রবিউল আখির ১৪৪০   ||   জানুয়ারি ২০১৯

আলকুরআন : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনন্য মুজেযা

হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চতুর্থ কারণ

কুরআন মুজেযা হওয়ার চতুর্থ কারণ হল, এ কিতাবে পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী এবং তাদের শরীয়ত ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের এমন স্বচ্ছ বিবরণ পাওয়া যায় যে, তদানীন্তন বিখ্যাত ইহুদী-খ্রিস্টান পাদ্রীগণ, যাদেরকে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের বিদগ্ধ প-িত মনে করা হত, তাদেরও সেভাবে জানা ছিল না।

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল না। কোনো জ্ঞানীজনের  সঙ্গেও  তিনি থাকেননি। জীবনে কোনো কিতাব ছুঁয়েও দেখেননি। এতদসত্ত্বেও পৃথিবীর সূচনাকাল থেকে রাসূলের যুগ পর্যন্ত নিখিল বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক অবস্থা, অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও সত্যনিষ্ঠ জীবন-বৃত্তান্ত এবং তাদের শরীয়তের এরূপ বিশদ বিবরণ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, এটি মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কালাম হতে পারে না।

একমাত্র আল্লাহই যে তাঁর নবীকে এসব বিবরণ জানিয়েছেন তাতে সন্দেহের  কোনো অবকাশ নেই।

 

পঞ্চম কারণ

কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষের মনের বিভিন্ন গোপন কথার সংবাদ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সংবাদগুলো সত্য এবং যথার্থ ছিল।

এ কাজটিও একমাত্র আল্লাহ তাআলাই করতে পারেন। কোনো মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। যেমন, কুরআনে পাকে ইরশাদ হয়েছে-

اِذْ هَمَّتْ طَّآىِٕفَتٰنِ مِنْكُمْ اَنْ تَفْشَلَا.

যখন তোমাদেরই মধ্যকার দুটি দল চিন্তা করেছিল যে, তারা হিম্মত হারিয়ে ফেলেছে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১২২

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ یَقُوْلُوْنَ فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ لَوْ لَا یُعَذِّبُنَا اللهُ بِمَا نَقُوْلُ.

আর তারা মনে মনে বলে, আমরা যা বলছি, তার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন না কেন? -সূরা মুজাদালাহ (৫৮) : ৮

এসব এমন বিষয় যে, কেউ তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি। একমাত্র কুরআনই তা উন্মোচন করেছে।

ষষ্ঠ কারণ

কুরআন মুজেযা হওয়ার ষষ্ঠ কারণ হচ্ছে সে সকল আয়াত, যাতে কুরআন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে এরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, তারা অমুক কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে না। পরবর্তীতে সে লোকেরা বাহ্যিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সে কাজ করতে সক্ষম হয়নি।

যেমন : ইহুদীদের বিষয়ে কুরআন ঘোষণা করেছে যে, তারা যদি নিজেদেরকে আল্লাহর প্রকৃত বন্ধু ও প্রিয়জন মনে করে,  তবে আল্লাহর কাছে যাওয়ার প্রতি তাদের আশা-আকাক্সক্ষা অবশ্যই থাকা চাই। তারা পারলে মৃত্যু কামনা করে দেখাক! এরপর ইরশাদ হয়েছে- وَ لَنْ یَّتَمَنَّوْهُ

কিন্তু (আমি বলে দিচ্ছি) তারা কখনোই এরূপ আকাক্সক্ষা করবে না।

মৃত্যু কামনা করা কারো জন্য কঠিন ছিল না। বিশেষ করে সে লোকদের জন্য, যারা কুরআনকে মিথ্যা অভিহিত করত। কুরআনের ঘোষণার কারণে মৃত্যু কামনা করতে তাদের ভয় পেয়ে যাবার কোনো কারণ ছিল না।

ইহুদীদের জন্য তো মুসলমানদের পরাজিত করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ ছিল। তারা চাইলে প্রতিটি মজলিসে জনসমক্ষে মৃত্যু কামনার ঘোষণা দিতে পারত। কিন্তু ইহুদী-মুশরিকেরা মুখে যতই কুরআনকে মিথ্যা বলুক, মনে মনে তারা ঠিকই জানত যে, কুরআন সত্য। এতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যদি আমরা এখন মৃত্যু কামনা করি, তবে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ব। এজন্য কুরআনের এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কোনো ইহুদীর পক্ষে মুখ দিয়ে একটি বারের জন্যও মৃত্যুকামনা করার সাহস হয়নি।

 

সপ্তম কারণ

কুরআন তিলাওয়াত শুনলে সাধারণ-অসাধারণ, মুসলিম-অমুসলিম সকলের অন্তরে যে অপূর্ব মোহময়তা ও অসাধারণ  অনুভূতি জাগ্রত হয় তাতে কুরআন যে আল্লাহর কালাম তা বরাবরই প্রমাণিত হয়।

হযরত জুবাইর বিন মুতইম রা. ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের নামাযে সূরা তূর তিলওয়াত করতে শোনেন। হুযূর যখন শেষ আয়াতে পৌঁছলেন, তখন জুবাইর রা. বলেন, মনে হল, আমার অন্তরাত্মা যেন উড়তে শুরু করেছে। সেদিনই সর্বপ্রথম আমার অন্তরে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছে।

সে আয়াতগুলো ছিল এই-

اَمْ خُلِقُوْا مِنْ غَیْرِ شَیْءٍ اَمْ هُمُ الْخٰلِقُوْنَ اَمْ خَلَقُوا السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ  بَلْ لَّا یُوْقِنُوْنَ اَمْ عِنْدَهُمْ خَزَآىِٕنُ رَبِّكَ اَمْ هُمُ الْمُصَۜیْطِرُوْنَ.

তারা কি আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, না কি তারাই (নিজেদের) স্রষ্টা? নাকি আকাশম-লী ও পৃথিবী তারা সৃষ্টি করেছে? না; বরং মূল কথা হচ্ছে, তারা বিশ্বাসই রাখে না। তোমার প্রতিপালকের ভাণ্ডার কি তাদের কাছে রয়েছে? নাকি তারাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক? [সূরা তূর (৫২) : ৩৫-৩৭] -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০৫০, ৪৮৫৪; দালাইলুন নুবুওয়াহ, আবু নুআঈম ১/৩০৮

 

অষ্টম কারণ

কুরআনকে বারবার পাঠ করলে বা শুনলে মনে কোনোরূপ বিরক্তি আসে না; বরং যত বেশি তিলাওয়াত করা হয়, ততই তার প্রতি আগ্রহ-আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। দুনিয়াতে যত চমৎকার আর আকর্ষণীয় বই আছে, দু-চারবার পড়ার পর তাতে একঘেয়েমি চলে আসে। তখন না সেটি পড়তে মনে চায়, না- শুনতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু পবিত্র কুরআনের এটি একক বৈশিষ্ট্য যে, যত বেশি এ গ্রন্থ পাঠ করা হবে, ততই তার প্রতি ভালবাসার টান তৈরি হবে। কুরআন আল্লাহর বাণী হওয়ার এটিও একটি প্রমাণ।

 

নবম কারণ

কুরআন ঘোষণা করেছে যে, তার সংরক্ষণের ভার স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এ মহাগ্রন্থ চুল পরিমাণ বিকৃতি ও রদবদলের হাত থেকে পরিপূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তাআলা তার এ ওয়াদা পূরণ করেছেন।

যার ফলে কুরআন নাযিলের সময়কাল থেকে আজ প্রায় চৌদ্দশ বছর গত হতে চলেছে, এ সুদীর্ঘ সময়ের প্রত্যেক শতাব্দীর সকল যুগে লাখো বনী আদম এমন ছিলেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন, যাদের বক্ষে সমগ্র কুরআন এমনভাবে সুরক্ষিত যে, তার একটি যবর-যেরেও ভুল থাকার কোনো অবকাশ নেই।

প্রত্যেক যুগেই  নারী-পুরুষ, শিশু-প্রবীণ সব শ্রেণীর মাঝে কুরআনের হাফেজ বিদ্যমান ছিলেন।

কখনো বড় কোনো আলেমেদ্বীনও যদি কুরআনের কোথাও ভুল করে বসেন, তবে ছোট ছোট বাচ্চারাও মুহূর্তে তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারবে।

পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম নিজেদের ধর্মগ্রন্থের ব্যাপারে এরূপ নজির দেখাতে পারবে না। বহু ধর্মগ্রন্থের অবস্থা তো এতটাই শোচনীয় যে, তার মূল কোন ভাষায় লিখিত, আর তাতে কয়টি অধ্যায় রয়েছে, এটুকু রহস্যভেদ করাও আজ মুশকিল হয়ে গেছে।

প্রতি শতাব্দীতে গ্রন্থ আকারেও এ কুরআনের যে বিপুল সংখ্যক নুসখা মুদ্রিত হয় দুনিয়ার আর কোনো গ্রন্থের ক্ষেত্রে হয়ত সেই সৌভাগ্য জোটেনি। অথচ ইতিহাস প্রমাণ করে, সকল যুগেই মুসলমানদের সংখ্যা কাফেরদের তুলনায় অনেক কম ছিল।

আর প্রকাশনা ও প্রচারমাধ্যমের যে প্রাচুর্য অমুসলিম জগতে ছিল, তার উল্লেখযোগ্য অংশও মুসলিমসমাজে ছিল না। এতদসত্ত্বেও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কারো কোনো গ্রন্থ পৃথিবীতে এতটা প্রকাশিত হয়নি, যতটা পবিত্র কুরআনের ক্ষেত্রে হয়েছে।

আর কুরআনের সুরক্ষাকে আল্লাহ তাআলা শুধু মলাটবদ্ধ গ্রন্থের উপর নির্ভরশীল করে রাখেননি যে, তাতে আগুন ধরে যাওয়া বা কোনোরূপ বিলুপ্তির আশংকা থেকে যাবে; বরং নিজ বান্দাদের অন্তরেও একে এমনভাবে গেঁথে দিয়েছেন যে, আল্লাহ না করুন, আজ যদি সারা পৃথিবীর কুরআনের সকল কপি বিলুপ্ত করে ফেলা হয়, তবুও এ কিতাব অবিকল সংরক্ষিত থেকে যাবে। কয়েকজন কুরআনের হাফেজ একত্রে বসলেই সমগ্র কুরআন পুনরায় লিখে নেওয়া সম্ভব।

এ নজিরবিহীন সুরক্ষাও একমাত্র কুরআনেরই বৈশিষ্ট্য এবং তা আল্লাহর বাণী হওয়ার জ¦লন্ত প্রমাণ। যেমনিভাবে মহান আল্লাহ এক চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর সত্তা, তাঁর উপর কোনো সৃষ্টির কর্তৃত্ব চলে না ঠিক তেমনি তাঁর মহান কালামও সর্বকালে সৃষ্টিকুলের হস্তক্ষেপ থেকে অনেক ঊর্ধ্বের এক চিরস্থায়ী কালাম। কুরআনের এ ভবিষ্যদ্বাণী দেড় হাজার বছর যাবৎ বিশ্বমানবতার সম্মুখে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান  রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে- ইনশাআল্লাহ। এমন প্রকাশ্য মুজেযা থাকার পরও কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়ার বিষয়ে কারো কি কোনো সংশয় থাকতে পারে?

 

দশম কারণ

এ ইলম ও মারেফাত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনিঃশেষ ফল্গুধারা, যা না অতীতের কোনো গ্রন্থ ধারণ করেছে, না ভবিষ্যতে করা সম্ভব। অতি সংক্ষেপে ও খুব অল্প শব্দে এত অজস্র জ্ঞান ভাণ্ডারের সমারোহ, যা একাধারে গোটা সৃষ্টিজগতের জরুরি বিষয়াদিকে অন্তর্ভুক্ত করে, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ও অবস্থার পূর্ণাঙ্গ, সুবিন্যস্ত এবং সর্বোত্তম বিধান দান করে।

যা একদিকে ব্যক্তি, পরিবার, গ্রামীণ ও নগর জীবন, অন্যদিকে সমাজ, সভ্যতা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা অবধি সকল অঙ্গনের একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম।

অধিকন্তু তা নিছক তাত্ত্বিকভাবে মতাদর্শ গোছের ‘আইন-ব্যবস্থা’ প্রণয়ন করেছে এমন নয়; বরং বাস্তব জীবনে তার যথাযথ প্রতিষ্ঠা-প্রবর্তন এবং অনন্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বের অপরাপর আইন ব্যবস্থাকে  ছাড়িয়ে গিয়ে, মানবসমাজের স্বভাব, চরিত্র, কর্ম ও আচরণ এবং সভ্যতা-সংস্কৃতিতে এমন মহা বিপ্লব সৃষ্টি করেছে যার দৃষ্টান্ত না সুদূর অতীতে খুঁজে পাওয়া যায়, না আগামীতে পাওয়া সম্ভব।

এ অত্যাশ্চর্য ও অসাধারণ বিপ্লব কি কোনো মানবীয় সাধ্য-সামর্থ্য ও কর্ম-কৌশলের ফল হতে পারে? বিশেষত যখন সেই  ব্যক্তি নিজেও একজন উম্মী আর তার সমাজও নিরক্ষর।

এসব হল সেই অকল্পনীয় শক্তি ও প্রভাব, যার কারণে কুরআনকে আল্লাহর বাণী মেনে নিতে যে কেউ বাধ্য হবেন, যদি তার বিবেক-বুদ্ধি সংকীর্ণতা ও একগুঁয়েমির কারণে সম্পূর্ণ ধ্বংস না হয়ে  থাকে।

এমনকি জড়বাদ ও ভোগবাদের এ যুগেও যে সকল খ্রিস্টান লেখক কুরআন নিয়ে সামান্য চিন্তা ও গবেষণামূলক কাজ করেছেন, তারাও একে অতুলনীয় অসাধারণ গ্রন্থ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

 

অমুসলিমদের সাক্ষ্য

ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ডক্টর মার্ডারেস যাকে ফ্রান্স সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কুরআনে কারীমের বাষট্টিটি সূরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনুবাদ করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিল, তার বক্তব্য দেখুন-

কুরআনের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি নিঃসন্দেহে মহান সৃষ্টিকর্তার বর্ণনাভঙ্গি। যেসব পরমজ্ঞান ও তত্ত্বকথা এ কালামে রয়েছে, তা কেবল কোনো ঐশীগ্রন্থেই থাকতে পারে।

আর বাস্তবতা হচ্ছে, এ বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তিরাও যখন এর অসাধারণ কার্যকারিতা ও অসামান্য প্রভাবের বৈশিষ্ট্যটি উপলদ্ধি করে, তখন তারাও বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলিমের জীবনে কুরআনের আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে খ্রিস্টান মিশনারী সদস্যবৃন্দ একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এরূপ একটি ঘটনাও দেখানো যাবে না, যাতে কোনো মুসলমান ইসলাম ও কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করার পর কখনো স্বেচ্ছায় ইসলামত্যাগ করেছে বা কুরআনকে অস্বীকার করেছে।’

মুসলিমজীবনে কুরআনের ঐশী প্রভাবের কথা এমন এক যুগে এ খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদের কলমে এল, যখন স্বয়ং মুসলমানরা ইসলাম ও কুরআনের বিষয়ে অজ্ঞ, এর শিক্ষা-দীক্ষা থেকে দূরে এবং এর তিলওয়াতের প্রতি উদাসীন।

হায়! এ লেখক যদি ইসলাম ও কুরআনের সেই সোনালী অতীত দেখতে পেতেন, যখন মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে কুরআনের আমল  ছিল। আর তাদের মুখে মুখে কুরআনের আয়াত ছিল!

এভাবে অন্যান্য নিরপেক্ষ খ্রিস্টান লেখকগণও এরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। মিস্টার উইলিয়াম ম্যুর তার ‘মুহাম্মাদ চরিত’ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ডক্টর শিবলী শামুয়েলও এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

এ যাবৎ আপনারা ‘আল কুরআন : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনন্য মুজেযা’ প্রসঙ্গে দশটি কারণ জেনেছেন। এখন সংক্ষেপে একটু লক্ষ্য করুন,

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতিম অবস্থায় পৃথিবীতে আগমন করেন। জীবনভর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদার্পণ করেননি। বই, কলমও স্পর্শ করেননি। নিজের নামটিও তিনি স্বহস্তে লিখতে পারতেন না। এভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক হলেন।

তিনি ছিলেন নির্জনপ্রিয়। খেলাধুলা, হাসি-তামাশা, অনুষ্ঠান ও জনসমাগমে যাতায়াত তাঁর ধাতে ছিল না। গদ্য-পদ্য সাহিত্যের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক ছিল না। জীবনে কোনো জনসমাবেশে কখনো বক্তৃতা বা ভাষণ দেওয়ারও সুযোগ ঘটেনি।

যখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর হল এবং লেখাপড়া শেখার স্বাভাবিক বয়সও আর বাকি রইল না ঠিক সে সময় তার পবিত্র যবানে এমন অকল্পনীয়, বিস্ময়কর, সর্বজ্ঞানের আধার, বহুবিধ তত্ত্বজ্ঞান ও ভাষা-সাহিত্যের মানদণ্ডে অসাধারণ এক অলৌকিক বাণী আসতে শুরু করল, যা কোনো বিদগ্ধ পণ্ডিত, বাকশিল্পী বা সাহিত্যগুরুর পক্ষেও সম্ভব না।

এ বাণীর মাধ্যমে তিনি আরবের খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিকদের সম্ভাষণ করছেন। তাদের আসরে গিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপকভাবে আর আরবদেরকে বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জ করছেন যে, এ কালাম আল্লাহর বাণী হওয়ার বিষয়ে তোমাদের কারো সংশয় থাকলে এর ছোট কোনো সূরার নমুনা তৈরি করে দেখাও। গোটা জাতি তার এ চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে ব্যর্থ ও অপারগ হয়ে পড়ছে।

যারা এতদিন তাকে ‘আল-আমীন’ ও বিশ্বস্ত উপাধিতে স্মরণ করত, তাকে সমীহ করে চলত, তারা সবাই এবার তার প্রতিরোধে অবতীর্ণ হল। তাকে এ বাণীর প্রচার থেকে নিবৃত্ত করতে ধন-সম্পদ,  নেতৃত্ব এবং সকল ভোগ সামগ্রীর প্রস্তাব নিয়ে হাজির হল। আর তিনি এর সবই প্রত্যাখ্যান করলেন।

পুরো গোষ্ঠী তাকে ও তার সঙ্গীদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন করতে উঠেপড়ে লাগল। তিনি এ সবকিছু সহ্য করে নিলেন। তবুও এ বাণী প্রচারের কাজ ছাড়লেন না। কওমের লোকেরা তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। যুদ্ধ-সংঘর্ষে নেমে আসল। তাকে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে মদীনায় পাড়ি জমাতে হল। শত্রুরা সেখানেও তাকে শান্তিতে বসবার করতে দিল না। সমগ্র আরব, ইহুদী এবং  খ্রিস্টানরা তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে গেল। মদীনার উপর বার বার আক্রমণ করতে লাগল।

তার শত্রুরা এতকিছু করল। অথচ কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এর ছোট্ট কোনো সূরার সমতুল্য কোনো রচনা তৈরি করে আনতে পারল না। কুরআন তাদেরকে তিরস্কার করল। আত্মসম্মানে ঘা দিল। তবুও তাদের তীব্র অহংবোধে মৃদু কম্পনও সৃষ্টি হল না।

আর শুধু যে আরববাসীই কুরআনের নজির পেশ করতে অপারগ ছিল তা-ই নয়; বরং যে পবিত্র মানুষটির উপর এ মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, তারও ক্ষমতা ছিল না, নিজ থেকে এর নজির পেশ করার। তার নিজস্ব বাণীসমগ্র (যাকে হাদীস বলে)  যেই মানের, কুরআনের বাণী নিঃসন্দেহে তা অপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

قَالَ الَّذِیْنَ لَا یَرْجُوْنَ لِقَآءَنَا ائْتِ بِقُرْاٰنٍ غَیْرِ هٰذَاۤ اَوْ بَدِّلْهُ ؕ قُلْ مَا یَكُوْنُ لِیْۤ اَنْ اُبَدِّلَهٗ مِنْ تِلْقَآئِ نَفْسِیْ.

যারা (আখেরাতে) আমার সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে না, তারা বলে, এটা নয়; অন্য কোনো কুরআন নিয়ে আস। অথবা এতে পরিবর্তন আন।  ( হে নবী!) বলুন, আমার এ অধিকার নেই যে, নিজের পক্ষ থেকে এতে কোনো পরিবর্তন আনব। -সূরা ইউনুস (১০) : ১৫

একদিকে কুরআনের এ জাজ্বল্যমান মুজেযাসমূহ আল্লাহর বাণী হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করছে। অন্যদিকে এর বিষয়বস্তু, অন্তর্নিহিত তত্ত্ব, গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আরো অধিক বিস্ময় সৃষ্টি করছে।

কুরআন নাযিলের শুরুর দিকে কয়েক বছর তো এমন সংকটময় পরিস্থিতি ছিল যে, তখন প্রকাশ্যে কুরআনী শিক্ষা প্রচার করাও সম্ভব ছিল না। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে গোপনে লোকদেরকে কুরআনের মৌলিক শিক্ষার দাওয়াত দিতেন। তারপর শত প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মাঝে কিছু কিছু প্রকাশ্য দাওয়াতও শুরু হল। কিন্তু কুরআনের প্রস্তাবিত আইন বাস্তবায়ন করার কোনো সুযোগ-সম্ভাবনা তখন ছিল না।

মদীনায় হিজরতের পর মাত্র দশটি বছর এমন জুটল, যাকে মুসলমানদের জন্য ‘স্বাধীনতার যুগ’ বলা যেতে পারে। কুরআনী জীবন-ব্যবস্থার পাঠদান, বাস্তবায়নের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা এবং যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য এটি শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। কিন্তু এ দশ বছরের ইসলামী ইতিহাসও অধ্যয়ন করলে জানতে পারবেন, এর প্রথম ছয় বছর শত্রুদের আক্রমণ আর মদীনার ইহুদী-মুনাফিকদের ক্রমাগত চক্রান্তের জালে এমনভাবে আবদ্ধ ছিল যে, কোনো গঠনমূলক কাজ বা এমন একটি জীবন-ব্যবস্থা, যা গোটা পৃথিবীর সকল ব্যবস্থা থেকে আলাদা, প্রণয়ন করার ও বাস্তবায়ন করার মোটেই অবকাশ ছিল না।

মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বড় বড় সকল যুদ্ধ এ ছয় বছরেই সংঘটিত হয়। বদর, উহুদ, খন্দকের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোও এ সময়ে ঘটে। হিজরতের ষষ্ঠ বছর দশ বছরের জন্য হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি সাক্ষরিত হয়, কিন্তু আরবের কোরাইশরা মাত্র এক বছর এ চুক্তিতে কায়েম থাকে। এরপর সেটিও তারা লংঘন করে। ফলে আবার যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয়ে যায়।

স্বাভাবিকভাবে কুরআনী দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার এবং এর সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বাহ্যত মাত্র এই দু’এক বছরই ছিল। এ সময় তিনি বিশে^র শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রতি কুরআনী দাওয়াত সম্বলিত পত্রাবলি প্রেরণ করেন। ব্যাপক পরিসরে কুরআনী নেযামের বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেন।  জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ স্বাধীনতার বয়স মাত্র চার বছর। এর মাঝে আবার মক্কা বিজয়ের অভিযানও সংঘটিত হয়।

এখন এ চার বছরের সংক্ষিপ্ত সময়কে দেখুন, আর কুরআনের এ অভাবনীয় সাফল্য লক্ষ্য করুন।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের সময় প্রায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে কুরআনের শাসন ছিল। যার মানচিত্র একদিকে রোম সীমান্তে, অন্য দু’দিকে ইরাক ও এডেন শহর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

ধরে নেওয়া যাক, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মী নবী ছিলেন না। ক্ষণিকের জন্য এ কথাও ভুলে যাওয়া যাক যে, তার গোষ্ঠী এমনই দুর্ধর্ষ ছিল যে, কখনো কোনো বাদশাহর অধীনতা স্বীকার করেনি। মন থেকে এ ইতিহাসও মুছে ফেলুন যে, সারা পৃথিবী তার বিপক্ষে ছিল, আরবের মূর্তিপূজক, ইহুদী, খ্রিস্টান সকলে একজোট হয়ে তাকে আর কুরআনকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে আমরণ উদ্যত ছিল; বরং সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশ ছিল ধরে নিন। তবুও তো একটি নতুন ধারার জীবনব্যবস্থা ও নতুন আইনের সংবিধান প্রথমত প্রণয়ন করে সুবিন্যস্ত করা, এরপর তা জনগণকে শেখানো-বোঝানো, তারপর তা যথাযথ বাস্তবায়ন করে অবশেষে একটি আদর্শ ও পবিত্র সমাজ গঠন করা এবং সারাদেশে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এ সবকিছু করতে যে সুদীর্ঘ সময় বিপুল অর্থ ও জনশক্তি অপরিহার্য ছিল, তা কি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণের কাছে ছিল?

আজকের পৃথিবীর যে কোনো সংবিধানকে সামনে রেখে হিসাব মিলিয়ে দেখুন, বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে যাবে। এ অভাবিত প্রভাব ও সাফল্য, এ আধ্যাত্মিক গুণাগুণ ও  বৈশিষ্ট্য একমাত্র আল্লাহর অসীম কুদরতেই সম্ভব হয়েছে।

কুরআনের অলৌকিকত্বের বিশদ বিবরণ ও আনুপূর্বিক বিশ্লেষণ একটি অতি দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ বিষয়। প্রতি যুগেই উম্মাহর আলেমসমাজ এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ভাষায় অজস্র মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে সর্বপ্রথম জাহিয ‘নযমুল কুরআন’ নামে একটি স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেন। তারপর চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে আবু আবদুল্লাহ ওয়াসেতী রাহ. ‘ইজাযুল কুরআন’ নামে আরেকটি কিতাব রচনা করেন। একই শতাব্দীতে ইবনে ঈসা রুম্মানী রাহ. এ নামেই একটি সংক্ষিপ্ত পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। কাযী আবু বকর বাকিল্লানী রাহ. পঞ্চম শতকের শুরুতে  একই নামে বৃহৎ কলেবরে একটি বিশদ গ্রন্থ রচনা করেন। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ‘ইতকান’ ও ‘খাসায়েসে কুবরা’তে, ইমাম রাযী রাহ. তার তাফসীরে কাবীরে, কাযী ইয়ায রাহ. ‘শিফা’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে গবেষণামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী ব্যাপক আলোকপাত করেছেন।

নিকট অতীতে মরহুম মুস্তফা সাদেক রাফেয়ী ‘ইজাযুল কুরআন’ (আরবী) নামে, আর সায়্যেদ রশীদ রেযা মিসরী ‘আলওহইউল মুহাম্মাদী’ শিরোনামে মৌলিক, সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত গ্রন্থ রচনা করেছেন।

উর্দূ ভাষায় মুহতারাম উস্তায শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী রাহ. ‘ইজাযুল কুরআন’ নামে একটি পুস্তক প্রণয়ন করেছেন। এটাও পবিত্র কুরআনের এক অপূর্ব বৈশিষ্ট্য যে, এ গ্রন্থের একেকটি বিষয়ের উপর স্বতন্ত্র ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাদ দিয়েও এত অজ¯্র গ্রন্থ-পুস্তক রচিত হয়েছে, যার নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

যাইহোক বলা উদ্দেশ্য হল, এখানে তো সম্পূর্ণ বিস্তারিতভাবে বিষয়টি আলোচনা করা যাচ্ছে না। কিন্তু যতটুকু আলোকপাত করা হল, তাতে একজন নিরপেক্ষ, নীতিবান ও উদারমনা মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য যে, ‘কুরআন আল্লাহর বাণী এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠতম মুজেযা।’

 

কিছু বিভ্রান্তির নিরসন

কোনো কোনো মহলকে বলতে শোনা যায়, এটা খুব সম্ভব যে, কুরআনের মোকাবেলায় অতীতে অনেক গ্রন্থ-প্রবন্ধ হয়ত রচিত হয়েছিল, কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে তা হারিয়ে গেছে!

এ বন্ধুরা যদি সামান্যতম বিচারবুদ্ধি দিয়েও চিন্তা করেন, তবে এ ধরনের সম্ভাবনার কোনো অবকাশ খুঁজে পাবেন না। কেননা পৃথিবী জানে, যখন থেকে কুরআন নাযিল হয়েছে, গোটা পৃথিবীতে কুরআনের অনুসারীর চেয়ে এর অমান্যকারীর সংখ্যা বেশি ছিল।

এটাও কারো অজানা নয় যে, যুগে যুগে প্রকাশনা ও প্রচারউপকরণের যে ছড়াছড়ি কুরআন অমান্যকারীদের কাছে ছিল, অধিকাংশ শতাব্দীতে সে তুলনায় কোনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণও কুরআন অনুসারীদের হাতে ছিল না। কুরআন তার বিরোধীদের সামনে এত উচ্চকণ্ঠে দাবি তুলছে, তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে, তাদের আত্মসম্মানে আঘাত করছে, অন্যদিকে ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো তার মোকাবেলায় নিজেদের জান-মাল-সন্তান সবর্স্ব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হচ্ছে, যদি এ লোকেরা কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কোনো কিছু রচনা করে আনত, তবে সেকথা বিশ্ববাসীর অজানা থেকে যাওয়া কি কোনোভাবে সম্ভব হতো?

এমন হলে কি কুরআন অস্বীকারকারীরা যুগে যুগে মুসলমানদের মোকাবেলায় তা পেশ করত না? মুসলমানদের পক্ষ থেকেও কি এ বিষয়ে শত শত জবাবি-খ-নমূলক গ্রন্থ রচিত হত না?

শুধু ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে মুসায়লামা কাযযাবের (নবুওতের মিথ্যা দাবিদার) একটি ঘটনা এমন ঘটেছিল, যখন সে কিছু আবোল-তাবোল অশ্লীল কথা লিখে সেগুলোকে কুরআনের সমতুল্য আসমানী ওহী হওয়ার দাবি করে বসে। দুনিয়ার মানুষ জানে যে, সেকথার ভাগ্যে কী জুটেছে- তখন স্বয়ং তার গোত্রের লোকেরাই সেসব তার মুখে ছুঁড়ে মেরেছিল। একথাগুলো এত অশ্লীল আর জঘন্য ছিল যে, কোনো ভদ্রমহলে তা মুখে আনাও সম্ভব নয়। তবে যেমনই হোক, সেসব আজও কিতাবাদিতে আছে।

যদি আরো কেউ কুরআনের মোকাবেলায় এরচে উৎকৃষ্ট বাণী রচনা করে আনত, তবে দুনিয়ার ইতিহাসে তা কি হারিয়ে যেতে পারত? আর কুরআনের শত্রুরাও কি যেকোনো মূল্যে সেটা সংরক্ষণ করে রাখত না?

যে মানুষগুলো কুরআনের মোকাবেলায় সর্বদা জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল, তারা এ চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে কত কথাই না বলেছে। কুরআন সেসব উল্লেখ করে করে উত্তরও দিয়েছে। কিন্তু একটি ঘটনাও এমন নেই, যেখানে কোনো কথাকে কুরআনের মোকাবেলায় পেশ করে তার সমতুল্য হওয়ার দাবি করা হয়েছে।

জনৈক রোমক ক্রীতদাস মদীনাতে কামারের কাজ করত। তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে তার কিছুটা জানাশোনা ছিল। মাঝে মাঝে সে নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ করত। আরবের কিছু মূর্খ লোক শত্রুতা ও প্রতিহিংসাবশত এ গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, রাসূলকে কুরআনের বিষয়বস্তু এ লোক শিখিয়েছে।

কুরআন নিজেই তাদের এ ভিত্তিহীন আপত্তি উদ্ধৃত করে উত্তর দিয়েছে যে, যেই লোককে তারা প্রিয়নবীর শিক্ষকরূপে অভিহিত করছে সে তো নিজেই একজন অনারবী। আরবি ভাষার বাগ্মিতা সে কী জানবে? এ কুরআন তো আরবীয় বাকশিল্পের এক অত্যুচ্চ গ্রন্থ। সূরা নাহলের ১০৩ নং আয়াত লক্ষ্য করুন-

لِسَانُ الَّذِیْ یُلْحِدُوْنَ اِلَیْهِ اَعْجَمِیٌّ وَّ هٰذَا لِسَانٌ عَرَبِیٌّ مُّبِیْنٌ.

তারা যার প্রতি এটা আরোপ করে তার ভাষা আরবী নয়। আর এটা (অর্থাৎ কুরআনের ভাষা) স্পষ্ট আরবী -সূরা নাহল (১৬) : ১০৩

কিছু মানুষ কুরআনের চ্যালেঞ্জের জবাবে এ কথা বলেছিল,

لَوْ نَشَآءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هٰذَاۤ.

ইচ্ছে করলে আমরাও কুরআনের মতো বাণী বলতে পারতাম! -সূরা আনফাল (৮) : ৩১

কিন্তু কেউ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুক যে, তারা কেন এ ইচ্ছা করল না?  তোমরা তো কুরআনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পেরেছ, জান-মালও খুইয়েছ। তোমাদের যদি এর সমকক্ষ কিছু বলা বা লিখে ফেলার এতই দক্ষতা থাকত তাহলে কুরআনের এ চ্যালেঞ্জের পরও এরূপ বাণী রচনা করে তোমরা বিজয়মুকুট কেন ছিনিয়ে আনলে না?

আসল কথা হচ্ছে, কুরআনের এ দাবির পর শত্রুরা মোটেই ভদ্রভাবে চুপ করে থাকেনি; বরং সরল-গরল যা কিছু তাদের মুখে এসেছে এর জবাবে বলে গেছে। তবুও কিন্তু কেউ এ কথা বলেনি যে, ‘আমাদের অমুক লোক কুরআনের মতো বাণী রচনা করেছে; অতএব কুরআনের এ দাবি (নাউযু বিল্লাহ) নির্জলা মিথ্যা ও অবাস্তব।’

কোনো কোনো বিদ্বেষীর মাথায় এ আজগুবি যুক্তির উদয় হয়েছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওত লাভের পূর্বে যখন কিছুদিনের জন্য সিরিয়া সফর করেছিলেন তখন পথিমধ্যে তাওরাতের সুপণ্ডিত পাদ্রী বুহায়রার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এর কাছেই নাকি তিনি এসব জ্ঞান অর্জন করেছেন।

কিন্তু কেউ এ লোকদের জিজ্ঞাসা করুক যে, মাত্র একদিনের একটি সাক্ষাতে এ পাদ্রীর কাছে এত ইলম ও মারেফাত, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অলৌকিক ভাষা-সাহিত্য, নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাজ্ঞান কীভাবে শিখে ফেললেন?

আজকাল কোনো কোনো আপত্তিকারী বলে যে, কোনো কথার নজির পেশ করতে না পারা এটা কখনোই সাব্যস্ত করে না যে, সেটি আল্লাহর বাণী বা কোনো অলৌকিক ব্যাপার। এমনটা ঘটতেই পারে যে, একজন শীর্ষতম সাহিত্যবিশারদ এমন চমৎকার গদ্য বা পদ্য রচনা করলেন, যার নমুনা সৃষ্টি করতে অন্যরা ব্যর্থ।

শেখ সাদী শিরাজীর গুলিস্তাঁ, ফয়যীর নুকতাবিহীন তাফসীরকে ব্যাপকভাবে অসাধারণ ও নজিরবিহীন গ্রন্থ বলা হয়। তাহলে কি সেসবও মুজেযা?

কিন্তু একটু মাথা খাটালেই তারা বুঝবেন যে, শেখ সাদী ও ফয়যীর কাছে পড়াশোনা আর লেখালেখির কতশত উপায়-সরঞ্জাম ছিল। কত দীর্ঘ অধ্যাবসায়ে তারা শিক্ষা অর্জন করেছেন। বছরের পর বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাটিয়েছেন। কত রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়েছেন। একটানা পরিশ্রম করেছেন। বিদগ্ধ জ্ঞানীজনদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। এরূপ বহুকালের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা আর চিন্তা-গবেষণার ফলে যদি ধরেও নেই যে, আরবীতে ফয়যী, হারীরী, মুতানাব্বী বা অন্য কেউ, ফার্সীতে সাদী, ইংরেজিতে মিলটন, গ্রীকভাষায় হোমার আর সংস্কৃতে কালীদাস প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাষার শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য-প্রতিভা ছিলেন তাহলে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

মুজেযা তো বলে, যা বস্তুজগতের সাধারণ নিয়ম ও উপকরণের বাইরে অস্তিত্ব লাভ করে। এ প্রতিভাবানদের ধারাবাহিক শিক্ষা গ্রহণ করা, শিক্ষকদের সংস্পর্শে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা, বিস্তৃত পাঠাভ্যাস আর দীর্ঘ সাধনা-অনুশীলন কি তাদের জ্ঞানগত দক্ষতা ও যোগ্যতা লাভের প্রকাশ্য মাধ্যম নয়? তাতে যদি তাদের বাণী বা সৃষ্টিকর্ম অন্যদের অপেক্ষা স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়, তবে এতে আশ্চর্যের কী রয়েছে?

আশ্চর্যের বিষয় তো এটা যে, যেই মানুষ কখনো বই-কলম স্পর্শ করেননি, কোনো মাদরাসা-মকতবে পা রাখেননি, তিনি এমন এক গ্রন্থ পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন যে, হাজারো সাদী আর লাখো ফয়যী এর জন্য জীবন উৎসর্গ করাকে নিজেদের পরম সৌভাগ্য মনে করেছেন। আর যেটুকু ইলম ও জ্ঞান, হেকমত ও প্রজ্ঞা তাদের অর্জিত হয়েছে সেসবকেও তারা সেই মানুষটির পবিত্র শিক্ষার সুফল অভিহিত করেছেন।

তাছাড়া সাদী ও ফয়যীর বাণীর সমকক্ষ রচনা করার কী প্রয়োজনই বা ছিল? তারা কি নবুওতের দাবি করেছিলেন? নিজেদের কালামের অনন্যতা ও অতুলনীয়তাকে নিজেদের মুজেযা বলেছিলেন? তারা কি বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন যে, আমাদের কথার কোনো নমুনা পেশ করা সম্ভব নয়। যার ফলে মানুষ তার মোকাবেলা করতে এবং নমুনা উপস্থিত করতে বাধ্য হত?

উপরন্তু কুরআনের ভাষা-সাহিত্যই কেবল অসাধারণ নয়, মানুষের মন-মস্তিষ্কে এর আশ্চর্য প্রভাব ততোধিক অসাধারণ ও বিস্ময়কর। যার ফলে অসংখ্য জাতি-গোষ্ঠীর স্বভাব প্রবণতায় পরিবর্তন ঘটেছে। মানবচরিত্রের গতানুগতিক ধারাই পাল্টে গেছে। আরবের রুক্ষ স্বভাবের গ্রাম্য মানুষগুলো ইলম ও হিকমার মহান উস্তাদরূপে বরিত হয়েছেন। এ অভূতপূর্ব বিপ্লবী বৈশিষ্ট্য শুধু মুসলমানরাই নন, এযুগের অগণিত অমুসলিমও স্বীকার করে নিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ইউরোপিয়ান প্রাচ্যবিদদের রচনাবলি একত্র করলে একটি অসামান্য গ্রন্থ রূপ লাভ করবে। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. এ বিষয়ে شهادة الأقوام على صدق الإسلام  নামক একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এখানে তার কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হল।

* ডক্টর গোস্টাভ লিবোন তার ‘তমদ্দুনে আরব’ গ্রন্থে এ বিস্ময়কর প্রভাবকে স্বীকার করেছেন। তার বক্তব্যের অনুবাদ লক্ষ্য করুন-

‘এ ইসলামের পয়গাম্বর, এ উম্মী নবীরও এক অসাধারণ ইতিহাস রয়েছে, যার আহ্বানে এক দুর্ধর্ষ বর্বর জাতি, যারা ইতিপূর্বে কখনো কোনো রাজ্যদখলকারীর অধীনে শাসিত হয়নি, তাদেরকে অনুগত করেছে। আর শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকর্ষের এত উচ্চ শিখরে তাদেরকে উন্নীত করেছে যে, পৃথিবীর পরাক্রমশালী সা¤্রাজ্যগুলোকে তারা নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। আজও সেই নিরক্ষর নবী নিজ কবরে শুয়ে লাখো আল্লাহর বান্দাকে ইসলামের কালেমার ওপর প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন।’

মিস্টার বিডোল যিনি নিজ মাতৃভাষায় কুরআন মাজীদের অনুবাদ করেছেন, তিনি লেখেন-

‘আমরা যতই এ গ্রন্থ মনোযোগ দিয়ে পড়ি, ততই তার প্রতি পূর্বের অধ্যয়নে সৃষ্ট অনীহা নতুন নতুন দিক থেকে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আমাদেরকে মোহাবিষ্ট ও বশীভূত করে ফেলে। বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। অবশেষে আমাদের দিয়ে সম্মান করিয়ে ছাড়ে।’

‘গ্রন্থটির বর্ণনাশৈলী তার বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্যের  দিক থেকে অতি পরিচ্ছন্ন, উৎকৃষ্ট, ভীতিপ্রদ এবং হুমকিমূলক। স্থানে স্থানে এর বিষয়বস্তু কথার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। এককথায় এ অপূর্ব গ্রন্থ সর্বকালে তার ঐশীক্ষমতা প্রদর্শন করে যাবে।’ -শাহাদাতুল আকওয়াম পৃ. ১৩

মিসরের জনপ্রিয় লেখক আহমদ ফাতহী বেগ জগলুল ১৮৯৮ সালে মিস্টার কন্ট হেনরীর বই ‘আলইসলাম’-এর আরবী অনুবাদ ছেপেছিলেন, যার মূল ছিল ফ্রেঞ্চ ভাষায়। বইটিতে মিস্টার কন্ট কুরআনের ব্যাপারে তার অভিমত এভাবে ব্যক্ত করেছেন-

‘বিবেক-বুদ্ধি হতভম্ব ও বিস্মিত যে, এরূপ অসাধারণ বাণী এমন একজন মানুষের মুখ থেকে কী করে বের হল, যিনি সম্পূর্ণ নিরক্ষর ছিলেন। সমগ্র প্রাচ্য স্বীকার করে নিয়েছে যে, মানবজাতির পক্ষে এর ভাষা ও বিষয়বস্তুর কোনো দিকের নজির পেশ করা অসম্ভব।’

‘এটা সেই বাণী যার, অপূর্ব সাহিত্যশিল্প আর রচনাশৈলি ওমর বিন খাত্তাবকে শান্ত করে দিয়েছে। তাকে আল্লাহর অনুগত হতে হয়েছে।’

‘এটা সেই বাণী, যখন ইয়াহইয়া আ.-এর জন্ম প্রসঙ্গে তার আয়াতগুলো জাফর বিন আবি তালিব আবিসিনিয়ার রাজদরবারে পড়ে শুনিয়েছেন, তখন আপনাআপনি সম্রাটের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছে।’

‘আর বিশপ চিৎকার করে বলে উঠেছেন যে, এ তো সেই উৎস থেকে নিসৃত বাণী, যা ঈসা আ.-এর বাণীর উৎস ছিল।’ -শাহাদাতুল আকওয়াম পৃ. ১৪

এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার ১৬তম খণ্ডের ৫৯৯ নং পৃষ্ঠায় এ কথা রয়েছে যে, ‘কুরআনের বিভিন্ন অংশের বিষয় ও মর্ম বৈচিত্র্যে ভরপুর। এর অসংখ্য আয়াতে ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শের কথা রয়েছে। কুদরতের নিদর্শনসমূহ, ইতিহাস আর নবীগণের ইলহামের মাধ্যমে এতে আল্লাহর বড়ত্ব, অনুগ্রহ ও সত্যবাদিতাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

‘বিশেষ করে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আল্লাহকে অদ্বিতীয় ও সর্বময়ক্ষমতার অধিকারী সত্তা ব্যক্ত করা হয়েছে। মূর্তিপূজা ও বস্তুপূজাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

‘কুরআনের ব্যাপারে এ বক্তব্য সম্পূর্ণ যথার্থ যে, এটি নিখিল বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ।’

ইংল্যান্ডের বরেণ্য ইতিহাসবিদ ডক্টর গিবন তার বিখ্যাত গ্রন্থ রোম সাম্রাজ্যের অধঃপতন ও বিলুপ্তির পঞ্চম খণ্ডের পঞ্চাশতম অধ্যায়ে লিখেছেন- ‘আটলান্টিক মহাসাগর হতে গঙ্গানদী পর্যন্ত পৃথিবীর অগণিত মানুষ কুরআনের ব্যাপারে এ কথা মেনে নিয়েছে যে, এটি সংসদের মূলমন্ত্র। মৌলিক আইনগ্রন্থ। শুধু ধর্মীয় নীতিমালারূপেই নয়, বরং যাবতীয় দ-বিধি এবং সরকারি আইন-সংবিধান হিসেবেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। যা যে কোনো ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি, যার সঙ্গে মানুষের জীবন জড়িত। মানবজীবনের শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে যার গভীর সম্পর্ক। প্রকৃতপক্ষে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত সর্ব বিষয়ে পরিব্যাপ্ত। এ শরীয়ত এমন বিজ্ঞোচিত মূলনীতি আর অভিনব আইনী পদ্ধতিতে প্রণয়ন করা হয়েছে, যার নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’

এখানে ইউরোপিয়ান প্রাচ্যবিদদের এসব স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যের বিশদ বিবরণ দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। এর অবকাশও নেই। নমুনাস্বরূপ শুধু কয়েকটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ভাষা-সাহিত্য, বাগ্মিতা ও বাকশিল্পের দিক থেকে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিচারে আর ইলম ও মারেফাত, জ্ঞান ও বিজ্ঞানময়তার বিবেচনায় কুরআনের অনন্যতা ও অসাধারণ হওয়াকে কেবল মুসলমানরাই নন, বরং সকল যুগের নিরপেক্ষ ও উদারমনা অমুসলিমরাও স্বীকার করেছেন।

কুরআন সারা দুনিয়াকে তার নজির পেশ করার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল। কেউ তাতে সক্ষম হয়নি। আজও প্রতিটি মুসলিম পৃথিবীর বিদগ্ধ প-িত আর ঝানু রাজনীতিবিদদের চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারে যে, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি ঘটনা এমন দেখাও যেখানে একজন তুখোড় প্রতিভাবান ও প্রাজ্ঞ দার্শনিক এগিয়ে এসে পৃথিবীর সকল মতাদর্শ ও রীতি-রেওয়াজের বিরুদ্ধে এক সম্পূর্ণ নতুন জীবনাদর্শ পেশ করেছেন। তার সম্প্রদায়ও ছিল মূর্খ আর বেদুঈন। তিনিও এরূপ অল্প সময়ে সেই শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছেন। আর তা বাস্তবায়নও করেছেন এমন সুদৃঢ় পন্থায়, আজকের পৃথিবীর সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত কোনো ব্যবস্থা- পদ্ধতিতে যার নজির পাওয়া অসম্ভব। অতীতের পৃথিবীতেও এর নজির ছিল না। কিন্তু এখন তো সভ্যতার উৎকর্ষকাল। এখন তো মুক্তচিন্তা, আধুনিকতা আর অতি প্রগতির যুগ; এখন কেউ করে দেখাক।

কারো একার পক্ষে সম্ভব না হলে স্বজাতি বরং বিশে^র সকল জাতি-গোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর সমতুল্য রচনা করে ফেলুক না!

فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا وَ لَنْ تَفْعَلُوْا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیْ وَ قُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ  اُعِدَّتْ لِلْكٰفِرِیْنَ.

তারপরও যদি তোমরা এ কাজ করতে না পার, আর এ তো নিশ্চিত যে, তোমরা তা কখনো পারবে না, তাহলে ভয় কর সেই আগুনকে যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যাকে কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। -সূরা বাকারা (০২) : ২৪ ষ

অনুবাদ : মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

 

advertisement