রবিউল আখির ১৪৪০   ||   জানুয়ারি ২০১৯

ধর্মান্ধতা : কে শ্রেষ্ঠ- মানুষ, না গরু?

ইবনে নসীব

টাইমস অব ইন্ডিয়ার উদ্ধৃতিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে, যার শিরোনাম এরকম- ‘ভারতে গরুকে রাষ্ট্রমাতা ঘোষণার বিল পাস।’ সংবাদের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, ভারতের হিমাচল প্রদেশের বিধানসভায় গরুকে রাষ্ট্রমাতা হিসেবে ঘোষণার সমর্থনে একটি বিল পাস হয়েছে। বিধানসভার কংগ্রেস দলীয় সদস্য অনিরুদ্ধ সিং বিজেপির সমর্থন নিয়ে এই প্রস্তাব পেশ করেন। অনিরুদ্ধ সিং বলেছেন, ‘গরু কোনো ধর্ম-বর্ণ-জাতির গ-ির মধ্যে পড়বে না। মানবজাতির প্রতি গরুর বিশাল অবদান রয়েছে। উত্তরাখ- ইতোমধ্যে গরুকে রাষ্ট্রমাতা ঘোষণা করেছে। গরু যখন দুধ দেয় না তখন তার কোনো জায়গা হয় না। তাই অবিলম্বে গরুকে রাষ্ট্রমাতা ঘোষণা করা দরকার!’

এর আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বিজেপি শাসিত উত্তরাখ- রাজ্যে গরুকে ভারতমাতা হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাস হয়েছিল। এখন সেই পথেই হাঁটল হিমাচল প্রদেশও। (দ্রষ্টব্য,  দৈনিক যুগান্তর ১৫-১২-২০১৮ঈ.; ভোরের কাগজ, ১৫-১২-২০১৮ঈ.; দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৭-১২-২০১৮ঈ.)

বর্তমান সময়ে যারা প্রগতি ও মুক্তবুদ্ধির কথা বলে থাকেন উপরের সংবাদটির ব্যাপারে তাদের মতামত জানতে পারলে ভালো হত। কিছু মানুষ যখন স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নিজেদেরকে গো-শাবক বলে পরিচয় দিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে এবং  রাষ্ট্রীয়ভাবে এই  পরিচিতি গ্রহণে বিমলানন্দ বোধ করে তখন মনে মিশ্র অনুভূতি না জেগে পারে না। বিষয়টি একাধারে বেদনারও, বিনোদনেরও।

অবশ্য ডারউইনের বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী লোকদের কাছে গোমাতা-দর্শনটি খুব অপাংক্তেয় হবে বলে মনে হয় না। অসম্ভব নয় যে, গো-বানর দম্পতির সুসন্তানেরা ভবিষ্যতে গরুর রচনায় উপরোক্ত তথ্যগুলোও সংযোজনের প্রয়াস পাবেন। একইসাথে নিজেদেরকে প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী পরিচয় দিয়েও যারপরনাই স্ফূর্তি অনুভব করবেন।

চারপাশের জাহিলিয়াতগ্রস্ত মানুষের আরোপিত চিন্তা-ভাবনার নমুনা দেখে অন্তরের অন্তস্তল থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকরগোযারি উৎসারিত হয় যে, তিনি আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে কত উন্নত চিন্তা ও স্বাভাবিক বিশ্বাসের অধিকারী করেছেন। তাওহীদের বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবন ও জগতের সব কিছুর সঠিক মূল্যায়নের যোগ্যতা দান করেছেন। ইসলামের বদৌলতে একজন সাধারণ মুসলিমের কাছেও স্পষ্ট যে, পৃথিবীতে যা কিছু মানুষের কাজে লাগে সবই আল্লাহর সৃষ্টি। গরু-ছাগল, উট-ভেড়া প্রভৃতি প্রাণীকে আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারের জন্য। কুরআন মাজীদে এইসকল প্রাণীকে বলা হয়েছে, ‘আনআম’ অর্থাৎ গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী। এইসকল প্রাণী মানুষের কী কী কাজে আসে তা স্মরণ করিয়ে কুরআন মাজীদ এই শিক্ষা দান করেছে যে, আল্লাহ তাআলার এই দান ভোগ কর আর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর শোকরগোযারি ও কৃতজ্ঞতা আদায় কর।

কত সত্য, স্বাভাবিক ও মনুষ্যত্বের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা! অথচ এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মানুষ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভুলে যা তাদের ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তারই পূজা-অর্চনা ও গুণকীর্তনে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। মনুষ্যত্বের এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কী হতে পারে? কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উদ্দেশে বলেছেন-

وَ لَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ نَسُوا اللهَ فَاَنْسٰىهُمْ اَنْفُسَهُمْ

তোমরা ওদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহ তাদের আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। -সূরা হাশর (৫৯) : ১৯

আল্লাহ-বিস্মৃত মানুষ যে অবশেষে আত্ম-বিস্মৃত হয়ে পড়ে এবং নিজেকে নিজে ক্ষুদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত করে- উপরের ঘটনাটি তার একটি দৃষ্টান্ত।

হাঁ, এখানে একইসাথে আরেকটি কথাও বলব। একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের আত্ম-বিস্মৃতির এই দৃষ্টান্ত আলোচনার পাশাপাশি আমরা সহনশীলও বটে। জী, অবশ্যই আমরা সহনশীল। এর চেয়ে বড় সহনশীলতা আর কী হতে পারে যে, একটি চেতনা ও বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও মনুষ্যত্বের অবমাননা বলে বিশ্বাসের পরও সেই চেতনাধারী ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোকদের সাথেও আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। বস্তুত এটিই তো প্রকৃত সহনশীলতা। ‘সহন’ কি ‘দহন’ ছাড়া হতে পারে?

তো এই বিশ্বাস ও অবস্থানের সাথে ভুলকে ভুল বলে বিশ্বাস করা এবং চিহ্নিত করে দেওয়াও আমরা কর্তব্য মনে করি। এটা মানবতা ও মানবতার প্রতি কল্যাণকামিতা। যেন মানুষ সেই ভুলের শিকার না হয়। যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়-অন্যায় এবং সুপথ-বিপথ স্পষ্ট করে দেওয়া তো মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। এরপর তা গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। এটিই ইসলামের শিক্ষা।

ভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতার অর্থ কখনো এই নয় যে, যা সত্য নয় তাকেও সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে, কিংবা তার যুক্তিসঙ্গত পর্যালোচনা থেকেও বিরত থাকতে হবে। এটা তো বর্তমান সময়ের পরিচিত পরিভাষা ‘বাকস্বাধীনতা’ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতারও পরিপন্থী।

ওই সংবাদে আরেকটি কথাও আছে। ‘গরুর উপর অত্যাচার ও গণপিটুনি ঠেকাতে রাজ্যে নতুন আইন করা প্রয়োজন বলেও দাবি করেন কংগ্রেসের এই বিধায়ক।’

শুধু গরু কেন, কোনো পশুপাখির উপরই জুলুম করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা যেসকল প্রাণীকে হালাল করেছেন তা হালাল। যে প্রাণীকে যেভাবে ব্যবহারের অনুমোদন শরীয়তে আছে সেভাবেই তা ব্যবহার করা যাবে। অন্যায়ভাবে কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। এটি ইসলামের শিক্ষা।

আমাদের মনীষীগণ পশু-পাখীর হক সম্পর্কেও অনেক বই-পুস্তক রচনা করেছেন, যেগুলোতে এ সংক্রান্ত কুরআন-হাদীসের বাণী ও বিধান সংকলিত হয়েছে। ভারতবর্ষের এক বিখ্যাত মনীষী হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-ও এ বিষয়ে লিখেছেন। যে কেউ তা সংগ্রহ করে পাঠ করতে পারেন। কাজেই এটি স্বীকৃত যে, পশু-পাখীর উপরও জুলুম করা  যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের উপর কি জুলুম করা যাবে? বর্তমান ভারতে যদি গরুর উপর অত্যাচার ও গণপিটুনি ঠেকাতে নতুন আইনের প্রয়োজন হয় তাহলে মানুষের উপর অত্যাচার ও গণপিটুনি ঠেকাতে আইন  ও আইনের প্রয়োগ আরো বেশি প্রয়োজন নয় কি? ভারত-জুড়ে যেভাবে গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগে মুসলমানদের গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে সেখানে মানুষের বদলে গরুর জন্য নতুন আইনের প্রস্তাব মর্মান্তিক পরিহাস নয় কি? চিন্তা ও কর্মের এই অবক্ষয়-আবদ্ধতার উপর কী-ইবা বলার আছে?

যাই হোক, আমরা ইসলামের সম্পদে সৌভাগ্যবান হওয়ায় আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করছি। একইসাথে তাওহীদের শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষেরা ঈমান ও তাওহীদের এই মহাসম্পদ লাভ করুন- অন্তরের অন্তস্তল থেকে এই কামনাও করছি। এই সম্পদ যেমন মানুষকে পরিচিত করে তার সৃষ্টিকর্তার সাথে তেমনি তাকে দান করে মনুষ্যত্বের প্রকৃত মর্যাদা।

 

 

advertisement