শাওয়াল ১৪৩৯   ||   জুলাই ২০১৮

তরুণদের প্রতি : ‘ইসলাম যেন আপনার হৃদয়ে শ্রদ্ধার জায়গায় থাকে’

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

[বিগত ১৫ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯ হিজরী/৪মার্চ ২০১৮ ঈসায়ী তারিখে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মিরপুরের ভবনে একটি দ্বীনী শিক্ষা মজলিসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। তাঁর মূল্যবান বয়ান আলকাউসারের পাঠকবৃন্দের জন্য উপস্থাপিত হল। -সম্পাদক]

হাম্দ ও ছানার পর

আজকের এই মজলিস একেবারে সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে। আমি সকলকে মোবারকবাদ জানাই। আপনারা এখানে এসেছেন। আসাটাই একটা বড় ব্যাপার। মোবারকবাদের একটি কারণ। এলেই কিছু পাওয়া যায়।

এধরনের মাজলিস থেকে সাধারণত মানুষ শূন্য পাত্র নিয়ে ঘরে ফিরে না- ইনশাআল্লাহ। মজলিসের শেষ অংশে আমাদের মুরুব্বী হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব আসছেন। হুযূর আসার আগে আগেই আমি কয়েকটি কথা পেশ করতে চাই।

আমি মারকাযের একজন ছাত্রতুল্য মানুষ। আমি হুযুরদের নির্দেশনা নিয়ে কিছু কিছু কাজ করি। যুবকদের সাথে- শরীয়তের দৃষ্টিতে এখানে সবাই যুবক- আমার কাজ করতে ভালো লাগে। যদিও আমি এখন  প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছি; মনটা যুবকের কাতারে রাখলে ভালো লাগে। মনে হয়, এখনো যুবক আছি। তো যুবকদের সঙ্গে কিছু গল্প করা, কিছু মতবিনিময় করা, যুবকদের সঙ্কট-সম্ভাবনা, ভাবনা-চিন্তা এগুলো আদান-প্রদান করা- এটার জন্যই কিছু কথা আমি পেশ করার চেষ্টা করব।

 

এখন যৌবন যার

এখানে অধিকাংশই এমন, যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কেউ কেউ আছে, যারা আরেকটু বড়- ইন্টারের ছাত্র, অনার্সের ছাত্র ও মাস্টার্সের ছাত্র।

মানুষ যখন এসএসসি পরীক্ষা দেয়, মাদরাসায় আমরা বলি, কাফিয়া পরীক্ষা দেয়, তখন একটা অনুভূতি ঘটে থাকে।  সেটা হল প্রাপ্তবয়স্কতার অনুভূতি। আমি বড় হয়ে গেছি। আসলেও সে বড় হয়ে গেছে। এই অনুভূতিটা তখন তাকে স্পর্শ করে। একটা গাছ লাগানোর পর যখন চারা গজায় তখনো গাছটাকে বড় মনে হয় না। আমরা গাছটাকে বাচ্চা গাছ বলতে পারি। গাছটা যখন মাথার উপর চলে যায় এবং একটু শক্ত হয়ে যায়, ডালপালা বিস্তৃত হয় তখন আমরা গাছটার আর প্রোটেকশন দরকার মনে করি না। এখন গরু, ছাগল যাই আসুক সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। এসএসসি পর্যন্ত যখন একটা ছেলে চলে যায়, বয়সের দিক থেকে, বোধের দিক থেকে, চিন্তার দিক থেকে, বিচরণের দিক থেকে, লেখা পড়ার দিক থেকে- একটা পরিপক্বতার সূচনার জায়গায় সে চলে আসে। নিজস্ব যিম্মাদারির জায়গায় সে চলে আসে।

বাংলাদেশে যুবক শব্দটা আরো পরে যুক্ত হয়। আঠারোর পরে, এডাল্ট বলে। প্রাপ্তবয়স্ক বলা হয়। তের  থেকে উনিশ এটাকে বলা হয়  টিন এজ। আঠারোর পর থেকে টিনের বয়সটা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসলে তেরোর পর থেকেই একটা ছেলে যুবক হয়ে যায়। মনের দিক থেকে, চিন্তার দিক থেকে, তার বিচরণের দিক থেকে। তার ভেতরে ভাবনাগুলো শুরু হতে থাকে- আমি কী হব, আমি কী করব। এজন্য যারা যুবক তাদেরকে বলছি, যদি আমরা ইসলামের ইতিহাসের দিকে দেখি, আমরা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে পাই যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবসময় যুবকদেরকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। আদর করেছেন। এগিয়ে দিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। বড় বড় দায়িত্ব তাদেরকে দিয়েছেন। আবার যুবকরা সেই দায়িত্ব পালনও করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও তৎকালীন ইয়াসরিব, এখন যেটাকে বলি মদীনাতুন নাবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এর উদ্দেশ্যে হিজরত করেননি। হজে¦র মৌসুমে বাইআতে আকাবায়ে উলায়, বাইআতে আকাবায়ে ছানিয়ায় বিভিন্ন মানুষ এসে রাসূলের কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ করে চলে যান। তখন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝে মক্কার একজন যুবক সাহাবী পাঠালেন। রাসূল নিজে হিজরতে যাওয়ার আগেই একজন যুবককে পাঠিয়েছেন। কেন? সে কুরআন শেখাবে, দ্বীনের তালীম দেবে। সেই যুবক বিপুল ভূমিকা রাখলেন। কারণ তিনি যুবক। কোনো প্রবীণ সাহাবীকে রাসূল পাঠাননি। এর মানে এই নয়- প্রবীণ সাহাবীগণকে রাসূল মহব্বত করেননি। তাঁদের দ্বারাও অনেক কাজ নিয়েছেন। যুবকদের থেকে রাসূল কাজ নিয়েছেনও বেশি, তারা কাজ করেছেনও বেশি। নিজেকে উজাড় করে করে কাজ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে, ইলমের ইতিহাসে, জিহাদের ইতিহাসে, দাওয়াতের ইতিহাসে, সংগ্রামের ইতিহাসে। সংকটের সময়, সংকটকে সামনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাসে এবং সেবার ইতিহাসে যুবকদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা বাংলা সাহিত্যেও যদি দেখি, যৌবনের কথা অনেক বেশি। কবি হেলাল হাফিজের কবিতা অনেক জায়গায় দেয়ালে লেখা থাকে- “এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।” হেলাল হাফিজ এখনও বেঁচে আছেন। আমি তার কবিতাটা উদ্ধৃত করলাম। এটা এই সময়ের উচ্চারিত কবিতা। এটা একাত্তরের আগে উনসত্তরে লেখা। যখন বাংলাদেশে খুব মুখর সময়। তখন  তিনি এই কবিতাটা লিখেছেন। কবিতাটার নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’?।  তো এখন যৌবন যার, দ্বীনের কাজ করার তার শ্রেষ্ঠ সময়। হাদীসের ভাষায়- এখন যৌবন যার, ইবাদাত করার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার, জীবনটাকে গড়ে তোলার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

আপনি যদি বলেন, এগুলো তো আপনি কবিতার মতো বলছেন? আমি বলব, না, আমি কবিতার মতো বলছি না। আমার বয়স এখন সাতচল্লিশ। আমি খুব আস্থার সঙ্গে আপনাদেরকে বলি, আপনারা বিশ্বাস করুন, যৌবনে আমি যা শিখিনি এখন তা চাইলেই শিখতে পারি না। আমি যে অভ্যাস যৌবনে করিনি, তা চাইলেই পারি না। এখন যদি আমি মনে করি, একশটা দুআ ইয়াদ করব, পারব না। মেমোরি জ্যাম হয়ে গেছে। মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক কাজ, অনেক  পেরেশানি, অনেক উদাসীনতা। কিন্তু আপনাদের এখন সময়। এখন যদি কেউ মনে করেন, আমি বিশটা সূরা শিখব, মাসায়েল শিখব, আমি চমৎকার করে আগামী এক বছরে একশটা দুআ শিখে ফেলব। আপনি পারবেন। আপনার অন্তরের শ্লেটটা কাঁচা। এখন দাগ দেবেন দাগ বসবে। বয়স পার হয়ে যাবে, আফসোস করবেন, পারবেন না। কেউ পারে না তা না। আমি একটা সাধারণ কথা বলছি। সাধারণ কথাটা এমন যে,  যৌবন পার হওয়ার পর অর্জন কঠিন হয়ে যায়। তখন মানুষ ফলাফল খোঁজে, যা অর্জন করেছে তার। যার অর্জন যতটুকু তার ফলাফল ততটুকু। ভালোর মধ্যে যৌবন যে কাটিয়েছে, সে যদি প্রৗঢ়ত্বে স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থাকে তাহলে ভালো কাজগুলো তার এমনি হয়ে যাবে। মন্দের মধ্যে যার যৌবন কাটে সে যদি প্রৌঢ়ত্বের মধ্যে তার গা-টাকে ছেড়ে রাখে তাহলে মন্দের মধ্যেই তার সময় কাটবে। তার চোখের ভুল ব্যবহার যদি যৌবনে বেশি হয়ে থাকে প্রৌঢ়ত্বে তার চোখের ভুল ব্যবহারই বেশি হবে। তার সময় অপচয়ের অভ্যাস যদি যৌবনে তৈরি হয় প্রৗঢ়ত্বে তার সময় অপচয়ের অভ্যাসটা থাকবে। মানুষের সাথে রুক্ষ আচরণের অভ্যাস যদি যৌবনে হয় তাহলে প্রৌঢ়ত্বে সে এখান থেকে খুব দ্রুত নিজেকে সরিয়ে আনতে পারবে না। যৌবনের সময়টা হচ্ছে কাঁচা সময়। অর্জনের সময়।

প্রাসঙ্গিক কথা- তারপরও বলি, আমি আমার বন্ধুদের সাথে একবার বলছিলাম, আমি একদিন দেখি নামাযের আগে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব, যার আলোচনা আপনারা আসরের নামাযের আগে শুনেছেন, আপনারা তাঁকে কীভাবে চেনেন, আমি জানি না, তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। একান্ন বায়ান্ন-এর মধ্যে। বাংলাদেশে যদি তিন জন আলেমকে বলা হয়, ইলমের সমুদ্র, ইসলামী প্রজ্ঞার ভা-ার তাহলে এর মধ্যে তিনি একজন। আমি এর চেয়েও নির্ধারিত করে বলতে পারতাম, কিন্তু আদবের কারণে বললাম না। আমি যদি বলতাম ইনি একজন, বলতে পারতাম, আমার কথাটা ভুল হত না। আমি এজন্য তিন জন, চার জন, পাঁচ জন এভাবে বললাম। সাত-আট বছর আগে তিনি একদিন একা একা ঝিলপাড় মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। পায়ে স্যান্ডেল। তিনি সবসময় সাদামাটা স্যান্ডেল ব্যবহার করেন। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন, কাত হয়ে হয়ে। আমি আমার এক প্রিয়জনকে বললাম, আগামী দিনের ইতিহাস হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। আজকে মানুষ তাঁকে ওইভাবে চেনে না। কিন্তু বিশ বছর পর -আল্লাহ তাঁর হায়াত বাড়িয়ে দিন- মানুষ তাঁকে খুঁজবে। খুঁজুক এটা আমরা চাই, একথা বলছি না। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হবে- মানুষ খুঁজবে। প্রজ্ঞাবান মানুষের  পেছনে ছোটাছুটি দুনিয়ায় এটা খুব ন্যাচারাল, খুব স্বাভাবিক। সে যেভাবেই হোক। মানুষ তাঁকে খুঁজবে। তিনি এখন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। আগামী দিনের ইতিহাস।

তো আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি, আপনাদেরও আগামী দিনের ইতিহাস হওয়ার যোগ্যতা আছে। এখন হয়তো মনে হচ্ছে খুব সাধারণ একজন মানুষ আপনি। এক হাজার জনের একজন। এক লাখ জনের একজন। এক কোটি জনের একজন। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন আমি ওই এক কোটি জনের একজন- আসলেই একজন হব- ইনশাআল্লাহ- অনন্য একজন। এক কোটির মধ্যে আমাকে আলাদা করা যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি ওই চেষ্টা করব। আমি এই মঞ্চে বসে এই কথা বলব না- দুনিয়াবীভাবে আপনি তেমনি একজন হন। আমি বলব- আপনারা লেখাপড়া করছেন পার্থিব জগতের বিষয়গুলো নিয়ে। হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব বলে দিয়েছেন যে, নিয়ত ঠিক থাকতে হবে। ভালো নিয়ত  নিয়ে, ভালো জীবন চর্চা নিয়ে, মুসলমানের কাছে যে জীবন চাওয়া হয়, ওই জীবন নিয়ে এখন থেকেই যদি তৈরি হন তাহলে আগামী দশ বছর, পনের বছর, বিশ বছর পরে আপনি ওই আলো বিতরণকারী মানুষে পরিণত হবেন- ইনশাআল্লাহ।

 

পাঁচটি বিষয়ের মূল্য দাও

আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস আপনাদের সামনে পাঠ করেছি। হাদীসটির তরজমা হল-

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে দাম দাও। মূল্যবান মনে কর। পাঁচটি জিনিসের আগে পাঁচটি জিনিস, পাঁচটি বিষয়ের আগে পাঁচটি বিষয়। হাদীসের শব্দ অত্যন্ত সাহিত্যপূর্ণ। পাঁচের আগে পাঁচকে মূল্য দাও। কোন্ পাঁচের আগে  কোন্ পাঁচ?

১. প্রৌঢ়ত্বের আগে যৌবনকে গুরুত্ব দাও। যৌবনকে যৌবন হারিয়ে ফেলার আগে গুরুত্ব দাও। হাদীসে এক নাম্বারে এই কথাটা বলা হয়েছে- شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ

২. صِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ অসুস্থতার আগে সুস্থতার মূল্য দাও। অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে গুরুত্ব দাও। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। মনে হতে পারে, আমি তো অসুস্থ হব না। যেদিন মারা যাব মারা যাব। হতে তো পারে এমন। কিন্তু বাস্তব কথা হল, যার শরীর আছে, দেহ আছে, স্বাস্থ্য আছে তার জীবনে অসুস্থতাও আছে। একটা হল সাধারণ অসুস্থতা যেটাকে আমরা অসুস্থতা বলি। আরেকটা হচ্ছে প্রাকৃতিক জরাগ্রস্ততা। মানুষের বয়স যখন বাড়তে থাকে শরীরের উদ্যম হারিয়ে যেতে থাকে। শরীরে কোনো অসুস্থতা না এলেও। এখন যেমন আপনি একটা দৌঁড় দিতে পারেন মসজিদের দিকে, বয়স যখন ষাট পার হবে সেভাবে তখন দৌড় দিতে পারবেন না। আপনি যদি মনে করেন, আপনি দুই রাকাত নামায আধা ঘণ্টা লাগিয়ে পরবেন, পারবেন না। দাঁড়িয়ে পারবেন না। আপনি যেভাবে সেজদা দিতে পারবেন একজন সত্তর বছর বয়সী মানুষ  সেভাবে পারবেন না।

৩. তিন নাম্বার غِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ দারিদ্র্যের আগে স্বচ্ছলতাকে গুরুত্ব দাও। পকেটে টাকা আছে, সামর্থ্য আছে,  খেয়ালই করা হচ্ছে না, টাকা উড়িয়ে দিচ্ছি আমি। খাদ্যের পেছনে, বিলাস ব্যসনের পেছনে। ফুর্তির পেছনে। টাকাটা ভাল কাজে লাগাচ্ছি না। তাহলে ওই লোকের আক্ষেপের সময় আসছে, যখন তার দরকার হবে তখন সে পাবে না। আখেরাতের ভালো কাজেও লাগাতে পারবে না। তার পার্থিব ভালো কাজেও লাগাতে পারবে না।

৪. চার নাম্বার فَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ তুমি নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার আগে সময়ের যে ফুরসত থাকে তাকে গুরুত্ব দাও। যেমন পরীক্ষার পর এখন আপনাদের আছে। চাকরিতে ঢুকে গেলে রাত দিন সময় দিতে হয়। তখন মনে অনেক কিছুই চাবে কিন্তু পারবেন না। ফারাগ শব্দের বাংলা তরজমা অবসর। অবসর বললে এখানে বুঝে আসবে না। ফারাগ বলতে নিমগ্নতাহীনতা। একটা কিছুর মধ্যে ডুবে যাওয়া, নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া, এনগেইজড্ হয়ে যাওয়ার আগের অংশটাকে ফারাগ বলে। আমি ডুবে গেলাম ব্যবসায়, আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম চাকরিতে, আমি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এই ব্যস্ত হওয়ার আগের অংশটা, যখন সময় কিছুটা ছড়ানো ছিটানো থাকে। যেমন, রাতভর গল্প করলে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। পরের দিন জবাবদিহিতা  নেই। ওই রাতটা আমি কাজে লাগাই। আসর থেকে এশা পর্যন্ত সময় একভাবে ব্যয় করলে চাকরি চলে যাবে না, পরীক্ষায় ফেল করার ব্যাপার আসবে না। ওই সময়টা হচ্ছে ফারাগ। নিমগ্নতার আগে অবকাশের যে সময়টা, যে সময় খুব স্বাভাবিক আনন্দময়, যে সময়টা গভীর নিমগ্নতাপূর্ণ নয়, সে  সময়টাকে তুমি মূল্য দাও। মানে দামী বানাও, কাজে লাগাও।

৫. حَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ তোমার জীবনটাকে তুমি মৃত্যুর আগে কাজে লাগাও। পাঁচ নম্বরটা হল, আগের চারটার নির্যাস।

এটা রাসূলে কারীমের হাদীস। কত চমৎকার কবিতার মত এই হাদীসটা- যারা আরবী বুঝেন তারা বুঝতে পারেন। রাসূল শুরুতে একবার বলেছেন ‘ইগতানিম’ গুরুত্ব দাও। এরপর শুধু শব্দগুলো বলেছেন। আপনারা আবার শুনুন- ‘ইগতানিম’ এটা গনীমত থেকে। গনীমত শব্দ আমরা সবাই বুঝি। মানে গনীমত মনে কর, দামী মনে কর, মূল্যবান মনে কর। যুবকদের কথা হাদীসের শুরুতেই রাসূল বলেছেন। এজন্য আমরা এ সময়টাকে গুরুত্ব দেই।

বারবার গুরুত্ব দিতে বলার অর্থ আবার এটা বুঝে নিয়েন না যে, আজকের আলোচনা আমাদেরকে টাইট বানিয়ে দিচ্ছে। নড়াচড়ার ব্যবস্থা নেই। মাত্র পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। একটু গল্পসল্প করব। হুজুররা বয়ান করে এমন পেরেক মেরে দিচ্ছে মাথার মধ্যে, মনে হচ্ছে যে, আর দম ফেলার সময় নাই। এটা না।  একটা নোসখা বলে দেওয়া হচ্ছে শুধু এখানে। আপনি দম ফেলবেন, হাসবেন, কথা বলবেন। গল্প করবেন। পরিবারকে সময় দেবেন। কোনো অসুবিধা নিই। সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার জন্যে, ভারাক্রান্ত হয়ে যাওয়ার জন্য নয় আজকের মজলিস। এখানে সবটুকুই আনন্দ। আপনাদের আনন্দটা বাড়ানোর জন্যই এত কথা। আনন্দ যেন সুন্দর হয়, আত্মঘাতী না হয়। আনন্দটা যেন পরে আপনাকে রাস্তার পাশে ফেলে না দেয়। মটর সাইকেল দুইভাবে চালানো যায়। একটা হচ্ছে, আমি দীর্ঘ সময় চালাব। রাস্তা দেখে দেখে চালাব। আরেকটা হচ্ছে, না, শুরুতেই একশ বিশ। তো শব্দ হবে, আওয়াজ হবে- সে মটর সাইকেল চালাচ্ছে। দশ মিনিট পর আওয়াজটা থেমেও যেতে পারে। ভাঙ্গা রাস্তা, নির্মাণের কাজ চলছে, সংস্কারের কাজ চলছে। তার আর হুঁশ নাই- মোটর সাইকেল এমনভাবে চালিয়েছে... মোটর সাইকেলেরও একেকটার একেক নাম। বাজাজ, হোন্ডা, পালসার। কী বিকট শব্দ! আমরা রাস্তায় মাঝেমধ্যে শুনি। মনে হয় হেলিকপ্টার আসছে। খুব ভয় লাগে। আমার জন্য ভয় লাগে না। আমার ভয় লাগে, এই বাচ্চাটা ‘থেমে’ যায় কি না ।

তো আমরা আপনাদেরকে নিয়ে ওই আলোচনাই করতে চাই যে, আপনারা লম্বা সময় ধরে চালান। আমাদের যেন এই আশংকা না থাকে- দশ মিনিট পর আওয়াজটা থেমে যেতে পারে।

হায়াত আল্লাহ দিয়েছেন। আবার প্রতিটি সতর্কতা রক্ষার কথাও শরীয়তে বলা আছে। এজন্য ডাক্তাররা রসিকতা করে বলেন, অল্প করে অনেক দিন খেতে চান, না বেশি করে অল্প দিন খেতে চান? যদি অল্প দিন বেশি খেতে চান, পয়সা পকেটে থাকে, সকালে একবার যান হোটেলে, বিকেলে একবার যান। নানা ধরনের ফাস্টফুড আছে, এটা ওটা আছে। খেতে থাকুন। দুই বছরের মাথায় ফ্যাট জমে যাবে। আমি ডাক্তারি কথা বলছি। তিন বছরের মাথায় ডাক্তার ব্লাডের  টেস্ট দিয়ে বলবে- আপনার এটার মাত্রা এত, এটার মাত্রা এত। তারপর একদিন বলবে- বয়সে যুবক মানুষ, কিন্তু আমার মনে হয়, আপনার এনজিওগ্রাম করা দরকার। বুকে যে চাপ লাগে- আমার ভয় হয়। চল্লিশের পর বলবে, আপনার ওপেন হার্ট সার্জারি লাগবে। নানা ধরনের সমস্যা যুক্ত হয়ে যাবে। পঁয়তাল্লিশে বলবে, আপনি ‘প্রস্তুতি’ নিন। বাবা সুস্থ, দাদা সুস্থ, যুবকের অবস্থা এমন। আমরা ওটা চাচ্ছি না। আমরা চাই, আপনি অল্প অল্প করে বেশি দিন খান। আশি বছর পর্যন্ত আপনার শরীর চাঙ্গা থাকুক। একটা পিজা দেখবেন খাবেন। একটু সবজি খাবেন। এই একটু মুরগী দেখবেন খাবেন। মাছ ফ্রাই দেখবেন খাবেন। আবার এড়িয়েও যাবেন, সংযম অবলম্বন করবেন। যেটা জীবনের সাথে যুক্ত। শরীয়ত এ কথা বলে। হালাল জিনিসগুলোকে আমরা ভোগ করব।  খারাপ জিনিসে আমরা যাব না। আমাদের দুনিয়াতেও ফায়দা, আখেরাতেও আমরা নাজাত পাব।

আমি এখন আপনাদেরকে সংযোজনী কয়েকটি কথা বলব।

 

চোখ ও কানের হেফাযত

যৌবনে চোখের ও কানের ব্যাপক ব্যবহার হয়। ব্যাপক প্রয়োগ হয়। যারা ভাল ছেলে তাদের অপপ্রয়োগ হয় না। ব্যাপক প্রয়োগ হয়। এ বয়সে যা দেখতে ভালো লাগে তাই দেখতে ইচ্ছা হয়। প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগে । মা-বাবাকে দেখতে ভালো লাগে। সুন্দর দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে। বই পড়তে ভালো লাগে। মাজার বই। রাতের পর রাত পড়তে ভালো লাগে। কোনো ক্লান্তি নেই। মাথাটাও খুব ফ্রেশ থাকে, নিতে ইচ্ছা করে। খুব এনজয়ের একটা সময়- যৌবন। চোখ ও কানের খুব ব্যবহার হয়।

একজন মানুষ, যার বয়স সাতচল্লিশ আটচল্লিশ, তার সাথে সুখের গল্প করুন। দেখবেন, কিছুক্ষণ পর তিনি বলবেন, তোর কথা শেষ হয়েছে? এখন শুয়ে পড়। আর ভাল্লাগে না। মাথা ব্যথা করছে। ভালো সুখকর একটা কথা শোনাবেন। দশ মিনিট পর উনি বলবেন, আর পারছি না। মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায়। তার চোখও ক্লান্ত হয়ে যায়। কানও ক্লান্ত হয়ে যায়। চোখ আর কানের সর্বোচ্চ ব্যবহারের সময় এই তারুণ্য, যৌবন। পনের থেকে নিয়ে চল্লিশ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ব্যবহার এই সময়ে  হয়।

আমি এখন এর পরের কথাটা বলি- এই সময়ে এই জিনিসগুলোর সবচেয়ে বেশি অপপ্রয়োগও হয়। অপপ্রয়োগ বলতে আমি ব্যাখ্যা করব না। সবাই বোঝে। শরীয়ত যেখানে চোখ দিতে নিষেধ করেছে, সেটা লাইভলি হোক বা স্ক্রীনে হোক, খুব স্বাভাবিকভাবে হোক বা প্রযুক্তির মাধ্যমে হোক, চোখটাকে বাঁিচয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কানটাকে বাঁিচয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।  কেন? দুইটা কারণ। আসলে কারণ অনেক। আমি এখানে দুইটা ভাগ করছি। একটা কারণ হচ্ছে, পার্থিব ক্ষতি। চোখ নষ্ট হবে, হৃদয় নষ্ট হবে। মাথা নষ্ট হবে। চরিত্র নষ্ট হবে। চিন্তা নষ্ট হবে। মেধা নষ্ট হবে। স্বাস্থ্যের উপর এটার চাপ পড়বে। কানের অপপ্রয়োগ হতে থাকলে মনোযোগ নষ্ট হবে। স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটা ছেলে যদি পাঁচ বছর-ছয় বছর শুধু তার মেধার অপপ্রয়োগ ঘটায়, তার চিন্তাই নষ্ট হয়ে যাবে। তার মেধাই নষ্ট হয়ে যাবে। এই ছেলে কোনো কাজ করতে পারবে না। তাকে দিয়ে কোনো দায়িত্বশীল কাজই হবে না। ভালো ব্যবসা হবে না। ভালো চাকরি হবে না। ভালো কোনো জব হবে না। সে তার চিন্তা সাজাতে পারবে না। সবসময় তার মাথা-চোখ-কান এক ধরনের নিষিদ্ধ বিষয় দিয়ে আচ্ছন্ন থাকবে। সুতরাং এগুলো থেকে বাঁচতে হবে।

দেখুন এখানে আরেকটা তর্ক আসে। বলা হয় এটা এনজয়ের সময়, এই আনন্দময় জীবন একটাই। কিন্তু মুসলমানদের কাছে জীবন একটা, না দুইটা? আর যদি একটাই বলেন, তাহলে সেটা হচ্ছে আখেরাত। ওদের কথা যদি আপনি মেনেও নেন তাহলে জীবন ওইটাই। এই জীবন হল ওই জীবনের তৈরির সময়। আল্লাহ তাআলা মানা করেননি জীবনকে এনজয় করতে। তার একটা সময় আছে। প্রাপ্তবয়স্কতার জীবন শুরু হয়েছে। হালালভাবে এনজয় করার জন্য গার্ডিয়ান আপনাকে একটা সময় দেবে। শরীয়ত সে এনজয়কে উৎসাহিত করেছে। নিষেধ করেনি। ওগুলোর মধ্যে অনেক সওয়াব। এখন একটু ধৈর্য ধরুন।

দুনিয়াবীভাবে আমি ব্যাখ্যা দিই। কোনো একটা ছেলে ভালো ক্যারিয়ার গড়বে, এসএসসি পরীক্ষা দেবে, সে  ছেলে নিশ্চয় এক মাস আগ থেকে খেলাধূলা ও টিভির অন্যান্য প্রোগ্রাম, এটা-সেটায় সময় ব্যয় করবে না। তার নিজের সেন্সই কাজ করবে যে, এখন না, এখন না। এখন ফেইসবুকে সময় দেওয়ার সময় না। খেলায় সময় দেওয়ার সময় না। এখন লেখা-পড়ার সময়। অন্তত পরীক্ষার আগের রাতে সে সময় দিতে চাইবে না। তার মা-বাবা বললেও না। বন্ধুরা বললেও না। যদি বলা হয়, তোকে দশ হাজার টাকা দেওয়া হবে, তাহলেও সে দেবে না। কেন? তার নিজের একটা অংক আছে। অংকটা হল, আজকে এটা করলে আমার ক্ষতি হয়ে যাবে। রেজাল্ট ভালো করতে হলে এখন অন্তত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমি একটা ভালো জায়গায় যেতে চাই। এটা যেমন একজন মানুষ বুঝতে পারে, বোঝার কারণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এবার চলুন আমরা আখেরাতের জীবনটাকে সামনে রাখি। আমাদের গোনাহ থেকে বাঁচতে হবে। আমাদের চোখ বাঁচাতে হবে। কান বাঁচাতে হবে। মাথা বাঁচাতে হবে। হায়াত বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে চাইলে দুইটা ফায়দা। দুনিয়ার জীবনে আমি সফল হতে পারব। যে ছেলে চোখের যত অপপ্রয়োগ কম করবে, কানের অপপ্রয়োগ কম করবে, মাথার অপপ্রয়োগ কম করবে সে দুনিয়াবী লেখা পড়াই করুক, ওখানে তার সাফল্য বেশি আসবে। ক্যারিয়ার সুন্দরভাবে গঠিত হবে। এটা দুনিয়াবী ফায়দা। তার চিন্তাশক্তি সুন্দর থাকবে। আর আখেরাতের ক্ষেত্রে সে কামিয়াবই কামিয়াব। তার গোনাহ বন্ধ হয়ে যাবে। যত চোখের গোনাহ কম হবে তত ইবাদতে সে স্বাদ পাবে। ইবাদতে আনন্দ পাবে। নিয়ন্ত্রণ করলে ইবাদতে আনন্দটা বাড়বে- এখানে আনন্দটা কমবে। এটা একটা অভ্যস্ততার পর। আখেরাতে আমাদের নাজাত দুনিয়াতেও আমাদের শান্তি। শরীর স্বাস্থ্যের সুস্থতা।

 

ফিকিরের হেফাযত

মাথা ও বোধ-চিন্তা নিয়ে এখন দ্বিতীয় কথা। এটাকে আমরা বলি ফিকির বাঁচানো। মুসলমান তরুণ বিজ্ঞানী হোন, ইঞ্জিনিয়ার হোন, সচিব হোন, ডাক্তার হোন এখন থেকেই ফিকির বাঁচান। ফিকির বাঁচানোর অর্থ কী? অনেক বড় কথা। শুধু একটা কথা, যেটা হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব বলে গেছেন আমি ওটার জের ধরে বলি, একজন মুসলমানের সবসময়  মনে রাখতে হবে আমার জীবন কিন্তু শুরু হবে মৃত্যুর পর। এখনকার ক্যারিয়ার এটা একটা ট্যাকনিক্যাল ক্যারিয়ার। আমার শিখতে হচ্ছে, চলতে হচ্ছে এজন্য আমি চলছি। আমার মূল শিক্ষা এবং মনপ্রাণ অন্যপানে। ধ্যানজ্ঞান থাকবে আরো উঁচু জায়গায়। এটাকে বড় করে ব্যাখ্যা করা দরকার। আমি ছোট করে ব্যাখ্যা করি।

মনে করুন, আপনি অফিসে চাকরিতে ঢুকেছেন। চাকরিতে যিনি বস, এক লাখ টাকা বেতন দেন, বাড়ি গাড়ি পান। ওনার সৌজন্যে আপনি চলেন। দু-তিন জন বস আছে। অফিসের সময় এবং বাসায় আসলেও ‘জি স্যার, স্যার, হাঁ, আমি এটা করছি স্যার।’ তার যা যা প্রশংসা করা দরকার আপনি কিন্তু  করছেন। যা যা আনুগত্য দরকার সব আপনি করছেন, নিষেধ নেই। আপনি স্যারকে যে আনুগত্য করছেন আমি ওই জায়গাগুলোর কথা বলছি। বৈধ আনুগত্যে নিষেধ নেই। আপনি কথা এবং বডি লেংগুয়েজ দিয়ে খুশী করছেন। এতে নিষেধ নেই। কিন্তু আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনার মা-বাবা বাসায় আছেন, বৃদ্ধ। আপনার হৃদয়ের ভেতরে কার জায়গা বড়-  আপনার মা বাবার না আপনার স্যারের? আচরণে এটা প্রকাশ পাচ্ছে কিন্তু হৃদয়ের ভেতর ওটা আছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে গৃহের ভেতরের আচরণে ওটা প্রকাশ পায়। আপনি আপনার মায়ের চিকিৎসা নিয়ে বেশি চিন্তিত। বাবার অবস্থা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তার খাদ্য নিয়ে, তার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত।  এটাই ন্যাচারাল। মানব স্বভাব হিসেবে মা-বাবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বেশি। কিন্তু আমরা অফিসিয়াল আচরণে বলছি, জি স্যার, আমি আসছি স্যার। আপনি যখন বলবেন তখনই আছি স্যার।

গোটা দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠান হল অফিসিয়াল বসের মত। আপনার দ্বীন, দ্বীনী বই পত্র, দ্বীনী মুরুব্বী, দ্বীনী জীবনটা হচ্ছে আপনার ঘরের মা-বাবা। আপনি বিজ্ঞানী হোন, ইঞ্জিনিয়ার হোন, ডাক্তার হোন, সচিব হোন, আপনি মিনিস্টার হোন,  প্রেসিডেন্ট  হোন, ইসলাম যেন মা-বাবার মতো আপনার হৃদয়ে শ্রদ্ধার জায়গায় থাকে। বাহ্যিক আচরণ কথাবার্তায় শরীয়তের সীমা মেনেই অনেক কিছু  আপনাকে করতে হচ্ছে। ওটা যেন আপনার হৃদয়ের ভেতরের জায়গায় না থাকে। আপনার অফিস তো পাল্টাতেও পারে। দল তো পাল্টাতেও পারে। ক্ষমতা তো বদলাতেও পারে। তখন আপনার বুলি তো পাল্টে যাবে। এ অফিসের বসকে আজকে আপনি বস বলছেন। পরের দিন ওই অফিসের বসকে বস বলবেন। এ অফিসের বসের সাথে আপনার দেখাই হবে না। দু বছর পর ক্যারিয়ার আরেকটু সামনে বেড়েছে। তখন আরেকজনকে বস বানিয়েছেন। বস বদল করেছেন। মুখের বুলিও বদলাচ্ছে। শ্রদ্ধাও বদলাচ্ছে। এটা দ্বীনের সঙ্গে না।  দ্বীন হচ্ছে মা-বাবা। আপনি লেখা-পড়া যাই করবেন, এখন থেকেই দ্বীনী জীবন গড়েন। কুরআন আমার নিকট সম্মানীয়। কুরআনী তালীম আমি শিখব। নামায আমার কাছে সম্মানীয়। নামায আমার হৃদয়ের জিনিস। আমার ঘরের মা-বাবা। কুরআনী মজলিস আমার ঘরের মা-বাবা। আমি উদাহরণ দেওয়ার জন্য এভাবে বললাম। উলামায়ে কেরামের দ্বীনের দাওয়াত আমার ঘরের মা-বাবা। আমি এটাকে রক্ষা করব। এটাই আমার শ্রদ্ধার জায়গা। এটা আমার মনের জায়গা। এটা আমার দিলের জায়গা। আমাকে পদ্ধতিগত কারণে অনেক কিছু শিখতে হবে। ঐগুলো আমি শিখব।

মুসলমান- সে বিজ্ঞানী হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, সচিব হোক, ডাক্তার হোক, তার জ্ঞানের ভিাত্তি হবে ইসলাম। তার ভাবনা হবে ইসলাম। তার প্রধান চিন্তার জায়গায় থাকবে ইসলাম। তার ফিকরে থাকবে ইসলাম। আপনার হৃদয়ের মূল জায়গাটায় থাকবে ইসলাম, কুরআন, হাদীস, নামায, রোযা, ইলম।

আমার এই কথা থেকে আপনারা এই ভুল অনুভূতি নেবেন না যে, তাহলে কি আমরা লেখা-পড়া করব না? আপনি স্মার্টফোনেও বিশেষজ্ঞ হয়ে যান কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু আপনার হৃদয়ের ভেতরে আপনার সাবজেক্টকে রাখেন। আপনি ডাক্তার হলে ডাক্তারিবিদ্যা আপনার  সাবজেক্ট। আর জীবনের ক্ষেত্রে আপনার সাবজেক্ট হল পরকালের সাবজেক্ট। আপনার জীবন গঠন করার সাবজেক্ট।

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ.

আল্লাহ আমাদেরকে এই দুআ শিখিয়েছেন- আয় আল্লাহ! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখেরাতে কল্যাণ দান করুন।

দুনিয়ার কল্যাণ হল দুনিয়ায় যেভাবে যেভাবে চললে দ্বীন অনুযায়ী চলা হবে। আমি উদাহরণ দিচ্ছি। দুইজন ছাত্র, সমান মেধার অধিকারী, সমান মার্ক পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। কিন্তু একজনের জীবন-যাপন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্ছৃঙ্খল। আরেকজনের জীবন হচ্ছে, যৌবনকাল থেকে সুন্দর দ্বীনী জীবন। তার চিন্তা, তার বেশভূষা তার চাল-চলন তার আখলাক তার চরিত্র সবই দ্বীনী দিক থেকে সুন্দর। মওতের পর ঐ দুজনের কী হবে- সেটা জানার ক্ষমতা আমার নেই। আমরা ইসলাম থেকে জানি, আল্লাহ তাআলা পরেরজনকে নাজাত দিয়ে দেবেন। আগেরজন একসময় নাজাত পাবে, কিন্তু ভোগবে। তবে এ দুজনের তুলনা করে দুনিয়াবী কথা আমি বলতে পারি, আপনি পরের জনকে দেখবেন সমাজের জন্য অনেক বেশি কল্যাণকর। পরিবারের জন্য কল্যাণকর। লেনদেনে সমস্যা করেন না এবং কখনো কেউ কষ্ট পাক এটা তিনি চান না। সময় মতো নামায পড়েন। পরিবারের সদস্যদের প্রতি মনোযোগ দেন। মহল্লার মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার ভেতর দ্বীন আছে। তো আমরা সমাজে এই উপকারটা পাই।

আমি আবারো বলছি, আমরা আমাদের ফিকিরকে বাঁচাবো। ফিকির মানে চিন্তা, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা আমাদের ফিকিরকে বাঁচাব এবং উন্নত করব। আমার দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে প্রধান জায়গায় থাকবে ইসলাম। আমার চিন্তার সবচেয়ে বড় জায়গায় থাকবে আল্লাহ্র রাসূলের মহব্বত।

 

সময়ের হেফাযত

সময় নষ্ট না করা। যৌবনকালে এটার সুযোগ অনেক বেশি। হাদীসে এসেছে-

فَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ.

তুমি নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার আগে সময়ের যে ফুরসত থাকে তাকে গুরুত্ব দাও। পরে চাকরি আসবে। ব্যস্ততা আসবে। বিয়ের পর আপনি চাইলেও সময় দিতে পারবেন না। ছেলেমেয়েদেরকে সময় দিতে হবে। উপার্জনে সময় ব্যয় করতে হবে। চাকরি হল একটা শব্দ। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল উপার্জন। প্রত্যেকটা মানুষের জীবিকা দরকার। সেটা কেউ চাকরির মাধ্যমে করে, কেউ ব্যবসার মাধ্যমে করে। তো কখনো কখনো এই নিমগ্নতা এমনভাবে পেয়ে বসে যে, সে যে একটু দ্বীনের লাইনে সময় দিবে,  বিশটা সূরা শিখবে, বিশটা  দুআ শিখবে, এই সময় তার থাকে না। বাসায় এসেও অফিস করতে হয়, ব্যবসাও করতে হয়। এটা জীবনের বাস্তবতা। কিন্তু এখন আপনার সময়টা এমন যে আপনাকে কেউ ডাকছে না। ফোন করে আপনাকে কেউ বিরক্ত করছে না। আপনি বরং বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত হচ্ছেন।

হাঁ, আপনি বলতে পারেন, আমি কি খেলাধূলার পেছনে একটু সময় দেব না? হাঁ, আপনি দেবেন- পরিমিত, নিয়ন্ত্রিত। ভেসে না যাওয়া, ডুবে না যাওয়া চাই। এমন যেন না হয় যে, আমি সময়টাকে উদ্যাপন করতে করতে এমন একটা জায়গায় গেছি যে, জাল ফেলে আমাকে এখন খুঁজে বের করতে হচ্ছে। অথবা অন্য জগতে হারিয়ে গেছি। গার্ডিয়ানরা পেরেশান। এ ছেলের মনোজগতে তারা ঢুকতে পারছে না। ছেলে মাশাআল্লাহ বাহ্যিকভাবে ভালো। রাতে বাসাতেই থাকে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। মা জিজ্ঞেস করে, বাবা, কী অবস্থা? ইন্টার পাশ ছেলে বলে, মা এখন ডিস্টার্ব করো না তো। এখন একটু ব্যস্ত আছি। ছেলের মাথায় একটা জগৎ ঢুকে গেছে। এই জগতে ক্লাব, এই জগতে নেট, এই জগতে বন্ধু, এই জগতে ক্যাম্পাস, স্টেডিয়াম, খেলা, পৃথিবী, রাজনীতি অনেক কিছু মাথার মধ্যে ঘুরছে। বাবা বলে, আমার সাথে গল্প কর, তোমার কী ভাবনা আছে? কী চিন্তা করছ?’ ছেলে বলে, বাবা! এখন না। এখন খুব ব্যস্ত আছি। এরকম অহরহ হচ্ছে। এটা থেকে বাঁচতে হবে।

আমরা এত এনগেইজড্ বা ডুবন্ত যেন এখনি না হয়ে যাই। মূল কাজ বাদ দিয়ে, লেখা-পড়া বাদ দিয়ে, দ্বীনের কাজ বাদ দিয়ে, পরিবারকে সময় দেওয়া বাদ দিয়ে আমরা এখনই এত ব্যস্ত না হয়ে যাই। মায়ের একটা কাজও তো আমি এগিয়ে দিতে পারি। মা কত খুশী হবেন। রান্নাঘরে গিয়ে বলবে- দাও মা, তোমার এই কাজটা করে দিই। তোমার দশটা পেঁয়াজ আমি ধুয়ে দিই। কখনোই করেননি। আজকে এটা একটু পরীক্ষা করে দেখুন তো। খাবার-দাবার শেষ করার পর  প্লেট পরিষ্কার করা, দস্তরখান পরিষ্কার করার যে কাজটা মা করেন- এসএসসি পাশ একটা ছেলে একদিন পরীক্ষা করে দেখুক,  মায়ের এক দশমাংশ কাজে আমি একটু শরিক হব। মা, আমি আজ  তোমার এ কাজটি করে দিই। দেখুন মায়ের দুআ পান কি না। এটি একটি কাজ। এটার মধ্যে মজা লাগাতে হবে।

আমাদের তরুণদের একটা সমস্যা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ তো। উন্নয়নশীল দেশে একটা সংকট হয়। পশ্চিমা দেশের কালচারটা যখন ওখানে বাদ হতে থাকে তখন উন্নয়নশীল দেশে এসে ঢুকে। এটা হীনম্মন্যতার সমস্যা । ওরা যেটা ছাড়তে থাকে ওটা আমরা ধরতে থাকি। ওরা যে জিনিস ধরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, আমরা এখনো ওই জায়গায় যেতে পারিনি। ওরা ইসলামের এমন অনেক রীতি ও সংস্কৃতি ধরে ফেলেছে, যে বিষয়ে আমরা সচেতন না। আপনি খোঁজ নিন পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক সমস্যা, অনেক চারিত্রিক সংকট। কিন্তু ব্যক্তিগত আচার-আচরণে ইসলামের অনেক সৌন্দর্য তারা ধরে ফেলেছে, যেটা আমরা দরকারই মনে করি না। একটা ছোট্ট উদাহরণ না দিলে হয়তো বুঝবেন না।

আমরা যখন কৈশোরকাল পার করি, তখন বাজারে মাত্র ফলের জুস আসতে শুরু করেছে। আব্বা বাজার থেকে ফল কিনে এনেছেন। ভালো ভালো ফজলি আম, ল্যাংড়া আম কিনে এনেছেন। বাসায় আম্মা কেটে দিচ্ছেন। ফলটা খেতে মন চাইল না। মন চাইল বাজারে চলে যাই। জুসটা কিনি। পনের টাকায় বা বিশ টাকায় জুসের প্যাকেটগুলো পাওয়া যেত। ভূটান থেকে আসত কিছু। জুস খেলে মনে হত, আহ! কী অসাধারণ জিনিস। বাসায় যে আব্বা আমটা কিনে এনেছেন, তখন ফর্মালিনের সমস্যা ছিল না এবং রসায়নিক পদার্থ ঘটিত যা যা সমস্যা তখন কিছুই ছিল না। কিন্তু কিনে আনা ফলটা ভালো লাগত না। কারণ এটা একেবারে প্রাকৃতিক জিনিস। ছোটকাল থেকে খেয়ে আসছি। এখন এটা একটা প্রবণতা। ঐটার স্বাদই আলাদা।

এখন আমি বুঝি, স্বাদ যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি স্বাদের আরেকটা প্রোগ্রাম মাথায় ঢোকানো ছিল। ওটা একটা প্যাকেটে থাকে। একটা দোকান থেকে কিনি। পকেট থেকে টাকা খরচ হয়। বিদেশী লোকেরা খায়। এখন যদি আমি আমার মনস্তত্ত্বটা পরীক্ষা করি, তাহলে বুঝতে পারি আমি কেন তখন কিনেছি। বড় লোকেরা কিনে। এটা একটু অভিজাত লোকেরা খায়। দেখতে খুব সুন্দর দেখা যায়। আমি একটা জুস খাচ্ছি। পাইপটা লাগাই, ফুটা করি, টান দিই। এই যে ব্যাপার, আমাদের কিশোরকালে আমরা এতে খুব মুগ্ধ হয়েছি। এখন এসে আমার বলতে হবে না, আপনারা সবাই বলবেন, জুসের চেয়ে প্রাকৃতিক ফলটা খাও। তাতে উপকার বেশি। ঘটনা কিন্তু ওটাই। আমরা মূলে ফিরলাম।

তো আমি বলছিলাম, সময় রক্ষা করা, ঘরে সময় দেওয়া। এবং যেসব সংস্কৃতিতে আমরা এখন অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি, আপনি একটু মাথা ঠা-া করে ভাববেন, দেখবেন শুধু সময়ের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই না, অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমরা তাদের অন্ধ অনুকরণ শুরু করেছি। পোশাকের ক্ষেত্রেই ধরুন, দেখবেন, আমরা ধরতে শুরু করেছি, ওরা ছাড়তে শুরু করেছে। ওরা ন্যাচারাল হতে শুরু করেছে, আমরা ‘ডিজুস’ হতে শুরু করেছি। ওরা নরমাল হতে শুরু করেছে আমরা মডার্ণ হতে শুরু করেছি। অথচ এ মডার্নিজমটা তারা বর্জ্য মনে করে ছাড়ছে, আর আমরা এটাকে প্রসাধন মনে করে গ্রহণ করছি। চলুন আমরা ইসলামকে মেনে চলি। সবসময় ন্যাচারাল থাকি। স্বাভাবিক থাকি। হালাল পথে থাকি।

 

ভালো বন্ধু ও ভালো পরিবেশ খুঁজে নিন

ভালো বন্ধু ও ভালো পরিবেশ আমরা বাছাই করার চেষ্টা করি। এটা অনেক বড় কথা। আমি ছোট করে বলি। ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে মহল্লায় বন্ধুদের নানা ধরন থাকে। আমি নিজেই বুঝি, কোন্ বন্ধুর সঙ্গে মিশলে আমার মস্তিষ্ক একটু গোনাহের দিকে ধাবিত হয়, ওই বন্ধুটাকে আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।  ওই পরিবেশটাকে আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। অথবা অপেক্ষাকৃত যে বন্ধুটা আমার জন্য কম ক্ষতিকর, আমার ক্যারিয়ারের জন্য, আমার জীবনের জন্য,  আমার চরিত্রের জন্য, আমার ভাবনার জন্যে, আমার দ্বীনদারির জন্য, ওই বন্ধুটার  সঙ্গে আমি সময় দিই। আমি আপনাকে এই কথা বলতে পারব না, আপনি বন্ধুর ঝামেলা এড়ান। আপনি তরুণ। বন্ধু আপনার লাগবেই। বন্ধু শব্দটা অনেক ভারী। বলা যায় সঙ্গী লাগবে, ক্লাসমেট লাগবে, কিছু মানুষের সাথে কথা বলতে আপনার ভালো লাগবে। এটা হবে, এটা মানুষের স্বভাব। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু  এখানেও আমাকে একটু বাছাই করতে হবে। আমরা গাড়িতে ওঠার ক্ষেত্রেও বাছাই করি। যে গাড়ি একটু লক্কর ঝক্কর দেখি, সেটার টিকিট কাটি না। আমরা পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও বাছাই করি।  যে মাছটা একটু ফ্যাকাসে ওই মাছটা কিনি না। আমরা আইসক্রীম কেনার ক্ষেত্রেও দেখি, ‘দেখুন তো তারিখটা কবের?’ ‘কবে এনেছেন, গতকাল?’ ‘তাহলে দেন।’ ‘এটা কি দুই মাস আগ থেকে আপনার ফ্রীজে আছে?’ ‘এটা দিয়েন না।’ আমরা জীবন-যাপনের সব ক্ষেত্রে বাছাই করি। যাদেরকে বাছাই করাটা আমার হৃদয়ের জন্য দরকার, জীবনের জন্য দরকার, বেঁচে যাওয়ার জন্য দরকার, ওই ক্ষেত্রে আমরা বাছাই করতে চাই না- এটা ঠিক না। ওখানে বাছাই করা বেশি দরকার- আমার বন্ধু বাছাই।

বাছাইটা কী? আনুষ্ঠানিকভাবে আনফ্রেন্ড করা- এটা ভালো না। আস্তে আস্তে সরে আসি। তাকে কষ্ট না দিয়ে সরে আসি। তাকে কেন কষ্ট দেবেন? কাউকে কষ্ট দেওয়া তো ঠিক না। তাছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে কারো সাথে কষ্টদায়ক আচরণে গেলে কালকে আপনার লজ্জা পেতে হতে পারে। মানুষ মানুষের কাছে মুখাপেক্ষী। সমাজে মানুষ মানুষকে নিয়ে চলে। তো আজকে আপনি বলছেন, না, ওর সঙ্গে আমি সময় দিতে পারছি না। তাকে আপনি আন্ষ্ঠুানিকভাবে বলে ফেলেছেন, আমার এখন দ্বীনের পথে চলতে হবে। সে খুব কষ্টও পেয়েছে। তাকে আপনি দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারবেন না। আরেকটা বিষয় হল, আগামীকাল তার দরকার হয়েও যেতে পারে আপনার, লেখাপড়ার কারণে  হোক বা সামাজিক কারণে। তখন আপনি কোন্ মুখে তার কাছে যাবেন? এজন্য এ জায়গাগুলোতে নির্মমতা না করা। আস্তে আস্তে নিজে ‘চুজি’ হোন, বাছাইপ্রবণ হোন, ফায়দা পাবেন- ইনশাআল্লাহ।

 

দ্বীনের জরুরি বিষয়গুলো শিখুন

পাঁচ নম্বর হিসেবে বলতে চাচ্ছি দ্বীনের জরুরি বিষয়গুলো শিক্ষা করা। সহীহভাবে কুরআন পড়তে শেখা। সুন্নতগুলো শেখা। এটা অনেক লম্বা তালিকা। আগের আলোচনাগুলোতে আপনার কিছু শুনেছেন। একটু একটু করে শুরু করুন। আপনার নোটে আনুন আমি জরুরি দ্বীনী বিষয়গুলো শিখব- ইনশাআল্লাহ।

 

ওলামায়ে কেরামের কাছে যাওয়া-আসা করুন

যারা স্কুল কলেজে পড়ছি তাদের জন্য এটা অনেক দরকারী- দ্বীনী মজলিসে উলামায়ে কেরামের কাছে যাওয়া। এমন কি তাবলীগের যে মজলিস হয়, দাওয়াতের যে মজলিস হয়,  সেগুলোতে কিছু সময় দেওয়া। শামিল হওয়া। অনেক সময় ভালো লাগতে চাইবে না। আমাদের এই বয়সে মন তো উড়–ক্কু। মনটা খুব উড়তে চায়। বন্ধুদের সাথে গল্প করতে মজা লাগে। তালীমের মজলিসে মজা লাগে না। এই বয়সে এটা স্বাভাবিক। এটাকে আমি খারাপ বলব না। তবে এখানে একটু কঠোর হতে হবে। না, আজকে এক ঘণ্টা বসবই বসব। আজকে আমি আমার মনের উপর একটা চাপ দেব। আছর থেকে মাগরিব আজকে বসব। হোক কষ্ট, তারপরও বসব। সপ্তাহে এক দিন তো একটু বসি। উলামায়ে কেরামের মজলিসে আজকে একটু যাব। মনটায় তিতা লাগে। তিতা ঔষধ খাওয়ার মতো। তা না হলে আপনি সুস্থ হবেন না। এটা এখন দরকার। আপনার মনটাকে ভালো করার জন্যে।

দুনিয়াতে এর অনেক উদাহরণ আছে।  দেখবেন, আপনি যখন গ্রামারটা শিখেন, খুব কষ্ট লাগবে। অংকের কঠিন বিষয়গুলো খুব কষ্ট লাগে। গল্প পড়তে মজা লাগে। আপনাকে হুমায়ুন আহমেদের বই পড়তে  দেওয়া হোক। পড়ালেখা বাদ দিয়ে বলবেন, আম্মু, আরেকটা দাও। আরেকটা দাও। কালকে আরেকটা পড়ব। সমস্যা নেই। এটা মুখরোচক বই। চানাচুরের মতো। কিন্তু ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে কঠিন জিনিসটা পড়তে হয়। গ্রামার পড়তে হয়। অংক করতে হয়। মাথা হয়তো ভারী হয়ে যাবে। মনে হবে, কেউ যেন মাথায় সুই দিয়ে পিন দিচ্ছে। তারপরও বলতে হবে, স্যার এরপর কী যেন শব্দটা! এরপর কী যেন শব্দটা! এভাবে শিখতে হবে। না শিখলে আপনি আগাতে পারবেন না। দ্বীনের ক্ষেত্রেও এ রকম। কখনো কখনো ভালো লাগবে না। মজলিসে বসতে, আলিমদের সঙ্গে বসতে, দাওয়াতের মজলিসে বসতে, তালিমের মজলিসে বসতে ভালো লাগতে চাইবে না। নফসও চাইবে না, শয়তান তো লেগেই আছে। শয়তানের কাজই তো এটা। দ্বীনী বিষয়ে মনের মধ্যে একটু মধু লাগিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে পাবেন না। সে তো দ্বীনী মজলিসের ব্যাপারে তিতার ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছে। দ্বীন নিয়ে যখন ভাববেন, মাথার মধ্যে, দিলের মধ্যে সে তিতা  ঢেলে দেবে।  দেখবেন, পথ পাড়ি দিতে খালি তিতা তিতা লাগছে। খালি তিতা মনে হচ্ছে। না, আজকে না। আগামী সপ্তায়। আজকে ওই বন্ধু ফোন করেছে। আজকে ওই প্রোগ্রামটা ছুটে যাবে। আজকে অনেক দিন পর খেলা দেখতে বসেছি, কীভাবে যাই। এরকম মনে হবে। অথচ হাসপাতালে যদি পড়ে থাকতেন তাহলে এরকম আরো কত খেলা মিস হত!

আমি আবারো মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা সবাই তরুণ। আমরা কাজের ক্ষেত্রে সকলে তরুণ থাকতে চাই। আমরা যারা এই বয়স পার করে এসেছি আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। মন চায়- সারা রাত জেগে ভালো একটা কাজ করব, পারি না। চাইলেও পারি না। একটা অভ্যাস বদলাব, চাইলেও পারি না। আপনাদের সময় খুব সুন্দর সময়। চাইলেই পারেন জীবনটা সুন্দর করতে। চাইলেই পারেন ভালো কাজে সময় ব্যয় করতে। চাইলেই এক পারা কুরআন মাজীদ হিফজ করতে পারেন। চাইলেই একশটা দুআ মুখস্থ করে ফেলতে পারেন। চাইলেই আপনি দ্বীনের দশটা চমৎকার বই পড়ে ফেলতে পারেন। মুরুব্বীদের পরামর্শ নিয়ে  দ্বীনী বই যখন পড়ব তখন উপন্যাসের মতো একবার পড়েই রেখে দেব না। বারবার পড়ব। ছয় মাস পরে পড়ব। আবার দেখি, এখানে কী যেন পড়েছিলাম? আবার পড়ি। এখানে হাদীসটা যেন কী ? আবার পড়ি। এখানে সীরাতের ঘটনাটা যেন কী, আবার পড়ি। সাহাবাদের জীবনী পড়ি, বুযুর্গদের জীবনী পড়ি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন। হ

অনুলিখন : এনামুল হাসান

 

 

advertisement