শাবান-রমযান ১৪৩৯   ||   মে-জুন ২০১৮

দুনিয়ার জীবন আখেরাতের জীবন

প্রফেসর হযরত মুহাম্মাদ হামিদুর রহমান

[দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। কথাটা নতুন। মোবাইল না হলে সম্ভবত এ কথাটা শোনা যেত না। মুঠোতে দুনিয়া ভরেও স্বস্তি মেলেনি। দুনিয়ার আগ্রহ আরও বেড়েছে। কমেনি। কমিউনিকেশন বাড়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। বাড়ির খবর বাইরে যাচ্ছে। বাইরের মানুষ ঘরে ঢুকছে। ঘর-সংসার ভাঙছে। গড়ছেও। ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি। এখন আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। সব এখন মোবাইল।

দ্বীনদাররা মোবাইলের ভালোটুকু নেওয়ার চেষ্টা করেন। সময়ের প্যাঁচে পড়ে এ চেষ্টাও অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যায়। টেকনোলজির এই এক সমস্যা। ব্যর্থতা নিয়েই আগে বাড়তে হয়। এরকম একটা চেষ্টা করলাম আমেরিকায় এসে। অনলাইনে বয়ান শোনার চেষ্টা। মোবাইলে। ভাইবার বা ইমোতে লাইভ হতে পারত। প্রফেসর হযরত কখনো স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন না। সুতরাং সেই সুযোগ নেই।

হযরত নোকিয়ার পুরোনো মডেলের একটি সেট ব্যবহার করেন। তাতে ক্যামেরা নেই। ফাংশনও বেশি নেই। যা আছে, তার সবটুকুও হযরত জানেন না। জানতেও চান না। তবে এলার্ম দিতে পারেন। এখন মোবাইলের এলার্মই বেশি ব্যবহার করেন। ঘড়ির এলার্ম প্রয়োজন হয় না। অনেক আগে একবার এলার্মের জন্য তিনি একটি ঘড়ি কিনতে গেলেন। নিউমার্কেটে। তখন আজিমপুরের বাসায় কেবল উঠেছেন। ১৯৯৫-৯৬ সালের ঘটনা। আমি সঙ্গে ছিলাম।  নিউমার্কেটে হযরতকে আমি ঐ একবারই যেতে দেখেছি। রিকশা থেকে দক্ষিণের গেইটে নামলেন। তারপর সোজা ঘড়ির দোকানে। দোকানদার একটি ঘড়ি দেখাল। টেবিল ঘড়ি। হযরত দাম জিজ্ঞেস করলেন। কোনো দাম-দর করলেন না। দাম পরিশোধ করে আবার আজিমপুরের বাসায়। বাসায় এসে ঘড়িটাতে হযরত এলার্ম সেট করতে চাইলেন। পারলেন না। ঘড়িটাই নষ্ট। আর ফেরতও দেননি।

। ২।

হযরতের কাছে যারা বাইআত হন, তাদের কসদুস সাবিল কিতাব থেকে পড়ে শোনানো হয়। যারা শোনান, তারা এর সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু কথাও বলেন; শায়েখের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার গুরুত্ব, কেমন করে তা রাখা যাবে, না রাখলে কী হবে ইত্যাদি। কাছাকাছি থাকলে অনেক সময় আমাকেও জিজ্ঞেস করে। আমি তাদের হযরতের সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাব্য সব মাধ্যমের কথা বলে দেই। অভিজ্ঞতায় যা জেনেছি, সব। নতুনদের জন্য সহজ হয়। আমেরিকায় এসে আমার জন্যই বিষয়টি কঠিন হয়ে গেল। কিছুতেই হযরতকে পাচ্ছি না।

হযরতের মোবাইলটা এখন বেশিরভাগ সময় সাইলেন্ট মুডে থাকে। এ মুডে থাকলেও হযরত ফোন ধরেন। আমি সম্ভাব্য সব সময়েই ফোন করলাম। পেলাম না। একটা সময় আমার জানা ছিল। সেটা কাউকে সাধারণত বলি না। বললেও অবশ্য সবাই সাহস করবে না। না করাই ভালো। আমার আর উপায় ছিল না। সে সময় ফোন করলাম। তখন হযরতের মোবাইল সাইলেন্ট মুডে থাকে না। সাইলেন্ট মুডে এলার্ম শোনা যায় না। তবে এ সময় ফোন করতে চাইলে মুজাহাদা লাগে। আমেরিকার সময় উল্টো। এখানকার পড়ন্ত বিকেলে বাংলাদেশে তাহাজ্জুদের সময়। কোনো মুজাহাদা করতে হয়নি। পাঁচটায় ফোন দিলাম। ছ’টার আগে ফজরের নামায হওয়ার কথা না। পেয়ে গেলাম। অযু করছিলেন। পরে কথা বললেন।

আহা! সেই কণ্ঠ। ভোরের নিস্তব্ধতায় কণ্ঠস্বরের আওয়ায খুব পরিষ্কার। কোনো জড়তা নেই। সময় চাইলাম বয়ানের। দিলেন। বাংলাদেশে জুমার দিন সকাল ন’টা। ডালাসে তখন আগের দিন রাত ন’টা। এদেশ সময়ে পিছিয়ে আছে! সবকিছুতে আমেরিকা আগে বাড়তে পারেনি। সূর্যের আলো তাদের পরেই দেখতে হয়। দ্বীনের আলোও একদিন দেখবে। সূর্যের মতোই একদিন উদয় হবে। এখন না হলেও পরে হবে। হবেই- ইনশাআল্লাহ।

। ৩।

সময় ঘনিয়ে এল। ঘরে বসে আছি। একটু পরেই হযরতকে ফোন করতে হবে। ভাই-ভাতিজাদের নিয়ে আমরা চারজন শ্রোতা। বক্তার সামনে কোনো শ্রোতা নেই। মাইক্রোফোন নেই। প্যান্ডেল নেই। শ্রোতারা মাত্র দশ হাজার মাইল দূরে! যারা চায়, তারা এমনি পায়। মোবাইল তখন হয়ে ওঠে নতুন জীবন। হযরতের মুরীদদের মধ্যে যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা এরকম আয়োজন করতে পারেন। করেন না। চান না যে এমন না। বিদেশে কাজ করে যে অবসর মেলে, তাতে আর কুলোয় না। এনজয়মেন্ট ছাড়া অন্যকিছু ভালো লাগে না। দ্বীনের কাজও যে আনন্দ দিতে পারে, এটা যদি সকলে বুঝত! -মুহাম্মাদ আদম আলী]

হামদ্ ও ছানার পর

আলহামদু লিল্লাহ। আমি একটি আয়াত প্রায়ই পড়ে থাকি। হাফেজ্জী হুযুর রাহ. আয়াতটি বার বার পড়তেন। আল্লাহ বলেন-

وَ اتَّقُوْا یَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِیْهِ اِلَی اللهِ  ثُمَّ تُوَفّٰی كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَ هُمْ لَا یُظْلَمُوْنَ .

ভয় কর সেদিনকে, যেদিন তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে আল্লাহ তাআলার কাছে। অতপর প্রতিটি প্রাণকে বদলা দেওয়া হবে- যা সে অর্জন করেছিল। তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না। - সূরা বাকারা (২) : ২৮১

সুতরাং এ দুনিয়াতে আমরা যা অর্জন করছি, তা আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে। পরিপূর্ণভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এটা মনে রেখেইে আমাদের কাজ করতে হবে। এখন আপনারা আমেরিকায় বসে আমার কথা শুনছেন। আর আমি ঢাকা থেকে কথা বলছি। আমাদের এ কাজের লক্ষ্য- এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া যে, আমাদের একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। এজন্য আমাদের তৈরি হতে হবে।

এখন দুনিয়ায় তাঁকে দেখা যায় না। পাশ্চাত্যে আল্লাহর ব্যাপারে কোনো পরওয়া নেই। আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় না। এখন সেখানে মুসলমানরা আছে। নতুন নতুন মসজিদ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কয়টা মসজিদ? কয়জন মুসলমান? মুসলমানদের মধ্যে সাদা (American White Citizen)

কয়জন আছে? এজন্য সেখানে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা সেকেন্ডারি। প্রাইমারি ব্যাপার হচ্ছে দুনিয়া। দুনিয়া আরও বেশি চাই। আরও বেশি চাই। আরও ভালো বাড়ি চাই। আরও ভালো খাবার চাই। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন-

بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَاؗ  وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی.

না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। -সূরা আ‘লা (৮৭) : ১৬-১৭

আখেরাত চিরস্থায়ী। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। এটাকে আল্লাহ তাআলা সুন্দরভাবে সূরা রূম-এ বলেছেন। সূরা নম্বর ৩০।

یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا  وَ هُمْ عَنِ الْاٰخِرَةِ هُمْ غٰفِلُوْنَ .

তারা দুনিয়ার বাহ্যিক দিক খুব ভাল জানে। কিন্তু আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল। -সূরা রূম (৩০) : ৭

তারা দুনিয়ার বাহ্যিক দিক খুব ভালে করে জানে। এখানে ‘যহিরান’ মানে, যা প্রকাশ্য। সবাই এটা দেখে। ‘হায়াতুদ দুনিয়া’ মানে দুনিয়ার হায়াত বা দুনিয়ার জীবন। They very well know the outworldly things of life । বড় বাড়ি, রাস্তা-ঘাটসব দেখা যায়। অথচ আখেরাত কত ভালো, কত সুন্দর। এখনকার মর্ডান টেকনোলজি দেখলে মনে হয়, আল্লাহ তাআলা এই ২০১৭ সালের জন্য এ আয়াত দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে আরেক জায়গায় আল্লাহ অবিশ্বাসীদের কথা নকল করেন-

وَ قَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْۤا اِنْ هٰذَاۤ اِلَّاۤ اِفْكُ ِافْتَرٰىهُ وَ اَعَانَهٗ عَلَیْهِ قَوْمٌ اٰخَرُوْنَ  فَقَدْ جَآءُوْ ظُلْمًا وَّ زُوْرًا .

যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা বলে, এটা (অর্থাৎ কুরআন) এক মনগড়া জিনিস ছাড়া কিছুই নয়, যা সে নিজে রচনা করেছে এবং অপর এক গোষ্ঠী তাকে এ কাজে সাহায্য করেছে। এভাবে (এ মন্তব্য করে) তারা ঘোর জুলুম ও প্রকাশ্য মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। -সূরা ফুরকান (২৫) :  ৪

ইসলাম কী বলে, মুহাম্মাদ সা. কী বলেন, তাঁর সাহাবায়ে কেরাম কী বলেন, অথবা মুসলমানরা কী বলে- সব মিথ্যা! মুহাম্মাদ সা. এটা বানিয়ে নিয়েছে! আল্লাহ কি আশ্চর্য ভঙ্গিতে অবিশ্বাসীদের কথা নকল করছেন। কি চমৎকারভাবে আল্লাহ মুসলমানদের সামনে পরিস্থিতি তুলে ধরছেন!

সূরা মূলক-এ আল্লাহ বলেন-

تَبٰرَكَ الَّذِیْ بِیَدِهِ الْمُلْكُ ؗ وَ هُوَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْر

অতি বরকতওয়ালা সেই সত্তা, সকল আধিপত্য যাঁর হাতে। সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান যিনি। -সূরা মূল্ক (৬৭) : ১

তারপরের আয়াত,

الَّذِیْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَ الْحَیٰوةَ لِیَبْلُوَكُمْ اَیُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا  وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْغَفُوْرُ .

যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যুকে ও জীবনকে। তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে আমলে কে সুন্দরতর। -সূরা মূল্ক (৬৭) : ২

একই পারায় সূরা কিয়ামাহ-এ আল্লাহ বলেন-

لَاۤ اُقْسِمُ بِیَوْمِ الْقِیٰمَةِ  وَ لَاۤ اُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ.

আমি শপথ করছি কিয়ামত দিবসের। আমি আরো কসম করছি আত্ম-ভৎর্সনাকারী আত্মার! -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ১-২

আল্লাহ এখানে ‘নফসে লাওয়ামার’ কসম করেছেন। এটি একটি রহস্যজনক কসম। নফসে লাওয়ামা মানে যে অন্তর নিজেকে নিজে ধিক্কার দেয়। আল্লাহ কেন এই কসম করলেন? আমি এটার একটা উদাহরণ দিয়ে থাকি। আপনি অফিসে যাবেন। দেরী হয়ে গেছে। খুব তাড়াহুড়ো। এর মধ্যে আপনার বিবি কিছু একটা বলল। আর আপনি খুব ক্ষেপে গেলেন। জোরে জোরে কথা বললেন। বাড়ির দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন। আর মনে মনে ভাবছেন, ‘আমি কাজটা ঠিক করিনি। এতটা না ক্ষেপলেও চলত। সে এমন কিছু করেনি, যে জন্য আমি এত ক্ষেপে গেলাম।’ সে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। এটাকে বলে ‘নফসে লাওয়ামা’। আল্লাহ এই নফসের কসম করেছেন।

তারপর আল্লাহ বলছেন-

اَیَحْسَبُ الْاِنْسَانُ اَلَّنْ نَّجْمَعَ عِظَامَهٗ.

মানুষ কি ধারণা করে, তার হাড়গুলোকে আমি একত্রিত করব না?  -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ৩

এটা আরেক সূরায় এভাবে এসেছে-

ءَاِذَا مِتْنَا وَ كُنَّا تُرَابًا  ذٰلِكَ رَجْعٌۢ بَعِیْدٌ.

আমরা যখন মারা যাব এবং মাটিতে পরিণত হব তখনো কি (আমরা পুনরুত্থিত হব)? এ প্রত্যাবর্তন সুদূর পরাহত! -সূরা কফ (৫০) : ৩

আল্লাহ তাআলা আবার অবিশ্বাসীদের কথা উল্লেখ করেছেন। এটা আমাদের দেশেও দেখা যায়। তারা কী বলে? ‘কী, আমরা মরে যাব এবং মাটি হয়ে যাব। তারপর আমাদের আবার জীবিত করা হবে? এটা কখনোই হবে না!’ আর সূরা কিয়ামায় আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ কি ধারণা করে, তার হাড়গুলোকে আমি একত্রিত করব না?’ তারপর আল্লাহ নিজেই বলছেন-

بَلٰى قٰدِرِیْنَ عَلٰۤی اَنْ نُّسَوِّیَ بَنَانَهٗ.

না না, আমি তো এমন শক্তিমান যে, তাদের আঙুলের অগ্রভাগকেও পূর্বের অবস্থায় সৃষ্টি করব। -সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ৪

এখন সারা দুনিয়ার এয়ারপোর্টগুলোর দিকে তাকাও। সেখানে মানুষের হাতের আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে। কয়টা আঙুলের? জন এফ. কেনেডি এয়ারপোর্টে আঙুলের ছাপ নেয় কি নেয় না? প্রতিটি মানুষেরই আঙুলের ছাপ নেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইডেন্টিফিকেশন আইটেম হচ্ছে আঙুলের ছাপ। ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ কেন এই কথা বললেন?

পুরো কুরআন মাজীদেই আল্লাহ অবিশ্বাসীদের উক্তি উল্লেখ করেছেন। এটা কুরআনের একটি মোজেযা যে, অবিশ্বাসীদের কথাগুলো মুমিনদের ঈমান বাড়ায়। সূরা ফুরকানেই আছে; ১৯ পারার প্রথম আয়াত-

وَ قَالَ الَّذِیْنَ لَا یَرْجُوْنَ لِقَآءَنَا لَوْ لَاۤ اُنْزِلَ عَلَیْنَا الْمَلٰٓىِٕكَةُ اَوْ نَرٰی رَبَّنَا  لَقَدِ اسْتَكْبَرُوْا فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ وَ عَتَوْ عُتُوًّا كَبِیْرًا .

যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে না, তারা বলে, ফেরেশতারা আমাদের সামনে একটু আসে না কেন? অথবা খোদাকে একটু দেখি না কেন? -সূরা ফুরকান (২৫) : ২১

সুতরাং অবিশ্বাসীদের অনেক উক্তিই কুরআনের আয়াত। কমেন্টগুলো কেমন লাগে? উপরের আয়াতের শব্দগুলো দেখ। لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا  মানে যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাতের আশা করে না; তারা বলে, আমাদের সামনে ফেরেশতারা নাযিল হয় না কেন? অথবা আমরা আল্লাহকে একটু দেখি না কেন? তারপর আল্লাহ যে কমেন্ট করেছেন, সেটা অনেক সুন্দর-

لَقَدِ اسْتَكْبَرُوْا فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ وَ عَتَوْ عُتُوًّا كَبِیْرًا.

তারা নিজেদের অন্তরে অহঙ্কার পোষণ করে এবং তারা গুরুতর সীমালংঘন করেছে।  -সূরা ফুরকান (২৫) : ২১

আমরা বলি, আমি হামীদুর রহমান। আমি মিলিটারির প্রধান। আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আমি বেশি জানি। আমি যে কোনো বিষয়ে জানি। পুরো জাতি আমার জ্ঞানের মুখাপেক্ষী। মানুষ এভাবে চিন্তা করে। এটাই তাদের অহঙ্কারী বানায়। পবিত্র কুরআন এটাকেই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে, যা অন্তরকে স্পর্শ করে।

আমি শুরুতে যে আয়াত পড়েছিলাম,

(তরজমা) ‘ভয় কর সেদিনকে, যেদিন তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে আল্লাহ তাআলার কাছে। অতপর প্রতিটি প্রাণকে বদলা দেওয়া হবে- যা সে অর্জন করেছিল।’ এখানে অর্জন বলতে কী বুঝিয়েছেন আল্লাহ তাআলা? আজ আমরা যে কথাবার্তা বলছি, এটা আমদের একটি অর্জন। পবিত্র কুরআনে এ কাজে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

وَ مَنْ اَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّنْ دَعَاۤ اِلَی اللهِ وَ عَمِلَ صَالِحًا وَّ قَالَ اِنَّنِیْ مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ .

তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে কিনা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে, নিজে নেক আমল করে এবং বলে, আমি মুসলমানদের একজন। -সূরা ফুসসিলাত (৪১) : ৩৩

সুতরাং আমি এখন যে কাজ করছি, simple telephone conversation (টেলিফোনে সাধারণ কথোপকথন), কিন্তু উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনাদের আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করা। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মুআযযিন প্রতিদিন পাঁচবার এটা বলে। আমেরিকায় আযান শোনা যায় না। মসজিদের বাইরে আযানের শব্দ যাওয়ার অনুমতি নেই। এ অবস্থা কি পরিবর্তন হয়েছে? এখনো হয়নি।

আমি বলছিলাম, এই কাজ আল্লাহ খুব পছন্দ করেন। কোন্ কাজ? মানুষকে আল্লাহ্র দিকে ডাকা। আমি এখন যেভাবে ডাকছি, এটাও একটা পদ্ধতি। মুআযযিন যেভাবে ডাকে, সেটা আরেক পদ্ধতি। মসিজদের ভেতরে অথবা মসজিদের বাইরে। প্রতিদিন পাঁচবার ডাকে। প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে আল্লাহ্র দিকে ডাকা। আমি এই টেলিফোনে কথা বলছি, এর প্রধান উদ্দেশ্যও সেটা। আল্লাহর উপর ঈমান আনো, তাঁকে মানো এবং তাঁর নির্দেশ অনুসরণ কর। তাঁর রাসূলকে অনুসরণ কর। আল্লাহ বলেন-

قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ  وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

আপনি ঘোষণা করে দেন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে মেনে চল। আমাকে অনুসরণ করে চল। আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন। তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা বড় ক্ষমাশীল, বড় করুণাময়। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩১

রাসুলকে এভাবে কথাগুলো বলতে বলা হয়েছে। রাসূলের পথই পথ। সিম্পল রুল। মুহাম্মাদ সা.-কে অনুসরণ করতে হবে।

আমেরিকায় মুআযযিনরা যেভাবে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকছে, তাতে ডাকার বিষয়টি ঠিক আছে। কিন্তু সুন্নাত ঠিক নেই। সুন্নাত কী? প্রকাশ্যে ডাকা। মসজিদের বাইরে। আযানের জন্য মাইক্রোফোন মসজিদের ভেতরে থাকতে পারে, বাইরেও থাকতে পারে। সুতরাং আমরা এক্ষেত্রে রাসূল সা.-কে অনুসরণ করতে পারছি না।

পরবর্তী পয়েন্ট, যদি তুমি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে ‘আমাকে’ মানে রাসূল সা.-কে অনুসরণ কর। আল্লাহকে তো ভালোবাসতে হবে। কারণ তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আমাদের এই অস্তিত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাদের দেখার শক্তি দিয়েছেন। শোনার শক্তি দিয়েছেন। সুতরাং তাঁকে ভালোবাসতে হবে। কিন্তু আমরা তাকে ভালোবাসি না।

যদি তুমি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে মুহাম্মাদ সা.-কে অনুসরণ কর। এটা একটি জেনারেল স্টেটমেন্ট।

মুসলমান কেমন আচরণ করবে? যেমন মুহাম্মাদ সা. শিখিয়েছেন। তিনি যেমনভাবে নামায পড়েছেন, তেমন নামায পড়তে হবে। তিনি মানুষের সাথে যেমন আচরণ করেছেন, তেমন আচরণ করতে হবে। তিনি মানুষের প্রতি দয়ালু আচরণ করেছেন। আমাদেরও মানুষের প্রতি বিন¤্র আচরণ করতে হবে। কুরআন মাজীদে এ ব্যাপারে অনেক আয়াত আছে। আল্লাহ রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ  وَ لَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَا نْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ .

(হে নবী!) এসব ঘটনার পর এটা আল্লাহর রহমতই ছিল, এজন্য তুমি মানুষের সাথে কোমল আচরণ করেছ। তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয় হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৫৯

রাসূল সা. যদি কেবল মানুষকে বলতেন, তুমি এটা কেন করেছ, সেটা কেন করেছ? তাহলে সবাই তার চারপাশ থেকে চলে যেত। সুতরাং এই আয়াত থেকে দেখা যায় যে, তিনি মানুষের প্রতি খুব ন¤্র আচরণ করতেন। রাসূল পিতামাতার প্রতি ন¤্র আচরণ করতে বলেছেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন-

وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا  اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنْهَرْهُمَا وَ قُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا.

তোমার মাবুদের ফরমান, তুমি একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে। আর তোমার মাতা-পিতার সঙ্গে করবে চরম সৎ ব্যবহার। তাদের মধ্যে একজন বা দু’জন যদি বুড়ো বয়সে তোমার কাছে থাকে, তবে তাদের সাথে উহ্ পর্যন্ত বলো না। তাদের ধমক দিও না। তাদের সঙ্গে আদব ও ভক্তিপূর্ণ কথা বল। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩

মূলকথা হচ্ছে, মুহাম্মাদ সা. যা যেভাবে করতে বলেছেন, আমাদের তা সেভাবেই করতে হবে। তিনি যেভাবে কথা বলেছেন, মানুষের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেছেন, আমাদের তা-ই অনুসরণ করতে হবে। তিনি তাঁর উম্মতকে ডান হাতে খেতে বলেছেন। যদি কেউ বাম হাতে খায়, তাহলে সে রাসূল সা.-কে অনুসরণ করছে না। প্রতিটি কজেই সুন্নাতকে অনুসরণ করতে হবে।

আল্লাহকে ভালোবাসতে হবে। এজন্য সূরা ফুরকানে বলা হয়েছে, ‘যারা আমার সাক্ষাৎ আশা করে না।’ তাকে ভালোবাসলে তার সাক্ষাতের আশা করা উচিত ছিল। আমরা আামাদের মা’কে ভালোবাসি। প্রতিটি শিশুই তার মাকে ভালোবাসে। মা তার জন্য কত কষ্ট করেছে। কুরআন ঘোষণা করছে-

حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ كُرْهًا وَّ وَضَعَتْهُ كُرْهًا.

তার মা তাকে বড় কষ্টে বহন/ধারণ করেছে। বড় কষ্টে প্রসব করেছে। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৫

পাশ্চাত্যে আল্লাহকে ভালোবাসতে শেখায় না। তারা বড় জোর মাকে ভালোবাসতে বলে। তারা বলে, O Mom, I love you so much! তুমি আমার জন্য অনেক করেছ।

আমি একবার একটি বই কিনলাম। ২০১২ সালে আটলান্টার এক লাইব্রেরি থেকে বইটি কিনেছিলাম। বইয়ের নাম, ও ষড়াব সু গড়স (আমি আমার মাকে ভালোবাসি)। এটা আমেরকিায় খুব সাধারণ যে, প্রতিটি শিশুই তার মাকে ভালোবাসে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মাকে ভালোবাসার কথা শিক্ষা দেয়। কিন্তু কেউ আল্লাহর কথা মেনশন করে না। আল্লাহ কি তোমার জন্য কিছু করেননি, যাতে তোমার তাঁকে ভালোবাসা উচিত? তিনি আমাদের পানি দিয়েছেন। কীভাবে সল্ট ওয়াটার থেকে মিষ্টি পানি বর্ষিত হয়? আল্লাহ সমুদ্রের লবনাক্ত পানিকে মিষ্টি পানিতে রূপান্তর করেন। মর্ডান সাইন্স আমাদের জানায় যে, সমুদ্রের পানি ইভাপোরেশন হয়ে উপরে উঠে। মেঘাকারে ভেসে বেড়ায়। সেখান থেকে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে বর্ষিত হয়। সেই পানি মিষ্টি। সমুদ্রের পানি সল্টিস। এটা সূরা ওয়াকিয়াতে বলা হয়েছে-

اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ ءَاَنْتُمْ اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْن.

তুমি যে পানি পান কর তার স¤পর্কে ভেবে দেখেছ, তুমি এ পানিকে মেঘ থেকে নামাও, না আমি নামাই? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৬৮-৬৯

আল্লাহর কথা বলো না। বলো নেচার। ক্রিয়েটার বলো। Allah is not mentioned (আল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয় না)। Creator is mentioned (সৃষ্টিকর্তা বলা হয়)। তুমি কি কোনো টেক্সট বই পেয়েছ, যেখানে লেখা আছে, আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত? আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, যিনি চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি করেছেন। আমরা বলি, Nature has created everything! স্টিফেন হকিংস, একজন পঙ্গু মানুষ। তার হাত-পা অবশ। ইন্টারনেটে তার ছবি দেখা যায়। আল্লাহ তাকে সর্বসময়ের বড় সাইন্টিস্ট বানিয়েছেন। কিন্তু তিনি আল্লাহকে বিশ্বাস  করেন না। দু-তিন বছর আগে তিনি এথিস্টদের দলের সদস্য হয়েছেন।  

আল্লাহ সূর্য বানিয়েছেন। চন্দ্র বানিয়েছেন। আকাশ তৈরি করেছেন। আল্লাহ তারকা বানিয়েছেন। সূর্য নয় লক্ষ ত্রিশ হাজার মাইল দূরে। আমেরিকায় মাইল বলে। তারা কিলোমিটার ব্যবহার করে না। চন্দ্র ২৩৮০০০ মাইল দূরে। সূর্য ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে। নিকটবর্তী স্টার এত দূরে যে, সেটা মাইলে আর হিসেব করা যাবে না। নতুন স্কেল বানাতে হবে। স্কেল হচ্ছে লাইট ইয়ারস (Light Years, আলোকবর্ষ)। সাড়ে চার আলোকবর্ষ লাগে। আর আমাদের নক্ষত্রজগতে এরকম তারকার সংখ্যা দশ হাজার কোটি। আমাদের নক্ষত্রজগতের নাম মিল্কিওয়ে (বাংলায় বলে ছায়াপথ)। এখন নক্ষত্রজগতের সংখ্যা কত? বলে যে, দশ হাজার কোটি। সুবহানাল্লাহ। এত বড় আকাশ যিনি বানিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া হয় না। আমাদের উচিত তাঁর শোকর আদায় করা, তাঁকে ভালোবাসা। আর তাঁকে ভালোবাসার প্রধান উপকরণ, রাসূল সা.-এর পথ অনুসরণ করে চলা। আল্লাহ আমাদের নেক আমলের তাওফীক নসীব করুন- আমীন।  হ

[২৮ ডিসেম্বর ২০১৭]

 

 

advertisement