শাওয়াল ১৪৩৯   ||   জুলাই ২০১৮

সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান : কিছু কথা

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

সরকার মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে। রীতিমত যুদ্ধ। বন্দুকযুদ্ধে ইতোমধ্যে বহু প্রাণহানি হয়েছে। ধারণা করা যায় আরও অনেক প্রাণ ঝড়বে। সরকারের লক্ষ্য মাদকব্যবসা সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলা। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য শেষ দাওয়াই হিসেবে বন্দুকযুদ্ধ বেছে নেওয়া হয়েছে। সরকারের ধারণা এ ব্যবস্থা কাজে আসবে। মাদকব্যবসা নির্মূূল হবে।

মাদকব্যবসার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। যে মাদকাসক্তির কবলে পড়ে হাজার হাজার তরুণ উচ্ছন্নে যাচ্ছে, হাজার হাজার পরিবার বিপর্যস্ত হচ্ছে, সমাজ কলূষিত হচ্ছে এবং সমগ্র দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে, তার ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শনের কোনও সুযোগ নেই। বরং এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল আরও আগেই। তারপরও দেরিতে হলেও টনক যে নড়েছে এবং সরকার তার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পূর্ণোদ্যমে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে, এজন্য আমরা তাকে সাধুবাদ জানাতেই পারি।

কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে অন্যখানে। বন্দুকযুদ্ধ নামে যেভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চালানো হচ্ছে তা কতটা যৌক্তিক এবং কতটা বিধিসম্মত? দ্বিতীয়ত এই চরম ব্যবস্থা দ্বারা মাদকাসক্তি নির্মূল ও মাদকব্যবসা রোধ করা কতটুকু সম্ভব হবে?

অনেকেই বলছে, বন্দুকযুদ্ধের নামে এভাবে মানবহত্যা কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, ন্যায়বিচার পাওয়া তার অন্যতম প্রধান মানবাধিকার। সরকারের কাজ প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কোনও অযুহাতেই কারও অধিকার হরণ করার অবকাশ তার থাকতে পারে না। কিন্তু বিনাবিচারে হত্যা করে সরকার মূলত অধিকার হরণের কাজটিই করছে। অপরাধীকে তার বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করছে। তাছাড়া যারা হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে তারা সকলে প্রকৃতই অপরাধী কি না সে প্রশ্নও উঠছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন উঠবেই। কেননা কে অপরাধী কে অপরাধী নয় তা কেবল বিচার নিষ্পত্তির পরেই সাব্যস্ত হতে পারে।

প্রশ্ন উঠেছে ব্যবস্থা অবলম্বনের স্বচ্ছতা নিয়েও। মাদকনির্মূলের নামে ক্ষেত্রবিশেষে বিরুদ্ধপক্ষ নির্মূলের সুযোগ নেওয়া হচ্ছে না তো? সরকারের সেরকম অভিসন্ধি না থাকলেও যুদ্ধের ডামাডোলে মাঝখান থেকে কেউ শত্রু দমনের সুযোগ নিতে পারে কি না? বিচারবিহীন যেকোনও তৎপরতায় সুযোগসন্ধানীদের অনুপ্রবেশ সহজ হয়ে যায়। ফলে তারা প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে নিরপরাধ প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেয়। এভাবে বহু নিরপরাধ ও নিরীহ লোক এ জাতীয় ব্যবস্থায় ফেঁসেও যায়। সুযোগসন্ধানীদের কারসাজি ছাড়াও এরূপ ব্যবস্থায় নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটা বিচিত্র নয়। বাস্তবে তা ঘটছেও। যে-কোনও যুদ্ধে নিরীহ লোক কিছু না কিছু মারা যায়ই। বিধিসম্মত যুদ্ধে সেরকম প্রাণহানি বৃহত্তর স্বার্থের অজুহাতে মেনে নেওয়া গেলেও হঠকারিতামূলক যুদ্ধে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

আজ বিশ^ব্যাপী ‘জোর যার মুলুক তার’ এর যে মাৎস্যনীতি চলছে তার দৌরাত্ম্যে দেশে দেশে একের পর এক হঠকারি যুদ্ধ চলছে। আর অগণ্য নিরীহ মানুষ তাতে প্রাণ হারাচ্ছে। দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ কখনই অন্যায় প্রাণহরণ মেনে নিতে পারে না। ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম ইসলামে এটা সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অন্যায়ভাবে কোনও একজন মানুষকে হত্যা করা দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সমান অপরাধ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا.

কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩২

সুতরাং যে সকল অভিযানে নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা থাকে তাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

সন্দেহ নেই যে, মাদকসেবন ও মাদকদ্রব্যের ব্যবসা অত্যন্ত কঠিন পাপকর্ম। এরূপ পাপকর্মে যাতে দেশের কোনও নাগরিক লিপ্ত না হয়ে পড়ে, এতে লিপ্ত ব্যক্তিদের যাতে শাস্তি ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা যায় এবং এর সর্বনাশা ছোবল থেকে যাতে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ সরকারের অপরিহার্য কর্তব্য। কিন্তু সে পদক্ষেপ অবশ্যই ন্যায়ানুগ ও পরিণামদর্শী হতে হবে। মাদকাসক্তি ও মাদকব্যবসা যেমন পাপ তেমনি অন্যায় নরহত্যাও পাপ বটে। বরং আরও গুরুতর অপরাধ। একটি পাপের রোধকল্পে আরেকটি পাপে লিপ্ত হওয়া বৈধ হয়ে যায় না। মাদকব্যবসা গুরুতর পাপ হলেও সরাসরি হত্যাযোগ্য অপরাধ নয়। কাজেই এর শাস্তিস্বরূপ ব্যবসায়ীকে হত্যা করা, তাও আবার বিনাবিচারে, তদুপরি এই হত্যাকাণ্ডের ধারায় কোনও নিরীহ ব্যক্তির প্রাণহরণ কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের কর্তব্য মানুষের জানমালের নিরাপত্তাবিধান করা। সেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন কোনও তৎপরতা চালানো যা নিরীহ নিরপরাধ মানুষের প্রাণহননের কারণ হয় তা হবে অতি কঠিন রাষ্ট্রীয় অপরাধ এবং তা হবে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের অসৎ ব্যবহারের নামান্তর। যে-কোনও প্রজাহিতৈষী সরকারের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।

যা হোক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বৈধাবৈধ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা আইনবিদেরাই করুন। আমরা কথা বলতে চাই দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে। এই চরম ব্যবস্থা আসলে কতটুকু সুফল দিতে পারে? অনেকেই বলছেন এর দ্বারা উপস্থিত কিছু সুফল পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু এটা স্থায়ী কোনও সমাধান নয়। যাদের হত্যা করা হচ্ছে তাদের শূন্যস্থান দখল করার মত লোকের অভাব হবে না। খবরে প্রকাশ, যারা মারা পড়ছে তারা মাদকব্যবসায় রাঘব-বোয়ল নয়; বরং তাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা চুনোপুঁটি মাত্র। তারা কাঁচাপয়সার লোভে এ পথে নেমেছিল। এ ব্যবসায় খুব সহজেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়। জিরো থেকে হিরো হওয়ার প্রলোভন মানুষকে বড় টানে। সেই টানে মাদকের নতুন নতুন যোগানদার নিহতদের জায়গায় এসে দাঁড়াবেই। অল্পতে ধনী হওয়ার নেশা যার মনমস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে ফেলে মৃত্যুভয় তাকে খুব একটা স্পর্শ করে না। এ ক্ষেত্রেও করবে না, বিশেষত যখন মাথায় ছাতা ধরার লোকেরা বহাল তবিয়তে থাকতে পারছে এবং সকল ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে খোশ মেজাজেই পরিস্থিতি উপভোগ করছে।

আসলে মাদকব্যবসা নির্মূল কখনও মাদকব্যবসায়ীকে বা মাদকের চোরাচালানীকে হত্যা করার দ্বারা সম্ভব নয়। মাদকদ্র্রব্যের সেবন যতদিন থাকবে মাদকের ব্যবসাও ততদিন চলবে। নজর দেওয়া উচিত সমস্যার গোড়ায়। আর সে গোড়াটা হচ্ছে মাদকের সেবন ও ব্যবহার। ব্যবহার দ্বারা চাহিদার সৃষ্টি হয়। চাহিদাই যোগানের পথ তৈরি করে দেয়। মাদকের চাহিদা নির্মূল না করে তার যোগান নির্মূলের চেষ্টা করা প-শ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। চাহিদা খতম করতে পারলে মাদকের যোগান আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে। উচ্ছেদ হয়ে যাবে সকল মাদকব্যবসায়ী ও মাদকের সব কারবারি।

যে সকল অঙ্গনে মাদকদ্রব্যের চাহিদা নেই সেখানে এর কারবারও নেই। মসজিদ-মাদরাসার পরিম-লে কোনও মাদকব্যবসায়ী ক্রেতা খুঁজবে না। তারা হক্কানী পীর-মাশায়েখের খানকায় কোনও প্রতিনিধি পাঠাবে না। দাওয়াত ও তাবলীগের মারকাযসমূহেও কখনও নেশাদ্রব্যের কারবার জমবে না। এর কারণ কী? কারণ কেবল এই যে, এসব জায়গায় মাদকদ্রব্যের কোনও চাহিদা নেই। এসব জায়গার সাথে সংশ্লিষ্টজনেরা মাদকদ্রব্য সেবন ও গ্রহণ করে না। তাই এসব অঙ্গনে মাদকদ্রব্য জোগান দেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। কোনও জোগানদারের মাথায় সে ভাবনা কখনও আসে না। কখনও আসবেও না।

সুতরাং মাদকব্যবসায়ীর জীবননাশ নয় বরং মাদকের চাহিদা নির্মূল করাই হওয়া উচিত মুখ্য কাজ।

এ কথা সত্য যে, নাগালের মধ্যে মাদকদ্রব্য পেলে দুর্বলচিত্তের লোক তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। তাই এ খবীস বস্তুর ব্যবসা বন্ধ করাটাও জরুরি বৈকি। কিন্তু ব্যবসা বন্ধের চেষ্টাও ততদিন সফল হবে না যতদিন না চাহিদা খতম করা সম্ভব হবে। কাজেই মাদকব্যবসা বন্ধের পাশাপাশি অধিকতর গুরুত্বের সাথে মাদকসেবন রোধে মনোনিবেশ করা দরকার।

সত্য বটে, মাদকাসক্তি রোধেও সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচী আছে। এ খাতে বাজেট আছে। লোকবল খাটানো হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণাও মোটামুটি চলছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাদকাসক্তি মোটেই কমছে না; বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তা কেন? এ ব্যাপারে সরকারী চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী?

আমরা মনে করি এর এক কারণ সরকারের ইচ্ছা ও আন্তরিকতার ঘটতি। সরকার মূলত মাদকাসক্তি বা মাদকসেবনের নির্মূল চায় না। চায় নিয়ন্ত্রণ।

এই যে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান তার উদ্দেশ্য কি এই যে, দেশ থেকে মাদকব্যবসা সম্পূর্ণ উৎখাত করা হবে? নিশ্চয়ই তা নয়। এ দেশে মদ্যপান তো নিষিদ্ধ নয়। তথাকথিত অভিজাত হোটেল ও বারগুলোতে কি মদ পরিবেশন ও সরবরাহ করা হয় না? মদের আমদানি ও বেচাকেনাও যথারীতি চলছে বলেই সকলে জানে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, মদের ব্যবসা ও সেবন নির্মূল করা নয় বরং নিয়ন্ত্রণ করাই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খোলামেলা সর্বত্র সবজায়গায় মাদকদ্রব্য বেচাকেনা ও সেবন-গ্রহণ করা যাবে না। করা যাবে কেবল সরকারিভাবে অনুমোদিত স্থানসমূহে। অনুরূপ সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্যেরও ব্যবসা ও ব্যবহার চলবে না। তা চলবে কেবল ঐসব মাদকদ্রব্যের, যা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। বলাবাহুল্য সরকারের অনুমোদিত মাদকদ্রব্য ও সেবন-ব্যবহারের অনুমোদিত স্থান খুব সঙ্কীর্ণ নয়। এর জন্য যে পরিমাণ সুযোগ ও অবকাশ রাখা হয়েছে তার বর্তমানে মাদকাসক্তি রোধ বা মাদকদ্রব্যের ব্যবসা ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা নিতান্তই অবাস্তব চিন্তা।

সরকারি আইনে যেসব জিনিস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ- সরকার কি তাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে? এ দেশে ঘুষ-দুর্নীতি কি হরদম চলছে না? সর্বপ্রকার নকলে দেশ সয়লাব। কে তা কতটুকু ঠেকাতে পারছে? দুর্নীতিদমন কমিশন নিজেই নাকি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এহেন অবস্থায় যে মাদকদ্রব্যের ব্যবসা ও ব্যবহারে যথেষ্ট অবকাশ তা নিয়ন্ত্রণ করার আশা কিভাবে করা যেতে পারে?

মাদকসেবনে শরীরে মাদকতা আসে, অন্তরে স্ফূর্তি জন্মায়, উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, মনে ঘোর লাগে, ভাবালুতা দেখা দেয় ও প্রাণ স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়। একবার যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে আর সহজে ফিরতে পারে না। সে নিজে তো ফেরেই না, আরও দশজনকে টানতে শুরু করে। তার ভাবাবেশ দেখে অন্যরা উৎসাহ পায়। এভাবে সমাজের সর্বত্র মাদকতার ক্রমবিস্তার ঘটে। সুতরাং মাদক নিরোধের জন্য জরুরি এর সবরকম সুযোগ ও অবকাশ বন্ধ করে দিয়ে এর প্রতি সাধারণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা। অর্থাৎ কোনও প্রকার মাদকদ্রব্য কোথাও বিক্রি করা যাবে না এবং কেউ কোথাও কোনও প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন ও ব্যবহার করতে পারবে না। করলে আইনত দ-নীয় হবে।

সাধারণ নিষেধাজ্ঞা তো শরীয়ত জারি করে দিয়েছেই। দরকার সেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। তা কার্যকর করার মধ্যেই কল্যাণ। শরীয়ত আল্লাহপ্রদত্ত আইন। কোন আইন কোন পর্যায়ে দিলে মানুষের কল্যাণ হবে তা মানুষ অপেক্ষা মানুষের স্রষ্টাই ভালো জানেন। ইরশাদ হয়েছে-

الا يعلم من خلق و هو اللطيف الخبير

যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জানবেন না, অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ? -সূরা মুলক  (৬৭) : ১৪

শরীয়তপ্রদত্ত এ সাধারণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করলেই যে রাতারাতি মাদকসেবন ও মাদকব্যবসা উচ্ছেদ হয়ে যাবে এমন নয়, কিন্তু তা উচ্ছেদের পক্ষে সহায়ক হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন তো মাদকসেবী ও মাদকব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ আইনের সহায়তা পাচ্ছে। সাধারণ নিষেধাজ্ঞা জারি করলে এবং সরকারিভাবে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকলে সে সহায়তা আর তাদের পক্ষে থাকবে না। তখন যারা এ কাজ করবে তারা তা অপরাধ জেনেই করবে এবং করবে চুরি করে, অন্যের আড়ালে। নিঃস্বন্দেহে তা হবে মাদক নির্মূলের পক্ষে একধাপ অগ্রগতি। চূড়ান্ত সফলতার জন্য দরকার হবে সেই অব্যর্থ দাওয়াই প্রয়োগ, পাপাসক্তি নিরোধের পক্ষে যার কার্যকারিতা চিরন্তন ও চিরপরীক্ষিত।

সে ঔষধ আর কিছুই নয়, কেবল তাকওয়া ও আল্লাহভীতি। এর প্রতি সরকারের দৃষ্টি না থাকাই তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। বস্তুত যে ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহভীতি সঞ্চারিত থাকে সে কখনও কোনও প্রকার পাপকর্মে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে না। বড় বড় পাপ তার দ্বারা হয়ত আদৌ সংঘটিত হবে না। আর যদি কখনও দুর্ঘটনাবশত ঘটেও যায় তবে অচিরেই তাওবা করে পাপের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।

কারও মনে এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে সে তাকওয়া চর্চার অঙ্গনগুলিতে চোখ বুলাক। নিঃসন্দেহে তার সাথে সম্পৃক্ত লোকদেরকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি পাপবিমুখ দেখতে পাবে। বিশেষত যে মাদকের বিরুদ্ধে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করছে তার ছিটেফোঁটাও এসব অঙ্গনে দেখতে পাবে না। সাধারণ ধুমপান পর্যন্ত যারা এড়িয়ে চলে মদ্যপানের দিকে তারা কখনও ঝুঁকতে পারে কি?

যে মাদকাসক্ত সন্তান তার জন্মদাতা বাবা-মায়ের বুকে ছুরি ধরছে কিংবা যে মাদককারবারী জিরো থেকে হিরো হয়ে জননেতৃত্বের পদ কলুষিত করছে- সে কে? যাদের দমনে আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা কারা? কারা আজ হেরোইন-ইয়াবার ছোবলে সর্বস্বান্ত? এ সর্বনাশা নেশার বিস্তার ঘটিয়ে গোটা একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে ফেলার যোগাড়যন্ত্র পূর্ণ করে ফেলেছে যারা, কারা সেই বিনাশীমঞ্চের কুশীলব? কোনও মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন বা তাদের সাহচর্যধন্য মুসল্লী? কোনও মাদরাসার মুদাররিস? কোনও ইসলাহী খানকার মুরীদ-মুর্শিদ? দ্বীনী দাওয়াতের কোনও মুবাল্লিগ? এদের যারা আজন্ম শত্রু তারাও এমন অপবাদ মুখে আনবে না। কেননা সকলেই জানে তারা জান্নাতের শারাবান তাহুরার প্রত্যাশী। সেই প্রত্যাশায় তারা দুনিয়ার নেশাকর শরাব এড়িয়ে চলে। নাপাক মাদকের স্পর্শ থেকে তারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। তাদের বিশ্বাস- নেশাকর সব দ্রব্য হারাম। তারা জানে এর নগদ মজাভোগ আখিরাতের চিরশান্তি থেকে বঞ্চিত থাকার কারণ। তারা আরও জানে এ বিধান আল্লাহ তা‘আলার দেওয়া। এটা লঙ্ঘন করলে আর কেউ না দেখুক আল্লাহ তা‘আলা ঠিকই দেখবেন। গোপনে নেশা করলে পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া যাবে, কিন্তু আল্লাহ্র সদাজাগ্রত দৃষ্টি থেকে বাঁচার সাধ্য কারও নেই। এই বোধের নাম তাকওয়া। তারা তাকওয়া বোধে উজ্জীবিত। এসব কেন্দ্রে তাকওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। এর চর্চা করা হয়। তাই এর সাথে যারা সম্পৃক্ত কোনও মাদক তাদের স্পর্শ করতে পারে না। না সেবনের স্পর্র্শ, না চোরাচালান ও ব্যবসা-কারবারের স্পর্শ। সুতরাং তারা কখনও উপরে বর্ণিত প্রশ্নতীরে বিদ্ধ হবে না, হতে পারে না। মাদকজনিত কোনও প্রকার পাপের তালিকায় তাদের নাম কখনও আসবে না।

তবে এসব প্রশ্নের জবাব কারা? কারা তা সকলেই জানে। যাদের জীবনে তাকওয়ার চর্চা নেই, মদ-নেশার ছোঁয়া তাদেরই পায়। সে ছোঁয়া থেকে তাদের বাঁচাতে হলে তাকওয়ার কোনও বিকল্প নেই। তাই চিরদিনের মত এখনও সময়ের দাবি- সর্বস্তরে তাকওয়ার চর্চা ছড়িয়ে দেওয়া। আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস, তার গুণাবলির পরিচয়, মৃত্যুপরবর্তী জীবন- কবর, হাশর, হিসাব-নিকাশ, আল্লাহ্র সামনে দাঁড়ানো ও সকল কাজের জবাবদিহিতা এবং সবশেষে জান্নাত-জাহান্নামের ঠিকানা- এসব বিষয়ের ভাবনা-বিশ^াস জনমনে ছরিয়ে দেওয়া ছাড়া মাদকের ধ্বংসকবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার আর কোনও উপায় নেই। নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে চাইলে তাদেরকে এ বোধের সাথে পরিচিত করতেই হবে। তরুণদের করতে হবে তাকওয়ার বোধে উজ্জীবিত। সে লক্ষ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষা কারিকুলাম ঢেলে সাজাতে হবে। তাতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তাকওয়া শিক্ষারও ব্যবস্থা রাখতে হবে। তা রাখতে হবে প্রত্যেক শ্রেণীতে। সেই সঙ্গে প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক থেকে তাকওয়া বিরোধী ভাবধারা ছাঁটাই করতে হবে।

দরকার শক্তিশালী দাওয়াতী কর্মসূচী। মুসলিম রাষ্ট্রের ধর্মমন্ত্রণালয় যদি নাগরিকদের মধ্যে তাকওয়া বিস্তারে বলিষ্ঠ ভূমিকা না রাখে তবে এ মন্ত্রণালয়ের সার্থকতা কী? দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কল-কারখানা কেন তার দাওয়াতী কর্মসূচীর আওতায় থাকবে না? বরং একটি আদর্শ জাতি গঠনের জন্য এটা এমনই জরুরি কাজ যে, এর জন্য আলাদাভাবেই দাওয়াতী মন্ত্রণালয় থাকা উচিত। যদি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থাকতে পারে তবে দাওয়াত সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় কেন থাকবে না? সরকার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে? সে অর্থ জাতিগঠনে সত্যিকার অর্থে কী কাজে লাগছে? আদৌ কাজে লাগছে কি? ওসবের সাথে সংশ্লিষ্টদের অনেকের মাতালতার যেসব কাহিনী অনেক সময় শোনা যায় তাই প্রমাণ করে জনগণের ঘাম ঝড়ানো অর্থ কাদের পেছনে কী কাজে ব্যয় হচ্ছে। সুতরাং গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসা নয় বরং গভীর দৃষ্টিতে ভেবে দেখতে হবে দেশ ও জাতি গঠনের জন্য করণীয় কাজ আসলে কী হওয়া উচিত।

মূলত কোনও প্রচেষ্টাই কাজে আসবে না যদি না জাতিকে তাকওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত করা যায়। কাজেই মাদক নিরোধে সফলতা পেতে হলে জাতিকে তাকওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলাই হওয়া উচিত সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। আর সে লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নেমে পড়ার এখনই সময়। আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement