রজব ১৪৩৯   ||   এপ্রিল ২০১৮

কাউকে কষ্ট দিব না

বিনতে ইসমাঈল

কখনো কারো মনে কষ্ট দিব না। তা অনেক বড় গুনাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার  সাহাবীদেরকে বললেন, তোমরা কি জানো, নিঃস্ব কে? তাঁরা বললেন, আমরা তো নিঃস্ব বলতে তাকেই বুঝি, যার কোনো ধন-সম্পদ নেই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, নিঃস্ব সে নয়, প্রকৃতপক্ষে নিঃস্ব হচ্ছে সে, যে কিয়ামতের দিন অনেক নামায- রোযা-যাকাতের নেকী নিয়ে আসবে, কিন্তু দুনিয়াতে সে একে গালি দিয়েছে, তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এর মাল জোর করে দখল করেছে, ওর রক্ত প্রবাহিত করেছে অর্থাৎ তাকে হত্যা করেছে অথবা আহত করেছে, তাই সকল মাযলুম তার সেসব জুলুমের বদলা নিতে আসবে। আল্লাহ তাআলা তখন জুলুমের বদলা হিসেবে তার নেকীগুলো মাজলুমদের দিয়ে দিবেন। একপর্যায়ে তার সকল নেকী শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু জুলুমের বদলা নেওয়া এখনো শেষ হবে না। তখন মাজলুমের গোনাহগুলো চাপিয়ে দিয়ে  তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১

নাউযুবিল্লাহ! আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন। কত ভয়ানক শাস্তি জালেমের জন্য। এবার একটু চিন্তা করে দেখি। আমি কারো প্রতি জুলুম করছি না তো! আমার কারণে কেউ মনে কষ্ট পাচ্ছে না তো! আমি হয়ত কারো চেয়ে একটু বেশি সুন্দর, কিংবা আল্লাহ তাআলা হয়ত অনুগ্রহ করে আমার মাঝে কারো চেয়ে একটু বেশি মেধা দিয়েছেন, আমি কি শোকর করছি আল্লাহর এই নিআমাতগুলোর, নাকি আত্মগর্বে লিপ্ত থেকে অন্যের উপর অহংকার করছি? তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছি? আল্লাহ হয়ত আমাকে অন্যের চেয়ে বেশি সচ্ছলতা দান করেছেন। আমি হয়ত অন্য অনেকের চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করছি। দামি দামি আসবাব-পত্র দিয়ে ঘর সাজাচ্ছি। কিন্তু এগুলোর বড়াই করে কারো মনে কষ্ট দিচ্ছি না তো! আমার অহংকারী কণ্ঠ কারো মনকে চুরমার করে দিচ্ছে না তো! আল্লাহ হয়ত আমাকে একটু সুযোগ দিয়েছেন কারো উপকার করার। আমার দ্বারা তার কোনো বান্দার উপকৃত হওয়ার। এই উপকারের খোঁটা দিয়ে আমি তার মনে কষ্ট দিচ্ছি না তো! তার হৃদয়টা দুঃখে  ভরিয়ে দিচ্ছি না তো! না। আমার দ্বারা কারো উপকারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করতে হবে এবং তাঁর কাছে বিনীত হতে হবে। খোঁটা দিয়ে এই উপকারের সওয়াব নষ্ট হওয়া থেকে আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।

আমার মাঝে হয়ত অনেক প্রতিভা আছে। আমি হয়ত কারো থেকে একটু বেশি শিক্ষিত, অনেক গুণের অধিকারী। বিভিন্ন কাজে অভিজ্ঞ, সে হয়ত আমার চেয়ে কম, তাই বলে আমি তাকে কটাক্ষ করছি না তো!

একটি পরিবারে অনেকজন নারী থাকে। আমি হয়ত সেই পরিবারের গৃহকর্ত্রী। এখন আমি কী আচরণ করছি তাদের সাথে! নিজেকে সবার উপরে কর্তৃত্ববান মনে করে তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করছি না তো! যে একটু কর্মে অপটু, বুঝবুদ্ধি কম তাকে সর্বদা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখছি না তো! সবার সামনে তার বিভিন্ন অপটুতা এবং বুঝবুদ্ধির কমতির কথা বলে তাকে লজ্জিত করছি না তো!

আমাদের ঘরে যখন নতুন কোনো মেয়ে আসে, যেমন, আমার পুত্রবধু- তার সাথে আমি কেমন আচরণ করি! নতুন মানুষ হিসেবে আমার ঘরে তার অনেক ভুলত্রুটি হতে পারে। সে হয়ত শুরুতেই এই ঘরের অনেক বিষয় ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারবে না বা বুঝতে সময় লাগবে। আমাকে তখন তার সহযোগিতা করতে হবে। তাকে সাহস দিতে হবে। কিন্তু তা না করে আমার ঘরে পা দেওয়ার সাথে সাথেই আমি তার দোষত্রুটি ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি না তো! তার পরিবার পরিজন নিয়ে নানান নেতিবাচক কথা বলে তার মনে আঘাত করছি না তো! বিভিন্নভাবে তার মনে আমার সম্পর্কে ভীতিকর ধারণা সৃষ্টি করছি না তো! তার মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করছি না তো!

আমি যদি ভাবি আমি ছেলের মা। সমাজে মেয়ের মায়ের চেয়ে ছেলের মায়ের কদর বেশি। মেয়ের মায়ের উপর ছেলের মায়ের প্রভাবও থাকে বেশি। তাই আমার মনোরঞ্জনের জন্য, আমার সন্তুষ্টির জন্য মেয়ের সাথে সাথে মেয়ের মাকে ও পরিবারকেও দিনরাত সচেষ্ট থাকতে হবে। আমার চাহিদা মতো আচরণ তাদের থেকে না পেলে মেয়েকে এবং তার পরিবারকে যা খুশি আমি করতে পারব, বলতে পারব। আর তারা মেয়ের পরিবার হিসেবে বিনাবাক্যে তা মেনে নিবে- এটি জুলুম। আমি সেই জুলুম তাদের সাথে করছি না তো!

তেমনিভাবে আমার ভ্রাতৃবধূর সাথে, তার পরিবারের সাথে এমন আচরণ করছি না তো! পিতৃগৃহে যখন বেড়াতে আসি, তার কাছে অযথা অন্যায় আবদার করছি না তো! তার কোনো আচরণ আমার মনমতো না হলে তার উপর মানসিক কোনো চাপ সৃষ্টি করছি না তো! তাকে নিয়ে নানান কু-কথা বলে তার প্রতি সবার মন বিষিয়ে তুলছি না তো!

আবার আমি যদি বধূ হয়ে থাকি তাহলে আমি কি আমার স্বামীর পরিবারের সাথে সুন্দর আচরণ করছি? তাদের শ্রদ্ধার নজরে দেখছি? তাদের উপর অন্যায় অসঙ্গত কোন কর্তৃত্ব চালাচ্ছি না তো! স্বামীর অন্তরে তার মা-বাবা, ভাই-বোন সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণা সৃষ্টি করছি না তো! তাদের প্রতি কুধারণা সৃষ্টি করে তার মাঝে এবং পরিবারের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করছি না তো! তার পরিবার যদি ভেবে থাকে, আমার সাথে যেমন খুশি তেমন ব্যবহারের সুযোগ তাদের রয়েছে, তা যেমন ভুল হবে, তেমনি আমি যদি ভেবে থাকি, তার সাথে আমার বিবাহের কারণে তার উপর একমাত্র আমার অধিকার থাকবে- তাও তেমন ভুল হবে। তাই তার উপর সেই অধিকারের দোহাই দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে তাকে যদি তার মা-বাবা, ভাই-বোন থেকে আলাদা করে দেই, তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ জুলুম। আমি সেই জুলুমে লিপ্ত নই তো!

আমার ঘরে হয়ত কাজের মানুষ আছে। তার সাথে আচরণের ব্যাপারে আমি কতটুকু সতর্ক! তার সাথে জুলুম না করার ব্যাপারে তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুশয্যায়ও তাকীদ দিয়ে গেছেন। তার ঘাম শুকানোর পূর্বেই তাকে তার ন্যায্য পাওনা দিয়ে দিতে বলেছেন। তার ভুলত্রুটিগুলো সত্তর বার মাফ করার কথা বলেছেন। তো আমি কি পালন করছি আমার প্রিয় নবীজীর অসিয়তগুলো। নাকি তার বিপরীত করছি? আমাকে ভাবতে হবে, সেও আমার মতোই রক্তমাংসে গড়া মানুষ। তার শরীরও আমার শরীরের মতো। হৃদয়টাও আমার হৃদয়ের মতো। সুতরাং আমার শরীর এবং হৃদয়ের সাথে আমি যেমন আচরণ করি, সেগুলোর ব্যাপারে আমি যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করি, তেমন আচরণ ও সতর্কতা তার ক্ষেত্রেও জরুরি। তার মাঝে আর আমার মাঝে পার্থক্য তো এতটুকুই, আমাকে আল্লাহ সচ্ছল পরিবারে জন্ম দিয়েছেন আর তাকে দিয়েছেন অসচ্ছল পরিবারে। সেই সুবাদে আমি পরিবারের মাঝে থাকতে পারছি। আমার চাহিদামতো সব পাচ্ছি। পড়ালেখা করে শিক্ষিত হতে পারছি। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে তাকে আমার বাসায় কাজ করতে হচ্ছে। পড়ালেখার ইচ্ছে থাকলেও পারছে না। কিন্তু সে আমার বাসার খাদেমা হলেও তাকে আমার মুসলিম বোন মনে করতে হবে। তার সাথে কোমল ও ইনসাফের আচরণ করতে হবে। তা না করে তার সাথে আমি পাশবিক আচরণ করছি না তো! সাধ্যের বাইরে কাজ দিয়ে তার উপর চাপ সৃষ্টি করছি না তো! ঠিকঠাকভাবে কাজ না করতে পারলে তাকে বকাঝকা, গালমন্দ, শারীরিক নির্যাতন করছি না তো! আমি উৎকৃষ্ট মানের খাবার খেয়ে তাকে বাসি পচা খাবার খেতে দিচ্ছি না তো! জামা কাপড় কেনার সময় আমার জন্য সুন্দর দামী পোশাক কিনছি আর তার জন্য যাচ্ছেতাই নিম্নমানের পোশাক কিনছি না তো! আমি খাটে শুয়ে তাকে মেঝেতে অথবা রান্না ঘরে গরমের মাঝে শুতে দিচ্ছি না তো! দিনরাত তাকে একের পর এক কাজে ব্যস্ত রেখে তার বিশ্রাম, ঘুম, বিনোদনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছি না তো! সে পড়তে চাইলে বা পড়ার মেধা থাকলে তাকে পড়তে বাধা দিচ্ছি না তো!

সবার সাথে মুআমালার ক্ষেত্রে আমাকে এভাবে একেক করে মুহাসাবা করতে হবে। আমাকে প্রতিটি মুহূর্ত সতর্ক থাকতে হবে। আমার কারণে কেউ জুলুমের শিকার হচ্ছে না তো! আমার জীবনের পণ হোক- আমি কাউকে কখনো কষ্ট দিব না। কারো উপর জুলুম করব না। কারণ, জুলুম এমন এক বিষয়, যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব কিয়ামতের দিন আমাকে দিতে হবে। জুলুমের কারণে আমার নেকীগুলো সেদিন মাজলুমদেরকে দিয়ে তাদের পাপগুলো আমার উপর চাপিয়ে আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। কতটুকু নেক আমলই বা আমি করতে পারছি, তাও যদি এভাবে বরবাদ হয়ে যায়, তাহলে আমার কী হবে? আমি তো তখন সত্যিই নিঃস্ব, চিরনিঃস্ব। কারো জুলুম বা পাওনা নিয়ে যেন আমাকে কিয়ামতের মাঠে হাজির হতে না হয়; আল্লাহ আমাকে হেফাজত করুন- আমীন।

 

 

 

advertisement