উ ম্মা হ : উত্তপ্ত কাশ্মীর
আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কাশ্মীর। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্ধৃতিতে মিডিয়ার বক্তব্য, ‘রাজ্যজুড়ে যে তীব্র বিক্ষোভ চলছে তা গত কয়েক বছরের মধ্যে দেখা যায়নি।’ এই তীব্র বিক্ষোভের পেছনের কারণ অতি ভয়াবহ। গোড়ার ব্যাপারটি হচ্ছে ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৫-এ নামে পরিচিত আইনে রাজ্যের বাসিন্দা ছাড়া অন্য কারো সম্পত্তি ক্রয় এবং সরকারি চাকরিতে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা রাখা হয়েছে। আইনটি কাশ্মীরী মুসলমানদের ভিটেমাটি রক্ষার এক বড় উপায়। কিছু কাল ধরে এই অনুচ্ছেদটি বাতিলের কথা উঠছে। ২০১৪ সালে এক বেসরকারি সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৫-এ ধারা বাতিলের এক আবেদন করেছিল। জম্মু কাশ্মীর সরকার আদালতে পাল্টা হলফনামা দিয়ে ওই আবেদন খারিজের আবেদন জানায়। কিন্তু জম্মু কাশ্মীর সরকারের একাধিক বার অনুরোধের পরও কেন্দ্রীয় সরকার ওই ধারার পক্ষে কোনো সাফাই দেয়নি; বরং অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেনু গোপাল বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।
আইনটি বাতিল করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মোট চারটি আবেদন করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি আবেদনই করেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সাথে সম্পৃক্ত উই দ্য সিটিজেন নামের একটি এনজিও।
বর্তমান কপটতার যুগে যে কোনো প্রকারের অন্যায়-অবিচার আরম্ভ করার জন্য নানা যুক্তি দাঁড় করানো হয়। তো এই আইন বাতিলের পক্ষেও যে যুক্তিটি দাঁড় করানো হয়েছে তা হচ্ছে, ‘আইনটি উচ্চমাত্রায় বৈষম্যমূলক। তাই তা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হোক।’
অথচ কাশ্মীরের মুসলিম জনগণের আশঙ্কা এই আইন বাতিলের নেপথ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, এতদঞ্চলের মুসলিম জনগণকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার পথ সুগম করা। যেমনটা হয়েছে জম্মু অংশে। ওখানে ধীরে ধীরে হিন্দু বসতি বাড়ানো হয়েছে এবং একটা ‘ভারসাম্য’ আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতের আসামে এখন যে ভয়াবহ প্রক্রিয়া চলছে তাতে কাশ্মীরী মুসলমানদের এই আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়। সম্প্রতি আসামে চ‚ড়ান্ত হওয়া খসড়া নাগরিকপঞ্জি রাজ্যের ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জনের নাম বাদ পড়েছে। শাসকদের চোখে এরা ‘বাংলাদেশী (পড়–ন মুসলিম) অনুপ্রবেশকারী’। এরা নাকি বছরের পর বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ আসামে ঢুকে রাজ্যের জনবিন্যাস বদলে দিয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, যে ‘জনবিন্যাস বদলানো’র অভিযোগে আসামের বিপুল সংখ্যক অধিবাসীদের অভিযুক্ত করে বাস্তুচ্যুত করার প্রস্তুতি সম্পন্ন হচ্ছে সেই একই অপরাধের বাস্তব আশঙ্কা করছেন কাশ্মীরের আন্দোলনরত মুসলিমরা। তারা বলছেন ৩৭০ আইনটি বাতিলের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনবিন্যাস বদলানো তথা ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে হিন্দুর সংখ্যা বাড়ানোই চ‚ড়ান্ত উদ্দেশ্য।
কাশ্মীরের মুসলমানদের প্রতারিত হওয়া ও প্রতিশ্রæতি ভঙ্গের শিকার হওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। কে না জানে, কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারণে প্রতিশ্রæত গণভোট আজো অনুষ্ঠিত হয়নি।
জওয়াহের লাল নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ আবদুল্লাহর পরিণামও সর্বজনবিদিত। এই কাশ্মীরী নেতার কাশ্মীরের নিজস্ব পতাকা ও স্বতন্ত্র রাজ্যের স্ট্যাটাসের শর্তে এবং দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি ছাড়া সর্ববিষয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের শর্তে ভারতে সাময়িকভাবে যোগদান এরপর রাতের অন্ধকারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তার অপসারণ ও কারাগারে নিক্ষেপ তো খুব বেশি দিন আগের কথা নয়।
আর সম্প্রতি গোটা ভারতজুড়ে যে উগ্র হিন্দুবাদের বিস্তার, আসামের মুসলমানদেরকে রোহিঙ্গা মুসলিমে পরিণত করার প্রক্রিয়া ইত্যাদির পর কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের যুক্তিতর্কে কাশ্মীরী মুসলিমেরা যদি আস্থা রাখতে না পারেন তাহলে তাদের কীভাবে দোষ দেওয়া যায়? খোদ হিন্দু ইতিহাসবিদেরাই একে অন্যায় বলে আখ্যায়িত করছেন। ২০১৪ সালে যখন এই ধারা বাতিলের বিতর্ক শুরুর প্রস্তাব আসছিল তখন ভারতীয় ইতিহাসবিদ কিংশুক চ্যাটার্জি বলেছিলেন, ৩৭০ ধারার ভিত্তি নিহিত আছে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাসে, ফলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টাও মোটেই সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেসন যে সই করেছিল কাশ্মীর ও ভারত সরকার, দুটো স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা- তার মাধ্যমেই কাশ্মীর-ভারত সংযুক্ত হয়েছিল।’
‘যে শর্তের ভিত্তিতে সেই চুক্তি সই হয়েছিল, ভারত সরকার একতরফাভাবে বলতে পারে না যে, পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে, তাই আমরা সেই শর্তগুলো আবার নতুন করে বিবেচনা করব।’
ড. চ্যাটার্জি আরো বলেছেন, ‘যদি ভারতের একশো কোটি মানুষও বলে, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর কাশ্মীরের মানুষ সে কথা না মানে তাহলে কিন্তু আইনি পথে বা গণতান্ত্রিক পন্থায় ভারত সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। অবশ্য গায়ের জোরে হয়তো সম্ভব।
(ভারতে সংবিধানের ৩৭০ ধারা নিয়ে বিতর্ক, শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি বাংলা দিল্লি, ২৮ মে ২০১৪)
এই গায়ের জোরের ব্যাপারটিই কাশ্মীরে চলমান রয়েছে। কেবল প্রচার-প্রচারণার জোরে ‘কাশ্মীর-ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ কথাটিকে সর্ববাদীসম্মত ব্যাপারে পরিণত করার চেষ্টা জারি রয়েছে। অথচ এটা সম্পূর্ণ বিতর্কিত একটি বিষয়। নিকট অতীতে জম্মু ও কাশ্মীর হাইকোর্ট বলেছে, ‘জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের কোনো অংশ নয়। ২০১০ সালের দিকে ভারতীয় বুকার পুরস্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ও ঠিক একই কথা বলেছিলেন- ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’। ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, ‘কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখেনাঙ্গে ইন্ডিয়া।’
এমনকি কাশ্মীরের হিন্দু রাজাদের বংশধর ড. করণ সিং ভারতের পার্লামেন্টে বলেছিলেন, যে শর্তে তার বাবা নিজের রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন দিল্লি তার মর্যাদা দিতে পারেনি।
ড. সিং সেদিন বলেছিলেন, যেদিন আমার বাবা সেই চুক্তিতে সই করেছিলেন সেদিন থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২৭ অক্টোবর তারিখে সেদিন আমি নিজেও ওই ঘরে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মহারাজা হরি সিং কিন্তু প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক শুধু এই তিন ক্ষেত্রে ভারতভুক্তি স্বীকার করেছিলেন, নিজের রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে দেননি। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। (বিবিসি ডট কম, ১৩ আক্টোবর ২০১৬ ‘কী আছে কাশ্মীর সংকটের মূলে’) যাই হোক কথা তো আরো অনেক আছে। কিন্তু এটুকু থেকেও আমরা কুরআনের ঐ শিক্ষার এক মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত উপলদ্ধি করতে পারি যেখানে কাফির-মুশরিককে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা কি এখনো কুরআনের দিকে ফিরে আসব না?