শাবান-রমযান ১৪৪০   ||   এপ্রিল-মে ২০১৯

সন্ত্রাস : হযরত মুফতী তকী উসমানীর উপর সন্ত্রাসী হামলা

আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ

গত ২২ মার্চ শুক্রবার জুমায় যাওয়ার সময় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়েছিলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহু তাআলা ওয়া রাআহু। গাড়িতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, এক নাতী ও এক নাতনী। তাঁদের গাড়ি লক্ষ করে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষিত হলেও আল্লাহ তাআলা তাদের হেফাযত করেছেন। ঐ হামলায় তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে দুইজন নিহত ও দুইজন আহত হয়েছেন। হামলার পর দারুল উলূম করাচিতে ফিরে সমবেত ছাত্র-শিক্ষক ও ভক্ত-অনুরক্তদের উদ্দেশে যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন তা ওয়াটস অ্যাপে পাওয়া অডিও ক্লিপ থেকে ইসলাম টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে  বক্তব্যটি আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি :

“আমি বুঝতে পারছি, আপনারা আজকের ঘটনায় চিন্তিত ও পেরেশান। আমি আপনাদেরকে সংক্ষেপে ঘটনাটি বর্ণনা করছি। আমি বায়তুল মোকাররমে জুমা পড়াই। সে উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিলাম। আমার সাথে আমার স্ত্রী এবং এক পৌত্র ও এক পৌত্রি ছিল। ছয়-সাত বছরের শিশু। একজন নিরাপত্তাকর্মী, যিনি পুলিশের পক্ষ থেকে আসেন, তিনি আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন। আমার ড্রাইভার হাবিব ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল।

যখন আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছই হঠাৎ বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হল। আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করেই গুলি ছোড়া হচ্ছিল। সামনের দিক থেকে, ডান ও বাম দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চলতে থাকল। আমার ড্রাইভারের শরীরের এখানে এবং এখানে (হাতের ইশারায় দেখান) দুটি গুলি লাগে। নিরাপত্তাকর্মীরও এখানে গুলি লাগে। আল্লাহর দয়া, আমার শরীরে, আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের গায়ে ভেঙ্গে আসা কাঁচের টুকরোর আঘাত ছাড়া তেমন কোনো আঘাত লাগেনি।

হামলাকারীরা আক্রমণ করে সামনের দিকে চলে যায়। তাদের হয়তো খেয়াল হয় যাকে তারা লক্ষ্য বানাতে চেয়েছিল তাকে লক্ষ্যে পরিণত করতে পারেনি, তখন আবার ফিরে আসে এবং আবারো চতুর্দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমার নিরাপত্তাকর্মী আবারও গুলিবিদ্ধ হন এবং শহীদ হয়ে যান। আমার ড্রাইভারের ডান হাত গুলির আঘাতে অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু সে বাম হাত দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জীবনবাজি রেখে গাড়ি চালাতে থাকে।

আমি তাকে বলেছিলাম, তোমার হাতে আঘাত লেগেছে। তুমি পেছনে এসো। আমি গাড়ি চালাই। কিন্তু সে রাজি হয়নি। সে বলল, হযরত! আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এমনটি করবেন না। ওরা আপনার উপর দ্বিতীয়বার হামলা করেছে। সম্ভাবনা আছে ওরা তৃতীয়বারের মতো হামলা চালাবে। আপনি পেছনে বসুন এবং মাথা নিচু করে বসুন যেন আপনার শরীরে গুলি না লাগে।

তার হাত গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল, রক্ত ঝরছিল, এই অবস্থায় সে নিপা চৌরাঙ্গি থেকে লিয়াকত ন্যাশনাল হাসপাতালে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর আমি তাকে গাড়ি থেকে নামাই। ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

আমরা আশা করেছিলাম, নিরাপত্তা কর্মী বেঁচে যাবেন। কিন্তু ডাক্তাররা জানালেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ড্রাইভারের কথা বলল, এর চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসা করলে সে বেঁচে যাবে এবং সুস্থ হয়ে উঠবে।

আমাদের পেছনের গাড়িতে একজন ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মী ছিল। গুলির আঘাতে নিরাপত্তা কর্মী শহীদ হয়ে যান এবং ড্রাইভার মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি। তার অপারেশন হবে।

আল্লাহর তায়ালার কুদরত যে, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনাদের দোয়া ছিল, আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ছিল। আল্লাহ তায়ালা আমাকে কীভাবে রক্ষা করলেন তার ব্যাখ্যা আমি জাগতিক কোনো উপায়ের দ্বারা করতে পারব না। আল্লাহর দয়ায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থ আছি। ভালো আছি। আমি ভয়ও পাইনি এবং চিন্তিতও নই। কিন্তু আমার দুইজন সাথী শহীদ হয়েছেন। তাদের জন্য আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। তাদের পরিবারের প্রতি আমার দোয়া ও সমবেদনা। দুইজন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিপূর্ণ ও দ্রুত আরোগ্য দান করুন। আমীন।”

এই ভয়াবহ হামলার মুখে তাঁকে নিরাপদ রাখার জন্য আমরা আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করছি- আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল মুরব্বী ও উলামাকে নিরাপদ রাখুন এবং তাদের মাধ্যমে উম্মাহকে বেশি থেকে বেশি উপকৃত করুন।

মৃত্যু তখনই আসবে যখন তা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। তার আগেও না, তার পরেও না। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ কত সত্য- ‘সকল সৃষ্টি যদি তোমার ক্ষতিসাধনে একজোট হয়ে যায় তবুও তারা তোমার ঐটুকু ক্ষতিই করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার বিষয়ে লিখে রেখেছেন।’

হযরত মাওলানার সঙ্গে থাকা দু’জন নিহত হয়েছেন, কিন্তু আল্লাহ তাঁকে হেফাযত করেছেন। এর আগের জুমায় নিউজিল্যান্ডের আননূর মসজিদের ভয়াবহ হামলায় ৫০ জনের মতো নিহত হলেও হুইল চেয়ার আরোহী বাংলাদেশের ফরিদ আহমদ বেঁচে গেছেন! সত্যিই আল্লাহ যদি হেফাযত করেন তাহলেই মানুষ নিরাপদ থাকে, আর আল্লাহ যদি তাঁর হেফাযত উঠিয়ে নেন- আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- তাহলে মানুষ নিরাপত্তার শত বেষ্টনীর মাঝেও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। একারণে নিরাপত্তার সাধারণ নিয়মগুলো পালনের পাশাপাশি কুরআন-সুন্নাহয় নিরাপত্তার যে আমলগুলো রয়েছে তার ইহতিমাম করা কর্তব্য।

পাকিস্তানে এর আগেও বিখ্যাত আলিমগণকে টার্গেট করা হয়েছে। তাঁদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন। এইসব ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার তেমন কোনো তদন্ত ও বিচার হতে দেখা যায়নি। হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহু তাআলার উপর হামলার পর দ্রæত তদন্ত ও বিচারের ঘোষণা এসেছে। ভবিষ্যতই বলে দিবে, তা কতটা সুষ্ঠু ও যথার্থ হয়।

এইসব হামলার ঘটনায় প্রথমেই যে কথাগুলো মনে আসে তা হচ্ছে, ব্যাপকভাবে আলেম-উলামা ও মাদরাসা পড়–য়াদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করার প্রবণতা আমাদের মুসলিম দেশগুলোতেও রয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যত সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই হয়ে থাকে অমুসলিম ও মুসলিমবিদ্বেষী চক্রের মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা ও পরিসংখ্যানে এ বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। মুসলিমরা সন্ত্রাসী নয়; বরং তারাই বর্তমান বিশে^ সন্ত্রাসের শিকার। সাধারণ মুসলিম জনগণের কথা তো বলাই বাহুল্য, গোটা পৃথিবীতে মুসলিম ও অমুসলিম দেশগুলোতে যে পরিমাণ আলেম-উলামাকে শহীদ করা হয়েছে  সে তুলনায় অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুদের কয়জন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন? এই বাস্তব অবস্থাটি আমাদের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণের পরিষ্কারভাবে বোঝা উচিত। বাইরের প্রচার-প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে চোখে দেখা বাস্তবতা ভুলে যাওয়া কিছুতেই বুদ্ধিমানের পরিচয় হতে পারে না।

 

 

advertisement