যিলহজ্ব ১৪৩৮   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৭

প্রতিক্রিয়া নয়, স্বাধীন কর্ম

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

হযরত হুযাইফা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لاَ تَكُونُوا إِمّعَةً، تَقُولُونَ: إِنْ أَحْسَنَ النّاسُ أَحْسَنّا، وَإِنْ ظَلَمُوا ظَلَمْنَا، وَلَكِنْ وَطِّنُوا أَنْفُسَكُمْ، إِنْ أَحْسَنَ الناسُ أَنْ تُحْسِنُوا، وَإِنْ أَسَاءُوا فَلاَ تَظْلِمُوا.

তোমরা ‘ইম্মা‘আ’ হয়ো না এবং বলো না, ‘লোকেরা সদাচার করলে আমরা সদাচার করব আর লোকেরা জুলুম করলে আমরাও জুলুম করব’; বরং নিজেদের (এই নীতিতে) অভ্যস্ত কর যে, লোকেরা সদাচার করলে তোমরাও সদাচার করবে আর লোকেরা অসদাচার করলে তোমরা জুলুম থেকে বিরত থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০০৭

ইমাম তিরমিযী রাহ. হাদীসটি বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেন- هذا حديث حسن غريب অর্থাৎ এটি ‘হাসান’ পর্যায়ের বর্ণনা। ইমাম তিরমিযী রাহ. ও অন্যান্য মুহাদ্দিসের পরিভাষায় حسن হচ্ছে নির্ভরযোগ্য বর্ণনার একটি প্রকার।

এই মোবারক হাদীসে রয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক শিক্ষা । সে শিক্ষাই আমরা এখন আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

হাদীসের প্রথম বাক্য- “তোমরা ‘ইম্মা‘আ’ হয়ো না”

‘ইম্মা‘আ’ কাকে বলে?

আরবী ভাষায় ইমমা‘আ (إِمَّعَةً) হচ্ছে-

الذي لا رأي له ولا عزم، فهو يتابع كل أحد على رأيه ولا يثبت على شيء.

‘এমন পরানুকরণকারী লোক, যার নিজস্ব কোনো মত নেই, সংকল্পও নেই, কোনো ব্যাপারে স্থিতিও নেই।’

আরবী ভাষার বিখ্যাত অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাচনিক উদ্ধৃত করা হয়েছে যে-

كنا في الجاهلية نعد الإمعة الذي يتبع الناس إلى الطعام من غير أن يدعى، وإن الإمعة فيكم اليوم المحقب الناس دينه.

‘জাহেলী যুগে আমরা ‘ইম্মা‘আ’ বলতাম ঐ সকল লোককে, যারা বিনা নিমন্ত্রণে মানুষের পেছনে পেছনে দাওয়াতে গিয়ে হাজির হয়। আর এখন তোমাদের মধ্যে ‘ইম্মা‘আ’ হচ্ছে ঐ সকল লোক, যারা দ্বীনের ক্ষেত্রে লোকের অনুকরণ করে।’

দ্বীনের ক্ষেত্রে পরানুকরণের অর্থ হচ্ছে, লোকেরা দ্বীনদারির পথে চললে সে-ও দ্বীনদারির পথে চলে আর লোকেরা বেদ্বীনীর দিকে গেলে সে-ও বেদ্বীনীতে লিপ্ত হয়।

অন্য এক বর্ণনায় ইবনে মাসউদ রা.-এর বক্তব্য পরিষ্কার ভাষায় এসেছে-

أَلَا لَا يُقَلِّدَنّ أَحَدُكُمْ دِينَهُ رَجُلًا، إِنْ آمَنَ آمَنَ، وَإِنْ كَفَرَ كَفَرَ، فَإِنهُ لَا أُسْوَةَ فِي الشّرِّ.

সাবধান! কেউ যেন তার দ্বীন ও ঈমান অন্যের কাঁধে ন্যস্ত না করে যে, ও ঈমান আনলে এ-ও ঈমান আনে, ও কুফুর করলে এ-ও কুফুর করে। কারণ, মন্দের ক্ষেত্রে কেউ আদর্শ নয়। (আল ই‘তিসাম, শাতিবী ২/৩৫৯)

তো ‘ইম্মা‘আ’ হচ্ছে এমন বিচার-বুদ্ধিহীন পরানুকরণকারী, যার  কাছে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো মাপকাঠি নেই, লোকে যা করে সেও তা-ই করে।

এটা মুমিনের শান নয়। মুমিনের আছে ন্যায়-অন্যায় ও করণীয়-বর্জনীয়ের নিজস্ব মাপকাঠি। তাই উপরোক্ত বাক্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানদারদের ‘ইম্মা‘আ’ হতে নিষেধ করেছেন।

জীবনের সকল ক্ষেত্রে, অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, সামাজিকতা, পর্ব-উৎসব, আচার-আচরণ, বেশ-ভূষা, স্বভাব-চরিত্র- সবক্ষেত্রেই মুমিনের কর্তব্য নিজ আদর্শের অনুসরণ।

ইসলাম যেহেতু কামিল দ্বীন এবং এতে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা রয়েছে তাই জীবনের সকল অঙ্গন এই নবী-শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

হাদীসের পরের অংশ-

تَقُولُونَ: إِنْ أَحْسَنَ الناسُ أَحْسَنَا، وَإِنْ ظَلَمُوا ظَلَمْنَا، وَلَكِنْ وَطِّنُوا أَنْفُسَكُمْ، إِنْ أَحْسَنَ النّاسُ أَنْ تُحْسِنُوا، وَإِنْ أَسَاءُوا فَلاَ تَظْلِمُوا.

‘এবং বলো না...,

এতে পূর্বোক্ত নির্দেশনার ব্যাখ্যা ও ব্যবহারিক রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ইম্মা‘আ’ হওয়া মানে এই নীতি গ্রহণ করা যে, লোকে সদাচরণ করলে আমরাও সদাচরণ করব, আর লোকে জুলুম করলে আমরাও জুলুম করব। এ যার নীতি সে হচ্ছে ‘ইম্মা‘আ’- অপদার্থ পরানুকরণকারী। এটা মুমিনের নীতি হবে না। মুমিনের নীতি হবে, লোকে সদাচরণ করলে মুমিন সদাচরণ করে, আর লোকে অসদাচরণ করলে সে জুলুম থেকে বিরত থাকে।

তো মুমিনের কর্ম ও আচরণ আবর্তিত হয় ইনসাফ কিংবা ইহসান (অনুগ্রহ কিংবা ন্যায়বিচার) এ দুয়ের মাঝে। তা কখনো জুলুমে নেমে আসে না। কারণ মুমিনের আচরণ নিছক প্রতিক্রিয়াবশত কিংবা অনুকরণবশত হতে পারে না, তা হয় নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ও নিজ আদর্শ অনুসারে। ইসলামী আদর্শে তো জুলুমের অবকাশ নেই। পক্ষান্তরে যার কর্ম ও আচরণ নিজ বিচার-বিবেচনা ও নিজস্ব আদর্শের আলোকে নয়; বরং অন্যের অনুকরণ বা অন্যের আচরণের প্রতিক্রিয়াবশত হয়ে থাকে সে ভালো কাজও করে প্রতিক্রিয়াবশত, আর সে কারণেই তার আচরণ প্রায়শ ন্যায় ও যৌক্তিকতার গণ্ডি অতিক্রম করে।

ইসলামে আচরণগত শিক্ষার প্রথম সীমানাটি হচ্ছে ইনাসাফের। ভেতর-বাইরের উসকানীতেও ইনসাফের সীমানা লঙ্ঘন করা যাবে না।

কুরআন মাজীদের ইরশাদ-

وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعْدِلُوا اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰی ؗ

আর দ্বিতীয় সীমানাটি হচ্ছে অন্যায়কারীর সাথেও অনুগ্রহের।

صِلْ مَنْ قَطَعَكَ، وَأَعْطِ مَنْ حَرَمَكَ، وَاعْفُ عَمّنْ ظَلَمَكَ

যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সাথে সদাচার করো, যে বঞ্চিত করেছে তাকে দান করো, যে জুলুম করেছে তাকে ক্ষমা করো। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস  ১৭৪৫২;

এক রেওয়ায়েতে আছে-

وَأَحْسِنْ إِلَى مَنْ أَسَاءَ إِلَيْكَ.

যে তোমার সাথে অসদাচরণ করেছে তার প্রতি অনুগ্রহের আচরণ করো।

এটা হচ্ছে আখলাকের উচ্চ পর্যায়। যার হিম্মত আছে তিনি এই পর্যায়ে উন্নীত হবেন। আর যার হিম্মত কম তিনি অন্তত দ্বিতীয় সীমানার ভেতর অবস্থান করবেন। এই সীমানাও অতিক্রম করে যাওয়ার অবকাশ নেই।

 

‘আলওয়াসিল’ ও ‘আলমুকাফি’

এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

لَيْسَ الوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ، وَلَكِنِ الوَاصِلُ الّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا

‘বিনিময় প্রদানকারী সম্পর্ক স্থাপনকারী নয়; সম্পর্ক স্থাপনকারী তো সে, যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে সম্পর্ক স্থাপন করে।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৯১

এ হাদীসে আত্মীয়স্বজনের পক্ষ হতে অসদাচরণের ক্ষেত্রেও সদাচারণের উৎসাহ দেয়া হয়েছে এবং ‘সদাচারের বদলে সদাচার’ অপেক্ষা এই অবস্থানের শ্রেষ্ঠত্ব বয়ান করা হয়েছে।

অন্য হাদীসে আছে, এক সাহাবী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার কিছু আত্মীয় আছে, যাদের অবস্থা হল, আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি, কিন্তু তারা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি, কিন্তু ওরা সম্পর্ক ছিন্ন করে, আর আমি ওদের মূর্খসুলভ আচরণ সহ্য করতে থাকি! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বাস্তবতা যদি এমনি হয় তাহলে তুমি যেন ওদের ছাইপাশ খাওয়াচ্ছ! আর তোমার পক্ষ নিয়োজিত থাকবেন আল্লাহর তরফ থেকে একজন সাহায্যকারী ।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৫৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৭৯৯২

এখানে ব্যাপার এই নয় যে, এক পক্ষ শুধু জুলুম করবে আর অন্য পক্ষ মুখ বুঝে সয়ে যাবে। কারণ ইসলামে তো যুলুমের সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়ার অবকাশ রয়েছে। এখানে বিষয় হচ্ছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির এবং উন্নত আচরণের। বাহ্যত যালিমকে বিজয়ী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সে হীন ও অপদস্থ। উপকারীর উপকার গ্রহণ করেও যে অসদাচরণ করে তার ঐ উপকার গ্রহণ কি লাঞ্ছনার ছাইপাশ খাওয়া নয়? বাহ্যত অসদাচরণের দ্বারা উপকারীর অসম্মান করলেও প্রকৃতপক্ষে যালিম এই কর্মের দ্বারা নিজেকেই হীন ও লাঞ্ছিত করছে। আর আখিরাতের কর্মফল তো রয়েছেই। এই দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ব্যক্তির কাছে নিজেকে নয়, ঐ অসদাচারী লোকটিকেই কৃপাযোগ্য বলে প্রতিভাত হয়। তারপর ঈমানদারের জন্য আল্লাহর রাসূলের ঐ বাণীর মধ্যে রয়েছে কত বড় বিজয়ানুভূতি যে, ঐ যালিমের অসদাচারের কারণে আল্লাহর সাহায্য তার অনুকুলে এসে গেছে। তাহলে সবদিক থেকে তো তারই জিত। আর এই জিতের কারণ হচ্ছে, অন্যের অন্যায় আচরণে প্রভাবিত না হয়ে নিজ আদর্শের উপর থাকা।

স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে এর উদাহরণ তো অজস্র। একটি মাত্র দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করছি।

 

অসদাচার তাঁর সহনশীলতাই শুধু বৃদ্ধি করে

হাদীস ও সীরাতের কিতাবসমূহে নির্ভরযোগ্য সনদে এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মদীনায় যায়েদ ইবনে ছা‘না নামক একজন ইহুদী ধর্ম-গুরু ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন যে, ইনিই শেষ নবী এবং পরে ইসলামগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কীভাবে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন তার বৃত্তান্ত তার নিজের ভাষায় এই রকম-

নবুওতের সবগুলো চিহ্নই আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখম-লে দেখতে পেয়েছি। দুইটি বিষয় বাকি ছিল। আর তা হচ্ছে-

يسبق حلمه جهله ولا تزيده شدة الجهل عليه إلا حلما.

‘তার সহনশীলতা মূর্খতার চেয়ে অগ্রগামী আর তাঁর সাথে অসৎ ব্যবহার তার সহনশীলতাই শুধু বৃদ্ধি করবে।’ তো আমি অগ্রীম মূল্য পরিশোধ করে তার কাছ থেকে কিছু খেজুর কিনলাম, যা পরে নির্দিষ্ট সময়ে সরবরাহ করা হবে। এরপর নির্ধারিত সময় আসার আগেই তাঁর কাছে উপস্থিত হলাম এবং তাঁর চাদর ও জামা বুকের কাছে খামচে ধরে তাঁর দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হানলাম এবং বললাম, হে মুহাম্মাদ! আমার পাওনা কি সরবরাহ করবে না? আল্লাহর কসম! হে বনী আব্দুল মুত্তালিব! তোমরা তো এক টালবাহানাকারী গোত্র। আমার আগে থেকেই জানা আছে, তোমাদের এই টালবাহানার স্বভাব! এ দৃশ্য দেখে ওমর রা. উঠে দাঁড়ালেন এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-

يَا عُمَرُ: أَنَا وَهُوَ كُنّا إِلَى غَيْرِ هَذَا مِنْكَ أَحْوَجُ أَنْ تَأْمُرَنِي بِحُسْنِ الْأَدَاءِ

‘ওমর! তোমার কাছে আমার এবং এই ব্যক্তির বেশি প্রয়োজন ছিল অন্যরূপ আচরণের। তুমি আমাকে আদেশ করতে সুন্দরভাবে পরিশোধ করার আর তাকে সুন্দরভাবে তাগাদা করার।’ -সুনানে কুবরা বায়হাকী, হাদীস ১১২৮৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৮৮

এরপর তিনি শুধু প্রাপ্য পরিশোধেরই আদেশ করলেন না, ওমর রা.-এর ঐটুকু আচরণের কারণে আরো বিশ সা খেজুর অতিরিক্ত দিতে বললেন।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই আচরণদৃষ্টে যায়েদ ইসলাম কবুল করেন এবং পাকা মুসলমান হয়ে যান। -আলমুজামুল কাবীর তবারানী, হাদীস ৫১৪৭

আমরা ভেবে দেখতে পারি, এই ঘটনায় মেযাজ হারানোর কতগুলো ব্যাপার ছিল। একে তো প্রাপ্য সরবরাহের নির্ধারিত সময়ের আগেই তাগাদা, দ্বিতীয়ত তাগাদাই শুধু নয় চরম অভদ্র-অশালীন আচরণ। এরপর শুধু ব্যক্তিগত অপমানই নয়, বংশের অপমান, বংশের উপর কালিমা লেপন! অন্যদিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো দুর্বল-অসহায় অবস্থায় ছিলেন না, ইচ্ছে করলেই প্রতিশোধ নিতে পারতেন, কিন্তু এরপরও এই সকল উসকানীর মুখেও তিনি স্বমহিমায় ভাস্বর রইলেন। এইসব হীন আচরণ তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে এক চুলও টলাতে পারল না।

তিনি কী করলেন? তিনি সময় না হওয়া সত্ত্বেও ঐ ইহুদীর প্রাপ্য পরিশোধ করে দিলেন, শুধু পরিশোধই করলেন না, প্রাপ্যের চেয়েও বেশি প্রদান করলেন।

এ ছিল তাঁর স্বাধীন কর্ম। তিনি তা-ই করেছেন, যা নিজের বিবেচনায় করতে চেয়েছেন। ঐ ইহুদী ধর্মগুরুর আচরণ তাঁর কর্মকে কিছুমাত্রও প্রভাবিত করতে পারেনি; বরং তাঁর শান্ত-স্বাধীন  আচরণই ঐ ইহুদীকে প্রভাবিত করেছে। তিনি মুসলিম হয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ অনুসারীতে পরিণত হয়েছেন। বলুন, কে এখানে বিজয়ী?

তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আচরণ ছিল স্বাধীন ও সম্পূর্ণ নিজস্ব আচরণ। প্রতিক্রিয়ামূলক আচরণের কথা যদি বলা হয় তাহলে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তো সেটাই ছিল, যা হযরত ওমর রা. থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল, আর বলাই বাহুল্য তা অন্যায় বা জুলুমও হত না। যে অশিষ্ট আচরণ ঐ ইহুদী ধর্মগুরু করেছেন তার সাজা তার প্রাপ্য ছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পরিবর্তে ভদ্রতা ও শালীনতা রক্ষার নির্দেশকেই হযরত ওমর রা.-এর করণীয় সাব্যস্ত করেছেন-

‘তোমার কাছে আমার এবং এই ব্যক্তির বেশি প্রয়োজন ছিল অন্যরূপ আচরণের,  আর তা হচ্ছে আমাকে তুমি উত্তম পন্থায় পরিশোধের আদেশ করবে আর তাকে আদেশ করবে উত্তম পন্থায় তাগাদার।’

এই ঘটনায় আরও যে দিকগুলো রয়েছে তা অন্য অবসরে আলোচনা করা যাবে।

আমাদের সমষ্টিগত জীবনে সীরাতের এই মহান শিক্ষার অনুসরণ অতি প্রয়োজন। যেখানেই দু’জন মানুষের সহাবস্থান সেখানেই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা। কাজেই এ জাতীয় ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত না হয়ে পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাধীন করণীয় সম্পন্ন করাই কাম্য।

সমষ্টিগত জীবনের এক ক্ষেত্র আমাদের পারিবারিক জীবন। এই জীবনের শান্তি, শৃঙ্খলা ও সাফল্যের জন্য এই গুণের বড় প্রয়োজন। পারিবারিক জীবনের সুখ শান্তি তো নানা কারণে জরুরি।

একে তো এটি নারী-পুরুষের গোটা জীবনকেই প্রভাবিত করে । দ্বিতীয়ত, পরিবারের  শিশু-কিশোরদের তথা ভবিষ্যত প্রজন্মের সাবলীল বিকাশের ক্ষেত্রেও পারিবারিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশের প্রভাব অতি গভীর। কাজেই পরিবারের যিনি কর্তা তাকে অবশ্যই এই গুণ, এই স্বাধীন আচরণের শক্তি অর্জন করতে হবে। এখানে তৃতীয় যে বিষয়টি আছে তা-হচ্ছে আল্লাহ তাআলা নারী ও পুরুষকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েই সৃষ্টি করেছেন, যা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে না পারলে অতি বড় সংযমী পুরুষেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুধু একটি হাদীস পেশ করছি, যিনি এই হাদীসের ভাব ও মর্ম যত গভীরভাবে উপলদ্ধি করবেন তিনি তত শান্তি ও কল্যাণ লাভে সমর্থ হবেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ لَنْ تَسْتَقِيمَ لَكَ عَلَى طَرِيقَةٍ، فَإِنِ اسْتَمْتَعْتَ بِهَا اسْتَمْتَعْتَ بِهَا وَبِهَا عِوَجٌ، وَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهَا، كَسَرْتَهَا وَكَسْرُهَا طَلَاقُهَا.

নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজর থেকে। সে কখনো এক নিয়মের উপর থাকবে না। তুমি যদি তাঁর দ্বারা উপকার পেতে চাও তাহলে তার বক্রতা সহই তা পেতে হবে। একেবারে সোজা করতে গেলে ভেঙ্গে ফেলবে। আর ভাঙ্গা হল তালাক দেওয়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৬৮

পারিবারিক জীবন ছাড়াও পাড়া-পড়শি, কর্তা-সহকর্মী, সঙ্গী-সাথী এবং দৈনন্দিন জীবনের নানা ক্ষেত্রে গণমানুষের সাথে যে সম্পর্ক সকল ক্ষেত্রেই  সীরাতের এই শিক্ষার অনুসরণ  অতি প্রয়োজন, অতি কল্যাণপ্রসূ। অতপর শুধু পার্থিব শান্তি-শৃঙ্খলাই নয় আখিরাতের জীবনের মুক্তি ও সাফল্যের জন্যও এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

 

ভেতরের প্রবণতা

শুদ্ধি ও যথার্থতা নির্ভর করে ভেতরের প্রবণতাসমূহের নিয়ন্ত্রণের উপর। যে মানুষটি বাইরের আচরণে বিজয়ী তিনি প্রথমে জয়লাভ করেছেন তার ভেতরের প্রবণতাগুলোর উপর। আর বাইরের আচরণে পরাজিত তিনি প্রথমে পরাস্ত হয়েছেন তার  ভেতরের প্রবণতার কাছে। অন্যের আচরণ এবং পারিপার্শ্বিক নানা পরিস্থিতি শুধু উৎসাহ বা উসকানীই দিতে পারে, কাজ করাতে পারে না। কাজ তো করে ব্যক্তি নিজে, নিজের ইচ্ছায়। কাজেই পরিবেশ পরিস্থিতিকে দোষ দিয়ে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত হওয়া যায় না।

কুরআন মাজীদে এই বাস্তবতা কত সুন্দরভাবে উন্মোচিত হয়েছে।

(তরজমা) যখন সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্য প্রতিশ্রুতি; আমিও তোমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি। আমার তো তোমাদের উপর কোনো অধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদের ডেকেছিলাম আর তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে কাজেই তোমরা আমাকে দোষারোপ না করে নিজেদেরকেই দোষারোপ কর...। সূরা ইবরাহীম (১৪) : ২২

কাজেই প্রতিক্রিয়াগ্রস্ততার কুফল থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়, নিজের ভেতরের প্রবণতাসমূহের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এটাই প্রকৃত বীরত্ব ও কর্তৃত্ব এবং সত্যিকারের বিজয় ও সাফল্য।

 

সত্যিকারের বীর

হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন পথ চলতে গিয়ে দেখলেন কিছু লোক কুস্তি করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলে- ما هذا এখানে কী হচ্ছে? লোকেরা বললেন-

هذا فلان الصريع ما يصارع أحدا إلا صرعه.

এখানে এক পালোয়ান আছে, যে-ই তার সাথে কুস্তিতে নামে তাকেই সে কুপোকাৎ করে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

أفلا أدلكم على من هو أشد منه

আমি কি তোমাদের বলব, এর চেয়েও শক্তিশালী কে?

رجل ظلمة رجل فكظم غيظه فغلبه وغلب شيطانه وغلب شيطان صاحبه

সে ঐ ব্যক্তি, যার উপর কেউ জুলুম করল (যার কারণে তার মনে ক্রোধ জাগল) কিন্তু সে ক্রোধ হজম করে ঐ ক্রোধের উপর বিজয়ী হল এবং নিজের শয়তান ও তার সঙ্গীর শয়তানের উপরও জয়লাভ করল। -মুসনাদে বাযযার: কাশফুল আসতার ২/৪৩৯, হাদীস, ২০৫৩

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন-

رواه البزار بسند حسن অর্থাৎ বাযযারের সনদটি হাসান। -ফতহুল বারী ১০/৫৩৫

যে নিজের ক্রোধের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে সে একসাথে তিন জনকে পরাস্ত করেছে :

১. ক্রোধকে, যার হাতে অনেক বড় বড় পালোয়ানও পরাস্ত হয়ে যায়।

২. নিজের শয়তানকে, যে সর্বদা তাকে অন্যায়ের দিকে প্ররোচিত করে। ক্রোধের পেছনে তো শয়তানের প্ররোচনা গভীরভাবে কার্যকর থাকে।

৩. ঐ ব্যক্তির শয়তানকে, যে জুলুম করে তাকে উত্তেজিত করেছে। বলাই বাহুল্য, অন্যের উপর জুলুমও মানুষ করে নফস ও শয়তানেরই প্ররোচনায়।

 

প্ররোচিত না হওয়া

সালাফের জীবনে প্ররোচিত না হওয়ার আশ্চর্য সব ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। দু-একটি ঘটনা সংক্ষেপে শোনাই।

এক লোক ওয়াহ্ব ইবনে মুনাব্বিহ রাহ. কে বলল- إن فلانا شتمك

অমুক আপনার সম্পর্কে কটূক্তি করেছে?

তিনি এ কথায় উত্তেজিত  তো হলেনই না; বরং যে এই সংবাদ দান করেছে তাকে লক্ষ করে বললেন-

ما وجد الشيطان بريدا غيرك

ওহে! শয়তান তোমাকেই পেল এই সংবাদের বাহকরূপে?! (মুখতাসারু মিনহাজিল কাসেদীন পৃ. ১৮৪)

ইমাম বুখারী রাহ. ‘আল আদবুল মুফরাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, এক ব্যক্তি উম্মুদ দারদা রাহ.-এর কাছে এসে বলল-

‘অমুক লোক আবদুল মালিকের কাছে আপনার নিন্দা করেছে।’ তিনি, তখন বললেন-

أن نُؤبنَ بما ليس فينا فطالما زُكِّينا بما ليس فينا

অর্থাৎ কখনো যদি আমাদের উপর এমন কোনো দোষ আরোপ করা হয় যে দোষে আমরা দোষী নই (তাহলে মনোকষ্টের কী আছে) ইতিপূর্বে বহুবার তো আমাদের এমন অনেক গুণের প্রশংসা হয়েছে, যা বাস্তবে আমাদের নেই।’

এখানে শুধু প্ররোচিত না হওয়াই নয়; এমন এক মানসিক অবস্থার বৃত্তান্ত আছে, যা এই সবের অনেক ঊর্ধ্বে।

তো সারকথা হচ্ছে, নিজের ক্রোধকে যিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেই প্রকৃত বিজয়ী বলে ঘোষণা করেছেন।

অতপর ঈমানদারদের জন্য এর বিনিময়ে আছে অতুলনীয় প্রাপ্তি।

একটি দীর্ঘ হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী বর্ণিত হয়েছে-

وَمَا مِنْ جَرْعَةٍ أَحَبّ إِلَيّ مِنْ جَرْعَةِ غَيْظٍ يَكْظِمُهَا عَبْدٌ، مَا كَظَمَهَا عَبْدٌ لِلّهِ إِلّا مَلَأَ اللهُ جَوْفَهُ إِيمَانًا

অর্থাৎ কোনো তিক্ত ঢোঁকই যা কোনো বান্দা গেলে আমার কাছে বেশি প্রিয় নয় ক্রোধের ঢোঁক গেলার চেয়ে। কোনো বান্দা যখনই আল্লাহর জন্য এই ঢোঁক গেলে আল্লাহ তার ভেতরকে ঈমান দ্বারা পূর্ণ করে দেন। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৩০১৫  আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে)

মুহাদ্দিস ইবনে কাছীর রাহ. বলেন-

انْفَرَدَ بِهِ أَحْمَدُ، إِسْنَادُهُ حَسَنٌ لَيْسَ فِيهِ  مَجْرُوحٌ، وَمَتْنُهُ حَسَنٌ

থতাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৪০৬

মুহাদ্দিস ইবনে কা‘ব রাহز বলেছেন-

ثلاث من كن فيه استكمل الإيمان بالله : إذا رضي لم يدخله رضاه في الباطل، وإذا غضب لم يخرجه غضبه عن الحق، وإذا قدر لم يتناول ما ليس له.

তিনটি গুণ যার আছে, তার আল্লাহর প্রতি ঈমান পূর্ণ হয়েছে- যখন সে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট তো এই সন্তুষ্টি তাকে অসার কর্মে লিপ্ত করে না, যখন যে ক্রুদ্ধ ও অসন্তুষ্ট, এই অসন্তুষ্টি তাকে ন্যায় থেকে বিচ্যুত করে না। আর যখন সে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী তখনও যা তার প্রাপ্য নয় তা গ্রহণ করে না। -ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৩/১৭৬

কাজেই প্রবৃত্তি ও পরিস্থিতির দ্বারা নয়, ন্যায় ও আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হওয়াই মুমিনের পরিচয়।

আরেকটি দীর্ঘ হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ، وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ مَلَأَ اللهُ قَلْبَهُ رَجَاءً يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

যে তার ক্রোধ সংবরণ করে, অথচ ইচ্ছা করলেই সে তা চরিতার্থ করতে পারত, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার অন্তর প্রত্যাশায় ভরে দিবেন। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১৪৬৪৬; আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে)

এই সকল প্রাপ্তির তুলনায় ক্রোধ সংবরণের কষ্টটুকু তো আসলে কিছুই না।

যাইহোক, মানুষের ভেতরের প্রেরণা ও প্রবণতাগুলোর মধ্যে এখানে উদাহরণ হিসেবে ‘ক্রোধ’ ও তা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আনা হয়েছে। এই মাহাত্ম্য শুধু ক্রোধের ক্ষেত্রেই নয়, রিপুর সকল চাহিদার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

 

কর্তৃত্ববান শাসক

রিপুর চাহিদাগুলোর উপর যিনি শাসনের ছড়ি ঘোরাতে পারেন তিনিই প্রকৃত শাসক, প্রকৃত বিজয়ী। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বর্ণনা করেছেন-

এই জিহাদেও (প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ) প্রয়োজন সবরের, তথা ধৈর্য ও সংযমের। যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি এবং স্বীয় শয়তানের বিরুদ্ধে ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে সে এদের উপর বিজয়ী হয় এবং আপন প্রবৃত্তির উপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় । তিনি তখন পরিণত হন এক কর্তৃত্ববান শাসকে। পক্ষান্তরে যে বিচলিত হয়ে রণেভঙ্গ দেয় সে হয় বন্দী ও পরাজিত। সে পরিণত হয় এক  লাঞ্ছিত দাসে; সে হয়ে পড়ে আপন প্রবৃত্তি ও শয়তানের হাতে বন্দী। কবি বলেন-

মানুষ যখন নিজের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয় তো প্রবৃত্তি তাকে ঐ জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে শক্তিমান হয়ে পড়ে দুর্বল। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম পৃ. ১৭২

কাজেই রিপু ও প্রবৃত্তির তাড়নায় নয়, কর্ম হতে হবে স্বাধীন আদর্শিক প্রেরণা থেকে।

 

নিজের মূল্য বোঝা

মানুষ অতি সম্মানের। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন। অন্যায় ও গর্হিত কর্ম তার এই মর্যাদার পরিপন্থী। কিন্তু এই উপলদ্ধির জন্য প্রয়োজন নিজেকে চেনা এবং নিজের মূল্য বোঝা। আমাদের সালাফ ও পূর্বসূরি এই বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন বলেই প্রবৃত্তির চাহিদায় অন্যায় কর্মে লিপ্ত না হওয়াকেই বিজয় ও কল্যাণ মনে করতেন। একেই তারা মনে করতেন নিজের প্রতি সুবিচার।

ইমাম  গাযালী রাহ. মালেক ইবনে দীনার রাহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বাজারে গেলে কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ জাগলে নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন-

اصبري فوالله ما أمنعك إلا من كرامتك علي.

সবর কর মন! আল্লাহর কসম! তোমাকে শুধু এজন্যই নিবৃত্ত রাখছি যে, আমার কাছে তুমি সম্মানের ও সমাদরের । -ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/৬৭

রিপুর তাড়না কিংবা অন্য কোনো প্ররোচনায় কোনো গর্হিত কর্মে লিপ্ত হলে এর দ্বারা নিজেকেই ছোট করা হয়, নিজের মর্যাদা বিনষ্ট করা হয়। এ কারণে প্রত্যেকের কাছে তার মানব-সত্তার দাবি, অন্যায়-অপকর্মের লাঞ্ছনা থেকে তাকে রক্ষা করা। আর তাই মানবের প্রকৃত মর্যাদা হচ্ছে তাকওয়া।

এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম সরাসরি তাকওয়াকেই মর্যাদা বলে অভিহিত করেছেন-

الحَسَبُ الْمَالُ، وَالكَرَمُ التَّقْوَى.

‘হসব হচ্ছে সম্পদ আর মর্যাদা হল তাকওয়া।’

(জামে তিরমিযী, হাদীস ৩২৭১; হযরত সামুরা রা.-এর সূত্রে)

অন্যায় ও গর্হিত কর্মের মূলে যেসব বিষয় রয়েছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে স্বভাবের হীনতা ও নীচতা। এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রাহ.। ‘তিনি ‘আলফাওয়াইদ’ কিতাবে এক জায়গায় লেখেন-

وأصل ذَلِك عدم الرّغْبَة والرهبة وَأَصله ضعف الْيَقِين وَأَصله ضعف البصيرة وَأَصله مهانة النَفس ودناءتها واستبدال الّذِي هُوَ أدنى بِالّذِي هُوَ خير وَإِلّا فَلَو كَانَت النّفس شريفة كَبِيرَة لم ترض بالدون فَأصل الْخَيْر كُله بِتَوْفِيق الله ومشيئته وَشرف النّفس ونبلها وكبرها وأصل الشّرّ خستها ودناءتها وصغرها قَالَ تَعَالَى قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا أَي أَفْلح من كبرها وكثرها ونماها بِطَاعَة الله وخاب من صغرها وحقرها بمعاصي الله فالنفوس الشّرِيفَة لَا ترْضى من الْأَشْيَاء إِلَّا بِأَعْلَاهَا وأفضلها وأحمدها عَاقِبَة والنفوس الدنيئة تحوم حول الدناءات وَتَقَع عَلَيْهَا كَمَا يَقع الذّبَاب على الأقذار فَالنّفْس الشّرِيفَة الْعلية لَا ترْضى بالظلم وَلَا بالفواحش وَلَا بِالسّرقَةِ والخيانة لِأَنّهَا أكبر من ذَلِك وأجلّ وَالنّفس المهينة.

এর মূলে আছে ভীতি ও প্রত্যাশাহীনতা, আছে বিশ্বাসের দুর্বলতা, আছে জ্ঞানের স্বল্পতা, আছে স্বভাবের নীচতা ও হীনতা এবং উন্নততর-এর বদলে নিম্নতর গ্রহণের প্রবৃত্তি। নতুবা স্বভাব-প্রকৃতি যদি হয় উন্নত-অভিজাত তাহলে তা তুচ্ছ বিষয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না। কাজেই সকল কল্যাণের মূলে আছে আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওফীক এবং মন-মানসের উচ্চতা ও আভিজাত্য, আর অকল্যাণের মূলে আছে মন-মানসের ক্ষুদ্রতা ও হীনতা। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا.

অর্থাৎ সেই সাফল্য অর্জন করেছে, যে নিজের স্বভাব-চরিত্রকে উন্নত ও পরিশুদ্ধ করেছে আর সে ব্যর্থকাম হয়েছে যে আল্লাহর নাফরমানীর দ্বারা নিজেকে হীন ও ক্ষুদ্র করেছে।

উন্নত ও নির্মল স্বভাব-প্রকৃতি কেবল উচ্চতর, শ্রেষ্ঠতর ও পরিণামে প্রশংসিত বস্তুই ভালবাসে আর হীন মন-মানস হীনতার চার পাশেই প্রদক্ষিণ  করে এবং নীচতায় পতিত হয় যেমন মাছি নাপাকি ও দুর্গন্ধযুক্ত বস্তুসমূহে পতিত হয়।

তো উঁচু স্বভাব-প্রকৃতি জুলুম, অশ্লীলতা, গর্হিত কর্ম ও আচরণ পছন্দ করে না, চুরি ও খিয়ানত পছন্দ করে না। কারণ সে এই সকল নীচতার উর্ধ্বে। পক্ষান্তরে হীন ও নীচ স্বভাবের অবস্থা হয়ে থাকে এর বিপরীত...। (আল ফাওয়াইদ, ইবনুল কায়্যিম পৃ. ৩১২-৩১২)

মানুষ যখন  সঠিক রুচির অধিকারী হয় এবং অন্যায়-অপকর্মের নীচতা আর সদাচার-সৎকর্মের উচ্চতা উপলদ্ধি করে তখন সে নিজের জন্য ঐ উচ্চতাই পছন্দ করে, যা তার আত্মমর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বস্তুত আসল বিষয় হচ্ছে সঠিক রুচি ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। এরই ভুলে সব কিছু ওলট পালট হয়ে যায়। তখন আনন্দের ব্যাপার পরিণত হয় বেদনার বস্তুতে। পরাজয়ের মাঝে খুঁজতে থাকে বিজয়। আর বিজয়কে মনে করে পরাজয়। নীচতার মাঝে অন্বেষণ করে মর্যাদা আর অধীনতার দ্বারা পেতে চায় স্বাধীনতার স্বাদ। ইসলাম এই রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির সংশোধন করেছে। ইসলাম শিখিয়েছে যে, প্রবৃত্তির প্ররোচনাকে জয় করতে পারাই বীরত্ব, চারপাশের মানুষ ও পরিবেশের দ্বারা প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত না হয়ে নিজ বিচার বিবেচনা ও আদর্শের অনুসরণের মধ্যেই মর্যাদা ও স্বাধীনতা। আর সবকিছুর মূলে রয়েছে আল্লাহর তাওফীক।

 

সমুজ্জ্বল প্রার্থনা

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক জ্যোতির্ময় প্রার্থনা-

اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الثّبَاتَ فِي الْأَمْرِ، وَالْعَزِيمَةَ عَلَى الرّشْدِ، وَأَسْأَلُكَ شُكْرَ نِعْمَتِكَ، وَحُسْنَ عِبَادَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ قَلْبًا سَلِيمًا، وَلِسَانًا صَادِقًا، وَأَسْأَلُكَ مِنْ خَيْرِ مَا تَعْلَمُ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا تَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا تَعْلَمُ.

ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি- এই দ্বীন ও ঈমানের বিষয়ে অবিচলতা এবং সুপথে চলার দৃঢ় প্রত্যয়। আপনার কাছে প্রার্থনা করছি- আপনার নিআমতের শোকরগোজারি এবং আপনার সুন্দর ইবাদত। আপনার কাছে প্রার্থনা করছি- সুস্থ হৃদয় এবং সত্যবাদী যবান। আপনার কাছে প্রার্থনা করছি- ঐ কল্যাণ, যা আপনি জানেন আর আপনারই আশ্রয় নিচ্ছি ঐ অকল্যাণ থেকে, যা আপনি জানেন। আর ক্ষমা চাইছি ঐ সকল বিষয় থেকে, যা আপনি জানেন।’

হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. বলেন , নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নামাযে এই দুআগুলো পাঠ করতেন। -সুনানে নাসায়ী ৩/৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান ২৪১৬

তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে মোবারক হাদীসটি পেশ করা হয়েছে তার মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে, নির্বিচার অনুকরণ-প্রবণতা পরিহার করা। কাজেই নির্বিচার অনুকরণ নয় এবং ভেতরের-বাইরের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়েও কাজ করা নয়। সর্বপ্রকার প্ররোচনার মুখে মুমিনের কর্তব্য, শরীয়তের শিক্ষা ও বিধানের বৃত্তে অবস্থান করা এবং নিজ স্বাধীন ইচ্ছায় উপযুক্ত কর্তব্য-কর্মটি সম্পন্ন করা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

advertisement