রবিউল আউয়াল ১৪৪০   ||   ডিসেম্বর ২০১৮

সভ্যতা : বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ পরে

আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ

গত ১২ নভেম্বর প্যারিসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর একটি। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে এই যুদ্ধ শুরু হয় আর সমাপ্তি ঘটে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের সময় বেলা এগারটায়।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে এই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ। আর আহত হয়েছেন দুই কোটি। পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশ থেকে ১৩ লাখ সৈন্য ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, যার মধ্যে নিহত হয় ৭৪ হাজার। এই বিরাট রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তির শতবর্ষ উদ্যাপনের জন্য ফ্রান্সের প্যারিসে সমবেত হয়েছিলেন বিশে^র প্রায় ৭০ জন নেতা। এইসব ক্ষেত্রে যেমনটা হয়- কিছু অভিনয়-আনুষ্ঠানিকতা, বাণী ও আহ্বানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপিত হয়েছে।

বিশ্বনেতৃত্বের নানা গতানুগতিক বক্তব্যের মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর একটি কথায় কিছুটা উপলব্ধি ও চিন্তাশীলতার ছাপ রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। জাতীয়তাবাদ হচ্ছে দেশপ্রেমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আমাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নামে এবং অন্য সব বিষয়কে উপেক্ষা করে আমরা ঐসব বিষয়কে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছি, যেগুলো একটি জাতিকে মূল্যবান, জীবন্ত ও মহান করে তোলে এবং সর্বোপরি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে।’ (আল জাযিরার সূত্রে দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৩ নভেম্বর ২০১৮)

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমন এক সময় এ কথাটি বললেন, যখন পৃথিবীর বড় বড় দেশে জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ এক ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। বর্ণ ও গোষ্ঠী এবং ভাষা ও ভূখ-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যে জাতি-গোষ্ঠী ও বৃহত্তর মানবজাতির পক্ষে কতটা ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে তার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকেই সম্ভবত তিনি এই কথাটা বলেছেন।

বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চোখধাঁধানো অগ্রসরতার যুগেও বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদ নামক অন্ধকারে বিশে^র বড় বড় শক্তিগুলোর নিমজ্জিত থাকার মতো ন্যক্কারজনক বাস্তবতাও সম্ভবত তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।

আর এ কারণেই তিনি বর্তমান সময়ের পরম পূজনীয় বস্তু জাতীয়তাবাদের প্রকৃত চেহারাটা তুলে ধরার একটা প্রয়াস পেয়েছেন- ‘আমাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নামে... গড়ে তোলে।’ বস্তুত এটিই হচ্ছে বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী চর্চিত জাতীয়তাবাদের প্রকৃত পরিচয়। এ তো শরীয়তের পরিভাষায় ‘তাআসসুব’, যার পরিচয় হাদীস শরীফে এভাবে দেওয়া হয়েছে-

...وَلَكِنْ مِنَ الْعَصَبِيّةِ أَنْ يُعِينَ الرّجُلُ قَوْمَهُ عَلَى الظّلْمِ.

‘আসাবিয়্যার একটি প্রকার হচ্ছে, কেউ অন্যায়ের ক্ষেত্রে নিজের কওমের সহযোগী হওয়া।’ এই কথাটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীর প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, সাহাবী জিজ্ঞাসা করেছিলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، أَمِنَ الْعَصَبِيّةِ أَنْ يُحِبّ الرّجُلُ قَوْمَهُ؟

আল্লাহর রাসূল! কেউ তার কওমকে ভালবাসা কি আসাবিয়্যা? তিনি উত্তরে বলেছেন, না, আসাবিয়্যা হচ্ছে, অন্যায়ের ক্ষেত্রে নিজের কওমের সহযোগী হওয়া। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৮৯

১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের নিহত হওয়ার ১০০ বছর পর এক অজ্ঞাতনামা সৈন্যের সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বিশ্ব নেতাদের সামনে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তা কি অবশেষে শেষ নবী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শিক্ষার স্বীকারোক্তিই হচ্ছে না?

আজ থেকে চৌদ্দ শত বছর আগে বিদায় হজে¦র ভাষণে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথাগুলো গোটা মানবজাতির উদ্দেশে বলেছিলেন তার একটি বাক্য ছিল-

أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلّا بِالتّقْوَى، إِنّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ، أَلَا هَلْ بَلّغْتُ؟ "، قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: " فَلْيُبَلِّغِ الشّاهِدُ الْغَائِبَ.

শোনো, কোনো আরবীর কোনো আজমীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো আজমীরও কোনো আরবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো লাল (চামড়ার) মানুষের কালো (চামড়ার) মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো কালো (চামড়ার) মানুষের লাল (চামড়ার) মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তাকওয়ার দ্বারা। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদার সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী। শোনো, আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? উপস্থিতি বলল, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তাহলে উপস্থিত যেন অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়। -শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস ৪৭৭৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮৯

আজ কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানীর পর বিশ্ব নেতাদের ঐ ব্যাধির স্বীকারোক্তির দিকে ফিরে আসতে হচ্ছে, যে ব্যাধি সম্পর্কে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বিশ্বকে সাবধান করেছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আসমানী ওহী ও মানবরচিত মতবাদের মধ্যেকার এই পার্থক্যটি বুঝে নেওয়া খুবই প্রয়োজন।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিছক একজন ‘বিশ্বনেতা’ ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর। যিনি কথা বলেছেন ওহীর ভিত্তিতে, আল্লাহ তাআলার প্রত্যাদেশ অনুসারে। যে আল্লাহ তাআলা মানুষের ¯্রষ্টা এবং তার রোগব্যাধি ও উপশমের ব্যবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত। আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছেন-

اَلَا یَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ  وَ هُوَ اللَّطِیْفُ الْخَبِیْرُ.

যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জানবেন না? তিনি তো সকল সূক্ষ্ম ও ভেতরের বিষয় সম্পর্কেও অবগত। -সূরা মুলক (৬৭) : ১৪

তাছাড়া কোটি কোটি মানুষের সমাধির উপর দাঁড়িয়ে এই ২০১৮ সালে  ‘বিশ্বনেতারা’ যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন তা তো শুধুই অভিব্যক্তি। বাস্তবে মানবজাতিকে এই মরণ-ব্যাধি থেকে মুক্ত করার কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা না তাদের কাছে আছে, না তারা সেটা প্রয়োগে সক্ষম; কিন্তু আল্লাহর নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি যেমন নিখুঁতভাবে, ব্যাপক ক্ষতিস্বীকার ছাড়াই এই ব্যাধি চিহ্নিত করেছেন, তেমনি তা নিমূর্লের উপযুক্ত ব্যবস্থাও প্রদান করে গেছেন। শুধু ব্যবস্থা প্রদানই নয়, এমন এক অজেয় কাফেলাও তিনি প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যারা ছিলেন বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নামক এই ধ্বংসাত্মক ব্যাধি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পৃথিবীর অতীত ও বর্তমান ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাঁর এই সাফল্য নিছক মানবীয় বুদ্ধি ও প্রয়াস দ্বারা সম্ভব হয়নি, আসমানী মদদ ও নুসরতেই সম্ভব হয়েছে। আর এটিই এক বড় পার্থক্য সাধারণ মানবীয় মতবাদ আর আসমানী নবুওত ও রিসালাতের মধ্যে। মানব-সমাজের নেতৃত্ব যখন সঠিক আসমানী শিক্ষার অনুগামী হয় তখন তা মানব-সমাজের ব্যাধিসমূহের নিরসনে ও নৈতিকতার নির্মাণে সাফল্য অর্জন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একশ বছর পর বিশ্বনেতাদের সম্মুখে ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যে উপলব্ধি উচ্চারণ করেছেন তাতে তিনি সত্যবাদী হয়ে থাকলে একমাত্র  ইসলামই হচ্ছে এই ব্যাধির পরীক্ষিত চিকিৎসা। তারা কি এই চিকিৎসা গ্রহণ করবেন?

 

 

advertisement