জুমাদাল আখিরাহ-রজব ১৪৪০   ||   মার্চ ২০১৯

সাফল্যের পথ বর্তমানকে কাজে লাগানো

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

কাল তিনটি- অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। সফল ও কর্মময় জীবনের জন্য তিন কালই গুরুত্বপূর্ণ। অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হয়, বর্তমানে কর্মব্যস্ত থাকতে হয়, আর ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতে হয়। শিক্ষা, কর্ম ও পরিকল্পনা এই তিনের মাধ্যমে এগিয়ে  যাওয়া যায় সাফল্য ও অর্থপূর্ণ জীবনের দিকে। কেউ যখন সত্যি সত্যি এগুতে চায় এবং সঠিক উপায়ে পরিশ্রম করে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য নেমে আসে। কাজেই বলা যায়, সফল জীবন গঠনের জন্য অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত তিন কালই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে এই তিনের মধ্যেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বর্তমান। বর্তমানকে যে কাজে লাগায় তার ভবিষ্যত সুন্দর হয়। ইসলাম আমাদেরকে এ বিষয়ে অতি গভীর ও যথার্থ শিক্ষা দান করে। বর্তমান নিবন্ধে একটি সহীহ হাদীসের আলোকে বিষয়টি আলোচনা করার চেষ্টা করব- ইনশাআল্লাহ।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللّيْلِ الْمُظْلِمِ، يُصْبِحُ الرّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا، أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا، يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ الدّنْيَا.

তোমরা ঐ সকল ফিতনা আসার আগেই আমল করে নাও, যা হবে অন্ধকার রাতের বিভিন্ন অংশের মতো। সকালে মানুষ মুমিন থাকবে, সন্ধ্যায় কাফিরে পরিণত হবে অথবা (বলেছেন), সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে সকালে কাফিরে পরিণত হবে। সে নিজের দ্বীনদারি বিক্রি করে দিবে পার্থিব কিছু সহায়-সম্পদের বিনিময়ে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৮

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রাহ. লেখেন-

معنى الحديث الحث على المبادرة إلى الأعمال الصالحة قبل تعذرها والاشتغال عنها بما يحدث من الفتن الشاغلة المتكاثرة المتراكمة كتراكم ظلام الليل المظلم لا المقمر.

এই হাদীসে নেক আমলের দিকে ধাবিত হওয়ার এবং নানাবিধ ফিতনার শিকার হয়ে নেক আমলের অবসর শেষ হওয়ার আগেই নেক আমল করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। যে ফিতনাসমূহের রূপ হবে চাঁদবিহীন অন্ধকার রাতের মতো।

ফিতনাকে উপমা দেওয়া হয়েছে অন্ধকার রাতের সাথে। উপমাটি অতি স্বাভাবিক ও সর্বজনবোধ্য। যে কোনো চক্ষুষ্মান ব্যক্তিই ইচ্ছে করলে তা উপলব্ধি করতে পারবে। দিন ও রাতের বেশিষ্ট্য সবার সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। দিনকে আল্লাহ বানিয়েছেন আলোকজ্জ্বল। দিনের আলোতে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। সাদা-কালো, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য স্পষ্ট থাকে। সাদাকে সাদা বলে, কালোকে কালো বলে চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না, কিন্তু অন্ধকার রাতে সবকিছু আঁধারে ঢেকে যায়। সাদা-কালো, যা দিনের আলোতে স্পষ্ট ছিল তা আর স্পষ্ট থাকে না। তখন কোন্টি সাদা আর কোন্টি কালো তা বোঝার জন্য আলাদা আলোর প্রয়োজন হয়। সেই আলো ছাড়া অন্ধকার রাতে কিছুই দেখা যায় না।

এই অবস্থাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। যে কোনো চক্ষুষ্মান এই অবস্থা দেখেন ও বোঝেন। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অবস্থার উদাহরণ দিয়ে হাদীস শরীফে ফিতনাসমূহের অবস্থা বোঝানো হয়েছে। ফিতনার সময় সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, করণীয়-বর্জনীয়, উচিত-অনুচিত- যা ইন্দ্রিগ্রাহ্য নয়, বুদ্ধিগ্রাহ্য, সেগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়, যেমন অন্ধকার রাতে সাদা-কালো একাকার হয়ে যায়।

ব্যক্তি ও সমাজের সৎপথে চলার ও সত্যের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য যা খুব দরকার তা হচ্ছে ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য-অসত্য স্পষ্ট থাকা এবং সত্য-ন্যায় গ্রহণে ও অন্যায়-অসত্য বর্জনে যা কিছু সহায়ক তা কার্যকর থাকা। কোনো সমাজে যখন সমষ্টিগতভাবে ভালোর জ্ঞান ও চর্চা অব্যাহত থাকে তখন সমাজের সদস্যদের ভালোর পথে চলা সহজ হয়। কে না বোঝে, উত্তম প্রচলন উত্তম কর্মের ক্ষেত্রে অতি সহায়ক। এই অবস্থাটাকে তুলনা করা যায় রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবসের সাথে। সমাজে যদি ভালো কাজের চর্চা ও প্রচলন থাকে তাহলে সর্বস্তরের মানুষের যেমন ভালো কাজটি জানা থাকে তেমনি তা মানাও সহজ হয়। আর বিপরীত বিষয়টি সম্পর্কে দ্বিধা, সঙ্কোচ, ভয় ও লজ্জা কাজ করে, যা ঐ পথে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের আভ্যন্তরীণ এই প্রেরণাসমূহ তখন মানুষের জন্যে কল্যাণকর হয়।  কিন্তু যখন সমাজে মন্দ কর্মের বিস্তার ও প্রচলন ঘটে, এর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং তত্ত্ব ও দর্শনগত সমর্থন আসতে থাকে তখন অনেকের কাছেই বিষয়টি অস্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু জ্ঞানগতভাবেই অস্পষ্ট হয় না, কর্মগতভাবেও ঐ বিষয়ের চর্চায় দ্বিধা, সঙ্কোচ কমতে থাকে। এভাবেই মন্দের অল্প বিস্তারও অধিক বিস্তারে সহায়ক হয়ে থাকে। এই অবস্থাটাকে তুলনা করা যায় অন্ধকার রাতের সাথে, যখন সাধারণভাবে সাদা-কালোর পার্থক্য স্পষ্ট থাকে না। সেটা স্পষ্ট হওয়ার জন্য বিশেষ আলোর প্রয়োজন হয়। সেই আলো অর্থাৎ ইলমে ওহীর আলো যাদের কাছে থাকে এবং যারা সেই আলোকধারী জামাতের সঙ্গে থাকে শুধু তাদের কাছেই ঐ সময় বিশ্বাসগত ও কর্মগত বিভ্রান্তিসমূহ স্পষ্ট থাকে। ফলে ঐসকল বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকাও তাদের পক্ষে সহজ হয়।

আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজ-জীবনকে পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে দেখি তাহলে এই সত্য খুব স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারব। ইসলামের দৃষ্টিতে যা কিছু ‘মুনকার’ ও পরিত্যাজ্য, তা আকীদা ও বিশ্বাসগত হোক, কিংবা কর্ম ও আচরণগত- এই সবের কত কিছু আমাদের মুসলিম-সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। কালেমা পাঠকারী কত আল্লাহর বান্দা সেসব বর্জনীয় বিশ্বাস ও কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে! কত বর্জনীয় বিষয় এমন আছে, যেগুলোর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও রয়েছে! সেসব প্রচার-প্রচারণার শিকার হয়ে কত অসংখ্য মানুষ বিপথগামী হয়েছে এবং অনৈসলামিক চিন্তা, বিশ্বাস ও কর্মের মাঝে লিপ্ত হয়েছে! এক এক করে এই সব বিষয়ের তালিকা যদি প্রস্তুত করা হয় তাহলে সেই তালিকা মোটেও ছোটখাটো হবে না, অনেক দীর্ঘ হবে।

সেই তালিকায় ঈমান-আকীদা সংক্রান্ত ফিতনা যেমন দেখা যাবে তেমনি দেখা যাবে কর্ম ও আচরণগত বহু ফিতনা। কুফর, শিরক, বিদআত শ্রেণির ফিতনাসমূহ যেমন দেখা যাবে তেমনি দেখা যাবে ফিসক-ফুজুর ও গুনাহ-পাপাচার শ্রেণির বহু ফিতনা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সকল অনাচারই ‘শুআবুল কুফর’ অর্থাৎ কুফরেরই শাখা-প্রশাখা।

কুরআন-সুন্নাহর নুসূস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিদের অজানা নয় যে, নসে ‘কুফর’ শব্দের প্রয়োগ যেমন ইসলাম থেকে খারিজকারী আকিদা ও কর্মের ক্ষেত্রে হয়েছে তেমনি সাধারণ গুনাহ ও নাফরমানীর ক্ষেত্রেও হয়েছে। ফরমাবরদারি ও নেক আমল যেমন ঈমানের শাখা-প্রশাখা তেমনি আল্লাহর নাফরমানী ও পাপাচার কুফরের শাখা-প্রশাখা।

 তো সমাজে যখন ফিতনার বিস্তার ঘটে তখন ফিতনার শিকার মানুষের কী অবস্থা হয় তা উপরোক্ত হাদীসে খুব সংক্ষেপে ও সারগর্ভ ভাষায় এভাবে বলা হয়েছে-

يُصْبِحُ الرّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا، أَوْ يُمْسِي مُسلماً وَيُصْبِحُ كَافِرًا.

‘ব্যক্তি সকালে মুসলিম থাকবে, সন্ধ্যায় কাফিরে পরিণত হবে কিংবা বলেছেন, সন্ধ্যায় মুসলিম থাকবে, সকালে কাফিরে পরিণত হবে’।

ইমাম নববী রাহ. বলেন-

وَهَذَا لِعِظَمِ الْفِتَن، يَنْقَلِبُ الْإِنْسَانُ فِي الْيَوْمِ الْوَاحِدِ هَذَا الِانْقِلَاب.

অর্থাৎ ফিতনাসমূহের বিস্তার ও ভয়াবহতার কারণে একদিনের মধ্যেই মানুষের এমন এমন পরিবর্তন ঘটবে।

এর আরো ব্যাখ্যা এসেছে পরের বাক্যে-

يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ الدّنْيَا.

সামান্য পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে নিজের দ্বীনদারি বিসর্জন দিবে।

[قال الطيبي : قوله يصبح استئناف بيان لحال المشبه، وهو قوله فتنا، وقوله يبيع إلخ بيان للبيان. ]

সকল ফিতনার স্বরূপ হচ্ছে মানুষ ঈমান থেকে কুফরের মধ্যে কিংবা ‘সালাহ’ ও পরহেযগারী থেকে গোমরাহী ও পাপাচারের মধ্যে চলে যাওয়া। আর এর পেছনে পার্থিব স্বার্থই বড় কারণ। সামান্য পার্থিব স্বার্থের জন্য নিজের দ্বীনদারি বিসর্জন দেওয়া। ফিতনাসমূহের পরিচয়ের ক্ষেত্রে এটি এমন এক সারগর্ভ বাণী, যার দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত সব ধরনের ফিতনা চিহ্নিত করা এবং ফিতনাকে ফিতনা হিসেবে বুঝতে পারা সম্ভব। শুধু তাই নয়, ফিতনার শিকার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পক্ষেও একান্তে নিজের বিচার নিজে করা সম্ভব।

ফিতনা থেকে আত্মরক্ষার জন্য ফিতনাকে ফিতনা হিসেবে চিনতে পারাটা জরুরি। এর জন্য জ্ঞান ও উপলব্ধির যে আলোর প্রয়োজন তা কুরআন-সুন্নাহয় উম্মতের জন্য রয়েছে।

কুফর-শিরক, গোমরাহী ও পাপাচারের যখন বিস্তার ঘটে তখন আমলে সালিহ ও নেক আমল থেকে মানুষ নানাভাবে বঞ্চিত হয়। আল্লাহর কাছে আমল মাকবুল হওয়ার জন্য তো ঈমান সবচেয়ে বড় শর্ত। কাজেই কুফর-শিরকের ফিতনায় পড়ে ঈমান হারানো ব্যক্তির আমলের কী মূল্য আছে?

তেমনি বিদআতে লিপ্ত হয়ে নিজ ধারণা অনুসারে বড় বড় আমলেও কোনো লাভ নেই। আমল তো সেটিই গ্রহণযোগ্য, যা সুন্নাহ মোতাবেক হয়।

তেমনি গুনাহ ও পাপাচারের বিস্তারের ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের আমলনামায় ভালো কাজ কমতে থাকে, গুনাহের কাজ বাড়তে থাকে। আর যা কিছু নেক আমল করা হয় তারও পূর্ণ সুফল থেকে বঞ্চিত হতে থাকে।

কাজেই হাদীস শরীফের শিক্ষা, ফিতনাসমূহ আসার আগেই ভালো কাজ কর।

ভবিষ্যতের সুসময়ের অপেক্ষায় বর্তমানকে কর্মহীন রাখা নিবুর্দ্ধিতা। বর্তমান সম্পর্কে এবং বর্তমানের করণীয় সম্পর্কে যে সজাগ হয় এবং সেই করণীয় নিষ্ঠার সাথে পালন করতে থাকে তার সময়টাই কাজে লাগে এবং সময়ের সুফল ঘরে তোলা তার পক্ষেই সম্ভব হয়।

এই মোবারক হাদীস থেকে আমাদের জীবন ও কর্মের জন্য যে শিক্ষাগুলো  আমরা গ্রহণ করতে পারি তা হচ্ছে :

এক. নেক আমল ও ভালো কাজের বিষয়ে উদ্যমী ও তৎপর হওয়া।

দুই. বর্তমানের মূল্য বোঝা। একে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

তিন. বর্তমানের নানাবিধ সমস্যা ও সঙ্কটে হতোদ্যম না হয়ে এই পরিস্থিতিতে সাধারণ ও বিশেষ উভয় প্রকারের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে যাওয়া।

চার. চারপাশের বিশ্বাসগত ও কর্মগত ফিতনা থেকে নিজের ঈমান আমলকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

পাঁচ. সম্পদের মোহ ও পদ-পদবির লিপ্সা  থেকে অন্তরকে শুদ্ধ ও পবিত্র করার চেষ্টা করা।

ছয়. ভিতরের প্রবণতাসমূহ যেমন, ক্রোধ, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা, যৌনতা, প্রবৃত্তিপরায়ণতা প্রভৃতির অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সন্ধান করা। কারণ এইসকল আভ্যন্তরীণ প্রবণতা ফিতনার শিকার হওয়ার অনেক বড় কারণ।

সাত. বাইরের প্রচার ও পাপাচারের পরিবেশে প্রভাবিত না হওয়া।

আট. দাওয়াত, তালীম, আমল বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement