রবিউল আউয়াল ১৪৪০   ||   ডিসেম্বর ২০১৮

নবীজীর প্রতি নারী সাহাবীদের ভালোবাসা

উম্মে আদীবা সাফফানা

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। এছাড়া ঈমান পূর্ণতা পায় না। ঈমানের পূর্ণতার জন্য নবীজীকে শুধু আল্লাহর প্রেরিত রাসূল হিসেবে মেনে নেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। সেইসাথে নবীজীকে ভালোবাসতে হবে হৃদয় থেকে। এ ভালোবাসা ঈমানের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। ঈমানকে সজীব ও জীবন্ত করে তোলে। সেইসাথে শরীয়তের আহকাম ও বিধি-বিধান মানাও সহজ করে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنّاسِ أَجْمَعِينَ.

তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষ থেকে প্রিয় হব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণীকে সাহাবায়ে কেরাম রা. হৃদয় দিয়ে বরণ করেছিলেন এবং বাস্তব জীবনে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন।

নবীজীকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে নারী সাহাবীগণও ছিলেন অগ্রগামী। তারাও নবীজীকে ভালোবেসেছেন হৃদয় থেকে। সে ভালোবাসা কখনো মুখে উচ্চারিত হত। কখনো বিভিন্ন কর্ম ও আচরণে প্রকাশ পেত। নিম্নে নারী সাহাবীদের ভালোবাসার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হল।

উহুদ যুদ্ধে প্রাথমিক জয়ের পর এক পর্যায়ে মুসলমানগণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। একে একে শহীদ হতে থাকেন অসংখ্য সাহাবী। মদীনা তখন শোকে স্তব্ধ। কারো বাবা নেই। কারো ভাই নেই। কেউবা স্বামী হারিয়েছেন।

বনু দীনারের এক নারী। উহুদ যুদ্ধে তার স্বামী, বাবা ও ভাই শহীদ হন। এসব আপনজনদের শাহাদাতের সংবাদ তাকে দেওয়া হলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, রাসূলুল্লাহ কেমন আছেন? উত্তরে বলা হল, তিনি ভালো আছেন। এরপর এ নারী সাহাবী যা বললেন, তা আজ ১৪০০ বছর পরও আলো ও সৌরভ ছড়াচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। আশেকীনে রাসূলদের উদ্দীপ্ত করছে নতুন চেতনায়। নবীজীর সুস্থতার খবর শুনে সেই নারী সাহাবী বলেছিলেন-

كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ!

(নবীজী ভালো আছেন।  সুস্থ ও জীবিত আছেন। তাহলে মনে আর দুঃখ নেই।) সব মসীবতই তাহলে তুচ্ছ!  -সীরাতে ইবনে হিশাম ৩/৬২

সুবহানাল্লাহ! কী দীপ্ত উচ্চারণ! ভালোবাসার কী গভীর অনুরণন!! বাবা নেই, ভাই নেই, স্বামীকেও হারিয়েছেন। একসাথে এত আপনজন হারিয়ে মানুষ কতটা শোকসন্তপ্ত ও বিধ্বস্ত হতে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু নবীজীর  প্রতি কতটা গভীর ভালোবাসা থাকলে এমন বিপর্যয়ের মুহূর্তেও উচ্চারিত হতে পারে-

كُلّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ!

নবীজী ভালো আছেন।  সুস্থ ও জীবিত আছেন। তাহলে মনে আর দুঃখ নেই। সব মসীবতই এখন তুচ্ছ!

হাঁ, সাহাবীগণ এতটাই ভালোবাসতেন নবীজীকে। সে ভালোবাসার সামনে সবচে আপনজনদের ভালোবাসাও ছিল তুচ্ছ।

 

নবীজীর সাহায্য-সহযোগিতা করা

সাহাবায়ে কেরামের কাছে নবীজী ছিলেন প্রাণের চেয়েও প্রিয়। তাই নবীজীর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা ছিল তাদের দিলের তামান্না। নবীজীর গায়ে কোনো আঁচড় লাগুক অথবা পায়ে কোনো কাঁটা বিঁধুক এটাও তারা সহ্য করতে পারতেন না। হযরত খুবাইব রা.-এর শাহাদাতের পূর্বের সেই সাহসী উচ্চারণ এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়। নবীজীর সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার ক্ষেত্রে নারী সাহাবীগণও কোনো অংশে কম ছিলেন না।

হযরত নাসীবা বিনতে কা‘ব রা.। উম্মে উমারা নামেই যিনি সমধিক প্রসিদ্ধ। সাহসিকতায় অনেক  পুরুষকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। উহুদ যুদ্ধে তার একটি ঘটনা। যুদ্ধপরিস্থিতি তখন পুরো বদলে গেছে। প্রাথমিক জয়ের পর এখন কাফেরদের পাল্লা ভারী। মুসলমানরা এদিক সেদিক ছুটে যাচ্ছে। সে মুহূর্তে নবীজীর সামনে দশজন মানুষও ছিল না। উম্মে উমারা বলেন-

فَقُمْتُ أُبَاشِرُ الْقِتَالَ، وَأَذُبّ عَنْهُ بِالسّيْفِ، وَأَرْمِي عَن الْقَوْسِ.

আমি তখন যুদ্ধে নেমে পড়লাম। তরবারী দিয়ে নবীজীকে রক্ষা করছিলাম আর তীর ছুড়ছিলাম। -সীরাতে ইবনে হিশাম ৩/৪৫

যুদ্ধে উম্মে উমারার ছেলে আবদুল্লাহও নবীজীকে রক্ষা করার জন্য প্রচ- যুদ্ধ করছিলেন। হঠাৎ একটি আঘাত এসে লাগে তার উপর । সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল।  কোনোভাবেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। উম্মে উমারা তখন একটি পট্টি দিয়ে জখমের স্থান বেঁধে দিয়ে বললেন, যাও বেটা, শত্রুর সাথে আবার গিয়ে যুদ্ধ কর। মায়ের এই উৎসাহ বিপুল প্রাণশক্তি সঞ্চার করেছিল আবদুল্লাহর মনে। মা-বেটার কথোপকথনের এই দৃশ্য দেখে নবীজী বলেছিলেন-

وَمَنْ يُطِيقُ مَا تُطِيقِينَ يَا أُمّ عُمَارَةَ!

হে উম্মে উমারা! তুমি যা পেরেছ তা আর কে পারবে! -তবাকাতে ইবনে সাদ  ১০/৩৮৫; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/৫১৬

 

নবীজীর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ

নবীজীর প্রতি নারী সাহাবীদের কী পরমাণ আস্থা ছিল এবং তারা নবীজীর জন্য কী পরিমাণ সমর্পিত ছিলেন তা একটি ঘটনা দ্বারাই বুঝা যাবে।

বিয়ে সবার জীবনেই  খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুখী সংসার, একজন মনের মত জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী সবারই হৃদয়ের স্বপ্ন। তবে নারীদের জীবনে এ স্বপ্নের মাত্রা অবশ্যই বেশি। জীবনের এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তও নবীজীর হাতে পূর্ণ ন্যস্ত করার উজ্জ্বল ঘটনা আলো করে আছে আমাদের ইতিহাসের পাতা।

হযরত ফাতিমা বিনতে কায়েস রা. ছিলেন হিজরতকারী নারীদের অন্যতম। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অঢেল ধন-সম্পদের অধিকারী। অন্যদিকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামা ইবনে যায়েদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে ফাতিমা বিনতে কায়েস রা.-এর সাথে কথা বলেছিলেন। হযরত ফাতেমা রা. বলেন, আমি নবীজীর এ বাণী শুনেছিলাম-

مَنْ أَحَبّنِي فَلْيُحِبّ أُسَامَةَ.

যে আমাকে ভালোবাসে সে যেন উসামাকেও ভালোবাসে।

তাই নবীজী যখন উসামা রা.-এর সাথে  বিয়ের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বললেন, আমি তখন বললাম-

أَمْرِي بِيَدِكَ، فَانْكِحْنِي مَنْ شِئْتَ

আমার বিষয় আপনার হাতে সোপর্দ করলাম, আপনি যার সাথে ইচ্ছে আমাকে বিয়ে দিন। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৩২৩৭

হযরত জুলাইবিব রা.। নবীজীর  কাছের একজন সাহাবী। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, জুলাইবিব! তুমি বিবাহ করবে না? জুলাইবিব রা. তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার অর্থসম্পদ ও বংশীয় আভিজাত্য বলতে কিছুই নেই। কে আমার কাছে তার মেয়ে বিবাহ দেবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন এক আনসারীকে তার মেয়ের জন্য জুলাইবিবের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আনসারী তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বললেন। স্ত্রীর সাথে কথা বললে তিনি কোনোভাবেই এ বিয়ের জন্য রাজী হচ্ছিলেন না। তবে তার কন্যা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পয়গাম শুনেছিল। একীন ও বিশ্বাসের সুদৃঢ় পাহাড় তার হৃদয়ে প্রোথিত ছিল। তাতে প্রবাহিত ছিল নবীপ্রেমের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা। তাই বাবাকে বললেন, আপনারা রাসূলুল্লাহর পয়গামকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? না, এটা কখনই হতে পারে না। আমি জুলাইবিবকে বিয়ে করব। অবশেষে বিবাহ হল এবং ঘর আলোকিত করে একটি সন্তান জন্ম নিল। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৩৯৩

 

নবীজীর আদেশ পালন

কারো প্রতি ভালোবাসার গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে তার আদেশ মেনে চলা। তার চিন্তা ও আদর্শকে জীবনে ধারণ করা। নারী সাহাবীগণ নবীজীর প্রতি যে গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন তা তাদের কর্ম ও আমলের মাধ্যমেও প্রকাশ পেত।

নবীজী একবার মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন। দেখলেন নারী-পুরুষ পাশাপাশি পথ চলছে। তখন (নারীদের লক্ষ্য করে নবীজী বললেন) তোমরা পুরুষদের পেছনে থাক। এবং পথের মাঝখানে না হেঁটে একপাশ দিয়ে হাঁট। এরপর নারীদের এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তারা রাস্তার পাশ দিয়ে এভাবে হাঁটতেন যে, তাদের কাপড় রাস্তার পাশের দেয়ালের সাথে লেগে যেত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৭২

একবার হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ রা.-এর ভাই ইনতেকাল করল। মৃত্যুর পর চতুর্থ দিন তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করে বললেন, সুগন্ধি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন আমার ছিল না। তবে আমি নবীজীর কাছে শুনেছি, কোনো নারীর জন্য স্বামী ছাড়া অন্যের মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ করা বৈধ নয়। শুধু এ হুকুম পালনের জন্যই আমি এমন করেছি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২২৯৯

নবীজীর ভালোবাসায় এমনই আলোকোজ্জ্বল ছিল নারী সাহাবীদের জীবন। নবী প্রেমের অসীম আকাশে তাঁরা জ¦ল জ¦ল করছেন নক্ষত্রের মত। নবীজীর প্রতি তাদের যে গভীর ভালোবাসা ছিল, আনুগত্যের যে পরাকাষ্ঠা তাঁরা প্রদর্শন করেছেন, কাগজের বুকে কলমের কালি দিয়ে তার পূর্ণ চিত্র  আঁকা সম্ভব নয়। এ প্রবন্ধে তাদের আলোকিত জীবনের কিছু দিক নিয়ে সামান্য আলোচনা করা হল। কিছু ঘটনা তুলে ধরা হল। এগুলো আমাদের জন্যও হতে পারে আলোর মশাল। যদি থাকে উন্মেলিত চোখ ও জাগ্রত হৃদয়।

 

 

advertisement