রজব ১৪৩৯   ||   এপ্রিল ২০১৮

সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন...

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

ইমাম মুসলিম রাহ. সহীহ মুসলিমের কিতাবুল ঈমানে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। বিখ্যাত সাহাবী আমর ইবনুল আস রা.-এর মৃত্যুশয্যার ঘটনা।

আমর ইবনুল আস রা. ছিলেন তৎকালীন আরবের সেরা বিচক্ষণ ও কুশলী ব্যক্তিদের একজন। ইতিহাসে তিনি পরিচিত ‘ফাতিহে মিসর’ উপাধীতে। দশ বছরেরও অধিক কাল তিনি ছিলেন মিসরের শাসনকর্তা। এর মধ্যে চার বছর খলীফায়ে রাশেদ ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর খিলাফত আমলে, চার বছর খলীফায়ে রাশেদ উছমান ইবনে আফফান রা.-এর খিলাফত আমলে, আর দুই বছর তিন মাস হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর শাসনামলে। এ থেকেও তাঁর যোগ্যতা ও মর্যাদা অনুমান করা যায়।

মিসর বিজিত হওয়ার পর মুসলিম জনগণকে লক্ষ্য করে তাঁর বাণী-

أنتم في رباط دائم.

ইতিহাসের বিখ্যাত বাক্যগুলোর একটি। ‘আনতুম ফী রিবাতিন দায়িম’-তোমরা রয়েছ নিরবচ্ছিন্ন সীমান্ত-প্রহরায়। অর্থাৎ এই ভূখ- ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলেও এখানে হক-বাতিলের সংঘাত চলতেই থাকবে। কাজেই মুসলিম জাতিকে তাদের দ্বীন ও ঈমানের সীমারেখা এবং সালতানাত ও ভূখণ্ডের সীমানা রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে যেতে হবে।

এই মহান সাহাবীর মৃত্যুশয্যার ঘটনা ইমাম মুসলিম রাহ. বর্ণনা করেছেন সহীহ মুসলিমের কিতাবুল ঈমানে।

***

আবদুর রহমান ইবনে শুমাছা আলমাহরী বলেন, আমরা (হযরত) আমর ইবনুল আছ রা.-এর মৃত্যুশয্যায় তাঁর কাছে এলাম। তিনি খুব কাঁদছিলেন এবং মুখমণ্ডল দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে রেখেছিলেন।

তাঁর পুত্র তাঁকে ডেকে  ডেকে যেন আশ্বস্ত করে বলছিলেন-

يَا أَبَتَاهُ، أَمَا بَشّرَكَ رَسُولُ اللهِ صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِكَذَا؟ أَمَا بَشّرَكَ رَسُولُ اللهِ صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِكَذَا؟

আব্বাজান! আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে এই এই সুসংবাদ দেননি?[1]

একথা শুনে তিনি মুখ ফেরালেন এবং বললেন-

إِنّ أَفْضَلَ مَا نُعِدّ شَهَادَةُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلّا الله، وَأَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ.

আমাদের সর্বোত্তম প্রস্তুতি হচ্ছে এই সাক্ষ্য যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল।[2]

এরপর বললেন-

إِنِّي قَدْ كُنْتُ عَلَى أَطْبَاقٍ ثَلَاثٍ : لَقَدْ رَأَيْتُنِي وَمَا أَحَدٌ أَشَد بُغْضًا لِرَسُولِ اللهِ صَلى الله عَلَيْهِ وَسَلمَ مِنِّي، وَلَا أَحَب إِلَي أَنْ أَكُونَ قَدِ اسْتَمْكَنْتُ مِنْهُ، فَقَتَلْتُهُ، فَلَوْ مُت عَلَى تِلْكَ الْحَالِ لَكُنْتُ مِنْ أَهْلِ النارِ...

আমার জীবনে তিনটি পর্ব অতিবাহিত হয়েছে। এক পর্বে আমার অবস্থা এই ছিল যে, আমার কাছে আল্লাহ্র রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চেয়ে বেশি অপছন্দের আর কেউ ছিল না। এমনকি সুযোগ পেলে তাঁকে হত্যা করতেও আমার চেয়ে বেশি উদগ্রীব আর কেউ ছিল না। ঐ অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হত তাহলে আমি জাহান্নামী হয়ে যেতাম।

দ্বিতীয় পর্বে যখন আল্লাহ তাআলা আমার অন্তরে ঈমান দান করলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম এবং আরজ করলাম-

ابْسُطْ يَمِينَكَ فَلْأُبَايِعْكَ.

আপনার হাত আগান, আমি আপনার হাতে বাইয়াত হব। তিনি হাত বাড়ালেন। কিন্তু তিনি যখন হাত বাড়ালেন আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। তিনি প্রশ্ন করলেন-

مَا لَكَ يَا عَمْرُو

কী হল আমর!

আমি বললাম-

أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ

আমি একটি শর্ত করতে চাই।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন-

تَشْتَرِطُ بِمَاذَا؟

 

কী শর্ত?

আমি বললাম-

أَنْ يُغْفَرَ لِي

আমাকে যেন মার্জনা করা হয়।[3]

তিনি বললেন-

أَمَا عَلِمْتَ أَنّ الْإِسْلَامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ؟ وَأَنّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا؟ وَأَن الْحَجّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ؟

তুমি কি জানো না, ইসলাম অতীতের সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেয়? তেমনি হিজরতও অতীত বিষয়াদি নিশ্চিহ্ন করে? হজ¦ও পূর্বের যা কিছু তা নিশ্চিহ্ন করে?

এরপর অবস্থা এই হল যে, আমার কাছে আল্লাহর রাসূলের চেয়ে বেশি প্রিয় ও আমার চোখে তাঁর চেয়ে বেশি মর্যাদার আর কেউ ছিল না। তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে আমি দুচোখ ভরে তাঁর দিকে তাকাতেও পারতাম না। আমার কাছে তাঁর চেহারা-সূরতের বৃত্তান্ত চাওয়া হলে আমি তা দিতে পারব না। কারণ, তাঁকে আমি দুচোখ ভরে কখনো দেখিনি। (হায়!) এই অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হত আমার প্রত্যাশা আমি জান্নাতী হতাম।

তৃতীয় পর্ব হচ্ছে যখন আমরা নানা দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। জানি না সেসবে আমার অবস্থা কী![4]৪  (তাহলে কীভাবে আমি নির্ভয় হই?)

শোনো! আমি যখন মারা যাব তখন যেন কোনো বিলাপকারিণী বা অগ্নি আমার সহচর না হয়। এরপর যখন আমাকে কবরে শোয়াবে তখন ধীরে ধীরে আমার উপর মাটি দিও। এরপর আমার কবরের পাশে এইটুকু সময় অপেক্ষা করো, যে সময় একটি উট-জবাই করে তার গোশ্ত বণ্টন করতে লাগে। যেন তোমাদের উপস্থিতিতে আমার একাকিত্ব দূর হয় আর আমি আমার রবের দূতের প্রশ্নের জবাব গুছিয়ে নিতে পারি। -সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদীস ১২১

 

 

 

 

 [মাওলানা আবদুল্লাহ আব্বাস নদভীর কলামসমগ্র থেকে অনূদিত। অনুবাদে : ইবনে নসীব][5]

 

[1] ১. পিতাকে লক্ষ্য করে পুত্রের এই কথাগুলোতে আছে ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ আদবের নমুনা। তা হচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রীর সামনে এমন কথা আলোচনা করা কাম্য, যা তার মনে আল্লাহ্র রহমতের প্রত্যাশা জাগ্রত করে। এ সময় আল্লাহর রহমতের আয়াত, মাগফিরাতের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত হাদীস এবং মুমিনদের জন্য আল্লাহ যে পুরস্কার রেখেছেন তা স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত। তেমনি তার ভালো কাজগুলোর আলোচনা কাম্য, যা তার মনে আল্লাহ্র রহমতের প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলবে। এই আশাবাদ ও মালিকের প্রতি সুধারণা নিয়েই সে এই নশ^র জগৎ থেকে বিদায় নিবে। এ বিষয়ের ইস্তিহ্বাব ও কাম্যতা সম্পর্কে আলিমগণ একমত।

প্রসঙ্গত কালেমা তালকীনের বিষয়টিও আলোচনা করা যায়। আলিমগণ বলেন, তালকীনের নিয়ম হল, মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে আস্তে আস্তে কালেমা পড়তে থাকা। তা শুনে তারও কালেমা পড়ার কথা মনে পড়বে। এ নাযুক সময় তাকে কোনো কিছুর আদেশ দেয়া বা পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়।

 

[2] ২. সকল মুসলিমকে আল্লাহ তাআলা ঈমানের ও কালেমার মর্যাদা বোঝার সৌভাগ্য দান করুন। এ-ই তো মুমিনের সবচেয়ে বড় সম্বল, আখিরাতের  সফরের সবচেয়ে বড় পাথেয়।

[3] ৩. এই শর্তারোপ থেকে বোঝা যায়, বিগত জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে কীরূপ খোদাভীতি ও অনুতাপ সৃষ্টি হয়েছিল। আমর ইবনুল আস ও তাঁর  মতো কঠিন মানুষগুলোর আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এভাবে মোমের মত বিগলিত হয়ে যাওয়া চিন্তা-ভাবনার অনেক বড় অনুষঙ্গ। ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতাই আল্লাহর ইচ্ছায় এদেরকে তাঁর প্রতি সমর্পিত হতে বাধ্য করেছিল।

[4] ৪. এই হচ্ছে প্রকৃত মুমিনের অবস্থা। ভয় ও প্রত্যাশার মাঝে তার অবস্থান।

এখানে আরো আছে জীবন ও কর্মের মূল্যায়নের এক জীবন্ত নমুনা। ঈমানদারের কর্তব্য, নিজের কর্ম ও জীবনের মূল্যায়ন ও মুহাসাবা জারি রাখা। মাঝে মাঝে এই চিন্তা করা যে, আমি যে অবস্থায় আছি এই অবস্থায় আমার মৃত্যু হলে আমার গন্তব্য কী হবে? ঠিকানা কোথায় হবে?

বিশেষত আপন ঈমান-আকীদার হালপুরসী করা প্রয়োজনÑ কী অবস্থায় সে আছে। তেমনি আমল ও কৃতকর্ম সম্পর্কেও চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। কারণÑ

عمل سے زندگی بنتی  ہے  جنت بھی جہنم  بھی  

يہ خاکی اپنی فطرت ميں   نہ ناری ہے نہ نوری

কর্মের দ্বারাই জীবন গঠিত হয়। জান্নাত বা জাহান্নামের উপযুক্ততা নির্ধারিত হয়। এই মাটির মানুষ তো সত্তাগতভাবে আলোরও নয়, আগুনেরও নয়।

সাহাবী হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর বাক্যটি এ সত্যেরও ঘোষক যে, দায়িত্বভার গ্রহণ শুধু আনন্দের ব্যাপার নয়, ভয়েরও ব্যাপার। যার দায়িত্ব কম তার জবাবদিহিতা কম, যার দায়িত্ব বেশি তার জবাবদিহিতাও বেশি। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য, এই কঠিন সত্যকে উপলদ্ধি করা। ঈমান-আকীদার দুরস্তির পর একজন সাধারণ মুসলিমের জন্য যতটুকু ইবাদত-আমল যথেষ্ট হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ববহুল পদে অধিষ্ঠিতদের জন্য কখনো ঐটুকু যথেষ্ট নয়। তাদেরকে স্ব স্ব পদের দায়িত্ব-কর্তব্যও পালন করতে হবে। তারা একান্তে ভেবে দেখতে পারেন, যে গুরুভার তাদের উপর অর্পিত হয়েছে সে সম্পর্কে তারা কতটুকু সচেতন এবং এর জবাবদিহিতার জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।

 

[5]  

   ১ উর্দু নিবন্ধে উল্লেখিত উদ্ধৃতিটুকুর তরজমা নেয়া হয়েছে সদেশ থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ বইটির বাংলা অনুবাদ থেকে। পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪০।

 ২ মাত্র বাইশ বছর বয়সে বিরল রোগ মোটর নিউরনে আক্রান্ত হন। তিনি বড় জোর কয়েক বছর বাচবেন বলে সে সময় চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন।

  ১. মাওলানা আলী আহমাদ ছাহেব বলেন, সে সময়ে দাখিল, আলিম ইত্যাদি শব্দের প্রচলন ছিল না।

২. মাওলানা আলী আহমাদ ছাহেব বলেন, ‘মাওলানা যফর আহমাদ উসমানী রাহ. উর্দুতে পড়াতেন। ছাত্ররাও দরসে তাঁর সাথে উর্দুতে কথাবার্তা  বলত। তৎকালীন আলিয়া মাদরাসাগুলোতে উর্দু-ফার্সীর ব্যাপক প্রচলন ছিল।’

৩. বড় হুযূর রাহ.-এর জামাতা এবং টুমচর মাদরাসার বর্তমান প্রিন্সিপাল হারুন আলমাদানী ছাহেব (হাফিযাহুল্লাহ)-এর পিতা।

 

 

advertisement