রজব ১৪৩৯   ||   এপ্রিল ২০১৮

সিরিয়া : বিধ্বস্ত মানবতার বীভৎস রূপ

মুহাম্মাদ খালিদ

মুহাম্মাদ বূআযীযী যখন গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলেন তখন কি তিনি জানতেন তার এই আত্মাহুতি বিশ্ব রাজনীতিতে কতটা প্রভাব বিস্তার করবে? বূআযীযী ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পাশ করা বেকার, যিনি চাকুরি না পেয়ে ফুটপাতে সবজি বিক্রি শুরু করেছিলেন। পুলিশ তার গাড়ি এবং ওজন মাপার ইলেকট্রিক যন্ত্র কেড়ে নিয়েছিল, দুর্ব্যবহারও করেছিল। ক্ষোভে-দুঃখে তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং জনসমক্ষে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। তার শরীরের এই আগুন যে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তা বূআযীযী দেখে যেতে পারেননি। সেই আগুনে মিশর পুড়েছে, পুড়েছে লিবিয়া, পুড়ছে ইয়েমেন আর এখনো জ¦লছে নবীদের পুণ্যভূমি সিরিয়া।

 

যেখান থেকে যুদ্ধ

সিরিয়া প্রসঙ্গ অবতারণার আগে আরব বসন্তের প্রেক্ষাপটে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া দরকার। বর্তমান উত্তর আফ্রিকার মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে উসমানী খেলাফতের অধীনে ছিল। পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রে ১৯২৪ সালে উসমানী খেলাফতের পতনের আগ-পরে এই অঞ্চলগুলো নিজেদের মত করে আলাদা হয়ে যায় এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আকৃতি লাভ করে। এই আরব দেশগুলোর অবস্থা তখন স্থিতিশীল ছিল না। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে তারা ছিল জর্জরিত। এরপর ধীরে ধীরে দেশগুলোতে একনায়কেরা বসে যান। কেউ বাদশাহ, কেউ প্রেসিডেন্ট, কেউ একদলীয় শাসনতন্ত্রের প্রধান, কেউ সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতায় বসলেও সবার শাসনপদ্ধতি ছিল একই। একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিতে এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিচালিত হত পুরো রাষ্ট্র।

বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে নজর বুলালে দেখা যায়, মিশরে হোসনি মোবারক, তিউনিসিয়ায় বেন আলি, ইরাকে সাদ্দাম হোসাইন, লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফি, ইয়েমেনে আলি আব্দুল্লাহ সালেহ এবং সিরিয়ায় হাফিজ আলআসাদের মত ব্যক্তিরা অনেকটা একনায়কের মত যুগ যুগ ধরে দেশগুলো শাসন করেছে।

উল্লেখিত দেশগুলোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য আরব দেশেও সেসময় ইসলামী খেলাফত যেমন ছিল না, তেমনি প্রচলিত ধারার গণতন্ত্রও সেখানে ছিল অনুপস্থিত। ফলে জনগণের মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না। তেল-বিপ্লবের পর লিবিয়া, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, সৌদির মত কয়েকটি দেশে সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধার উন্নয়ন ও জনগণের আর্থিক সমৃদ্ধি হলেও অন্যান্য দেশ আগের অবস্থাতেই পড়ে ছিল। ভুল রাষ্ট্রনীতি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলিম স্বার্থবিরোধী কাজকর্ম, বিশেষত ফিলিস্তিন ইস্যুতে শাসকদের ব্যর্থতায় জনগণ মনক্ষুণœ ছিল। পাশাপাশি প্রত্যেক দেশেই শাসক পরিবারের সীমাহীন সম্পদ-ভোগবিলাস- দুর্নীতি এবং কঠোর হস্তে বিরোধী মতকে দমন করার মত বিষয়গুলো বৃহৎ জনসাধারণকে বিষিয়ে তুলেছিল। অধিকাংশ দেশেই রাজনৈতিক দল বা সংগঠন করার সুযোগ নেই। ফলে সরকার যত বড় ও বিতর্কিত কাজই করুক না কেন জনগণের কিছুই বলার সুযোগ ছিল না। বিরোধী মতের লোকদের প্রকাশ্যে গ্রেফতার বা গোপনে গুম করে ফেলা হত। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলেও সেই ক্ষোভ প্রকাশের মত দল বা সংগঠন তাদের ছিল না। একাকী মানুষের পক্ষে তো কিছু করা সম্ভব না।

দীর্ঘদিন ধরে সরকারি নিপীড়ন আর অচল জীবনব্যবস্থায় ত্যক্ত বিরক্ত বূআযীযী যখন পুলিশের হাতে নিজের জীবিকার শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে আত্মাহুতি দিলেন তখন টনক নড়ল জনগণের। নিরীহ যুবকের নির্মম মৃত্যু নাড়া দিল তিউনিসিয়ার অসংখ্য মানুষকে। ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার মানুষগুলো ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজপথে নেমে এল। বহুদিন তারা সহ্য করেছে। এই একটা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তারা নিজেদের ভেতরে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে রাজপথে এসে উগরে দিল। শেষমেশ তারা বেন আলীর সরকার পতনের ডাক দিয়ে বসল। এই ধরনের অপরিকল্পিত আন্দোলনের জন্য তিউনিসিয়া সরকার প্রস্তুত ছিল না। সচরাচর এমন আন্দোলন হয় না বিধায় এগুলো দমন করতেও তারা অভ্যস্ত ছিল না। সবমিলিয়ে প্রবল জনবিক্ষোভের মুখে জানুয়ারির ৪ তারিখে শাসক পরিবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে এবং বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ হাতিয়ে সৌদি পালিয়ে গেল।

তিউনিসীয় জনগণের এ অভূতপূর্ব সফলতা প্রবলভাবে উৎসাহিত করল অন্যান্য আরবদেশের জনগণকে। বূআযীযীর মত অন্যান্য রাষ্ট্রের আরো কিছু মানুষ আগুনে আত্মাহুতি দিল। এদের মধ্যে মিশরের দু’জন সাংবাদিকও আছেন। এই ঘটনাগুলো আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। প্রথমে মিশর এরপর একে একে বাহরাইন, ইয়েমেন, লিবিয়া, আলজেরিয়া ও সিরিয়ায় ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হল। মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সৌদি সরকার বেতন দুই থেকে তিন গুণ বাড়িয়ে দিল।

২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই মারমুখী বিক্ষোভে স্বৈরশাসকেরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কারণ বিগত বিশ-পঁচিশ বছরের ইতিহাসে মানুষ এভাবে কখনো রাস্তায় নেমে আসে নি। প্রবল বিক্ষোভে মিশরের হোসনি মোবারক এবং ইয়েমেনের আলী আব্দুল্লাহ সালেহ পদত্যাগ করলেন। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন ঘটল আট মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। কিন্তু সিরিয়া পড়ে গেল মহাসংকটে।

 

গৃহযুদ্ধের সূচনা

২০১১ সালের ২৬ শে জানুয়ারিকে সিরিয়ার মানুষ আজীবন মনে রাখবে। এই সময়েই যে তাদের বিপ্লবের সূচনা! বাথ পার্টির করাল গ্রাস থকে মুক্তি পেতে এ সময়েই শুরু হয়েছিল তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, উসমানী সালতানাত থেকে আলাদা হওয়ার অল্পকিছু দিন পরেই ফ্রান্স সিরিয়া দখল করে নিয়েছিল। সেখানে সুন্নী হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ৭৪ ভাগ, আলাবী ১২ ভাগ এবং খ্রিস্টান ১০ ভাগ। বিস্ময়করভাবে দেশের প্রধান সুন্নী জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে একেবারে সংখ্যালঘু শিয়া আলাবী সম্প্রদায়ের সাথে ফরাসীদের খাতির গড়ে উঠে এবং তাদের দিয়েই ফরাসিরা সিরিয়ার জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করে। পাশাপাশি এই শিয়াদেরকে তারা জাতীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসে। শেষতক এদের হাতেই দেশের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ফরাসিরা চলে যায়। এরপর আলাবী সম্প্রদায় বাথ পার্টির নাম নিয়ে ক্ষমতায় চেপে বসে। হাফিজ আলআসাদ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শাসন করে মৃত্যুবরণ করার পর তার ছেলে বাশার আলআসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করে। চলতি বছর তার ক্ষমতারোহণের দেড় যুগ পূর্ণ হতে যাচ্ছে।

কথিত আরব বসন্তের প্রেক্ষাপটে অন্যান্য আরবদেশে যে সমস্যাবলী ছিল তা সিরিয়াতেও বিদ্যমান। পাশাপাশি মাত্র ১০ ভাগ মানুষ পুরো দেশের ৯০ ভাগ মানুষকে জিম্মি করে অর্ধশতাব্দী ধরে শাসন ও দমন-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে- এটা সিরীয় আপামর জনসাধারণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। যুগের পর যুগ ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ মনের মধ্যে পুষে রেখে তারা একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিল। আরব বসন্ত তাদের সেই সুযোগ এনে দেয়।

আরব বসন্তে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথমে রাজধানী দামেস্ক এরপর গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ দারার জনগণ রাস্তায় নেমে আসাদ ও বাথ পার্টির ক্ষমতা ত্যাগের দাবি তোলে। ক্রমেই আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। একপর্যায়ে আসাদ সরকার বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে রাস্তায় ট্যাংক বহরসহ আর্মি নামিয়ে দেয়। এতে জনতা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং সরকারি বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। ইতিমধ্যে সিরিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর সাথে জনতার সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মৃত্যুর মিছিলের সাথে বাড়তে থাকে প্রতিবাদকারীদের ক্ষোভ। এমতাবস্থায় সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পাশাপাশি তুরস্কের এরদোয়ান সরকার তাদের দেশে আসাদ বিরোধীদের অফিস খোলার সুযোগ করে দেয়।

জুলাই নাগাদ সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ১৪০০ ছাড়িয়ে যায়। তা সত্ত্বেও বিক্ষোভে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনাবাহিনীর সাথে জনতার সংঘাত চরম আকার ধারণ করে। বাশার অনুগত সেনাবাহিনীতে সুন্নী যত সৈনিক ছিল তারা দলত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে যোগ দিতে শুরু করে। এতদিনে বিভিন্ন প্রদেশে বাশার বিরোধীরা মিলিশিয়া-যোদ্ধাবাহিনী তৈরি করে ফেলেছিল। বিদ্রোহী সৈন্যরা এসব গ্রুপকে একত্র করে ২০১১ সালের অক্টোবরে তৈরি করেন আলজাইশ আসসূরী আলহুর বা ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। সেনাবাহিনী এতদিন সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাংক চালিয়ে দিলেও এখন যুদ্ধ শুরু হয় সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সাথে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ইরান ও রাশিয়া বাশারের পক্ষে অবস্থান নেয়, বিপরীতে তুরস্ক, সৌদি, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে শুরু করে।

 

বাইরের শক্তির উপস্থিতি

এই প্রেক্ষাপটে সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর স্বার্থ ও পক্ষপাতের কারণ সামনে থাকা জরুরি। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সিরিয়াতে যে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে তা মূলত আগ থেকে চলে আসা বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণের অনিবার্য ফল। বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে আমেরিকা-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। সে মতে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে আমেরিকার রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। আরব শাসকদের গোলামির জালে বন্দী করে সেসব দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে আমেরিকা সে অঞ্চলে মোড়লগিরি করে। একমাত্র সিরিয়া এর ব্যতিক্রম। হাফিজ আলআসাদ এবং তদীয় উত্তরসূরী বাশার আলআসাদ আমেরিকার বলয়ে না গিয়ে রাশিয়া পক্ষে যোগ দিয়েছিল। সুতরাং সিরিয়া ছিল মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সর্বশেষ এবং একমাত্র ঘাঁটি। আমেরিকা দেখল আরব বসন্তের ঢেউয়ে সিরিয়ায় যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা এখন সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় যদি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে তাদের মাধ্যমে বাশারের পতন ঘটানো যায় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার সর্বশেষ আশ্রয়টুকুও শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং এটা তার সামনে সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দেখা দিল। বিপরীতে একই চিন্তা রাশিয়ার মাথাতেও আসল। বাশারের পরাজয় ঘটলে মধ্যপ্রাচের মত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সে তার সর্বশেষ মিত্রকে হারাবে। তাই যে কোনো মূল্যে বাশারকে ক্ষমতায় রাখতে হবে।

সিরিয়া যুদ্ধের পালামঞ্চে আমরা যে নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখি সেখানে আমেরিকা-রাশিয়ার পাশাপাশি আরো কিছু দেশকে অভিনয়ে দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে এখানে তাদের কী স্বার্থ? আঞ্চলিক রাজনীতি বলতে একটা ব্যাপার আছে। সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে তার আধিপত্য ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, ইরান সৌদির হেজাযভূমিসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য নিজেদের দখলে নিয়ে বৃহৎ শিয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। ইরানের এমন স্বপ্ন সৌদির জন্য মারাত্মক হুমকির ব্যাপার। এখানে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসতে পারে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে সিরিয়ার বাশার সৌদির প্রতিপক্ষ এবং ইরানের মিত্র।

দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালে দেখা যায় একপাশে সিরিয়া, তাদের পৃষ্ঠপোষক রাশিয়া, ইরান এবং লেবাননের সামরিক শিয়াগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। বিপরীতে সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী, তাদের সমর্থন যোগাচ্ছে আমেরিকা, ইসরাঈল, সৌদিআরব, তুরস্ক এবং তাদের মিত্ররা।

প্রথমদিকে আমেরিকা ও সৌদি মদদপুষ্ট সিরিয়ান বিদ্রোহীদের বাশার একাই সেনাবাহিনী দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল। তাতে বছর দেড়েক যুদ্ধের পর বাশার বাহিনী এতটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল যে, তাদের পতন সময়ের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল। এমতাবস্থায় আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর সর্বশেষ ঘাঁটিটি ধ্বংসের আনন্দে বিভোর ঠিক তখনই রাশিয়া সরাসরি সৈন্য, অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান নিয়ে মাঠে অবতীর্ণ হয়। ইরান থেকেও আসে বিপুল পরিমাণ সৈনিক ও অফিসার। এমনকি লেবাননের হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদেরও রণাঙ্গনে বাশারের পক্ষে লড়তে দেখা যায়। মিত্রদের এমন অভাবনীয় সহায়তায় বাশার বাহিনী আবার ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং দ্রুত যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে যায়। এই সময়টায় যুদ্ধ সবচেয়ে হিং¯্র ও মারাত্মক আকার ধারণ করে।

 

আইএস

এমন পরিস্থিতিতে আইএসের উত্থান সিরিয়া সংকটকে আরো জটিল করে তোলে। সাবেক আলকায়েদা নেতা আবু বকর বাগদাদি ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল ইরাকে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপর ক্রমেই তারা ইরাক ও সিরিয়ায় বিস্তার লাভ করতে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৪ সালের জুন মাসে তারা ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও ঐতিহাসিক শহর মসুল দখল করে। ২০১৪ সালের ২৯শে জুন রমজান মাসে মসুলের ঐতিহ্যবাহী নূরী গ্রান্ড মসজিদে জুম্মার খুতবায় বাগদাদী খেলাফতের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে। একসময় তারা সিরিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর রাক্কা দখল করে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে।

আইএসের উত্থানের পর সিরিয়া যুদ্ধ ত্রিমুখী আকার ধারণ করে। বাশার, বিদ্রোহী বাহিনী, আইএস- প্রত্যেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। মাঝখান দিয়ে আইএস দমনের নামে শুরু হয় আমেরিকা-ইসরাঈলের বর্বরতা। তাদের ক্রমাগত বিমান হামলায় মৃত্যু ঘটে অসংখ্য নিরীহ মানুষের। সবমিলিয়ে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ত্রিমুখী যুদ্ধ অপূরণীয় ক্ষতি করেছে ইরাক ও সিরীয় জনগণের। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মসুল পতনের মাধ্যমে আইএসের খেলাফতের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটলেও বাশার বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যকার দ্বিমুখী যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থনপুষ্ট বাশার বাহিনী অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাদের হামলায় একের পর এক বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহরের পতন ঘটছে। যখন যে শহরে অভিযান শুরু হয় সেখানকার মানুষ মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ে পড়ে। বাশার বাহিনী ও রাশিয়া সর্বশেষ গণহত্যা চালায় দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত গৌতায়। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি হামলা শুরু করে ১৮ মার্চ তারা গৌতা দখল করে। এই সময়ে কিয়ামতের বিভীষিকা নেমে এসেছে গৌতাবাসীর ওপর। মুহুর্মুহু বিমান হামলায় কেঁপে উঠেছে আকাশ-বাতাস। বিমান হামলা, ট্যাংক, কামান ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণে শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানুষ গুলির আঘাতে মরেছে, বিমান হামলায় মরেছে, আগুনে পুড়ে মরেছে। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত হওয়া ভবনের ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে নাম না জানা কত মানুষ। চিকিৎসার অভাবে মাটিতে পড়ে কাতরেছে আহত শিশুরা। এরপর অনাহারে বিনা চিকিৎসায়, ফুলের মত শিশুরা বুকভরা অভিমান নিয়ে নিষ্ঠুর এই পৃথিবী ত্যাগ করেছে। তাদের নিয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকু বাবা-মায়েরা পায়নি। মাসব্যাপী হামলায় খাবারের মজুদ ফুরিয়ে গেছে। গরু-ছাগলের মত ঘাস খেয়ে কেটেছে তাদের দিন। এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার উঠেছে গৌতার অলিগলিতে। কিন্তু না, তাদের হাহাকারে, তাদের আহাজারিতে কিছুই আসে যায় না মানুষের খোলস পরা এই পৃথিবীর হায়েনাদের। বিধ্বস্ত ভবনের ভগ্ন দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে তাদের আর্তনাদ। তাদের ফরিয়াদ শোনার মত সময় এই ব্যস্ত পৃথিবীর নেই। নিষ্ঠুর পৃথিবীর এ এক বীভৎস রূপ।

একই বর্বরতার শিকার হয়েছিল বিদ্রোহীদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি আলেপ্পো (হালাব)-এর জনগণ। মাসের পর মাস ব্যাপী অবরোধে আলেপ্পোর মানুষ কীভাবে কালাতিপাত করেছিল তার স্থির ও ভিডিও চিত্র দেখলে পৃথিবীর পাষাণতম মানুষেরও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে। মানবতা ও মনুষ্যত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অসহায় নারী-শিশুর রক্ত পান করে এভাবেই বাশার বাহিনী দখল করছে একের পর এক শহর।

১৯ মার্চ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বাশার বিজয়ী বেশে গৌতায় প্রবেশ করেছে। তার মাটি চাই। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গৌতার মাটি বাশার পেয়েছে। কিন্তু সেই মাটিতে লেগে আছে ছোপ ছোপ রক্ত, সেই মাটিতে মিশে আছে অসহায় নারীর তপ্তাশ্রু, সেই মাটি সাক্ষী হয়ে আছে একবিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার।

গৌতায় হামলার সময় সিরিয়ায় তুর্কি অভিযানের কথা বেশ আলোচিত হয়েছে। বুঝে না বুঝে অনেকেই বগল বাজিয়েছে। অথচ সিরিয়ার মূল যুদ্ধক্ষেত্রের ধারেকাছে তুরস্ক যায়নি। তাদের টার্গেট ছিল তুর্কি সীমান্তে অবস্থিত সিরিয়ার আফরিন এলাকা। যেখানে বিপুল পরিমাণ কুর্দির বসবাস। এই কুর্দিরা অস্থিশীলতার সুযোগে আলাদা কুর্দিস্তান তৈরি করতে চাচ্ছে, যাকে তুরস্ক নিজের জন্য হুমকি মনে করে। কারণ এতে তুরস্কের ভেতরে থাকা কুর্দিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং তুরস্কের সীমান্তবর্তী বিশাল ভূখ-সহ কুর্দিস্তানের সাথে মিশে যেতে চাইবে। এদের দমনের জন্য তুরস্কের এই অভিযান। এর সাথে সিরিয়ার মূল  লড়াইয়ের কোনো যোগসাজশ নেই।

 

শেষকথা

সিরিয়া যুদ্ধ যেভাবে মোড় নিয়েছে তাতে অভাবনীয় কিছু না ঘটলে বাশারের চূড়ান্ত বিজয় সময়ের ব্যাপার। রাশিয়ার অস্ত্র আর ইরানী ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সহায়তায় দেশের সিংহভাগ এলাকা তার আয়ত্তে চলে এসেছে। নিকটতম সময়ের মধ্যেই তারা হয়ত সিরিয়া যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করবে। বিদ্রোহী গ্রুপের পক্ষে আমেরিকা ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সমর্থন ও সহায়তা সত্ত্বেও কেন এই পরাজয়? এর কারণ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা অতি প্রয়োজন। বাশারবিরোধী জোটের অনৈক্য ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ভিন্নতার ব্যাপারটি মোটেই উপেক্ষা করার মতো নয়। যে কারণে তা শুধু ধ্বংসই টেনে আনল। যে উদ্দেশ্যে এই বিপুল প্রাণহানী তা অধরাই থেকে গেল। সিরিয়া আগে বাশারের হাতে ছিল, এখন আটবছর যুদ্ধের পরেও হয়ত তার হাতেই থাকবে। কিন্তু দুই সিরিয়ার মাঝে কত তফাৎ! মাঝখানের আটবছরের গৃহযুদ্ধ পুরো দেশটাকে তছনছ করে দিল। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, ব্যাংক, হাসপাতাল, দামেশকের সমৃদ্ধ প্রকাশনীগুলো- সব মিশে গেছে মাটির সাথে। যুদ্ধশেষে বাশার যে দেশটা হাতে পাবে তা ভগ্ন, বিধ্বস্ত, জনশূন্য ভুতুড়ে এক দেশ। সে দেশের আকাশ নীল হয়ে আছে স্বজনহারা মানুষের বেদনায়, সে দেশের বাতাস ভারি হয়ে আছে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের হাহাকারে। এক যুদ্ধ সব কেড়ে নিল, সব।

সিরিয়া যুদ্ধ যত সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ততই বড় হয়ে আমাদের সামনে দুলতে শুরু করেছে। আমাদের ভাইদের এত অশ্রু ঝরলো, এত জীবনপ্রদীপ নিভলো, আমরা কী করলাম? আমাদের মুসলিম শাসকেরা কী করল? ওআইসি, আরবলীগ কিংবা এসিতে বসে বিলাস করা ‘খাদিমুল হারামাইন’রা কী করলো? অন্যের বিপদে তারা কুলুপ এঁটে রইল কিংবা দু’লাইনের বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব পূরণ করল, হায়েনার হিংস্র থাবা যখন তাদের দেশে পড়বে তখন কে দাঁড়াবে তাদের পাশে? ইরাক, আফগান, কাশ্মীর, ফিলিস্তীন, মিয়ানমার, সিরিয়া- উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্র রক্ত ঝরছে কেবল মুসলিমের। এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা আছে আমাদের কিংবা মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের? পরিবার নিয়ে আরামআয়েশ করে দিব্যি খেয়ে-পরে দিন কাটাতে পারলেই যদি সন্তুষ্ট থাকি তবে কী পার্থক্য  চতুষ্পদ জন্তুর সাথে? ‘আপন জান বাঁচা’র এই ধান্ধা আর কতদিন? আপন জান বাঁচানোর জন্যই যে সবে মিলে অন্যকে রক্ষা করতে হবে, নইলে শকুনের বিষাক্ত দৃষ্টি একদিন আমাদের ওপরও পড়বে- সেই অমোঘ সত্য কে বোঝাবে আমাদের?

 

 

 

advertisement