শাবান-রমযান ১৪৪০   ||   এপ্রিল-মে ২০১৯

ছোট্ট সা‘দের রোযা

বিনতে ইসমাঈল

বছর ঘুরে আবারো রমযানুল মুবারকের আগমন ঘনিয়ে এসেছে। সা‘দের আব্বু বলেন, রমযান হচ্ছে এক বছর পর পর আসা সম্মানিত অতিথি। এই অতিথি শুধু একমাস থাকে, তারপর চলে যায়। এই এক মাসে অতিথির যদি উপযুক্ত সম্মান করা হয়, ভালোভাবে মেহমানদারি করা হয়, তাহলে আল্লাহ অনেক অনেক খুশি হন। বান্দাকে মাফ করে দেন। অনেক আজর দান করেন। আল্লাহ এত খুশি হন যে, তিনি বলেছেন-

كُلّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ، إِلّا الصِّيَامَ، فَإِنّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ.

আদম সন্তানের প্রতিটি আমলই তার জন্য, তবে রোযা ব্যতীত। তা শুধু আমার জন্য এবং এর পুরস্কার আমি নিজেই দিব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪

বান্দার প্রতি দয়াময়ের পুরস্কার আর কী হতে পারে, জান্নাত ব্যতীত! হাঁ, যে রমযানের পরিপূর্ণ হক আদায় করবে, ঠিকমতো রোযা রাখবে, কারো সাথে ঝগড়া, মারামারি করবে না, গালি-গালাজ করবে না, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।

বাবার মুখে রমযানের এতো এতো ফযীলতের কথা শুনে ছোট্ট সা‘দের খুব ইচ্ছে হল রোযা রাখার। কিন্তু সে যে ছোট! এখনো নাকি তার যোরা রাখার বয়স হয়নি। তাই কেউ তাকে রোযা রাখতে দেয় না। আম্মুও না, ভাইয়াও না, আপুও না, এমনকি আব্বুও না, যিনি রোযার এত বড় বড় ফযীলতের কথা শোনান। শুধু বলেন, তুমি এখনো ছোট। বড় হও তারপর রোযা রেখ।

কিন্তু এবার সা‘দ প্রতীজ্ঞা করেছে, যেভাবেই হোক, আব্বু-আম্মুকে রাজী করাবে, সেও এবার রোযা রাখবে। অন্তত একটা হলেও রাখবে। সবাই এতো এতো আজর নিয়ে যাচ্ছে আর সে পিছিয়ে থাকবে! নাহ! আর তা চলবে না।

সে মনে মনে বলল, পাশের বাড়ির মাহমুদ সবগুলো রোযা রাখে, অথচ সে তো আমার বয়সী! মাহমুদ রাখতে পারলে আমি রাখতে পারব না কেন? আমার শক্তি তো মাহমুদের চেয়েও বেশি। সেবার কুস্তি লড়ে আমিই জিতেছি আর মাহমুদ হেরেছে! তাহলে!

তার চেয়েও বড় লজ্জার কথা, মাসউদ চাচার ছেলে নাবীল, যে কি না আমার ছোট- সেও নাকি এবার রোযা রাখবে। আর আমি বড় হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখব! নাহ! হতেই পারে না। মাহমুদ রোযা রাখে বলে সবাই তাকে কত্ত আদর করে! কত্ত সুন্দর সুন্দর উপহার দেয়! সবাই তার কত্ত সুনাম করে! কত্ত মর্যাদা তার সবার কাছে! আর আমি...! কত কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছি রোযা না রাখার কারণে।

রাতে শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে, যেভাবেই হোক আব্বু-আম্মুকে রাজী করাতেই হবে। রাজি না হলে, সে খাবে না। পড়বে না, ঘুমাবে না, কিছু করবে না। শুধু কাঁদবে আর কাঁদবে। কেঁদে কেঁদে সাগর বানিয়ে ফেলবে। তখন  দেখবে, আম্মু-আব্বু তাকে রোযা রাখতে না দিয়ে কীভাবে থাকেন! আম্মু যদি এবারও বলেন, ‘ছোটদের রোযা হয় ছোট ছোট; তিন বেলা খেলে তিনটা রোযা হয়ে যায়’- সে কথা কিছুতেই মানব না।

সা‘দ জানে এভাবে রোযা হয় না। এগুলো আমাকে সান্ত¦না দেয়ার জন্য বলে! এসব ভাবতে ভাবতে সা‘দের চোখজুড়ে ঘুম নেমে এল।

সকাল হল। সা‘দের ঘুম ভাঙল। ওযু করে এসে আব্বুর সাথে দস্তরখানে বসল। আম্মু নাশতা সাজিয়ে তাদের সামনে রাখলেন। সা‘দ ভাবল, এই তো সুযোগ। এখনই আব্বু-আম্মুকে রাজী করানোর উপযুক্ত সময়। সে  মুখ ভার করে বলল, আমি নাশতা খাব না। আম্মু তো হয়রান! কী বলে তাঁর সোনামণি! কেন সে নাশতা খাবে না! আব্বু পেরেশান! কী হয়েছে বাবা, কেন নাশতা খাবে না! সা‘দ বলল, আগে বলো, আমার কথা রাখবে, তাহলে খাব, নইলে কিচ্ছু খাব না।

আম্মু আব্বু দুজনই বলে উঠলেন, আমাদের সোনামণির কথা রাখব না, তা কি হয়! কী চায় আমাদের সোনামণিটা! সব দিব। সা‘দ তো এবার মহাখুশি। এবার আম্মু-আব্বু অবশ্যই তাকে রোযা রাখতে দিবেন। ও তাড়াতাড়ি বলে ফেলল মনের কথাটা- আমাকে কাল তোমাদের সাথে রোযা রাখতে দিতে হবে!

শুনে আব্বু-আম্মু তো, যাকে বলে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তাদের ছেলে যে এভাবে আবদার করে বসবে, ভাবতেই পারেননি। কবে এত বুদ্ধিমান হলো ছোট্ট ছেলেটি!

ছেলেকে বলেছেন, কথা রাখব- না রাখলে এখন কেমন হবে! তবুও সেই আগের কথাই বললেন, না, বাবা! তুমি ছোট। বড় হয়ে রোযা রেখো।

সা‘দ তো শুনে কান্না জুড়ে দিল। বলল, রোযা রাখতে না দিলে আমি খাব না, কিচ্ছু করব না। সবাই রোযা রাখছে, আমি রাখলে দোষ! ওর কান্নাকাটি দেখে আব্বু-আম্মু দুজনেই বললেন, ঠিক আছে বাবা, তোমাকে এবার রোযা রাখতে দিব ইনশাআল্লাহ। এখন আর কান্না করো না সোনামণি! চোখ মুছে একটু হাসো তো!

সাথে সাথে সা‘দের কান্না থেমে গেল। তার খুশি আর দেখে কে, যেন স্পেন জয় করে ফেলেছে! সে আম্মু-আব্বুর গালে টুক করে দুটো আদর দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, এই তো আমি আর কাঁদছি না। এখনই নাশতা খাচ্ছি। আম্মু কাছে টেনে নিয়ে তাকে আদর করতে লাগলেন। আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, সোনার ছেলে আমার!

সন্ধ্যায় আব্বুর সাথে বন্ধুদেরকে নিয়ে সা‘দ বাড়ির ছাদে উঠল চাঁদ দেখতে। অনেক কষ্টের পর চিকন এক ফালি চাঁদ দেখা গেল। দেখতে পেয়ে সে মহাখুশি! চিৎকার করে বলে উঠল- আব্বু, আব্বু দেখ, ঐ যে রমযানের চাঁদ! আব্বু বললেন, বাবা! চাঁদ দেখে দুআ পড়তে হয়-

اللّهُمّ أَهِلّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَالْإِيمَانِ وَالسّلَامَةِ وَالْإِسْلَامِ رَبِّي وَرَبّكَ اللهُ.

(মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৭৬৭)

দুআ পড়ে সবাই ছাদ থেকে নেমে এল। সা‘দের আম্মু তার বন্ধুদেরকে তার সাথে থাকতে বললেন। বললেন, আজ সবাই আমাদের বাসায় থাকো। সবাই একসাথে সেহরী খাবো ইনশাআল্লাহ। রাত ৪টা বাজে আব্বু সবাইকে ঘুম থেকে জাগালেন। সাদ দেখল, আম্মু জায়নামাযে নামায পড়ছেন। সেও মিসওয়াক করে, ওযূ করে আম্মুর পাশে দাঁড়িয়ে গেল নামায পড়তে।

একটু পরে আম্মু খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। সবাই দস্তরখানে বসল সা‘দের সবচেয়ে পছন্দের খাবার মুরগী আর চিংড়ি মাছ। আম্মু আজ তাই রান্না করেছেন। বাহ, কী মজা! সা‘দ মজা করে খেতে লাগল। একটু পরে সবার খাওয়া শেষ হল। মসজিদে আযান দিল, সবাই একসাথে আব্বুর সাথে ফযরের নামায পড়তে গেল। আম্মুও জায়নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। সকাল হল, সা‘দের মনে আজ কী যে খুশি! আনন্দে তার পায়রার মতো উড়তে ইচ্ছে করছে। নিজেকে তার আজ অনেক বড় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আজ যেন সে ভাইয়ার সমান হয়ে গেছে।

বন্ধুদের সাথে খেলাধূলা, গল্প করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। এতক্ষণ তার একটুও ক্ষুধা লাগেনি কিন্তু এখন! কেমন যেন পিপাসা লাগছে তার। গরমও লাগছে বেশ। আম্মু বললেন, গোসল করে এসো, দেখবে ভালো লাগবে। মায়ের কথা মতো গোসল করে এল সে। পিপাসা ভাবটা যেন কিছুটা কমে গেল। গরমও আর লাগছে না। কিন্তু আসরের সময় হতেই তার আবার পিপাসা লেগে গেল। এবার ক্ষুধাও লাগছে বেশ। রোযা রাখা তো তাহলে বেশ কষ্টের, মনে মনে ভাবলো সা‘দ। এজন্যই বুঝি আব্বু-আম্মু তাকে রোযা রাখতে দেয় না।

আসলে আব্বু-আম্মু যা বলেন, সব তার ভালোর জন্যই বলেন, সেই বুঝতে পারে না, মনে মনে ভাবল, আর কখনো আব্বু-আম্মুর নির্দেশ সে অমান্য করবে না। তারা যা বলবে সে তা-ই করবে। আম্মু বললেন, বেশি কষ্ট হলে রোযা ভেঙে ফেলো। কিন্তু না! যত কষ্টই হোক সে রোযা ভাঙবে না। সে জানে, যত কষ্ট তত সওয়াব!

ধীরে ধীরে সময় গড়াতে লাগল, সা‘দের ক্ষুধাও বাড়তে লাগল। আব্বু কত রকমের ফল, খাবার নিয়ে আসলেন। আম্মু রান্নাঘরে মজার মজার ইফতারী তৈরি করতে  লাগলেন। খাবারের  মৌ মৌ ঘ্রাণ সা‘দের ক্ষুধাটাকে যেনো আরো বাড়িয়ে তুলছে। সা‘দের এক বন্ধু এসে সা‘দের কানে কানে বলল, এক কাজ করো। লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু খেয়ে ফেল; কেউ দেখবে না। তোমার ক্ষুধাও যাবে, রোযাও হবে। আমিও একবার এমন করেছিলাম। কেউ টের পায়নি।

সা‘দ ভাবল, বুদ্ধিটা তো মন্দ নয়। খাওয়াও হবে, আবার রোযাও হবে। কারণ কেউ তো জানবে না, আমি যে কিছু খেয়েছি। এই ভেবে লুকিয়ে লুকিয়ে যেই না সে খাবারের দিকে হাত বাড়াল, অমনি তার মনে পড়ে গেল আম্মুর একটি কথা।

আম্মু একদিন বলেছিলেন, মানুষ সবার থেকে আড়াল হতে পারলেও আল্লাহ থেকে কখনো আড়াল হতে পারে না। আল্লাহ সবসময় দেখেন, সবখানে দেখেন। যত গোপন জায়গাই হোক না কেন, আল্লাহ দেখেন। ছোট্ট থেকে ছোট্ট পোকা, যেগুলো দেখাও যায় না। আল্লাহ সেগুলোও দেখেন।

কথাটা মনে আসতেই সাথে সাথে সে হাত গুটিয়ে নিল। বন্ধুকে বলল, কক্ষণও না! আমি এক ফোটা পানিও পান করব না; মরে গেলেও না! আমাকে না হয় কেউ দেখছে না। কিন্তু আল্লাহ তো দেখছেন। সুতরাং যত কষ্টই হোক, আমি সবর করব। তবুও কিছু খাব না। তার কথা শুনে বন্ধুটি বেশ লজ্জিত হল। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইস্তিগফার করল এবং মনে মনে প্রতীজ্ঞা করল, এমন কাজ সে আর কখনো করবে না।

ইফতারের সময় ঘনিয়ে এল। আব্বু মসজিদে ইফতারী দিয়ে আসলেন। তারপর সবাইকে নিয়ে দস্তরখানে বসলেন। বাহ, কত্ত কিছু আজ দস্তরখানে! কত মজার মজার খাবার। কত মজার মজার শরবত। আমের শরবত, লেবুর শরবত, কমলার শরবত, রুহ আফজার শরবত আরো কত কী!

সা‘দ বসে বসে শুধু সময় গুণছে, কখন সময় হবে আর মুআযযিন আযান দিবেন। এত মজার মজার খাবার দেখে তার যেন আর তর সইছিল না, আর বাকি আছে কয়েকটা মিনিট। কিন্তু এই কয়েক মিনিটকেই তার মনে হতে লাগল কয়েক বছর। আব্বু সবাইকে নিয়ে মুনাজাত করলেন।

একটু পরই আযান হল। আব্বু সবার হাতে খেজুর তুলে দিলেন। সা‘দ বিসমিল্লাহ বলে প্রথমে খেজুর খেল। তারপর প্রাণভরে আমের জুস পান করল। এতক্ষণে যেন তার শরীর মন সব জুড়িয়ে এল। আব্বু তাকে দুআ শিখিয়ে দিলেন-

ذَهَبَ الظّمَأُ وَابْتَلّتِ الْعُرُوْقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ.

(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৭)

আব্বু বললেন, এ দুআর অর্থ হল-

“পিপাসা দূর হল, শিরা-উপশিরা সিক্ত হল; এবং ইনশাআল্লাহ প্রাপ্তির খাতায় সওয়াব লেখা হল।”

দুআর অর্থ জেনে তার আরো ভালো লাগল। মনের আনন্দে মজা করে ইফতার খেতে লাগল। তার ছোট মনটাতে তখন বারবার অনুভব হতে লাগল, আজকের মতো সুন্দর দিন তার জীবনে আগে কখনো আসেনি। আজকের মতো মজার খাবার সে আর কোনোদিনই খায়নি। প্রথম বারের মতো রোযা রাখতে পেরে আজ সে অনেক খুশি, অনেক আনন্দিত। ষ

(আল ক্বিরাআতুর রাশিদা অবলম্বনে)

 

 

advertisement