রজব ১৪৩৯   ||   এপ্রিল ২০১৮

সুস্থতা-অসুস্থতা : দুটি নিআমত

হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী রাহ.

কখনো কখনো ছোট একটি ঘটনাও মানুষের জন্য উপদেশের অনেক বড় বার্তা নিয়ে আসে। আমার ব্যস্ততা কিংবা অলসতার দরুন বায়্যেনাত (মাসিক পত্রিকা) তৈরি হয়ে প্রেসে যেতে সবসময় দেরি হয়ে যায়। যিলকদ সংখ্যাটি প্রেসে গিয়েছে যিলকদের প্রথম দিকে। তাই এবার সঙ্গীদের বলেছিলাম, যিলহজ্ব সংখ্যাটিও যেন একসাথে আট-দশ দিনের মধ্যেই তৈরি করে ফেলা হয়। এ সময় অন্য সকল ব্যস্ততা বন্ধ। বিলম্বের এ ধারা যেন এখানেই শেষ হয়।

এটা সম্ভবত ২ যিলকদ বৃহস্পতিবারের ঘটনা। ৩ যিলকদ জুমার দিন গোসল করার সময় ডান কানের নিচে সামান্য ব্যাথা অনুভূত হল। পিঁপড়ার কামড়ের মতো। চিন্তার দূরতম সীমায়ও একথা আসেনি যে, এটা কোনো কঠিন অসুস্থতার পূর্বাভাস। জুমা পড়া হল। জুমার পর অভ্যাস অনুযায়ী খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ কাইলুলাহ। আসরের পূর্বে শরীরের তাপ একটু একটু বাড়তে থাকে। সাথে অবসাদ আর ক্লান্তি। বাদ আসর জিকিরের মজলিসে আর শরিক হতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু অলসতাকে প্রশ্রয় দিলাম না। অযু করে অভ্যাস অনুযায়ী জিকিরের মজলিসে শরিক হওয়ার জন্য মাদরাসায় চলে গেলাম। সেখান  থেকে মাগরিবের পূর্বে গেলাম আল ইখওয়ান মসজিদে। (জুমার দিন বাদ মাগরিব সেখানে দরসে কুরআন হয়।) দরস শেষ করে গাড়ীতে পৌঁছার আগেই শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি শুরু হল। খুব কষ্টে বাসায় এলাম। শরীর কাঁপার সাথে শুরু হল প্রচণ্ড জ্বর। কানের নিচে যেখানে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছিল সে জায়গাটা ফুলে গেল। ফোলাভাব ২/৩ দিনের মধ্যে ছড়িয়ে গেল সমস্ত ঘাড়ে। কানে বড় বড় ফোড়া দেখা দিল। পানি পড়তে লাগল সেখান থেকে। এমন জ্বালা হচ্ছিল যে, কোনো দিকেই পাশ ফিরতে পারছিলাম না। জ্বর ছিল একশ চার-পাঁচ ডিগ্রি। মনে হচ্ছিল গরম চুলায় জ্বলছি। অস্থিরতা ও অশান্তির কোনো শেষ ছিল না।

ডাক্তার জ্বরের ঔষধ দিল। তাতে এ পরিমাণ ঘাম হচ্ছিল যে, দৈনিক তিন-চারবার ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মোছা হত। এরপরও জ্বরের তীব্রতা কমত না। অনবরত কয়েক রাত এক ফোটাও ঘুম হয়নি। পনের দিন এভাবেই বিছানায় পড়ে রইলাম। রোগের কারণে একদম দুর্বল হয়ে গেলাম। আল্লাহ তাআলার লাখো শুকরিয়া তিনি নিজ দয়া ও অনুগ্রহে পুনরায় সুস্থতা দান করেছেন। আমি যেন নবজীবন লাভ করেছি।

বাহ্যিকভাবে এটা খুব সামান্য একটি ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটছে। আলোচনা করার মত গুরুত্বপূর্র্ণ বিষয় না। কারণ উদ্ঘাটন কিংবা এ থেকে কোনো ফলাফল বের করার প্রয়োজনীয়তাও হয়তো মনে হবে না অনেকের কাছে। কিন্তু এই সামান্য ঘটনাটি অসামান্য উপদেশের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছিল আমার জন্য। শারীরিকভাবে যেমন প্রভাবিত হয়েছিলাম তেমনি চিন্তা-চেতনায় এবং মন-মস্তিষ্কে গভীর রেখা অংকন করেছিল ঘটনাটি। পাঠকের সামনে সেই অনুভূতিগুলো কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

* * *

সুস্থতা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصّحّةُ وَالْفَرَاغُ.

দুটি নিআমতের ক্ষেত্রে অনেক মানুষ ধোঁকার মধ্যে রয়েছে : ১. সুস্থতা  ২. অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪২২

অনেক মানুষ ধোঁকার মধ্যে থাকার অর্থ হল, প্রথমত এই দুই নিআমত সাধারণত একসাথে লাভ হয় না। অনেক মানুষ সুস্থ, কিন্তু তার অবসর নেই। আবার অনেকে অবসর, কিন্তু সুস্থ নয়। আর কারো ভাগ্যে যদি উভয় নিআমতই একসাথে মিলে যায় তবে এর প্রকৃত মূল্যায়ন খুব কম মানুষই করে থাকে; বরং অযথা কাজকর্মে এ দুই নিআমত নষ্ট হয়ে যায়।

অসুস্থতাও আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। বিভিন্ন হাদীসে রোগ-শোক ও বালা-মসিবতেরও তাৎপর্য ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অসুস্থতা দেহের যাকাত স্বরূপ। এর দ্বারা শরীর গুনাহমুক্ত হয়, পাক-পবিত্র হয়। আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা বুলন্দ হয়। ভবিষ্যত জীবনের জন্য উপদেশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়।

জামে তিরমিযীর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কিয়ামতের দিন বিপদগ্রস্ত লোকদেরকে যে মহা পুরস্কার দেয়া হবে তা দেখে আফিয়াতের অধিকারী লোকেরা কামনা করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি তাদের দেহ কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হত (আর তার বিনিময়ে আখেরাতের এ মহা পুরস্কার লাভ হত) -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪০২

অসুস্থতার সময় নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা মানুষের কাছে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে। শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, আভ্যন্তরীণ প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার মিথ্যা অহমিকা অনেকেরই আছে। কোনো অভিনব সৃষ্টিশীল কাজ করে নিজের দিকে তা সম্পৃক্ত করে পুলক অনুভব করার মানসিকতা আছে সবারই। কখনো কোনো বড় কাজ করতে পারলে বুদ্ধির অপরিপক্কতা ও অপূর্ণতার দরুন উজ্ব ও অত্মমুগ্ধতার শিকার  হয়ে যায় অনেকেই। কখনো এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, ব্যক্তি নিজেকেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক ও সর্বেসর্বা মনে করে বসে। অথচ মানুষ এতটাই দুর্বল ও অক্ষম যে, তাকে পরাভূত করার জন্য ছোট্ট একটা পাখীই যথেষ্ট।

অধিকাংশ সময়ই মানুষ ভুলে যায় যে, তার শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, প্রতিভা ও যোগ্যতা তার নিজের ক্ষমতাবলে পাওয়া নয়; বরং তা মালিকের দান। তিনি দিয়েছেন। চাইলে আবার ছিনিয়েও নিতে পারেন। তাছাড়া মানুষের শক্তি, সুস্থতা ও যোগ্যতার ব্যবহারও আল্লাহ তাআলার দয়া ও তাওফীকের উপর নির্ভরশীল। মানুষের কৃত কল্যাণকর কাজ নিজের শক্তিবলে নয়; বরং দয়ালু ও মহান প্রতিপালকের দয়া ও করুণার কারণেই সম্পাদিত হয়। যদি এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তাওফীকের ছায়া উঠিয়ে নেন তাহলে মানুষ এক পাও উপরে উঠাতে পারবে না। যেমনিভাবে বিদ্যুৎ ছাড়া কারখানার সকল মেশিন অচল পড়ে থাকে তেমনিভাবে আল্লাহর দয়া ও তাওফীক ছাড়া মানুষের সকল প্রতিভা ও যোগ্যতা অচল পড়ে থাকবে। মানুষের অস্তিত্ব, শারীরিক-আত্মিক সকল শক্তি ও প্রতিভা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ  তাআলার হেফাযত ও তত্ত্বাবধানের মুখাপেক্ষী। তিনি যদি হেফাযতের কুদরতি চাদর একটুখানি উঠিয়ে নেন তাহলে মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সকল প্রতিভা ও যোগ্যতা মূল্যহীন হয়ে পড়বে। মানুষ দুর্বল কোনো পাখী কিংবা কীট-পতঙ্গ থেকেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে না।

قُلْ مَنْ یَّكْلَؤُكُمْ بِالَّیْلِ وَ النَّهَارِ مِنَ الرَّحْمٰنِ.

বল, রাতে ও দিনে দয়াময় ছাড়া আর কে তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে।-সূরা আন্বিয়া (২১) : ৪২

মোটকথা মানুষের সবকিছুই মহান মালিকের দান। মানুষ যেমন নিজের অস্তিত্বের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী তেমনি নিজের হেফাযত ও নিরাপত্তা এবং বাহ্যিক ও ভেতরগত সকল শক্তির সঠিক ব্যবহারের জন্যও তাঁর মুখাপেক্ষী।

মানুষের সকল গুণই অপসৃয়মান। এখন হয়ত আছে কিছুক্ষণ পর আবার দূর হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অক্ষমতা, দুর্বলতা ও মুখাপেক্ষিতা মানবজীবনের এমন অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা এক মুহূর্তের জন্যও দূর হয় না। প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে এ বিশ্বাস থাকলেও বিশ্বাসের উপলব্ধি জাগরুক নেই অনেকের মাঝেই।

* * *

হযরত আরেফ বিল্লাহ ড. আবদুল হাই রাহ. অনেক সময় বলতেন, আমলকে যদি নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত কর তাহলে এর জন্য পস্তাতে হবে তোমাকে। যদি নেক আমল কর তাহলে তো উজ্ব ও গর্বে ফুলে উঠবে। আর যদি আমলের মধ্যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তাহলে হতাশ হয়ে আমলের হিম্মতই হারিয়ে ফেলবে। হযরত বলতেন, সবসময় আমলকে আল্লাহ্র দিকে নিসবত কর। তাঁর দান এবং ইহসান মনে কর। এতে মনে কখনো আত্মগর্ব জাগবে না। আবার কখনো হতাশও হবে না। কোনো কামাল বা  পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি গেলে সাথে সাথে শুকরিয়া আদায় করে বল-

الحمد لله، اللهُم لَكَ الْحَمْدُ ولك الشكر.

হে আল্লাহ! আপনার শুকরিয়া, আপনি এ মহা নিআমত আমাকে দান করেছেন। আর যদি কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলেও মালিকের দান মনে করে তার সঠিক মূল্যায়ন করবে।

পবিত্র কুরআনের ইরশাদ-

وَ اِنْ تَعُدُّوْا نِعْمَتَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا  اِنَّ الْاِنْسَانَ لَظَلُوْمٌ كَفَّارٌ.

তোমরা আল্লাহ্র নিআমত গণনা করে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ অকৃতজ্ঞ ও নাফরমান। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৪

শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, ‘আল্লাহ তাআলার  নিআমত এত অসংখ্য যে, যদি তোমরা সবাই মিলে ভাসাভাসাভাবেও গণনা  শুরু কর তাহলেও ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বে। শেষ অংশের ব্যাখ্যায় বলেন- ‘মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অকৃতজ্ঞ ও জালেম ঐ ব্যক্তি, যে এত অসংখ্য  নিআমত দেখেও নিজের প্রকৃত ও মহান দাতার হক সম্পর্কে সচেতন হয়নি।

আমরা আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায়ের ক্ষেত্রে কত অক্ষম! তাঁর একটি নিআমতের শুকরিয়াও আমাদের পক্ষে যথাযথভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। শুধু আফিয়াতের নিআমতের কথাই চিন্তা করুন। কত বিস্তৃত এই নিআমাত! কত অসংখ্য তার শাখা-প্রশাখা। এই অসংখ্য শাখা-প্রশাখার অধিকাংশের ক্ষেত্রেই আমাদের মনে হয় না যে, এরও শুকরিয়া আদায় করা উচিত।

প্রতিটি মুহূর্তে আমরা কত নিআমতের মধ্যে ডুবে আছি। অনেক নিআমতের দিকে তো মানুষের দৃষ্টি যায় এবং কিছু না কিছু হলেও শুকরিয়া আদায় করে। কিন্তু লাখো-কোটি নিআমত এমন, যা মানুষের উপলদ্ধি- সীমারও বাইরে; সেগুলোর শুকরিয়া আদায় হবে কীভাবে? আমাদের এই দেহযন্ত্রের প্রতিটি অংশের জন্যই কি আলাদা আলাদাভাবে শুকরিয়া করা উচিত নয়? কিন্তু আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যার দেহের কোনো একটি অঙ্গের সুস্থতা ও আফিয়াতের জন্য সার্বক্ষণিক শুকরিয়া আদায়ের সৌভাগ্য হয়েছে।

দিনের তুলনায় রাতের বেলা রোগের কষ্ট ও তীব্রতা সাধারণত বেড়ে যায়। এর কারণ এটা হতে পারে যে, দিনের কোলাহল ও কর্মের আয়োজনে অসুস্থতার প্রতি রুগীর মনযোগ থাকে না। কিন্তু যখন সকল আয়োজন ও কর্মচাঞ্চল্য শেষ হয়ে যায় তখন রাতের নির্জনতায় অসুস্থ ব্যক্তির সকল মনোযোগ নিবদ্ধ হয় রোগের প্রতি। তাই কষ্টের অনুভূতিও তখন বেড়ে যায়। আরেকটি কারণ এ-ও হতে পারে যে, রাত হচ্ছে বিশ্রামের সময়। এজন্য স্বভাবগতভাবেই মানুষ রাতের বেলা একটু আরাম ও বিশ্রাম করতে চায়। তবে অসুস্থতা এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে কষ্টের অনুভূতিও দ্বিগুণ হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ- এক ব্যক্তি সুস্থ। শারীরিক কোনো রোগ তার নেই। সে ঘুমাতে চাচ্ছে। কিন্তু অন্য একজন তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে না। অনবরত কয়েক রাত এভাবেই কেটে গেল। সে হয়তো অসুস্থ নয়। কোন ব্যথা-বেদনাও নেই তার শরীরে। কিন্তু বিশ্রাম না করতে পারাটা তার জন্য অনেক বড় কষ্টের ব্যাপার। এখন যদি ব্যথা-বেদনার পাশাপাশি বিশ্রামের আনন্দ থেকেও বঞ্চিত থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এতে রোগীর কষ্ট আরো বেড়ে যায়। এসব কারণে রাত আসার কল্পনাই অসুস্থকে অস্থির করে তোলে। হায় আল্লাহ! রাত কাটাব কী করে!

রাতের বেলা যে বিষয়টি আমার গভীরভাবে উপলদ্ধি হত এবং আমার দুর্বলতা অস্থিরতা, মানসিক কষ্ট ও বেচাইনি আরো বাড়িয়ে দিত, তা হল, এটা তো আমার সেই পরিচিত ঘর, বছরের পর বছর যেখানে আমি  আছি; সেই পরিচিত বিছানা, সবসময় যেখানে আমি বিশ্রাম করি। এখানে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আছে, ঔষধ আছে, খাবার আছে। সেবার জন্য মানুষ আছে। এরপরও শুধু রাতের অন্ধকার ও নির্জনতা আমার রোগের প্রকোপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাহলে কবরের অন্ধকার ও নির্জনতায় কী পরিমাণ অস্থিরতা ও একাকিত্ব বোধ হবে। সেখানের সবকিছুই তো অপরিচিত। সেই জগৎ। সেই জায়গা। সেই মাটির বিছানা। যেখানে শোয়ার সুযোগ আর কখনো হয়নি। সেখানে আপন কেউ নেই। কোনো  সেবক নেই। কোনো পরিচিতজন নেই। নেই কোনো সহমর্মী। রাতের নির্জনতা ও অন্ধকার যখন মনের মাঝে এ পরিমাণ অস্থিরতা ও বেকারারী সৃষ্টি করে তাহলে কবরের নির্জনতা, অন্ধকার ও একাকিত্ব কীভাবে সহ্য হবে। আর (নাউযুবিল্লাহ, ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ) ঐখানে যদি কোনো কষ্টের, কোনো শাস্তির সম্মুখীন হই তাহলে বাঁচার কী উপায় হবে? খুব অস্থির হয়ে বার বার اللهم آنس وحشتي في قبري

দুআটি পড়তাম। সেইসাথে গভীরভাবে উপলদ্ধি হত- শুধু আল্লাহর সাথে হৃদয়ের সম্পর্কই তো কাজে আসবে কবরে। এই সম্পর্ক যাদের নসীব হয়েছে, কোথাও কোনো অবস্থাতেই তাদের নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ববোধ হয় না। কিন্তু আমরা তো মাখলুককে মন দিয়ে দিয়েছি। তার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। যদি মাখলুকের সাথে নয়, আল্লাহর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হত তাহলে কবরের নিঃসঙ্গতার আশংকা আর মনে জাগত না। মোটকথা, অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রাতের নির্জনতা উপদেশ গ্রহণের বার্তা নিয়ে আসে। কবরের একাকিত্বের চিন্তা মনের মাঝে জাগিয়ে তোলে।

* * *

অসুস্থতা হচ্ছে মৃত্যুর কিনারা। অসুস্থ ব্যক্তি যখন রোগযন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে তখন একটি মাত্র ধাক্কাই যথেষ্ট জীবন- নৌকা থেকে মৃত্যুর নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য। জীবনসায়াহ্নের মুহূর্তটাকে ‘জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ’ বলার ভুল একটা প্রচলন সমাজে আছে। অথচ জীবন আর মৃত্যুর মাঝে কোনো যুদ্ধ হয় না। মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ে এসে জীবন প্রদীপকে এক ফুৎকারে নিভিয়ে দেয়। হ্যাঁ, এটাকে আশা ও নিরাশা, শংকা ও সম্ভাবনার যুদ্ধ বলা যেতে পারে।

বারবার মনে জাগছিল, রোগের প্রকোপ যদি আরেকটু বেড়ে যায় তাহলে এখনি হয়তো আমার মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যুর পর আশপাশের সবাই, আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার স্ত্রী-পুত্র, আমার পরিবার-পরিজন, এই বিশাল পৃথিবীর মানুষেরা আমার কী উপকার করতে পারবে?! আমার সামনে তো তখন আখেরাত, শুধুই আখেরাত। যে আমল শুধু আখেরাতের জন্য করা হয়েছে তাই শুধু কাজে আসবে। দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল ধান্দা মরুভূমির মরীচিকা। মিথ্যা প্রহেলিকা। এতে বিভোর হয়ে আখেরাত ভুলে যাওয়া কত বড় মূর্খতা! কত বড় নির্বুদ্ধিতা! আফসোস! আমরা সবাই এই নির্বুদ্ধিতার মাঝেই ডুবে আছি।

মানুষ খুব দ্রুত অতীতের কথা ভুলে যায়। পবিত্র কুরআনেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে-

وَ اِذَا مَسَّ الْاِنْسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنْۢبِهٖۤ اَوْ قَاعِدًا اَوْ قَآىِٕمًا  فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُ ضُرَّهٗ مَرَّ كَاَنْ لَّمْ یَدْعُنَاۤ اِلٰی ضُرٍّ مَّسَّهٗ .

মানুষকে যখন বিপদ স্পর্শ করে তখন শুয়ে-বসে-দাঁড়ানো অবস্থায় আমাকে ডাকতে থাকে। আর যখন তাকে বিপদ মুক্ত করে দেই তখন এমনভাবে চলে যায় যেন সে বিপদে পড়ে আমাকে ডাকেইনি। -সূরা ইউনুস (১০) : ১২

শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী রাহ.  এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন- ‘অর্থাৎ মানুষ মূর্খতাবশত নিজেই আযাব চাইতে থাকে, কিন্তু যখন বিপদের সামান্য ঝাঁকুনি খায় তখন হতবিহ্বল হয়ে আমাকে ডাকা শুরু করে। মসিবত যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর যখন বিপদ সরিয়ে নেয়া হয় তখন সবকিছু ভুলে যায়। তখন আর আল্লাহর কথা মনে থাকে না। সেই গাফলত, সেই উদাসিনতা, সেই পাপাচারে আবার মেতে ওঠে। ইতিপূর্বে যেগুলোর মাঝে সে আকণ্ঠ ডুবে ছিল।

সুখের অবস্থায় তুমি আল্লাহকে স্মরণ কর, বিপদের অবস্থায় তিনি তোমাকে স্মরণ করবেন।

মুমিনের শান হল, সে কখনো আল্লাহকে ভুলে যায় না। বিপদ-আপদে সবর করে আর সুখে-শান্তিতে শোকর করে। মুমিন ছাড়া এই সৌভাগ্য আর কারো ভাগ্যে জুটে না।

আমাদের অনেকেই বিপদ-আপদ ও অসুস্থ অবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে খুব ডাকতে থাকে। মান্নত করে, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে, জীবন ধারা বদলে ফেলার সিন্ধান্ত নেয়। আর যখন বিপদ-মুক্ত হয়ে যায় তখন সব অঙ্গীকার, সব প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়। জীবনটাকে আর বদলানো হয় না। অসুস্থাবস্থায় মুখে যিকিরের যে জীবন্ত উচ্চারণ ছিল, দুআ ও ইনাবাত ইলাল্লাহ্র মাধ্যমে হৃদয়ে যে স্বাদ ও সজীবতার অনুভব ছিল, মনের মাঝে আখেরাতের যে জাগ্রত উপস্থিতি ছিল, সুস্থ হওয়ার পর তার কিছুটা ছোঁয়া, কিছুটা ছায়া থাকলেও দিলের সেই কাইফিয়াত, হৃদয়ের সেই স্বাদ ও সজীবতা আর নেই।

এতে মনের মধ্যে ব্যথা অবশ্যই আছে। তবে গাফলতের এ সামান্য ছায়াপাতও আল্লাহ পাকের অনেক বড় নিআমত। কারণ, আমাদের মত দুর্বলদের জন্য আল্লাহ তাআলার সার্বক্ষণিক স্মরণ সাধ্যের বাইরে। তবে হ্যাঁ, পিছনের অবস্থা একদম ভুলে যাওয়া, সুস্থ হওয়ার পর শুকরিয়া আদায়ের পরিবর্তে অকৃতজ্ঞ হওয়া এবং অতীতের মত আবার পাপাচারে ডুবে যাওয়া- এ ধরনের গাফলত খুবই নিন্দনীয়। পবিত্র কুরআনে এর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ ধরনের গাফলত ও উদাসীনতা থেকে আমাদের রক্ষা করুন।

হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. -এর কাছে সংবাদ এল, তার অমুক ভাই মারা গেছে। পরবর্তীতে জানা গেল, খবরটি ভুল। সে ভাই এখনো জীবিত আছে। ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহ. তখন তার ভাইকে চিঠি লিখলেন, প্রথম সংবাদটি যদিও ভুল ছিল, তবুও আমরা তোমার ব্যাপারে মনে করি, মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলা তোমাকে আবার দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যেন প্রথম জীবনের ভুল-ত্রুটির সংশোধন তুমি করতে পারো। তাই তোমার কর্তব্য, নবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গণীমত মনে করে তা অহেতুক কাজকর্মে নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে।

কঠিন রোগ-ব্যাধি ও অসুস্থতা থেকে সুস্থ হওয়ার পর মনে মনে এ ধারণাই করা উচিত, আমি মারা গিয়েছিলাম। আল্লাহ তাআলা দয়া ও অনুগ্রহবশত আমাকে পুনরায় জীবন দান করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে বেশি থেকে বেশি ফলপ্রসূ বানানোর চিন্তা করা উচিত।

[অনুবাদে  : শাহাদাত ছাকিব]

 

 

 

advertisement