রজব ১৪৩৯   ||   এপ্রিল ২০১৮

সাম্প্রদায়িকতা : বৌদ্ধ-তাণ্ডব

আবদুল্লাহ নসীব

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শ্রীলংকার মুসলিমেরা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। মুসলমানদের মসজিদ, বাড়িঘর ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে একের পর এক হামলা চালিয়ে গেছে উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা। সপ্তাহব্যাপী মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় আগুন দেয়া হয়েছে প্রায় অর্ধশত ঘরবাড়িতে, ভাংচুর করা হয়েছে দুই শ’রও বেশি দোকান ও প্রতিষ্ঠান। হামলা হয়েছে বিভিন্ন জায়গার চারটি মসজিদে।

শ্রীলংকার সংবিধানে ২৯ (২) ধারা ও উপধারায় সংখ্যালঘু অধিকার ও ধর্মীয় নিরাপত্তার কথা আছে। বৌদ্ধ-মহানায়কেরা সেই সংবিধানেরও সংশোধন দাবি করছেন। মহানায়কেরা আরো বলছেন, ‘এ দেশে কুরআন নিষিদ্ধ করা উচিত। যদি আপনারা না করেন আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারণা চালাব।’ বিশ্লেষকগণ বলছেন, শ্রীলংকায় এর আগেও এধরনের মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়েছে। মিয়ানমারের ‘মাবাথা’র মতো শ্রীলঙ্কাতেও আছে বুদুবালা সেনা (বিবিএস) নামে উগ্রবাদী বৌদ্ধ সংগঠন, যাদের বিরুদ্ধে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানো ও মুসলিমবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ রয়েছে।

২০১২ সালে এই সঙ্ঘের নেতারা তথাকথিত ‘ধর্মান্তরকরণ’ ও ‘ইসলামী টেররিজম’-এর বিরুদ্ধে উসকানীমূলক র‌্যালি শুরু করে। ২০১৩ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজা পাকসে বিবিএস (বুদুবালা সেনা)-এর নেতাদের সাথে আলোচনা করে সিংহলি বৌদ্ধ ও ভিক্ষুদের সহিংসতা ও ধর্মীয় কারণে বিরোধে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে সময় চরমপন্থী ভিক্ষুরা যেসব দাবি তুলেছিল তার মধ্যে নি¤েœাক্ত অযৌক্তিক দাবিগুলোও ছিল :

মধ্যপ্রাচ্যের সহায়তায় কোনো মসজিদ নির্মাণের অনুমতি না দেওয়া, কাউকে ইসলামধর্মে দীক্ষিত না করা, বোরকা নিষিদ্ধ করা, খাদ্যদ্রব্য ও কোনো বিষয়ের উপর সিলোন জমিয়াতুল উলামার হালাল সনদ প্রদান পদ্ধতি বাতিল করা ইত্যাদি।

এইসব প্রকাশ্য দাবি-দাওয়ায় চরমপন্থী ভিক্ষুদের সংকীর্ণতা, উগ্রতা ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের স্বধর্ম পালনে বাধা দেওয়ার প্রবণতা একেবারেই স্পষ্ট।

২০১৩ সালে কান্ডি শহরে র‌্যালি করে রত্নপুর জেলার দশম শতাব্দীর একটি ঐতিহাসিক মসজিদে এই ‘অপরাধে’ হামলা চালানো হয় যে, এর পাশেই কুরাগালা বৌদ্ধ আশ্রম রয়েছে।

সাম্প্রতিক দাঙ্গাতেও বিবিএস ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সংগঠন বৌদ্ধদের জোর করে ইসলামধর্মে দীক্ষিত করার ধুয়া তুলেছে। অথচ দুই কোটির কিছু বেশি জনসংখ্যার দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ। বৌদ্ধরা ৭০ শতাংশ আর তামিল ১৩ শতাংশ, যার অধিকাংশই হিন্দু। এ থেকে বোঝা যায়, দাঙ্গা ছড়ানোর পেছনে কিছু মুসলিম যুবকের হাতে এক সিংহলি লরি ড্রাইভারের নিহত হওয়ার অভিযোগটিও একটি বাহানা মাত্র।

এই উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের ‘মানবিকতা’র মাত্রা বোঝার জন্য এই উদাহরণটি যথেষ্ট যে, গত বছর মিয়ানমারের মগদের নিষ্ঠুর নির্যাতনে বাধ্য হয়ে কিছু রোহিঙ্গা মুসলিম শ্রীলংকায় আশ্রয় নিতে শুরু করলে বিবিএস প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করতে থাকে। এমনকি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়া একটি বাড়িতেও তারা আক্রমণ চালায়। পরে পুলিশ আক্রান্ত পরিবারটিকে নিরাপত্তা দিয়েছে।

তবে একথা বলতেই হচ্ছে যে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে যে জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালিত হয়েছে সে তুলনায় শ্রীলংকার পরিস্থিতি এখনো অপেক্ষাকৃত ভালো। শ্রীলংকার প্রশাসন ও পুলিশ দাঙ্গার বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নিয়েছে। সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদেরও অনেকে এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। শ্রিলঙ্কার সাবেক ক্রিকেট-অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা লিখেছেন, ‘শ্রীলংকায় জাতিগত বা ধর্মীয় অবস্থানের কারণে কেউ হামলা বা হুমকির শিকার হতে পারে না। এখানে বর্ণ-বিদ্বেষ বা সহিংসতার কোনো স্থান নেই।’

এ থেকে বোঝা যায়, সরকার ও প্রশাসন ইচ্ছা করলে অন্যায় প্রতিরোধ করতে পারে। ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ অধ্যুষিত শ্রীলংকায় সরকারের অজনপ্রিয় হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও অন্যায়-অত্যাচার রোধে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। দুর্বৃত্ত  শ্রেণির অন্যায় দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার ধারা শুরু হলে এর শেষ স্বজাতির ধ্বংসের মধ্য দিয়েই হতে পারে। তামিল বিদ্রোহীদের সাথে মিটমাট করে শ্রীলঙ্কা যখন কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে এগুচ্ছে এ সময় বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের এইসব উচ্ছৃঙ্খলা যে দেশটিকে আবারো সংঘাতমুখর করে তুলতে পারে তা নিশ্চয়ই সে দেশের সরকার উপলদ্ধি করেন।

তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধসম্প্রদায়ের সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার যে মাত্রা তাতে নিশ্চিত থাকার কোনো সুযোগ নেই। এই সংকীর্ণতার মাঝে জাহিলিয়াতের সব নমুনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই উগ্রতা, সেই বর্ণবাদ, সেই পৌত্তলিকতা। সিংহলি বৌদ্ধরা মনে করে তারাই দেশের সেরা সন্তান এবং এই ভূখণ্ডে একমাত্র তাদেরই অধিকার। তাদের এক রাজনৈতিক শ্লোগান- এক দেশ, এক রাষ্ট্র, এক বৌদ্ধ ধর্ম।

এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম চিন্তাশীল দাঈদের ভবিষ্যত-করণীয় সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা অতি প্রয়োজন। ইসলামের সাম্য, উদারতা ও মানবিকতার প্রচারে ব্যাপক ব্যবস্থাগ্রহণ আশু প্রয়োজন। মুসলিমদের প্রতি স্থানীয় অধিবাসীদের সহানুভূতি বৃদ্ধির প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিশ্বের সব দেশের মুসলমানদের এখনই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত যেসব মুসলিম দেশে শ্রীলংকানদের স্বার্থ রয়েছে ঐসকল মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দের দৃঢ় অবস্থান কাম্য।

অন্যান্য ভূখণ্ডের মুসলিম ভাই-বোনের অবস্থা থেকে নিজ ভূখণ্ডের ব্যাপারেও শিক্ষা নেয়া কর্তব্য। ইসলাম-বিরোধী অন্যায় অপপ্রচার, মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চেতনাহারী নানা অপতৎপরতার বিষয়ে মুসলিম উলামা ও দাঈগণের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।

 

 

advertisement