত ও আদর্শগত বিষয়গুলো ছিল আমাদের সম্পদ, আমাদের বিশিষ্টতা। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে যেন সেই সম্পদই আমাদের হাতছাড়া হতে চলেছে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।

আখিরাত-মুখিতার জায়গায় দুনিয়া-মুখিতা, খালিক-মুখিতার স্থলে মাখলুক-মুখিতা, দ্বীনী-ইলমে মাহারাত ও পারদর্শিতার স্থলে স্বীকৃতি ও সার্টিফিকেট-মুখিতা আমাদের অঙ্গনেও প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এটা হঠাৎ একদিনে ঘটে গেছে এমন নয়, দীর্ঘদিন থেকে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন ঘটছে। ছাত্রদের মধ্যে পড়াশোনায় গভীর নিমগ্নতার পরিবর্তে পরীক্ষা-পাশের প্রবণতা, ইলমী ও ফন্নী অধ্যয়নের পরিবর্তে নোট ও গাইড শ্রেণির বই-পুস্তকের দিকে ঝোঁক, সচেতনতার নামে দরসী পড়াশোনার চেয়ে নিজ নিজ রুচি-অভিরুচি অনুসারে বাইরের নানা বিষয়ে মগ্নতা ইত্যাদি বহুদিন থেকেই আমাদের অঙ্গনে বাড়ছিল। সবশেষে সাম্প্রতিক সরকারি স্বীকৃতির পর যেন এই ধারার গতি আরো বৃদ্ধি পেল, যা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো লজ্জাকর ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে চলে এল। আল্লাহ তাআলাই হেফাযতের মালিক।

এখানে আমাদের গভীরভাবে যে সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে তা হচ্ছে, মাখলুকের স্বীকৃতিই যদি আমাদের কাম্য হয়- নাউযুবিল্লাহ, সেটাও কিন্তু ঐ পথে নয়, যে পথের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি। কারণ, কওমী মাদরাসার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় কোনোভাবে খুব ভালো ফলাফলও যদি করা হয় কিন্তু প্রকৃত যোগ্যতা তৈরি না হয় তাহলে কী লাভ হবে? এই সার্টিফিকেট ও নাম্বারশিট দ্বারা কতদূর যাওয়া যাবে? জনগণ কি আপনার সার্টিফিকেট দেখবে, না আপনার দ্বীনী ও ইলমী যোগ্যতা দেখবে? আমাদের যে কর্মক্ষেত্র তাতে সার্টিফিকেটের জোরে কয়দনি চলা যাবে?

এজন্যই বলছিলাম, মাখলুকের কাছেও যদি স্বীকৃতি কাম্য হয় সেটার পথও এটা নয়, সেটার পথও আগেরটাই। আমাদেরকে আমাদের সাবজেক্টে পারদর্শী হতে হবে। আমাদের সার্টিফিকেটের সরকারি স্বীকৃতি নামক যে বস্তু তা এমন কোনো বস্তু নয়, যার জোরে নিজস্ব পারদর্শিতা ছাড়া আমরা কোনো জায়গায়  পৌঁছুতে পারব। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা যদি আমাদের নীতি, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে জাগতিক শিক্ষা-অন্বেষীদের পথ অবলম্বন করি তাহলে আমরা দুকুলই হারাব।

এটা এক বাস্তবতা, যা আরো গভীরভাবে বলেছেন, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর রা.- ‘আমরা সেই সম্প্রদায়, যাদের আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান দান করেছেন। আমরা যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো পথে সম্মান খুঁজি তাহলে আল্লাহ আমাদের লাঞ্ছিত করবেন।’

আমরা যারা কওমী ঘরানার মানুষ আমরাও ঐ সম্প্রদায়, যাদের আল্লাহ ইলম, তাকওয়া ও ইখলাসের মাধ্যমে সম্মান দান করেছেন। আমরা যদি অন্য কোনো পথে সম্মান খুঁজি তাহলে আমাদের লাঞ্ছিত হতে হবে।

আজ আমাদের তলাবা-আসাতিযা সকলকে খুব গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে- আমরা কোন পথে যাব। সম্মান ও মর্যাদার পথ সেটিই, যে পথে আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত যে পথে চলে আমরা সম্মান ও মর্যাদা পেয়েছি। আমরা যখন ছায়ার পিছনে না ছুটে গন্তব্যের পথে ছুটেছি তখন ছায়া আমাদের পিছনে পিছনে এসেছে। এখন যদি গন্তব্যের পথ ছেড়ে ছায়ার পিছনে ছুটি তাহলে শুধু গন্তব্য থেকেই দূরে সরে পড়ব না, ছায়ার নাগাল পাওয়াও আমাদের জন্যে সম্ভব হবে না।

আসুন, একান্তে একটু ভাবি এবং ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ করি।

 

 

advertisement