যিলহজ্ব ১৪৩৮   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৭

জীবন অতি মূল্যবান

মুহাম্মাদ হেলালুদ্দীন

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مِنْ حُسْنِ إِسْلاَمِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَالاَ يَعْنِيهِ

মানুষের ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল, যে কাজে দ্বীন বা দুনিয়ার কোনো ফায়দা নেই তা ছেড়ে দেয়া। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৮

অর্থাৎ যে কাজে আখেরাতের কোনো ফায়দা রয়েছে অথবা দুনিয়ার কোনো বৈধ ফায়দা রয়েছে তা করবে। কিন্তু যে কথা-কাজে দুনিয়া-আখেরাতের কোনো ফায়দা নেই তা করবে না। আর যে কথা-কাজে বিলকুল কোনো ফায়দা নেই, উপরন্তু তাতে ক্ষতি রয়েছে তা অবশ্যই পরিহার করবে, যাতে দুনিয়া-আখেরাতের কোনো লোকসান না হয়।

গুনাহের ক্ষতি

সব ধরনের গুনাহে দুনিয়া-আখিরাতের ক্ষতি রয়েছে। আমাদের গুনাহের দ্বারা দুনিয়ারও ক্ষতি ও বরবাদী নেমে আসে। মানুষের প্রশান্তি উড়ে যায়। মানুষ অস্বস্তি ও অস্থিরতার মাঝে থাকে। আর আখেরাতের ক্ষতি  তো রয়েছেই। সবচে’ বড় শাস্তি  তো কবর ও দোজখের শাস্তি। আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানদের তা হতে রক্ষা করুন- আমীন।

 

জীবন মূল্যবান

মোটকথা, অনর্থক কথা-কাজ থেকে বাঁচা অতি জরুরি। কারণ, আমাদের জীবন অত্যন্ত দামী। তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন। আমরা যদি সামান্য সময়ও চিন্তা করি তাহলে আমাদের বুঝে আসবে যে, জীবনের মূহূর্তগুলো কত মূল্যবান। এর সঠিক মূল্য তো বুঝে আসবে আখেরাতে গিয়ে, যখন আমাদের ইখতিয়ারে কিছু থাকবে না; চাইলেও একটি নেকী অর্জন করা সম্ভব হবে না। দুই রাকাত নামাযের কী মূল্য- তা সেদিন বুঝে আসবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের তা বুঝিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

مَرّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَلَى قَبْرٍ دُفِنَ حَدِيثًا فَقَالَ: رَكْعَتَانِ خَفِيفَتَانِ مِمّا تَحْقِرُونَ وَتَنْفِلُونَ يَزِيدُهُمَا هَذَا فِي عَمَلِهِ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ بَقِيّةِ دُنْيَاكُمْ.

قَالَ ابْنُ صَاعِدٍ: هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ حَسَنٌ

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন সদ্য দাফনকৃত একটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সাহাবীদের লক্ষ করে বললেন, দুই রাকাত নামায, তোমরা যেটাকে সামান্য মনে কর, এই ব্যক্তির কাছে এই দুই রাকাত নামায -যা তার আমলনামাকে সমৃদ্ধ করবে- সারা দুনিয়া থেকে উত্তম। -আযযুহদু ওয়ার রাকাইক, ইবনুল মুবারাক, হাদীস ৩১; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৯২০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৩৫০৬

অর্থাৎ, তোমরা কখনো তাড়াতাড়ি দুই রাকাত নামায পড়ে নাও আর এটাকে সামান্য মনে কর। অথচ তা সামান্য নয়, এই মৃতব্যক্তি, যে এই কবরের মধ্যে রয়েছে, সে আফসোস করছে এবং তামান্না করছে, হায় আমার জীবনের আরো কিছু সময় যদি মিলতো, তাহলে আমিও দুই রাকাত পড়ে নিতাম আর তা আমার আমলনামাকে সমৃদ্ধ করত। তার কাছে দুই রাকাত নামায দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়েও উত্তম।

দুনিয়ায় যত নিআমত আছে, যত সম্পদ আছে- সোনা-রূপা টাকা-পয়সা, পদ-পদবী, রাজত্ব-সাম্রাজ্য, ইয্যত-সম্মান অর্থাৎ দুনিয়ার যত নিআমত; তার কাছে দুই রাকাত নামায এই সকল নিআমত হতে উত্তম। এজন্য সে তামান্না করছে, হায়! যদি আমার জীবনের আরো দুই মিনিট মিলে যেত তাহলে দুই রাকাত নামায পড়ে নিতাম! তোমরা দুই রাকাত নামাযকে সামান্য মনে কর; তার কাছে জিজ্ঞেস কর- দুই রাকাত নামায কত মূল্যবান!

 

 

যতদিন দেহে প্রাণ আছে

এখনো আমরা জমীনের উপর। দেহে প্রাণ আছে, ইচ্ছাশক্তি আছে। চাইলেই নেক আমলের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারছি। চাইলেই سُبْحَانَ اللهِ  বলতে পারছি এবং এর ফযীলত ও সওয়াব লাভ করতে পারছি। মৃত্যু এসে গেলে শত আফসোস করেও একবার সুবহানাল্লাহ বলতে পারব না।

 

سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِه-এর সওয়াব

এক হাদীসে আছে, যদি কোনো ব্যক্তি দিনে একশ বার سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ পড়ে তাহলে তার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা বরাবর হয়। আর এর সাথে যদি سبحان الله العظيم মিলানো হয় তাহলে তার সওয়াব আরো বেড়ে যাবে। কারণ আরেক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় একশ বার سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ পড়বে কিয়ামতের দিন তার চেয়ে বেশি সওয়াব নিয়ে আর কেউ উঠবে না। তবে ঐ ব্যক্তি, যে অনুরূপ আমল করেছে বা তারচে’ বেশি। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯১, ২৬৯২)

সময় কাজে লাগানোর এর চেয়ে মূল্যবান উপায় আর কী আছে। সময় চলে গেলে এর উপর আফসোস হওয়ায়ই তো স্বাভাবিক।

 

দরূদ শরীফের ফযীলত

সময় কাজে লাগানোর আরেক উত্তম আমল দরূদ শরীফ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَلّى عَلَيّ وَاحِدَةً صَلّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا

যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পেশ করবে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৮

সবচেয়ে ছোট বাক্যে দরূদ হল, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটুকু বললেও উক্ত সওয়াব লাভ হবে। আর দরূদের সবচেয়ে উত্তম বাক্য হল দরূদে ইবরাহীমী, যা আমরা নামাযে পড়ি। সওয়াবের পরিমাণের সাথে সাথে দরূদের আরেক ফযীলত হল আল্লাহর নৈকট্য লাভ। সাথে সাথে আল্লাহর রহমতকে আকর্ষণকারী সবচেয়ে উত্তম আমল হল দরূদ।

দরূদ পড়া সবার জন্য সহজ। ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর ব্যক্তিও প্রত্যেক নামাযের পর খুব সহজেই তা পড়তে পারে। নামায পড়তে আসছে তো পথেই পড়ে নিতে পাড়ে। মসজিদে আসার পর মসজিদে বসে বসে পড়তে পারে। নামাজের পর যখন তাসবীহাত পড়ছে তো  দুই-দশবার পড়ে নিতে পারে। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর রহমত বর্ষণ করেন। আর আমরা তো পদে পদে আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী। সুতরাং সময়ের অপচয় না করে সুযোগ হলেই দরূদ পাঠ করা উচিৎ।

 

কাজ তিন প্রকার

ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, মানুষের যাবতীয় কাজ তিন প্রকার। এক. এমন কাজ যাতে দ্বীন-দুনিয়ার কোনো ফায়েদা আছে। অর্থাৎ দুনিয়ার কোনো বৈধ ফায়দা রয়েছে কিংবা দ্বীনের বা আখেরাতের কোনো ফায়দা রয়েছে। যেমন তাতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, ক্ষমা ও অনুগ্রহ রয়েছে। এর পাশাপাশি দুনিয়ারও উপকারিতা রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রকার কাজ হল, যাতে দুনিয়া-আখিরাতের কোনো না কোনো লোকসান রয়েছে। দ্বীনের লোকসান- যেমন কোনো গুনাহের কাজ। চাই তা ছোট হোক বা বড়, হাতের গুনাহ হোক বা চোখের, কানের গুনাহ হোক বা অন্তরের। তেমনি যে কাজে দুনিয়ার ক্ষতি রয়েছে। এ ক্ষতি জানের হোক বা মালের।

তৃতীয় প্রকার কাজ হল, যাতে দুনিয়া-আখেরাত এবং দ্বীনের কোনো লাভ নেই আবার ক্ষতিও নেই।

এখন যে কাজে দুনিয়া-আখেরাতের কোনো ফায়দা রয়েছে তা তো আমার উপকার করবে। নিজের চব্বিশ ঘণ্টা সময় এমন কাজেই ব্যয় করা উচিত এবং সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন কাজ করবে, যাতে দুনিয়ার বৈধ ফায়দা রয়েছে কিংবা আখেরাতে প্রতিদান রয়েছে।

আর যে কাজে দুনিয়া-আখেরাতের কোনো না কোনো লোকসান রয়েছে এমন কাজ হতে নিজেকে রক্ষা করবে।

বাকি রইল ঐ কাজ, যাতে কোনো লোকসান নেই, উপকারও নেই। নেকী নেই, বদীও নেই। কোনো আজর ও প্রতিদানও নেই, কোনো শাস্তিও নেই। তো ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, যদি মানুষ চিন্তা করে, তাহলে বুঝবে যে, তৃতীয় প্রকার কাজেও লোকসান রয়েছে। কেননা, সে যতটুকু সময় অনর্থক কাজে ব্যয় করল, যদি তা ভালো কাজে ব্যয় করত তাহলে না জানি কত ফায়দা অর্জিত হত।

 

একটি কিসসা ও তার শিক্ষা

উপরের বক্তব্যের একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত রয়েছে। এক ব্যক্তি অনেক গরীব, অভাব-অনটনে জর্জরিত। ঘটনাক্রমে সে একটি দ্বীপে পৌঁছল। সেখানে একটি স্বর্ণের পাহাড় রয়েছে। আর পাহাড়ের মালিক তাকে বলল, তুমি তো গরীব মানুষ। অভাব-অনটনে দিন কাটাও। আমার এই স্বর্ণের পাহাড় থেকে তুমি যত স্বর্ণ বের করতে পারবে সব তোমার। আর জেনে রেখ, আমি যখন চাইব নিষেধ করে দেব। কিন্তু আমি একথা বলব না যে, কোন্ সময় নিষেধ করব। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নিষেধ না করব ততক্ষণ যত ইচ্ছে নিতে পার। আর যখন নিষেধ করব তখন এক রত্তিও নেওয়ার অনুমতি থাকবে না। নিতে চাইলেও নিতে পারবে না। শুধু তাই নয় তুমি যদি দ্বীপ হতেও বের হতে না চাও তাহলে তোমাকে জোর করে বের করে দেব।

বিবেকের দাবি, সে এক মুহূর্তও গাফলতে কাটাবে না। রাত-দিন স্বর্ণ সংগ্রহের কাজেই লেগে থাকবে। যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায় এর মধ্যে সে চেষ্টা করবে কত বেশির থেকে বেশি স্বর্ণ সংগ্রহ করা যায়।

এখন যদি কেউ তাকে বলে, এ দ্বীপ অনেক বড়, অনেক সুন্দর। অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা আছে এখানে; চল, ঘুরে দেখে আসি। তাহলে সে কী উত্তর দিবে? বলবে, রাখ তোমার সুন্দর দ্বীপ আর বিনোদন। আমার এগুলোর সময় নেই। আমার এখন একই ব্যস্ততা। সে যতটুকু সময় পাবে নিজের থলেতে স্বর্ণ জমা করবে। রাত-দিন এ ফিকিরেই থাকবে।

কিন্তু লোকটি যদি ঐ ব্যক্তির কথা শুনে ঐ দ্বীপ ঘুরে দেখা আর বিনোদনে লেগে যায় তো বাহ্যত এতে তার কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু বাস্তবে কত বড় ক্ষতি! ঘুরে ঘুরে সময় শেষ করল আর একসময় মালিক বলল, যাও এ দ্বীপ থেকে বের হয়ে যাও। আর সে চাইল আমাকে এক মিনিট সময় দিন। তা তো মালিক আর দিবে না। তখন তার আফসোসের আর সীমা থাকবে না। এটাই হল অনর্থক কাজে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতি।

 

আমাদের অবস্থা

আমরা সময় নষ্ট করার অজস্র পথ আবিষ্কার করেছি এবং তা আমাদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। গুনাহের কথা না হয় বাদই দিলাম। এতে তো দুনিয়া-আখেরাতের ক্ষতি রয়েছে। সর্বদা তা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কিন্তু গুনাহ ছাড়াও আমাদের অনর্থক কাজের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ।

আমরা যদি পরস্পরে কথাবার্তা শুরু করি তাহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্থক কথায় নষ্ট করে দেই। এতে নারী-পুরুষ সবাই লিপ্ত। যদি অজান্তে কেউ আমাদের কথা রেকর্ড করে তারপর মজলিশ শেষে সে রেকর্ড শুনিয়ে দেয় তো আমরা নিজেরাই অনুমান করতে পারব, এক হাজার কথার মধ্যে একটি কথাও কাজের নয়; অনর্থক কথা-বার্তায় আমাদের মজলিশ ভরা থাকে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

 

সাজ-সজ্জায় সময় ব্যয়

অনর্থক কাজসমূহের একটি হল, সাজ-সজ্জা ও রূপচর্চা। অন্যায় প্রদর্শন ও বেপর্দার নিয়ত ছাড়া প্রয়োজন পরিমাণ সাজ-সজ্জা ও ত্বকের যত্ন নেয়াতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু মেয়েরা উৎসব-অনুষ্ঠানে নিজেকে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নিজেকে সাজানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে। না জানি সাজ-গোজের কত স্তর অতিক্রম করে মেয়েরা কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কাবেল হয়। অথচ স্বামীর জন্য সাজতে মোটেও প্রস্তুত নয়। সাজলে সাজ স্বামীর জন্য।

আজকাল তো কিছু পুরুষদেরও রূপচর্চায় ব্যস্ত দেখা যায়। তারাও এক্ষেত্রে মহিলাদের চেয়ে পিছনে নয়। এক হল ত্বকের যত্ন নেয়া আরেক হল সাজগোজ। আমি বলছি, অনর্থক ও অন্যায়  সাজগোজের কথা। এসব অনর্থক কাজ। আল্লাহ রক্ষা করুন।

 

মৃত্যুর পূর্বেই কিছু করে যাও

হযরত মাজযুব রাহ. বলেন, বাহ্যিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হলে নশ্বর পৃথিবী দ্বারা ধোকা খাবে। পৃথিবী তো নকশওয়ালা সাপ, যা দংশন করে। মনে রেখো অন্যথায় পস্তাবে। একদিন তো মরতে হবে। আখের হল মৃত্যু। সুতরাং যা করার করে নাও।

 

হাফেজ ইবনে হাজার রাহ.-এর ঘটনা

হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম ইবনে হাজার আসকালানীর একটি ঘটনা শুনিয়েছিলেন। আগের যুগে তো কলম বাশের কঞ্চির হত। তো বার বার তা চিকন করার প্রয়োজন হতো। হাফেজ ইবনে হাজার রাহ.-এর অবস্থা ছিল যে, যখন কলম কাটতেন তখন যবান দ্বারা আল্লাহ আল্লাহ যিকির করতেন।

এই যে অল্প সময়ে কলম কাটতেন এটুকু সময়ও নষ্ট হতে দিতেন না। হাত তো কলম কাটার কাজে লিপ্ত, চোখ দেখার কাজে সুতরাং যবান কেন আল্লাহর যিকিরে মশগুল হবে না। আল্লাহ তাআলা যাকে বিবেক দান করেছেন, আখেরাতের ফিকির দান করেছেন সে এভাবে সময় বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আখেরাতের কাজে ব্যয় করে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরও তাওফীক দান করুন।

 

চার কাজ

এখন আমরা আমাদের জীবন কীভাবে আখেরাতের কাজে ব্যবহার করব? এজন্য চার কাজের ইহতেমাম করব। এর দ্বারা আমরা অনর্থক কাজ-কর্ম থেকে বেঁচে জীবনের সময়কে কাজে লাগাতে পারব।

১. গুনাহ থেকে বাঁচা

প্রথম কাজ হল যাবতীয় গুনাহ থেকে খাঁটি তওবা করা এবং ভবিষ্যতে তা থেকে বাঁচার পাক্কা ইরাদা করা। হিম্মত করব আর আল্লাহ তাআলার তাওফীকও চাইব।

২. সবকাজ আল্লাহর জন্য করা

দ্বিতীয় হল, ঐ কাজ যাতে দুনিয়া-আখেরাতের ফায়দা রয়েছে তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়ত করব। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা যত কাজ করি, এর মধ্যে কিছু রয়েছে ইবাদত এবং কিছু রয়েছে দুনিয়ার বৈধ কাজ। সকল কাজে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির নিয়ত করব। তাহলে সবকিছুই কাজে আসবে- ইনশাআল্লাহ।

৩. যিকিরের অভ্যাস

তৃতীয় কাজ হল, বেশি বেশি যিকিরের অভ্যাস করা। এটা অনেক বড় দৌলত। এ দৌলত তো ইবনে হাজারের নসীব হয়েছিল। হাতে কলম কাটছেন যবানে الله الله যিকির করছেন। যখন কারো যিকিরের আদত হয়ে যায় তখন শুয়ে-বসে, চলতে-ফিরতেও তার যবান আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকে। ফলে সে   الَّذِينَ إِذَا رُؤُوا ذُكِرَ اللَّهُ (যাদেরকে দেখলে আল্লাহ্র কথা স্মরণ হয়)-হাদীসের মেসদাক হয়ে যায়।

তো আল্লাহর অধিক জিকির ঐ নিআমত, ঐ দৌলত যার আজর-সওয়াবও সীমাহীন।

এর জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সারাদিনের মাসনূন দুআগুলোর ইহতিমাম করা। এর দ্বারা আমরা জীবনের মুহূর্তগুলো আল্লাহর স্মরণে কাটাতে পারব।

৪.  অনর্থক কাজ ছেড়ে দেয়া

চতুর্থ কাজ হল, যাবতীয় অনর্থক কাজ, কথা-বার্তা, আলোচনা, মজলিশ, প্রোগ্রাম থেকে নিজেকে বাঁচানো। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই চার কাজের মুহাসাবা করা।

আমি সকালে ইরাদা করেছি, আমি ফরয-ওয়াজিব-সুন্নত যথাযথ আদায় করব, গুনাহ থেকে বাঁচব। অনর্থক কাজ থেকে বাঁচব, বেশি বেশি জিকির করব। সব কাজ আল্লাহর জন্য করব। এখন আমি ভেবে দেখব যে, সারাদিন কীভাবে কাটালাম। শোয়ার পূর্বে পাঁচ মিনিট বের করে মুহাসাবাহ করব। যদি তাতে কোনো কমতি হয় তাহলে ইসতিগফার করা- আল্লাহ যে ত্রুটি হয়েছে মাফ করে দাও আগামীর জন্য তাওফীক দাও। দুআ করা-

اللَّهُمّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ، وَشُكْرِكَ، وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ

এভাবে বিগত দিনের জন্য ইসতিগফার করা আর আগামীর জন্য দৃঢ় সংকল্প করা ও আল্লাহর তাওফীক চাওয়া।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তো সকল ত্রুটির সংশোধন ও ক্ষতিপূরণ খুব সহজ। মৃত্যুর পর শত চাইলেও এক বিন্দু ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। শত আফসোস করেও একটি নেক আমলের, তাওবার সুযোগ পাওয়া যাবে না। আমাদের কি জানা আছে, আগামীর সুযোগ আমার নসীব হবে কি না? এজন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে কমতি হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত পেছনের জীবনে যত লোকসান হয়েছে সবকিছুর ক্ষতিপূরণ শোয়ার পূর্বে করে নাও। এবার দুআ করো, ইয়া আল্লাহ! আগামী দিন আমাকে আপনার মর্জি মোতাবেক কাটানোর তাওফীক দান করুন। প্রতিদিন আমরা এ কাজ করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ সফল হব।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এসব কথার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

(মাওলানা আব্দুর রউফ সাখখারবী দা. বা.-এর বয়ানের আলোকে প্রস্তুতকৃত)

 

 

advertisement