রবিউল আখির ১৪৩৯   ||   জানুয়ারি ২০১৮

আমার মুহসিন কিতাব-৪

মাওলানা ইযায আলী আমরূহী রাহ.

[শাইখুল আদব মাওলানা ই‘যায আলী রাহ. ১৩০০ হিজরী পহেলা মুহাররম ১৮৮২ ঈসাব্দ ২ নভেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ূনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুরাদাবাদ জেলাধীন ‘আমরূহা’ গ্রামের অধিবাসী। বাবার কর্মসূত্রে বাদায়ূনে আসেন। এরপর চলে যান শাহজাহানপুরে। সেখানেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। অল্প বয়সেই তিনি কুরআন মাজীদ হিফয করেন। এরপর বাবার কর্মস্থল বদলি হওয়ার সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। সবশেষে ভর্তি হন দারুল উলূম দেওবন্দে। সেখানে শাইখুল হিন্দ রাহ.-সহ তৎকালীন বড় বড় মনীষীদের কাছে আদব, ফিক্হ, তাফসীর ও হাদীসের কিতাব পড়েন। ১৩২১ হিজরী ১৯০৩ ঈসাব্দে দেওবন্দ থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করার পর শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর নির্দেশে ভাগলপুর জেলার ‘পূরীনী’তে মাদরাসায়ে নোমানিয়ায় শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। সেখানে প্রায় সাত বছর শিক্ষকতার পর শাহজাহানপুরে এসে ‘আফযালুল মাদারেস’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই মাদরাসা পরিচালনা করেন তিন বছর। এরপর ১৩৩০ হিজরী ১৯১২ ঈসাব্দে দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৩৪০ হিজরী ১৯২১ ঈসাব্দে দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা হাফেয আহমাদ সাহেবের সঙ্গে হায়দারাবাদ যান। যদিও সেখানকার প্রাদেশিক মুফতী ছিলেন হাফেয আহমাদ ছাহেব কিন্তু ফতোয়া প্রদানের যাবতীয় দায়িত্ব তিনিই আঞ্জাম দিতেন। এক বছর পর আবার দেওবন্দ ফিরে আসেন। ১৩৪৭ হিজরী ১৯২৮ ঈসাব্দে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ‘তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দে’র বক্তব্য অনুযায়ী তাঁকে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় দু’বার। প্রথমবার ১৩৪৭ হিজরী থেকে ১৩৪৮ হিজরী পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার ১৩৬৪ হিজরী থেকে ১৩৬৬ হিজরী পর্যন্ত। দারুল উলূম দেওবন্দে তিনি চুয়াল্লিশ বছর ফিক্হ ও আদবের খেদমত করেন। তিনি আরবী ও উর্দূ দুই ভাষায়ই কবিতা লিখতেন। বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ‘আল-কাসেম’ ও ‘আর-রশীদ’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে যেমন রয়েছে মৌলিক গ্রন্থ তেমনি আছে তরজমা ও হাশিয়া। তবে গুরুত্বপূর্ণ দরসী কিতাবের হাশিয়ার খেদমতই করেছেন বেশি। যেমন, হাদীস শাস্ত্রে শামায়েলে তিরমিযী। ফিক্হ শাস্ত্রে নূরুল ইযাহ, মুখতাসারুল কুদূরী, শরহে নুকায়া ও কানযুদ দাকায়েক। আরবী সাহিত্যে দিওয়ানে হামাসা ও দিওয়ানে মুতানাব্বী। বালাগাত শাস্ত্রে তালখীসুল মিফতাহ ও আরূযুল মিফতাহ। বিশেষ করে দিওয়ানে হামাসা ও দিওয়ানে মুতানাব্বীর উপর লেখা তাঁর হাশিয়া খুবই প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত। এছাড়া তাঁর মৌলিক রচনা ও সংকলনের মধ্যে রয়েছে নাফহাতুল আরব, মুফীদুত তালিবীন ও ‘দুনিয়া কো ইসলাম সে কিস কিস তারাহ রুকা গিয়া’ ইত্যাদি। অনুবাদ করেছেন ইবনে হাজার মাক্কী রাহ.-এর ‘কিতাবুয যাওয়াজির’ ও হাবীবুর রহমান উসমানী রাহ.-এর ‘কাসিদায়ে লামিয়া’। উলামায়ে দেওবন্দের নক্ষত্রতূল্য এই মনীষী ১২ রজব ১৩৭৪হিজরী/৬ মার্চ ১৯৫৫ ঈসাব্দে এই দুনিয়া ছেড়ে যান। মাকবারায়ে কাসেমীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। -অনুবাদক] [হযরত মাওলানা ই‘যায আলী রাহ. (১৩০০-১৩৭৪ হি.)-এর এই লেখায় বেশ কিছু ইলমী বিষয় রয়েছে। তালিবুল ইলম ভাইদের উপকৃত হবার মত বিষয়ও অনেক। তবে নেসাব সংক্রান্ত যে আলোচনা এখানে এসেছে, তা বুঝা ও তা নিয়ে চিন্তা ফিকির করা বড়দের কাজ। আশা করি তালিবুল ইলম ভাইয়েরা এ লেখা থেকে কেবল নিজেদের শেখার বিষয়গুলোই নেবেন। আর যা করবেন আসাতিযায়ে কেরামের পরামর্শক্রমেই করবেন। -আবদুল মালেক] নদওয়াতুল উলামা লখনৌ থেকে প্রকাশিত ইলমী পত্রিকা ‘আন-নদওয়া’য় দীর্ঘদিন ধরে ‘মেরী মুহসিন কিতাবেঁ’ শিরোনামে দেশের প্রসিদ্ধ ও বরেণ্যদের লেখা ছাপা হচ্ছে। সেখানে তাঁরা খুব সংক্ষেপে নিজেদের শিক্ষাজীবন ও মুহসিন কিতাবের গল্প বলছেন। তাতে বিশেষ করে তলাবা ও উলামায়ে কেরাম খুবই উপকৃত হচ্ছেন। তাছাড়া এর মাধ্যমে উর্দূ সাহিত্যেও একটি চমৎকার ধারার সূচনা হচ্ছে। বর্ণনার সাবলীলতা, উপস্থাপনার মাধুর্য ও রুচির বৈচিত্র্য শিরোনামটিকে এমন আকর্ষণীয় করে তুলেছে যে, নতুন লেখা তো বটেই পুরনো লেখাগুলোও অফুরন্ত স্বাদ ও সুবাস বিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সফরে আমি আহলে ইলমদেরকে মুগ্ধতার সঙ্গে লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি। সম্প্রতি আমাকেও এ বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছে। আমি সে আদেশ পালন করতে চেয়েছি এবং কিছু লিখেছিও। কিন্তু প্রাথমিক দুয়েক কথা বলে যখনই নিজের প্রসঙ্গে লিখতে যাই কলম থেমে যায়। এই শিরোনামে লেখা তো তাঁদেরই সাজে যাদের উপর বহু কিতাব ইহসান করেছে এবং তাঁরাও সেই ইহসান গ্রহণ করতে পেরেছেন। অথবা এখানে তারাই লিখবেন, যারা জ্ঞানী-গুণী ও বরেণ্যদের কাছে সমাদৃত। যাদের আত্মকথা পড়ে সবাই উপকৃত হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে তো এসবের কোনোটিই নেই। ফলে এখানে আমার লেখা হবে ওযু ছাড়া নামায পড়ার মতো। তারপরও আদেশ এবং জোর নির্দেশ- যেন কিছু না কিছু লিখি। এখন তা পালন না করে আমার কোনো উপায় নেই। আমার বড় ভাইজান হাফেয ছিলেন। আম্মার কাছে শুনেছি, তার তিলাওয়াত খুব সুন্দর ছিল। ছোটবেলা দুষ্ট বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আম্মা আব্বাকে না জানিয়েই তিনি এলাহাবাদ চলে যান। সেখানে গিয়ে পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হন। প্রথমে কনস্টেবল ছিলেন। পরে কয়েক বছরের মধ্যেই সাব-ইন্সপেক্টর হন। চাকুরীর জন্য যেদিন বের হয়েছেন সেদিন থেকে মনে হয় আর কুরআন মাজীদ হাতে নিয়ে দেখেননি। তাই নামাযে যেটুকু পড়া হয় এর বেশি আর তিলাওয়াত হয়নি। হাফেয সাহেবগণ বলেন, কুরআন মাজীদ মুখস্থ করা যতটা কঠিন, মুখস্থ রাখা তারচেয়ে ঢের কঠিন। তো, ভাইজান সাব-ইন্সপেক্টরের পদ পেয়েছেন, কিন্তু কুরআন মাজীদ ইয়াদ রাখতে পারেননি। বিষয়টি আম্মাকে খুব কষ্ট দিত। আমার নানা আলেম ছিলেন না। তবে আগের দিনের মানুষদের মতো অনেক দ্বীনদার ছিলেন। আমার বড় আরো দুই ভাই আছেন। তাদের মধ্যে একজন উর্দূ মডেল পাশ করে চাকুরীর খোঁজে গোয়ালিয়র চলে যান। আরেক ভাই আরবী পড়া শুরু করেন। তবে মীযান পর্যন্ত গিয়েই পড়া শেষ করেন। আব্বাজানের এক বন্ধু সায়্যিদ মুহাম্মাদ আলী সাহেবের পীড়াপীড়িতে বরং শেষ করতে বাধ্য হন। এরপর জেনারেল শিক্ষায় এন্ট্রান্স পাশ করেন। এবার বলি নিজের কথা। কুরআন মাজীদ হিফযের উদ্দেশ্যে আম্মাজান আমাকে একজন বয়স্ক উস্তাযের নিকট পাঠান। আমিও হিফয শুরু করি। একদিনের ঘটনা, দরসে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি সায়্যিদ মুহাম্মাদ আলী সাহেব এসেছেন। আমি উস্তাদজীর কাছেই বসা। তিনি আমাকে দেখে বললেন, এ কার ছেলে? উস্তাদজী বললেন, মুনশী মেযাজ আলীর। আমি জানতাম, ইনি আব্বার বন্ধু। তাই উস্তাদজীর সঙ্গে আমাকে নিয়ে কথা বলতে দেখে ভাবলাম, তিনি আমার উপর খুশি হবেন এবং আমাকে সাবাশি দিবেন। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তিনি রেগে উঠলেন। উঁচুস্বরে বললেন, মেযাজ আলী এমন পাগলামী করল কেন! এই মাসুম বাচ্চাটাকে কুরআন হিফযে লাগিয়ে দিল!? সে কি চাচ্ছে, তার ছেলে হাফেয হয়ে গোরস্তানে গোরস্তানে কুরআন খতম করুক! এই ছেলেটাকে সে কি ফাতেহা পড়ে হালুয়া খেতে বাধ্য করতে চাচ্ছে!? আশ্চর্য পাগলামি! আমি তখন অনেক ছোট। ভালো করে কথাও বলতে পারি না। অনেক শব্দই উচ্চারণ করতে গিয়ে তোতলামী আসে। সেজন্য সাথী সঙ্গীরা আমার তোতলামী জড়ানো শব্দগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে। তো ঘটনা সেই ছোট বয়সের হলেও সায়্যিদ সাহেবের কথাগুলো আমার হৃদয়ে খুব রেখাপাত করেছিল। এমনকি কথাগুলো কুরআনে কারীম অবমাননার পর্যায়ের মনে হয়েছিল। সায়্যিদ সাহেব ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন না। সম্ভবত ইংরেজির এক অক্ষরও জানতেন না। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তেন। এমনকি নামাযের সময় হলে কখনো ইংরেজ প্রশাসকের সামনে পেশ করা কাগজপত্র খোলা রেখেই মসজিদে চলে যেতেন। এছাড়া কাচারিতে সাধারণত আলেমদের মতো জুব্বা পরে যেতেন। যাই হোক, আল্লাহর হুকুমে আমি ‘হাফেযে কুরআন’ নামে প্রসিদ্ধ হলাম। আনন্দের বিষয় হল- শেষ বয়সে এসে সায়্যিদ সাহেব তার ছোট ছেলেকে কুরআনের হাফেয বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! আমার জানা নেই তাঁর এই পরিবর্তন কীভাবে হয়েছিল। সায়্যিদ সাহেব ধনী মানুষ ছিলেন। ছেলের কুরআনুল কারীম হিফযের জন্য ভালো ভালো উস্তায নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু তার আশা পূরণ হয়নি। আমার মনে হয়, সেই যে কুরআন-অবমাননাকর কথা তিনি বলেছিলেন, তা আল্লাহ পছন্দ করেননি। সেজন্যই তার ছেলে হাফেয হতে পারেনি। হিফয শেষ করার সময় আমার বয়স কত ছিল ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু স্পষ্ট মনে আছে, কেউ কেউ আমার দিকে ইশারা করে বলত, মুনশীজী (অর্থাৎ আমার আব্বা মেযাজ আলী) গর্ব করার জন্য ছেলেকে হাফেয নামে প্রসিদ্ধ করে দিয়েছে। এত কম বয়সে একটা শিশু হাফেয হয় কীভাবে! অবশ্য তাদের এসব কথা একেবারে ভুলও ছিল না। কারণ, আমার হিফযের অবস্থা এমন ছিল, প্রথমবার তারাবী পড়ানোর কষ্টের কথা এখনো মনে পড়ে। সে রমযানে সাহরী থেকে ফারেগ হয়ে কুরআন মাজীদ নিয়ে বসতাম। এরপর প্রাকৃতিক প্রয়োজনে তো অবশ্যই উঠতাম। এছাড়া সারাক্ষণ সেখানেই বসে থাকতাম, পারা ইয়াদ করতাম। এমনকি নামাযের সময়ও উঠতাম না। ওখানেই নামায পড়তাম। অর্থাৎ শেষরাত থেকে ইয়াদ করা শুরু করতাম, একেবারে তারাবীহর আগ পর্যন্ত পড়ে সেখান থেকে উঠে সোজা মসজিদে চলে যেতাম। এই সময়ের মধ্যে ইয়াদ করতাম কেবল সোয়া পারা। সেটাও বহু কষ্টে! এজন্য কেউ আমার হাফেয হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলে সেটা একেবারে অমূলক হত না। এভাবে ছাব্বিশ রমযান দিবাগত রাতে যখন আমাদের খতম হল, তখন তো আম্মা-আব্বার খুশির কোনো সীমা ছিল না। বড় ভাইও অনেক খুশি হয়েছিলেন। সে রাতে আমার এত আরামের ঘুম হয়েছিল যে, সাহরীর সময় খুব কষ্ট করে ওঠাতে হয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে মকতবে গেলাম। ভাবছিলাম, আজ সাথী-সঙ্গীরা এবং খোদ উস্তাদজীও আমার প্রশংসা করবেন। (অবশ্য হাফেয ছাহেব হুযুর আমার সামনে কোনোদিন প্রশংসা করেছেন বলে মনে পড়ছে না।) মকতবে হাজির হতেই এক ছাত্র টিপ্পনী কেটে বলল, ‘ছাব্বিশ দিন পর আজ ঘরের জেলখানা থেকে ওর মুক্তি মিলেছে রে!’ আর উস্তাদজী তাঁর স্বভাবসুলভ সরলতা নিয়ে বললেন, ‘কুরআনের অর্থ না বুঝতে পারলে শুধু হিফয করে কী লাভ?! কুরআনের অর্থ বুঝতে হলে তো আরবী জানতে হবে।’ উস্তাদজীর কারামাতই বলা যায় অথবা হতে পারে আল্লাহ তাআলার কুদরতের কোনো কারিশমা, তখনই আমি আরবী শেখার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করি। এ থেকে স্পষ্ট হয়, আমার আরবী পড়ার মূল প্রেরণাও ছিল এই কুরআন মাজীদ। এভাবেই আমার জীবন শুরু হয়েছে। এরপর হাফেয সাহেবই আমাকে ফার্সী কিতাব ‘আমাদনামা’ পড়ানো শুরু করেন। তিনি মোটামুটি ফার্সী জানতেন। গুলিস্তা পড়ানোর সময় উর্দূ তরজমার সাহায্য নিতেন। এরই মধ্যে আব্বাজান ‘তিলহরে’ বদলি হয়ে যান। আমাকে ওখানকার ‘মাদরাসায়ে গুলশানে ফয়েয’-এ ভর্তি করে দেন। এ মাদরাসায় ছাত্র ছিল অর্ধশতাধিক। সকলেই মাসিক অযীফা দিত। এছাড়া বাইরে থেকে প্রতি মাসে সম্ভবত আট রুপি করে আর্থিক ইআনাত আসত। এভাবেই ছোট্ট পরিসরে মাদরাসার কার্যক্রম চলত। মাদরাসায় মৌলভী মাকসূদ আলী খান নামে একজন উস্তায ছিলেন। সরফ ও নাহব শাস্ত্রে ছিলেন খুব দক্ষ। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল কিছুটা প্রাচীন ধারার। ষাট-সত্তর বছর আগে পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশে যে ধারার পাঠদান পদ্ধতি ছিল কিছুটা সেরকম। সেজন্য মীযান তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করতে হয়েছে। মুখস্থও ছিল একেবারে শব্দে শব্দে। মুনশাইবের ‘বাব’ এবং ‘সরফে সগীর’ও মুখস্থ ছিল। ‘যুবদা’ও মুখস্থ ছিল হুবহু। নাহবেমীর এবং কাফিয়ার শেষ কয়েক পৃষ্ঠা ছাড়া পুরো কিতাব মুখস্থ ছিল। আর এসব বিষয়ের প্রতি ধ্যান ও মনযোগ তখন এত বেশি ছিল যে, অধিকাংশ সময় ঘুমের মধ্যে কুরআন মাজীদের পরিবর্তে মীযান নাহবেমীরের বাক্য মুখ দিয়ে বের হত! এখানে আমি গুলিস্তা কিতাবও নতুন করে শুরু করি। এখানের ছাত্ররা ফার্সী ভাষার অনেক নিয়ম-কানুন মুখস্থ করার পর গুলিস্তা পড়ার সুযোগ পেত। ফলে ‘কাওয়ায়েদ’ পড়ার পর আল্লাহর মেহেরবানীতে গুলিস্তা আমার কাছে আর কঠিন মনে হয়নি। এরই মধ্যে আব্বাজান চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। আমরা আবার শাহজাহানপুর চলে আসি। তখন এমন একজনকে আমার পড়াশোনার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়, যিনি মোটামুটি আরবী জানতেন। তাই এ কয়েক বছর আমার আরবীর তেমন উন্নতি হয়নি; বলতে গেলে এ কয়েক বছর আমার সময়গুলো তেমন একটা কাজে লাগেনি। তবে আল্লাহর শোকর, সময় নষ্ট হওয়ার অনুভূতি আমার ছিল, এজন্য আমি পেরেশানও ছিলাম। একসময় আল্লাহর মেহেরবানী হল। আমি আব্বাকে বললাম, আমার তো ফার্সী অনেকগুলো কিতাব এখনো পড়া হয়নি। এখন যাঁর কাছে পড়ছি তিনি খুব ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়া তাঁর হয়ত সেগুলো পড়ানোর সুযোগও হবে না। তাই আমাকে ‘সেকান্দারনামা’ পড়ার অনুমতি দিন এবং শাহজাহানপুরে ‘মাদরাসা আইনুল উলূম’-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিন। আল্লাহর মেহেরবানীতে অনুমতি হয়ে গেল। মাদরাসায় গিয়ে দেখি সেখানের উস্তাযগণও খুব ব্যস্ত। কারো কাছ থেকে সময় নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। এক পর্যায়ে আমার আগ্রহ ও মেহনত দেখে দিল্লীর আমীনীয়া মাদরাসার মুহতামিম মুফতী কিফায়াতুল্লাহ ছাহেবের দয়া হল। তিনি আমাকে ‘সেকান্দারনামা’ পড়ানোর জন্য আধা ঘণ্টা সময় দিলেন। আমি সেটুকুতেই অনেক খুশি হলাম এবং তাকে গনীমত মনে করলাম। কয়েক মাস পর আসাতেযায়ে কেরাম মেহেরবানী করে আমাকে একটি জামাতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানে দুইজন উস্তাযের তত্ত্বাবধানে দৈনিক ছয়টি করে দরস হত। সেখানে আরবী কিতাবও পড়া শুরু হল। উস্তাযগণের মেহনত ও তত্ত্বাবধান ছিল এত সুন্দর যে, ইলম হাসিল করতে গিয়ে যে ধরনের কষ্ট হয় তার কিছুই আমরা অনুভব করিনি। দরসে ও দরসের বাইরে যখন যা জিজ্ঞেস করার দরকার হত জিজ্ঞেস করতে পারতাম। মাদরাসায় তো বটেই, বাসায় গিয়েও জিজ্ঞেস করতে পারতাম। হযরত মাওলানা সায়্যিদ বশীর আহমদ মুরাদাবাদী রাহ.-কে তো বহুবার ঘুম থেকে জাগিয়ে কিতাব ‘হল’ করেছি। আল্লাহ তাআলা তাঁর কবরকে রহমতের নূর দিয়ে ভরে দিন। আশ্চর্যের বিষয় হল, এজাতীয় আচরণে না আমাদের কোনো সংকোচ ছিল, না তিনি বিরক্ত হতেন। এছাড়াও মুফতী কিফায়াতুল্লাহ ছাহেব দুপুরের বিশ্রাম বাদ দিয়ে আমাকে শরহে বেকায়া পড়িয়েছেন। মেহেরবান আল্লাহ তাঁদের সবাইকে উত্তম থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। সেই দিনগুলোতে আমার জন্য মনে রাখার মত আরেকটি বিষয় ছিল- আমাদের বাড়ির পাশের বাজারে এক আর্য লোকের আতরের দোকান ছিল। তার বয়স ষাটের কম হবে না। তার দোকানে গেলেই তিনি নানা ধরণের প্রশ্ন করতেন। বিশেষ করে ইসলাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে তার প্রশ্ন হত বেশি। আমার সেসব প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকায় উস্তাযগণের কাছে ছুটে যেতাম এবং জবাব জেনে নিতাম। ওদিকে কুরআনের ‘ফাসাহাত বালাগাত’-এর বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট একটি বিষয়ে পরিণত হল। কেবলই মনে হত, কুরআনে নাহু-ছরফ ছাড়াও অন্য অনেক বিষয় আছে। এই অবস্থায় দারুল উলূম দেওবন্দে যাই। কিছুদিনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি পড়া শেষ হলে শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর কাছে তাফসীরে বাইযাবী পড়া শুরু হয়। সূরা বাকারার প্রথমেই রয়েছে ‘হুরুফুল মুকাত্তাআত’-এর আলোচনা। শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর তাকরীর এখন আর মনে নেই। এছাড়া সেই তাকরীর বোঝার যোগ্যতাও তো আমার নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে, কুরআন মাজীদ সম্পর্কে আমার যেসব ভুল ধারণা ছিল প্রতিদিনের দরসে সেগুলো দূর হতে থাকে। আমার পুরো আলোচনা থেকে সম্ভবত এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে, আমার ‘ইলমে যাহিরী’র অসীলা যেমন ছিল কুরআন মাজীদ তেমনি আকীদা শুদ্ধতার অসীলাও ছিল এই কুরআন মাজীদ। দারুল উলূম দেওবন্দে আমি যখন নূরুল আনওয়ার পড়ছি তখন দাওরায়ে হাদীসের এক ছাত্র আমাকে মাকামাতে হারীরী পড়াতেন। তার পাঠদান আমার মধ্যে আরবী ভাষার প্রতি মহব্বত তৈরি করে। একসময় আরবী সাহিত্যের মহত্ত্ব এমনভাবে মনে গেঁথে যায়, যার অসীলায় ভালো ধারণা পোষণকারীরা আমাকে ‘আদীব’ বলে। আর আমি আপন মনে বলি- لو صاحب آفتاب کہاں اور ہم کہاں + احمق بنیں ہم اس کو نہ سمجھیں اگر غلط হায় সাহেব! কোথায় সূর্য আর কোথায় আমরা?/বড় আহমক বনে যাব যদি এই ভুল ধরতে না পারি। আগেই বলেছি, আমার সরফ ও নাহবের উস্তাদজী আগের কালে পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের শিক্ষকদের ধারায় পড়াতেন। ফলে জটিল থেকে জটিল সীগাগুলোর তালীল, কঠিন ও পেঁচানো ইবারতগুলোর তারকীব ইত্যাদি খুব গুরুত্বের সঙ্গে করতে হত। এজন্য আমি শরহে জামী সমাপ্ত করার আগে নাহব বিষয়ে দরসে নেযামীর কয়েকটি কিতাব ছাড়া আর কোনো কিতাব মুতালাআ করার সুযোগ পাইনি। দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হওয়ার পর শাইখুল হিন্দ রাহ. আমাকে ভাগলপুর জেলার ‘পূরীনী’ অঞ্চলে অবস্থিত মাদরাসায়ে নোমানিয়াতে আরবী সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করতে বলেন। সেখানে কিছু সুযোগ পাওয়ায় দরসের বাইরের অনেক কিতাব মুতালাআ করি। সেসময় মুফাসসাল, আওযাহুল মাসালিক, শরহে ইবনে আকীল ইত্যাদিও মুতালাআয় ছিল। যামাখশরী রাহ.-এর ইলমী ব্যক্তিত্বের দাবি তো হল, তাঁর কিতাব ‘মুফাসসাল’-এর নাম উল্লেখ করার পর আর কোনো কিতাবের নাম উল্লেখ না করা। কিন্তু এখানে তো আমাকে বলতে হচ্ছে মুহসিন কিতাবের কথা। বলতে হচ্ছে, কোন্ কিতাবের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা হয়েছে বেশি- তার কথা। ফায়দা লাভের দিক থেকে আমি ‘আওযাহুল মাসালিক’কে ‘মুফাসসাল’ থেকে বেশি মুফীদ মনে করি। এরপর যখন ‘ইবনে আকীল’ মুতালাআ করেছি তখন তার প্রতি আমার মহব্বত বেশি হয়েছে। কিতাবটি আমি বারবার পড়েছি এবং চেয়েছি, তালিবুল ইলমরাও এই কিতাব পড়ুক। কিন্তু মাদরাসায়ে নোমানিয়া ছিল এমন এক কমিটির অধীন, যার অনুমতি ছাড়া এই চাওয়ার বাস্তবায়ন ছিল নীতিবহির্ভূত। এজন্য সেই কিতাব পড়ানোর ইচ্ছা আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। দারুল উলূম দেওবন্দে যখন এলাম তখন আমার বড় ছেলেকে পড়াতে হচ্ছে। সেই সূত্রে এক জামাতকে ‘শরহে ইবনে আকীল’ পড়ালাম। আমার ধারণা, তাতে ওদের অনেক ফায়দা হয়েছে। এভাবে মাদরাসার নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কয়েকবার কিতাবটি পড়িয়েছি। লেখক ‘ইবনে আকীলে’র ইখলাসের বরকতে যেই কিতাবটি পড়েছে তার ভক্ত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা বলি কিছুদিন ধরে আমাদের এখানে বোম্বের এক সাথী থাকেন। তিনি প্রথমে এমএ পাশ করেছেন। এখন দারুল উলূম দেওবন্দের ফারেগ এক মাওলানার কাছে মাদরাসার কিতাবাদি পড়েন। আমার কাছ থেকেও লেখাপড়ার বিষয়ে পরামর্শ নেন। তিনি মীযানুস সরফ থেকে শরহে ইবনে আকীল পর্যন্ত পড়েছেন। সেদিন তিনি বললেন, আমার কাছে শরহে ইবনে আকীলের প্রতিটি শব্দই খুব ভালো লাগে। সংক্ষেপ কথা হলো, দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আমার কাছে বর্ণনার সরলতা, শাস্ত্রীয় কায়দা-কানুন ও উপস্থাপনার সৌন্দর্যের বিচারে এই কিতাবের কোনো তুলনা ছিল না। কিন্তু যখন দারুল উলূম দেওবন্দে এলাম তখন কাশ্মিরী রাহ.-এর নির্দেশনায় সিবাওয়াইহ্ার ‘আল-কিতাব’ মুতালাআ করি। ইতিমধ্যে সেটি চারবার মুতালাআ করা হয়েছে। এখন মনে হয়, বরং আমার বিশ্বাস- সীবাওয়াইহ্র এই কিতাবই একজন তালিবুল ইলমের সামনে নাহবের জ্ঞানভা-ার উন্মোচিত করে দিতে পারে। এরপর তালিবুল ইলম সেখান থেকে যোগ্যতা অনুযায়ী যত ইচ্ছা হাসিল করতে পারে। কিতাবটি দরসে পড়ানোর দ্বারা হয়ত তেমন ফায়দা হবে না বরং ক্ষতিই হবে। কিন্তু এটা হয়ত অনুচিত হবে না, কোনো তালিবুল ইলম কাফিয়া বা এজাতীয় কিতাব বোঝার যোগ্য হয়ে গেলে এ কিতবাটি তার মুতালাআয় থাকবে। এমনকি কাফিয়ার স্থলে শরহে ইবনে আকীলও রাখা যেতে পারে। নেসাব বিষয়ে আমার স্বতন্ত্র কিছু নিবেদন আছে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে শীঘ্রই সেগুলো আন-নদওয়ার আহলে ইলম পাঠকদের খেদমতে পেশ করব। তাতে ভালো কিছু থাকলে তারা গ্রহণ করবেন। অন্যথায় পরিহার করবেন। আরবী সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা বলি। মনপূত না হলে আশা করি আমাকে ‘মাযূর’ ধরে নেবেন। কারণ, হতে পারে- معشوق من ست آں كه به نزديك تو زشت است আমার প্রেমাস্পদ তো সে-ই যে তোমার কাছে অপছন্দনীয়। এ যুগের উলামায়ে কেরাম মাকামাতে হারীরী পছন্দ করেন না। আসাম প্রদেশে সরকারি মাদরাসাগুলোতে পরীক্ষক হিসেবে গিয়ে জানতে পেরেছি, সেখানে এই মযলূম কিতাবের কেবল পাঁচ মাকামা নেসাবে রাখা হয়েছে। প্রশ্ন তৈরি করার সময় আমার অবাক লাগত, এ কয় পৃষ্ঠা নেসাবে রাখারইবা কী প্রয়োজন! বরকত হাসিলই উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে তালিবুল ইলমদেরকে কিতাবটি একবার যিয়ারত করিয়ে দিলেই হয়! এখানেই শেষ নয়। কেউ কেউ নাকি শালীনতার সীমা অতিক্রম করে এই কিতাব ও কিতাবের লেখক সম্পর্কে মন্দ শব্দ ব্যবহার করতেও দ্বিধা করেন না। আমি মাকামাতে হারীরীর খুব প্রশংসা করি। মনে করি, শব্দভা-ার, শব্দের ব্যবহার, ‘ইলমে বদী’র শৈলী ও হাকীকত এই কিতাবের মাধ্যমে যেমন স্পষ্ট হয় অন্য কোনো কিতাবের মাধ্যমে তা হয় না। এক কথায় এই কিতাবের সমকক্ষ কোনো কিতাব আমি দেখি না। যাইহোক, দরসে কমপক্ষে পঁচিশ মাকামা পড়ানো উচিত। সেইসাথে ‘তারীখে ইয়ামানী’র উল্লেখযোগ্য একটা অংশও রাখা যেতে পারে। এবার ‘দিওয়ান’ সম্পর্কে বলি, মুতাআখখিরীনের দিওয়ানের মধ্যে খুব আগ্রহের সঙ্গে কয়েকবার পড়েছি ‘দিওয়ানে বুহতুরী’। কিন্তু সাধারণভাবে জাহিলী যুগের কবিদের কথায় যে আকর্ষণ ও সাবলীলতা আছে পরবর্তীদের মধ্যে আমি সেসব গুণ দেখতে পাই না। জাহিলী যুগের কবিদের মধ্যে ইমরুউল কায়েসের কবিতা আমার বেশি পছন্দ। পরবর্তীদের মধ্যে ‘মাআররী’র ‘সাকতুয যানদ’ ও তার শরহ ‘তানভীর’ এবং ইবনে ফারেযের কবিতা এখনো আমার শিথানের পাশে থাকে। আমি এইসব কবিদের কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি। সাহিত্যের জন্য আমার মনে হয় যে পরিমাণ নাহব ও সরফ জরুরি ঠিক সেই পরিমাণ জরুরি ‘ইলমে মাআনী’ ও ‘ইলমে বয়ান’। ইলমে মাআনীর বিভিন্ন পরিভাষা ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লাভের জন্য ‘মুখতাসারুল মাআনী’ খুব জরুরি। এরপর ‘দালাইলুল ই‘জায’ কিংবা ‘মুতাওয়াল’ পড়ে নিলেই যথেষ্ট। আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, তালিবুল ইলমদেরকে প্রথমে সহজ ও সংক্ষেপে শাস্ত্র ও শাস্ত্রের পরিভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। আর আসাতিযায়ে কেরাম খুব হেকমতের সঙ্গে তালিবুল ইলমদের মধ্যে এমন যোগ্যতা তৈরি করে দেবেন যেন তারা খুব আগ্রহ নিয়ে মাদরাসায় আসে, মাদরাসা ও জেলখানার পার্থক্য পরিষ্কার বুঝতে পারে। দরসের সময়গুলো যেন জেলবন্দির মতো না কাটে। তালিবুল ইলমদের মধ্যে যখন শব্দের অর্থ ও মর্ম বোঝার যোগ্যতা তৈরি হবে তখন তাদেরকে ভাষাবিদদের কিছু উপস্থাপন শৈলী বুঝিয়ে ‘মুখতারুস সিহাহ’ ও এজাতীয় কোনো কিতাব পড়িয়ে দেবেন। তাদের মধ্যে আরবী বোঝার যোগ্যতা তৈরী হয়ে গেলে ‘মুনতাহাল আরীব’ এরপর ‘লিসানুল আরব’ থেকে উপকৃত হবার পদ্ধতি শিখিয়ে দেবেন। ‘আকরাবুল মাওয়ারিদ’ কিতাবটি অনেক সহজ হওয়া সত্ত্বেও তাতে আমার অনেক আপত্তি আছে। ‘মুনজিদ’ও নতুন শব্দের জন্য এক পর্যায়ে উপকারী মনে হয়। কিন্তু প্রাচীন আরবী, বিশেষ করে তাফসীর ও হাদীসের ক্ষেত্রে এর দ্বারা উপকৃত হওয়া বিষ মেশানো মধু থেকে ভিন্ন কিছু নয়। দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক মুহতামিম হযরাতুল উস্তায মাওলানা মুহাম্মাদ আহমাদ রাহ. যখন হায়দারাবাদ দক্ষিণের উচ্চ আদালতে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্বে নিযুক্ত হলেন তখন অধমও তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তখনই আমার প্রথম ফতোয়া লেখার সুযোগ হয়। সেসময় ‘মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যাহ’ ও ‘আল-হুজাজুল ওয়াযিহা ফিল বায়্যিনাতিল রাজিহা’ থেকে অনেক উপকৃত হয়েছি। তাই আজও সেই মুসান্নিফদের জন্য দুআ করি। ‘মাজাল্লা’ তো এখনো আমার কাছে আছে। তা দুর্লভ কোনো কিতাবও নয়। শুনেছি এক খ্রিস্টান তার ব্যাখ্যাও লিখেছে। সেই ব্যাখ্যাগ্রন্থের উদ্ধৃতিও এখন প্রচুর পাওয়া যায়। তবে ‘আল-হুজাজুল ওয়াযিহা’, যাকে ফিকহের বিশ্বকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না- খুবই দুর্লভ। কিতাবদুটির বিষয়বস্তু হল মুআমালা ও লেনদেন। ব্যাপক জানার জন্য হয়ত এ দু কিতাবের সহযোগিতা যথেষ্ট নয়। তবে ‘কাযা’ বা বিচার সংক্রান্ত মাসায়েল খুব সহজেই এখানে পাওয়া যায়। ব্যাপকভাবে জানার জন্য আমার ধারণায় ‘বাদায়েউস সানায়ে’ খুবই চমৎকার। শরহে বেকায়ার কথা এখানে উল্লেখ না করলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ, সেটি পড়ার পর বারবার পড়ানোরও সুযোগ হয়েছে। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার দরুন তা থেকে খুব বেশি উপকৃত হতে পারিনি। শরহে নুকায়া নামে দুটি কিতাব আছে। একটি মোল্লা আলী কারী রহ.-এর। আরেকটি শুমুন্নী রহ.-এর। দ্বিতীয়টির হাতে লেখা নুসখা তো দারুল উলূম দেওবন্দের কুতুবখানায় আছে। প্রথমটি ছেপেছে ‘কাযান’ থেকে। হিন্দুস্তানের কয়েক জায়গায় এর বিভিন্ন নুসখা দেখেছি। তবে সম্ভবত সবগুলোই কাযান থেকে ছাপা নুসখা থেকেই নকল করা। কারণ, বড় বড় ভুলের ক্ষেত্রে আসল নকল সবগুলোই বরাবর। একটি নুসখা আমার কাছেও আছে। মদীনা মুনাওয়ারাহ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। সেটিও কাযানের ছাপা। হিন্দুস্তানে কেবল কিতাবুল হজ পর্যন্ত এক খণ্ডে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় খ- কিতাবুল ওয়াকফ পর্যন্ত মুদ্রণাধীন রয়েছে। শরহুন নুকায়ার এই নুসখা সম্পর্কে আমার প্রশংসা যদিও অজ্ঞের প্রশংসা। তবে কিতাবটিকে মোল্লা আলী কারী রাহ.-এর ইলমী বৈশিষ্ট্যের নিদর্শন মনে করা হয়। তাকলীদের যে ভুল অর্থ বর্তমান হিন্দুস্তানে প্রচারিত, এই কিতাবের মাধ্যমে তা দূর হতে পারে। প্রাসঙ্গিক আরেকটি কথা বলি, আমার মতে একেবারে শৈশব থেকেই বাচ্চাদেরকে আখলাক ও তাসাওউফের প্রতি আগ্রহী করা উচিত। তবে আমলীভাবে। কিতাব পাঠদানের মাধ্যমে নয়। আর চেষ্টা করা উচিত, যেন তার দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই শিক্ষারও উন্নতি হতে থাকে। নিকটতম সময়ের মধ্যে যেহেতু নেসাব সংস্কার বিষয়ে কিছু লিখতে হবে তাই শুধু এটুকু বলেই সমাপ্ত করছি, ইমাম নববী রহ.-এর ‘রিয়াযুস সালেহীন’ নেসাবভুক্ত করা সম্ভব না হলে কমপক্ষে মাধ্যমিক স্তরের তালিবুল ইলমদের জন্য কিতাবটি অনানুষ্ঠানিক পাঠ্য করা যেতে পারে। আর যারা দরসী কিতাবাদি মোটামুটি বুঝে, দরসে অন্তর্ভুক্ত শাস্ত্রগুলো সম্পর্কেও যথেষ্ট জানে তাদের জন্য ইমাম গাযালী রহ.-এর রচনাবলী মুতালাআ করাও আমি উপকারী মনে করি। ষ ভাষান্তর : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

advertisement