যিলকদ ১৪৩৯   ||   আগস্ট ২০১৮

আপন অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে করণীয় তিন কাজ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تُطِعِ الْكٰفِرِیْنَ وَ الْمُنٰفِقِیْنَ وَ دَعْ اَذٰىهُمْ وَ تَوَكَّلْ عَلَی اللهِ  وَ كَفٰی بِاللهِ وَكِیْلًا.

কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না এবং তাদের পক্ষ থেকে যে কষ্ট-ক্লেশ তোমাকে দেওয়া হয়, তা অগ্রাহ্য কর এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখ। কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট। - সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৮

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তিনটি হুকুম দিয়েছেন। ক. কাফের ও মুনাফিকদের কথায় চলো না; খ. তাদের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা কর এবং গ. আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখ।

কিয়ামত পর্যন্ত আপন আপন অবস্থান অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে এর প্রতিটি হুকুম অতি গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। এর প্রতি শৈথিল্য ও অমনোযোগের পরিণাম হয় অতি অশুভ। আজ সারা বিশ্বে মুসলিম জাতির ব্যক্তিজীবন অব্যবস্থিত, সমাজজীবন বিপর্যস্ত এবং তাদের রাষ্ট্রসমূহ বহুমুখী আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত। এর একমাত্র কারণ এ হুকুমসমূহ পালনে আমাদের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, আমরা এগুলো মেনে চলার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও যত্নবান নই। আজ তারই খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। এর থেকে নিস্তার পেতে চাইলে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। আর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দরকার এ হুকুমগুলোর পুনর্পাঠ। প্রয়োজন আন্তরিকতার সাথে এর অনুসরণ শুরু করে দেওয়া এবং তা এখনই।

 

কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না :

প্রথম হুকুম হচ্ছে- কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। কাফের মানে অবিশ্বাসী, অমুসলিম, যারা আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয় বা তাঁকে এক মানে না, যারা প্রতিমার পূজা করে, যারা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সারা জাহানের সকল মানুষের নবী মানে না বরং তাঁকে সর্বশেষ নবী বলে স্বীকার করে না, যারা কুরআন মাজীদকে আল্লাহর কালাম বলে বিশ্বাস করে না বা কুরআনে প্রদত্ত বিধানাবলীকে আপন আপন ক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয় বলে স্বীকার করে না, যারা কুরআনের আইন পরিবর্তনযোগ্য বলে ধারণা রাখে- এরা সকলেই কাফের ও অমুসলিম। কুরআন-বর্ণিত যে-কোনও একটা বিষয়কেও যে ব্যক্তি অস্বীকার করে, সেও কাফের। নাস্তিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদী, কাদিয়ানী প্রভৃতি সম্প্রদায়সমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআন বলছে- এদের আনুগত্য করো না এবং এদের কথা ও পরামর্শ অনুযায়ী চলো না।

কুরআন এদের সাথে সহাবস্থান করতে নিষেধ করেনি। এর জন্য ভারসাম্যপূর্ণ নীতিও দান করেছে। কুরআনের সেই শিক্ষা ও বিধান অনুসারে যে-কোনও অমুসলিম জাতির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করা যাবে। তাদের প্রতিও মানবিক আচরণ করা শরীয়তের হুকুম। তাদের প্রতি জুলুম করা বা শুধুশুধুই তাদের উত্ত্যক্ত করা কুরআনী আইনে সম্পূর্ণ নিষেধ ও নাজায়েয। শরীয়তের শুধু তাদের আনুগত্য করতে একান্ত পরামর্শক ও অভিভাবকরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে।

মুসলিম ব্যক্তি ও মুসলিম জাতি কিভাবে পারিবারিক জীবনযাপন করবে, কিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, কিভাবে বিচার-আচার করবে, কিভাবে রাষ্ট্র চালাবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় কুরআন-সুন্নাহে বলে দেওয়া হয়েছে। তাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ। এ দ্বীন আল্লাহপ্রদত্ত দ্বীন। এর কোথাও কোনও কমতি নেই, অসঙ্গতি নেই এবং নেই কোনওরকম ত্রুটি।

ইসলামের বাইরে আর যত বিধান আছে তা সবই মানবরচিত। যারা নিজেদের আসমানী ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করে, তারাও আসমানী বিধান বিকৃত করে ফেলেছে। এখন তারা যা মানছে তা তাদের নিজেদের তৈরি করা। সেসব বিধান অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। তা মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করে, একের দ্বারা অন্যের প্রতি জুলুমের পথ সৃষ্টি করে দেয় এবং মানুষের মানবিক গুণাবলী ধ্বংস করে তার মধ্যে পশুপ্রবৃত্তি উসকে দেয়।

এরূপ অশুভ আইনের যারা রচয়িতা ও প্রবক্তা, তাদের নিজেদেরই কর্তব্য এর নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহপ্রদত্ত কল্যাণকর বিধানাবলী শিরোধার্য করে নেওয়া। তাদের বিপর্যস্ত মনুষ্যত্বকে বাঁচানোর এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

পাশবিকতার কবল থেকে তাদের মনুষ্যত্বকে উদ্ধার করার এ উপায় তাদের কে বাতলাবে? ইসলাম নামক মহামুক্তির পথ কে তাদের দেখাবে? নিশ্চয়ই এ পথের অনুসারীগণ অর্থাৎ মুসলিম জাতি। কুরআনের পূর্ণাঙ্গ, সমৃদ্ধ ও কল্যাণকর বিধানাবলীর আমানত তাদেরই কাছে গচ্ছিত। তাদের কর্তব্য নিজেদের জীবনে এ আমানতের যথাযথ সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের অপরাপর জাতির সামনেও এর চির প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা।

যাদের কর্তব্য কুরআনী নির্দেশনার সাথে অন্যদের পরিচিত করা, অন্যদেরকে এর কল্যাণকরতা বোঝানো ও এর অনুসরণের প্রতি উৎসাহ যোগানো, তাদের পক্ষে কি এটা শোভা পায় যে, তারা জীবনের কোনও ক্ষেত্রে কুরআনী নির্দেশনা থেকে বিমুখ হয়ে অন্যের পরামর্শে কান দেবে বা অন্যের হুকুমবরদার হয়ে চলবে?

হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, খৃষ্টান প্রভৃতি অমুসলিম জাতির কথামত চলতে কুরআন আমাদের নিষেধ করে দিয়েছে। সে নিষেধাজ্ঞা বিশেষ কোনও ক্ষেত্রে নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রে। ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। আদেশ করা হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً  وَّ لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّیْطٰنِ  اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ.

হে মুমিনগণ! ইসলামে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। -সূরা বাকারা আয়াত ২০৮

ইসলামী নির্দেশনার বাইরে এক কদম চললেও তা হয় শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ। মানব-শয়তানও শয়তানই বটে। যে মানুষ কাউকে ইসলামী বিধানের বাইরে চলার পথ দেখায় সেও এক শয়তান। এ আয়াত তার অনুসরণ করতে নিষেধ করেছে। কারণ সে দুশমন। ইসলাম ও মুসলিম জাতির দুশমন। যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে ইসলামী বিধানের বিপরীতে অন্য কোনও বিধান অনুসরণ করতে বলে, যে-কোনও মুসলিমের সে এক প্রকাশ্য দুশমন। পূর্ণাঙ্গ দ্বীনে পরিপূর্ণরূপে দাখিল হতে চাইলে এরূপ দুশমনকে এড়িয়ে চলতেই হবে। পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের অনুসরণকামী এক মুসলিমের পক্ষে তার জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই এরূপ দুশমনের পরামর্শ গ্রহণের কোনও সুযোগ থাকে না।

কাজেই একজন মুসলিম যেমন মসজিদে কুরআনী আইনের অধীন থাকে, কোনও খৃষ্টানের পরামর্শ সেখানে নেয় না, তেমনি তার অর্থব্যবস্থায়ও সে কুরআনী বিধানেরই অধীন থাকবে। সেখানে সে বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ ইত্যাদির সামনে নতজানু হবে না। একজন মুসলিম যেমন বিবাহ, তালাক, জানাযা ও দাফন-কাফনের কাজে ইসলামী শরীআতের অধীন থাকাকেই অবশ্যকর্তব্য মনে করে, কোনও হিন্দু-বৌদ্ধের কথা কদাপি মানে না ও মানবে না, তেমনি আদালতী কর্মকাণ্ডেও তার অবশ্যকর্তব্য শরীআতী বিচারব্যবস্থার আওতাধীন থাকা। জাতিসংঘ বা অন্য কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা যাই বলুক না কেন, তাতে সে আদৌ কর্ণপাত করবে না।

দাম্পত্যসম্পর্ক স্থাপনের নিয়ম যে শরীআত আমাদের প্রদান করেছে, সেই শরীআতই স্বামী-স্ত্রীর কার কী কাজ, কার কী অধিকার এবং কার বিচরণক্ষেত্র কোথায়, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছে। একজন মুসলিমের কর্তব্য- যেমন শরীআত অনুযায়ী তার বিবাহ সম্পন্ন হয়ে থাকে, তেমনি স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে যাবতীয় করণীয়ও সে শরীআত থেকেই নেবে। জাতিসংঘ বা অন্য কোনও সংস্থার শেখানো বোল এ ক্ষেত্রে কদাচ বোলবে না। সে ‘আকাশের পাখি ঊর্ধ্বে থাকিয়া কণ্ঠে দ্বীনের লহরী’-ই তুলবে।

পারিবারিক জীবন নির্বাহে যেমন শরীআতের সুস্পষ্ট হিদায়াত আছে, তেমনি বৃহত্তর পরিবার- রাষ্ট্র কিভাবে চলবে তার নির্দেশনা দিতেও শরীআত ভুল করেনি। একজন মূল্যবোধসম্পন্ন মুসলিম সেক্ষেত্রে শরীআতকে পাশ কাটিয়ে পথভ্রষ্ট খৃষ্টান বা অন্য কোনও জাতির অনুকরণের কথা ভাবতে পারে কি?

রাষ্ট্রের একটা বড় অঙ্গ প্রতিরক্ষা বিভাগ। এ সম্পর্কে কুরআনের একটা নির্দেশনা হল-

وَ اَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَّ مِنْ رِّبَاطِ الْخَیْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهٖ عَدُوَّ اللّٰهِ وَ عَدُوَّكُمْ وَ اٰخَرِیْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ  لَا تَعْلَمُوْنَهُمْ  اَللّٰهُ یَعْلَمُهُمْ

(হে মুসলিমগণ!) তোমরা তাদের (মুকাবিলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-ছাউনি প্রস্তুত কর, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের (বর্তমান) শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে এবং তাদের ছাড়া সেইসব লোককেও, যাদেরকে তোমরা এখনও জান না; (কিন্তু) আল্লাহ তাদেরকে জানেন। -সূরা আনফাল (৮) : ৬০

শত্রুরা তো সর্বপ্রকার মারণাস্ত্র তৈরি করছে, সর্বাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র মজুদ করছে, কে কারচে’ বেশি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেতে থাকছে, কিন্তু আমাদের বেলায় তাদের ভিন্ন নীতি। সমরাস্ত্র যোগাড় ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরির আমাদের যেন কোনও প্রয়োজন নেই। এ ব্যাপারে তারা আমাদের সম্পূর্ণ উদাসীন রেখে নিত্যনতুন ভোগ ও বিলাসিতায় যাতে ডুবে থাকি, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেই মন্ত্রণাই আমাদের দিচ্ছে। আমরা তাদের সে মন্ত্রণা বেশ ভালোভাবেই কবুল করে নিয়েছি। আমাদের অফিস-আদালত ও নগরসজ্জা, আমাদের গাড়ি-বাড়ির চমক এবং আমাদের মিটিং-মজলিস ও অনুষ্ঠানাদির জৌলুস দেখলে কে ভাবতে পারে আমাদের কোনওরকম অভাব আছে? বাস্তবিকপক্ষে আমাদের অভাব নেইও। তা নেই বলেই এতসব বিলাসিতা ও ফুর্তিতে বিপুল উৎসাহে অর্থ ঢালতে পারছি। অথচ প্রতিরক্ষা খাতে সুচিন্তিতভাবে যেমন অর্থব্যয় করা দরকার ছিল তা আমরা করছি কি? আদৌ করছি না। কারণ যাদের মন্ত্রণামত আমরা চলছি তারা আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দিতে বারণ করে। বাধ্যগত অনুচরের মত সেই বারণ আমরা মেনে চলছি।

আমরা তাদের বারণ মানছি শিক্ষা খাতেও। এক্ষেত্রে তাদের বারণ- শিক্ষায় যেন আমরা কিছুতেই তাওহীদ ও রিসালাত সম্পর্কিত আকীদার প্রতিফলন না ঘটাই। জড়বাদী চিন্তা-চেতনা এমনকি পৌত্তলিকতার অন্ধকার দ্বারা আমাদের শিক্ষানীতি আচ্ছন্ন হয়ে থাকুক- সেটাই তাদের কাম্য। তাদের সে কামনা পূরণে আমাদের উৎসাহে কোনও ঘাটতি নেই। আমরা বিপুল উদ্যমে তাদের ইচ্ছামাফিক শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কারিকুলাম ঢেলে সাজিয়েছি। কিম্ভুতকিমাকার সে সাজে আর যা-কিছুই পরিদৃষ্ট হোক, ইসলামের মেযাজ ও চেহারার ছিটেফোঁটা তাতে দৃষ্টিগোচর হয় না। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত কোমল শিশুদের থেকে শুরু করে উচ্চবিদ্যাপিঠে অধ্যয়নরত তরুণদের চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মে দ্বীনের আলো বিচ্ছুরিত হতে পারছে না। নির্জলা ইহলৌকিকতা ও নিষ্প্রাণ জড়বাদের প্রাচীরঘেরা শিক্ষায়তনে তা বিচ্ছুরণের কোনও সুযোগ রাখা হয়নি। এর ভয়াবহ পরিণাম আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। অনেক আশা ও অনেক সম্ভাবনার তরুণেরা সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়ে দিন দিন সকলের দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ সবই বন্ধুত্বের লেবাসধারী দুশমনদের পরামর্শ গ্রহণের কুফল। এই কুফল যাতে ভুগতে না হয়, সেজন্যই কুরআন আমাদের সতর্ক করেছিল- তাদের আনুগত্য করো না, তাদের কথায় চলো না।

কথা মানতে নিষেধ করা হয়েছে মুনাফিকদেরও। মুনাফিক মানে কপট চরিত্রের লোক। যারা মুখে নিজেদের মু’মিন-মুসলিম বলে প্রকাশ করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান এবং ইসলাম যে সত্য দ্বীন সে বিশ^াস পুরোপুরি নিজ অন্তরে পোষণ করতে পারে না, ইসলামী পরিভাষায় তাদের মুনাফিক বলে।

অন্তরে যে খাঁটি বিশ^াস নেই তা কিভাবে বুঝব? বোঝার কিছু আলামত আছে। কথায় কথায় মিথ্যা বলা, ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, আমানতের খেয়ানত করা এবং বিরোধ-বিসংবাদে গালাগালি করা- এগুলো মুনাফিকের আলামত।

এক শ্রেণীর লোক আছে, যাদের মধ্যে এসব আলামত যথেষ্ট পাওয়া যায়। তারা উলামা-মাশায়েখ ও দ্বীনদার-পরহেযগারদের সম্পর্কে মিথ্যাচার করে বেড়ায়, তাদের নামে কুৎসা রটায়, দ্বীন সম্পর্কে কিছু না জেনেও সর্বত্র মিছে জ্ঞানবিদ্যা জাহির করে, দ্বীনের প্রকৃত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে মিথ্যা ঠাওরিয়ে নিজেদের অজ্ঞতাপ্রসূত ও অমূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে সত্যিকার ইসলাম হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালায়, তারা মতলববাজ ঘোর মিথ্যুক। স্বার্থের ধান্ধায় ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করে। ক্ষমতার পালাবদল হলে তারাও বদলে যায়। আগের সব ওয়াদা-অঙ্গীকার ভুলে নবাগতদের সাথে নতুন ওয়াদা-অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। তাদের মুখে মধু, মনে বিষ। স্বার্থে আঘাত লাগলেই মনের বিষ মুখ দিয়ে ওগড়াতে শুরু করে। সবচে’ বেশি বিষ ঢালে উলামা-মাশায়েখদের বিরুদ্ধে। তাদের দ্বীন-আলোকিত মতের সাথে নিজেদের জাহিলী চিন্তা-ভাবনার মিল হয় না বলে মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি অভিধায় তাদের বিদ্ধ করে। এভাবে মুনাফিকীর সব আলামত তারা নিজ বুকে আগলে রেখেছে।

তবে কি আসলেই তারা মুনাফিক? তা না হলে ইসলামী আইনের কথায় তাদের গাত্রদাহ হয় কেন? নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও ইসলামের শাসন তারা অপছন্দ করে কেন? মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সর্বস্তরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা শুনলে যাদের গায়ে জ¦র আসে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের ইবনে উবাঈ ও তার অনুগামী মুনাফিকদের সাথে তাদের পার্থক্য কতটুকু?

এই শ্রেণীর লোক আজ অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে নিজেদের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। হয়তো ইসলামের সর্বাত্মক দাওয়াতের অভাব এবং দাওয়াতদাতাদের বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতার কমতিও এর জন্য খানিকটা দায়ী। তা দায় যার উপরই বর্তাক না কেন এটা বাস্তব যে, বর্ণচোরা ওই শ্রেণীটির অবস্থান বেশ মজবুত। আপন অবস্থান থেকে তারা এখন সর্বত্র নসিহত বিলিয়ে যাচ্ছে। নসিহত করছে কৃষক-শ্রমিককে, ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবককে। তারা নসিহত করছে তরুণ প্রজন্ম ও নারী-সমাজকে এবং সরকারকে ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে। এমনকি নসিহত বিলাচ্ছে উলামা-মাশায়েখকে লক্ষ্য করেও। নসিহতের ব্যাপারে তাদের কোনও রাখঢাক নেই। ভাবখানা এমন যে, কেবল তারাই শিক্ষিত ও বিদ্বান, আর সকলে মহামুর্খ! লোকমুখেও প্রচার- তারা বুদ্ধিজীবি। এবং সেইসংগে ‘সুশীল সমাজ’-এর তকমা তো তাদের আছেই। কাজেই তারা তাদের কথা লুকাবে কেন? যা বলার ঢাকঢোল পিটিয়ে বলছে।

 

তা তারা যত উচ্চবাচ্যই করুক না কেন, তাদের কথায় কান দেওয়া ঠিক নয়। কুরআন বলছে- মুনাফিকদের কথামত চলো না। তাদের কথায় চললে ডোবা ছাড়া গতি নেই। তাদের মন-মস্তিষ্ক ভিন্ন ছাঁচে ঢালা। তারা শিক্ষা পেয়েছে হয় সরাসরি বেদ্বীনদের দেশে বেদ্বীনদের কাছে, নয়তো বেদ্বীনদের হাতেগড়া এ দেশীয় সংস্করণের কাছে। তাদের মুখ থেকে যা বেরোয় তা নিজেদের উদ্ভাবন নয়, কেবলই শেখানো বোল। শুধুই পশ্চিমের নকলনবিসী। তাদের কথায় যে পড়বে সে সব হারাবে। ঈমান-আকীদা হারাবে, সভ্যতা-সংস্কৃতি হারাবে। মাতাপিতা সন্তান হারাবে, শিক্ষক তার ছাত্র হারাবে, স্বামী তার বউ হারাবে কিংবা বউ স্বামী হারাবে, এমনকি দেশ তার অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব হারাবে। এই বহুমুখী হারানোর সূত্রপাত কি ইতোমধ্যে হয়ে যায়নি?

হাঁ সূত্রপাত বেশ আগেই হয়ে গেছে। এগিয়েও গেছে অনেক দূর। তবে এখনও পর্যন্ত আমরা সবকিছু হারিয়ে বসিনি- এই যা সান্ত¡না! কিন্তু ওদের কথায় চলতে থাকলে সর্বহারা হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তা যাতে হতে না হয় সেজন্য এখনই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কুরআনের হুকুম অনুযায়ী কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য পরিহার করে চলতে হবে। তারা যা করতে বলে তা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং যে পরামর্শ দেয় তা অবশ্যই অগ্রাহ্য করতে হবে।

গ্রাহ্য করতে হবে কেবলই আল্লাহ ও রাসূলের কথা। শুনতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ’র নির্দেশনা। আঁকড়ে ধরতে হবে শরীআতের পথ।

 

ওদের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা কর :

শরীআতের পথে চললে ওই মহল ধেয়ে আসবে। কাফের ও মুনাফিকদের পক্ষ থেকে নেমে আসবে উৎপীড়নের খড়্গ, যেমনটা খড়্গ তারা চালিয়েছিল পবিত্র মক্কায় ও সোনার মদীনায়। তারা হামলা চালিয়েছিল জান-মালের উপর, আঘাত করেছিল ইজ্জত ও আব্রুর উপর। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম তাতে অটল থেকেছিলেন। উপেক্ষা করেছিলেন তাদের যাবতীয় উৎপীড়ন। পরিশেষে বিজয় তাঁদের পদচুম্বন করেছিল।

চূড়ান্ত বিজয় মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে হলেও তার ভীত রচিত হয়ে গিয়েছিল মদীনা মুনাওয়ারায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার দিনে, যখন মক্কা মুর্কারামা থেকে উৎপীড়িত মুসলিমগণ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এখানে চলে আসেন এবং এখানে আনসার-মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপিত হয়। তাদের সেই প্রীতিবন্ধনে প্রভাবিত হয়ে এখানকার ইহুদী গোত্রসমূহ তাঁদের সংগে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়।

কে না জানে, মদীনা মুনাওয়ারায় ইসলামের এ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল পবিত্র মক্কায় দীর্ঘ তের বছর দাওয়াতী কার্যক্রমে অবিচলিত থাকা এবং তাতে বেঈমানদের জুলুম-নিপীড়ন উপেক্ষা করা ও সর্বপ্রকার জুলুম-অত্যাচারে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করার মাধ্যমে।

আজও প্রতিটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের কর্তব্য ইসলামের সূচনাকালীন মু’মিনদের পথ অনুসরণ করা। অর্থাৎ তাদের মত কুরআন ও সুন্নাহ’র পথে অবিচলিত থেকে পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের দাওয়াত জারি রাখা। বেঈমানদের কথায় কর্ণপাত করার কোনও সুযোগ আমাদের নেই। ইজ্জত-আব্রু এমনকি জান-মালের উপরও যদি তারা হামলা চালায়, তবে সেসব হামলা আপাতত আমাদের উপেক্ষাই করে যেতে হবে। চরম ধৈর্যের সাথে আমাদের আপন আদর্শে অবিচলিত থাকতে হবে। এ আয়াতে সে নির্দেশই আমাদের দেওয়া হয়েছে।

 

আল্লাহর উপর ভরসা রাখ :

দুর্বল মনে সন্দেহ জাগতে পারে, মন টলে উঠতে পারে এবং ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হতে পারে। তা যাতে না হয় তাই কুরআন তৃতীয় নির্দেশ দিয়েছে- আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।

হাঁ মু’মিনদের তো আল্লাহরই উপর ভরসা রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাঁর ইবাদত-আনুগত্যের সর্বশেষ বিধিমালার নাম ইসলামী শরীআত, কুরআন-সুন্নাহ যার উৎস। এ বিধিমালার প্রচার-প্রতিষ্ঠায় যারা আত্মনিয়োগ করবে, তারা আল্লাহর কর্মী। আল্লাহর কর্মী ও তাঁর সৈনিক হওয়ার মত মর্যাদাকর কাজ জগতে আর কী হতে পারে? এতবড় মর্যাদাপূর্ণ কাজে যারা আত্মনিয়োগ করবে, তারা আল্লাহর সাহায্য না পেয়ে পারে কি?

ইখলাসের সাথে এ কাজে অবতীর্ণ হলে আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যাবেই। তিনি অন্তরে হিম্মত ও মনোবল দেবেন, অটুট ধৈর্যশক্তি দেবেন, পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি দান করবেন এবং শত্রুদের মধ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসার সাথে তাঁর কাজে নেমে পড়ে, তাকে সফলতায় পৌঁছানোর জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। সফলতার যাবতীয় ইন্তিজাম তিনি করে দেন। কুরআনের বহু আয়াতে এ আশ্বাসবাণী শোনানো হয়েছে। এ আয়াতেও শেষকথা বলা হয়েছে- وَ كَفٰی بِاللهِ وَكِیْلًا ‘কর্মসম্পাদনকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট’।

সুতরাং আমরা যারা মুসলিম, যারা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ^াস রাখি এবং নিজেদেরকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত বলে দাবি করি, তাদের প্রত্যেকের কর্তব্য এ আয়াতকে জীবনের মাইলফলক বানানো।

এ দেশের প্রত্যেক মুসলিম চাষী, মুসলিম শ্রমিক, মুসলিম ছাত্র, মুসলিম শিক্ষক, মুসলিম ব্যবসায়ী, মুসলিম আইনজীবী, মুসলিম সাংসদ, মুসলিম মন্ত্রী এবং যে-কেউ নিজেকে একজন মুসলিমরূপে আল্লাহর সামনে দাঁড় করাতে চায়, তার কর্তব্য আপন-আপন স্থানে শরীআত মোতাবেক জীবনযাপন করা ও শরীআতী জীবনাদর্শ প্রচারে সংকল্পবদ্ধ থাকা। এর বিপরীতে যে যেই কথাই বলুক না কেন, তাতে সে আদৌ কর্ণপাত করবে না এবং যে যেই পরামর্শই দিক না কেন, সে তা ঘৃণাভরে উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করবে। পরামর্শদাতা দেশী-বিদেশী যেই হোক না কেন এবং যতবড় শক্তিশালীই হোক না কেন, কুচ পরওয়া নেহী। শরীআতের অনুসারীকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট।

এ আয়াতের নির্দেশ কোনও ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। প্রত্যেক মুসলিমই এ নির্দেশের আওতাভুক্ত। তবে তুলনামূলকভাবে মুসলিম রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ও নীতিনির্ধারণী মহলের পক্ষে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা শিক্ষা, ব্যবসা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে ইসলাম-বিরোধীদের মুখোমুখি সরাসরি তাদেরকেই হতে হয়। মুনাফিক ও বর্ণচোরা শ্রেণীর কুরআন-সুন্নাহবিরোধী পরামর্শ বেশিরভাগ তাদের কাছেই আসে। রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তাদের হাতে থাকায় দায়-দায়িত্বও তাদের অনেক বেশি। জনগণের ঈমান-আকীদা ও আমল-আখলাকের উন্নতি-অবনতি সম্পর্কে যেমন তাদের আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তেমনি জনগণের নিরাপত্তা ও পার্থিব হক্বসমূহের বিষয়েও জবাবদিহি করতে হবে। উভয় প্রকারের দায়িত্ব পালনে ইসলামী শরীয়তের কাছেই তারা দায়বদ্ধ। তাই কুরআন-সুন্নাহ’র ব্যাপারে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা প্রদর্শনও তুলনামূলকভাবে তাদেরই বেশি জরুরি। সুবিধাভোগের ধান্ধায় মুনাফিক শ্রেণী সর্বদা তাদের ঘিরে থাকার চেষ্টা করে। তারা সুযোগমত তাদের ইসলামবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রয়াস পায়। সুতরাং তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকা ও চোখ-কান খাড়া রাখা সরকারি মহলের অবশ্যকর্তব্য, যাতে কোনওক্রমেই আপন দুরভিসন্ধিতে তারা সফল হতে না পারে।

রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কাফের-মুনাফিকদের করা যাবেনা আনুগত্য। তাদের আনুগত্য করা অর্থাৎ তাদের কথা ও পরামর্শ মোতাবেক কাজ করার শেষ পরিণতি একটাই- আপন অস্তিত্বের বিলুপ্তি। অর্থাৎ নিজেদের দ্বীন ও ঈমান বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ বেঈমান হয়ে যাওয়া। কেননা সেটাই তাদের লক্ষ্য। সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হওয়ার নয়। ক্ষমতাসীন মহলের সতর্কতাই পারে তাদের সে কুমতলব ব্যর্থ করে দিতে। সুতরাং আপন অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা সতর্ক হবে কি? তা না হবে কেন, যখন ক্ষমতার বিরাট নিআমত আল্লাহ তাদের দান করেছেন, যে নিআমতের যথাযথ ব্যবহারের সাথে এ দেশের ইসলাম ও মুসলিম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থ জড়িত? আল্লাহ তো প্রত্যেক নিআমত সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করবেন যে, তার ভোগ-ব্যবহার কিভাবে করা হয়েছে? নিশ্চয়ই ক্ষমতা সম্পর্কেও এ প্রশ্ন তিনি করবেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককেই এ আয়াতের নির্দেশনা মেনে চলার তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement