জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯   ||   মার্চ ২০১৮

তলাবায়ে কেরাম! মনোযোগ নষ্ট করবেন না : এখন ইলম অর্জনে নিবিষ্ট থাকুন

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ইলম অন্বেষণ পূর্ণ নিবিষ্টতা চায়।

لكل شيء آفة وللعلم آفات.

‘সবকিছুর একটি বিপদ আছে, কিন্তু ইলমের রয়েছে অনেক বিপদ।’ এ উক্তি তো পুরনো। কিন্তু এর সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত হয়তো এ সময়টি। এজন্য এখন মনোযোগের কমতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইলম অর্জনের আনুষ্ঠানিক স্তরটি হচ্ছে কঠিন কোরবানীর সময়। আগে এ কোরবানীর বড় ক্ষেত্র ছিল খোর-পোশের মান-পরিমাণে কমতি, আবাসন সংকট, যোগাযোগের জটিলতা এবং উপায়-উপকরণের অপ্রতুলতা। এখন সাধারণভাবে এসবের কোনো কমতি নেই। প্রায় সবখানেই আসবাব ও উপকরণের ছড়াছড়ি। এখন কোরবানীর যে প্রকৃত ক্ষেত্র, তা সর্বত্র ও সর্বযুগের জন্য কোরবানীর ক্ষেত্র ছিল। সে ক্ষেত্র অতীতের তুলনায় এখন বেশি মুজাহাদা ও কোরবানীর প্রত্যাশী।

আজ শুধু একটি কথাই নিবেদন করছি, প্রথম প্রথম তো ছাত্রদেরকে মোবাইলের কথা বলতাম- এটা আপনার জন্য নয়, এটা আপনার জন্য উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি বয়ে আনার পর্যায়ে পড়ে। মোবাইল আপনার জন্য প্রাণসংহারী বিষ। তখন পর্যন্ত মোবাইল আর ইন্টারনেট ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েনি। এখন তো মোবাইল আর ইন্টারনেট পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এখন তো ছাত্রদের জন্য মোবাইল আর বিষ থাকেনি; বরং সরাসরি খুনি। কিন্তু পরিস্থিতি হল, আসাতিযায়ে কেরামের সব উপদেশ পরিহার করে, প্রতিষ্ঠানের সব আইন-কানুনের খেলাফ করে মোবাইলের সঙ্গে সম্পর্ক দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সব অভিযোগ আল্লাহরই কাছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

যে ভাইয়েরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে পরবর্তী স্তরে প্রবেশ করেছেন, তারা যদি নিজ শিক্ষকের অনুমতি ও দিক-নির্দেশনায় ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমকেও ইল্ম ও দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতে চান তাহলে নীতি-বিধান মেনে আল্লাহর ওপর ভরসা করে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ছাত্রদের জন্য মোবাইলে জড়িয়ে পড়া কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের বড়রা কোনো নওজোয়ান আলেমকে অনুমতি দিয়ে থাকলে তা শর্তসাপেক্ষ অনুমতি। এতে ছাত্রদের একথা বোঝা ঠিক নয় যে, তারও অনুমতি হয়ে গেছে। এ তো সুস্পষ্ট ভুল তুলনা।

কয়েকদিন আগে হযরতপুর মাদরাসাতুল মদীনায় গিয়েছিলাম, দেখেছি, আদীব হুযুর এ বিষয় নিয়েই পেরেশান। তিনি বলছিলেন, ‘শোনা যায়, এখন নেটে কোনো কোনো মুরুব্বির বক্তব্য আসে, তরুণ আলেমরা তাদের সাক্ষাৎকার নেয়, মুরুব্বিরা তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য সাক্ষাৎকার দেন, বক্তব্য দেন। এতে তাঁদের নিয়ত তো নিশ্চয়ই ভালো। নিয়ত তো হল, এই ময়দানেও তরুণ আলেমরা কাজ করুক। কিন্তু তাঁদের তাশজী‘কে মুতলাক ধরে নিয়ে মাদরাসার তালিবুল ইলমরাও ভাবে, মুরুব্বিরা তো ইজাযত দিয়েছেন। কিছু মুরুব্বি না দিক, মুরুব্বিদের ইজাযত তো আছে। আর এটার জরুরত তো আমরা মাহসুস করছি, সেইসাথে ইজাযতও আছে। সুতরাং সোনায় সোহাগা। সেইজন্য এখন মুবতাদী তালিবুল ইলমরাও নাকি দাওয়াতী নিয়তে ফেসবুক ব্যবহার করে। এটা আমি মনে করি, একেবারে আত্মঘাতী।

যতক্ষণ পর্যন্ত তলবে ইলমের প্রাতিষ্ঠানিক স্তর সম্পন্ন না হবে, দায়িত্বশীলতার বয়সে যতক্ষণ না উপনীত হবে; -অনেকে তো এই বয়সে এসেও উপনীত  হয় না- সেটা আলাদা কথা, কিন্তু আমাদেরকে তো একটা মিয়ারে আসতে হবে। মিয়ার হল, প্রাতিষ্ঠানিক তালীম থেকে ফারেগ হওয়া। এই স্তরে পৌঁছলে তখন একজন মানুষকে তার নিজের দায়িত্বের উপর ছেড়ে দেওয়া যায়। তো যদি মনে করে যে, কোনো একজন মুরুব্বির তত্ত্বাবধানে আমি এই কাজটা করব, মুরুব্বির অধীনে- মুরুব্বিকে ব্যবহার করে নয়, তাহলে আমি তাকে খুশিমনে ইজাযত দিবো- ঠিক আছে, তুমি তোমার মুরুব্বির অধীনে কাজটা করো। তবে শুধু সাবধান করে দেব যে, এই পথের প্রতি মোড়ে মোড়ে ফণা তোলা সাপ ছোবল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। এর একটা ছোবল যিন্দেগী বরবাদ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এটা মনে রেখে সামনে চলো। কিন্তু তলবে ইলমীর প্রাতিষ্ঠানিক স্তর সম্পন্ন করার আগে আমি কখনো ইজাযত দিব না। কারণ এ বিষয়ে আমার শরহে সদর আছে যে, জাওয়াল এবং শাবাকা ধ্বংসের পথ।

‘অথচ এটা এখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা এখন বড় ফেতনায় পড়ে গেছি। মাদরাসার ভেতরেও আমরা রোধ করতে পারছি না। কারণ নফসের তাকাযা তো আছেই, আর যদি একটু বাহানা খুঁজে পায়...

আমি যেটা বলছিলাম, এরা যে মুরুব্বির দুআ নিয়ে করছে বলে- আসলে মুরুব্বিকে ব্যবহার করা এক জিনিস আর মুরুব্বির হাতে ব্যবহৃত হওয়া ভিন্ন জিনিস। এখনকার তরুণদের অনেকে কিন্তু মুরুব্বিদেরকে ব্যবহার করছে। আমি যদ্দূর বুঝি, তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে, তাদেরকে দেখিয়ে যে, উনারা আছেন আমাদের সঙ্গে, উনারা আমাদের জন্য দুআ করছেন, এটাকে আমি মুরুব্বির অধীনে কাজ করা বুঝি না। আমি বুঝি, মুরুব্বি তাদেরকে পরিচালনা করবেন। শুধু দুআ দিবেন আর ব্যবহৃত হবেন- এটা না। এটা হলে কোনো লাভ নেই। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।’

পূর্ণ কল্যাণকামনার ভিত্তিতে মনের গভীর থেকে উৎসারিত এ উপদেশ যদি আজ আমরা মূল্যায়ন না করি, তাহলে পরবর্তীতে পরিতাপ তো করতে পারব। কিন্তু পরিতাপ কখনো অতীত ফিরিয়ে আনতে পারে না। আর পরিতাপ করে সব গাফলতের কাফফারা সম্ভব হয় না। আশা করি, তলাবায়ে কেরাম এ বাস্তবতা উপলব্ধির চেষ্ট করবেন।

এখন আমাদের আসল উদ্দেশ্য হল, অর্জন করা এবং গঠিত হওয়া। এ পথে সবার আগে বাধা হল, মোবাইল ও ইন্টারনেট। এজন্য কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই এ থেকে বেঁচে থাকুন। আল্লাহ আপনাকে দ্বীন ও ইল্মে দ্বীনের জন্য কবুল করুন- আমীন।

 

advertisement