রবিউল আখির ১৪৩৯   ||   জানুয়ারি ২০১৮

প্রেক্ষাপট : মধ্যপ্রাচ্য ও আরব জাহান : জাগুক মুহাম্মাদ নামের দায়িত্ববোধ

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

তুমি যদি মুহাম্মাদ হও, তবে এ নামের কোনও দাবি তোমার কাছে থাকে না কি? তোমার এ নাম কে রেখেছে? কেন রেখেছে? যার নামে তোমার এ নাম, তাঁকে তোমার ভাবার দরকার আছে না কি? নিশ্চয়ই যিনি তোমার এ নাম রেখেছেন, তাঁকে লক্ষ করেই তোমার এ নাম তিনি বাছাই করেছেন। তার এ বাছাইকরণের মর্যাদা রক্ষার প্রয়োজন তোমার আছে না কি? ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, আলটপকা তার মুখে এ নাম এসে গেছে অমনি রেখে দিয়েছেন। তিনি তোমার এ নাম ভেবেচিন্তেই রেখেছেন। তা তিনি কী ভেবেছিলেন? কাকে ভেবেছিলেন? নিশ্চয়ই তিনি ভেবেছিলেন এ নামের একজনা এককালে এ দেশে জন্ম নিয়েছিলেন। জন্ম নিয়েছিলেন নিতান্তই গরীবের ঘরে। জন্ম নিয়েছিলেন এতিম হয়ে। বাবার মুখ দেখার নসীব তাঁর কোনওদিনই হয়নি। অভিভাবকত্ব পেয়েছিলেন দাদার। দাদাই কী ভেবে তাঁর নাম রাখেন ‘মুহাম্মাদ’? মুহাম্মাদ মানে চরম প্রশংসিত। হ্যাঁ, সেই এতিম মুহাম্মাদ কালে এমনই কীর্তি জগৎসম্মুখে প্রদর্শন করেন, যা তাঁকে চরম প্রশংসিত করে তোলে সারা জাহানের মুখে। মানুষ নামের উপযুক্ত যে-কোনও ব্যক্তি তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য। সেই যে কীর্তি প্রদর্শনের কাল থেকে তাঁর প্রশংসা শুরু হয়েছে, তখন থেকে অবিরাম তাঁর প্রশংসা চলছে আরবে-আজমে, পূবে-পশ্চিমে, উত্তরে-দক্ষিণে, জলে-স্থলে, যমীনে-আসমানে- সর্বত্র সবখানে। তাঁর প্রশংসা করছে কালো আফ্রিকান, লাল ইউরোপিয়ান, সাদা রুশ ও ধূসর এশিয়ান। তা কেন তাঁর এত প্রশংসা? কী এমন কীর্তি তিনি রেখে গেছেন জগৎসভায়? কী এমন তিনি করেছেন, যা জগতের প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে বাধ্য করছে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে? তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে? হ্যাঁ, মানুষ নামের এ জীব তাঁর কাছ থেকে যা পেয়েছে, তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। ছিল অভাবনীয়। আত্মকলহে জর্জরিত মানুষ কখনও কি ভেবেছিল, তারা সব দ্বন্দ্ব-কলহ ভুলে এক কাতারে একশা হয়ে যাবে? কখনও কি তারা ভাবতে পেরেছিল, বংশ-গোত্রের বিভেদ ঘুচে তাদের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে? এ কি কখনও চিন্তা করা সম্ভব ছিল যে, রক্ত ও বর্ণের বৈষম্য মুছে মনুষ্যত্বের মহিমায় সব মানুষ একাত্ম হয়ে যাবে? হ্যাঁ, যা ভাবা সম্ভব ছিল না, যা ছিল কল্পনার অতীত, মহান উম্মী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই বাস্তবে পরিণত করে দেখালেন। বু‘আছ যুদ্ধের আগুন নিভে গেল। আওছ-খাযরাজ এক হয়ে গেল। বিলাল-সুহায়বের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হল। কে কুরায়শ, কে কুরায়শ নয় সে প্রশ্ন তিরোহিত হল। কে আরব, কে আজম এ প্রশ্ন ঘৃণ্য হয়ে গেল। বর্ণবৈষম্য জাহিলিয়ত সাব্যস্ত হল। সকলের জান, সকলের মাল ও সকলের ইজ্জত সমান মর্যাদা পেল। দুর্বল পেল শক্তিমানের আশ্বাস। শক্তিমান পেল দুর্বলের ভালোবাসা। সামাজিক মর্যাদায় ও রাষ্ট্রীয় সুবিধায় স্থাপিত হল সবার সমান অধিকার। গড়ে উঠল একটা জাতি। এমন একটা জাতি, যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের লক্ষবস্তু আখিরাত। তারা বিলাসিতাবিমুখ। তারা ত্যাগী; ভোগবাদী নয়। তারা বিদ্যানুরাগী। তারা নারীকে সম্মান দিতে জানে। তাদের নারী নিজ আসনটি চেনে। নিজের মর্যাদা বোঝে। তাদের নারী অনুপ্রেরণাদাত্রী। তারা তাদের শিশুদের তরবিয়ত করে। তাদের কোল শিশুর পাঠশালা। সেখানে হয় সোনার মানুষ গড়ার হাতেখড়ি। তাদের হাতেগড়া মানুষেরাই গড়েছে ইতিহাস। সত্যিকার মানুষের ইতিহাস। তারা জ্ঞান বিলিয়েছে জগদ্ব্যাপী। দূর করেছে অজ্ঞতার অন্ধকার। তারা মানুষকে মানুষের পূজা থেকে মুক্তি দিয়েছে। বস্তুবাদের দাসত্ব থেকে উদ্ধার করেছে। মানুষের ভেতরে জাগ্রত করেছে মনুষ্যত্ববোধ। সর্বত্র ন্যায়ের নিশানা উড়িয়েছে। বিস্তার ঘটিয়েছে উদার-উন্নত চিন্তার। অনন্যসাধারণ এ জাতি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই মেহনতের ফসল। তাঁর মেহনতের বদৌলতেই মানুষ পেয়েছে চলৎশক্তি। শিখেছে ভাবতে; দোজাহানের মুক্তির ভাবনা। মানুষ বুঝতে পেরেছে ভালোমন্দের তারতম্য। জানতে পেরেছে পাপ-পুণ্যের ফারাক। শুরু হল সৌন্দর্যের পথে অগ্রযাত্রা। আজ যেখানে যতটুকু ভালো, যতটুকু কল্যাণ তা সেই ছুটে চলারই অর্জন। তাই তো তিনি মুহাম্মাদ- সকলের প্রশংসিত। প্রশংসা তাঁর প্রাপ্যই বটে। মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহনতে যে সচলতা মানুষ লাভ করেছিল, তার অর্জন ছিল কতই না বিপুল, বিস্ময়কর! কিন্তু কালক্রমে তাঁর উপর পড়েছে নানা অপশক্তির কুনজর। ভেতর থেকেও লেগেছে ঘুণপোকা। এসেছে স্থবিরতা। ফলে সেই অর্জনে নতুন যোগ না হয়ে ঘটেছে নানামাত্রিক বিয়োগ। ফলে সেই মহান জাতিটির আজ এই ভগ্নদশা। ওহে মুহাম্মাদ! সেই মহান নবী, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষেরই নামে তোমার নাম। এ নামের সাথে জড়িয়ে আছে জাতিগঠনের ইতিহাস। মানবতার মুক্তির ইতিহাস। সকল বৈষম্যরেখা মুছে ফেলার ইতিহাস। পরবর্তীকালে সেই ইতিহাসের সাথে যোগ হয়েছে অনেক ভাঙচুরের কাহিনী। সেই ভাঙচুর কারা করেছে? শত্রুর কারসাজি আছে বৈ কি! কিন্তু ওই নামের যারা নিশানাবরদার, তারাও কি কম দায়ী? ভাঙচুরের হাতুড়ি-শাবল তো তারাই চালিয়েছে। কৃচ্ছ্রতার স্থানে বিলাসিতা কারা এনেছে? ত্যাগের স্থানে ভোগে কারা মেতেছে? সম্প্রীতির স্থানে দ্বন্দ্ব-কলহে শক্তিক্ষয় কারা করেছে? কারা দিলো ন্যায়-ইনসাফের জায়গায় জুলুম-নির্যাতনের প্রতিষ্ঠা? দুনিয়াজুড়ে ইসলামী খেলাফতের গোড়াপত্তন করেছিলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। শত-শত বছর তা চলছিল পূর্ণ শৌর্য-বীর্যে। সেই বিস্তীর্ণ শক্তিমান খেলাফত জরাগ্রস্ত হল। শেষে তা ভেঙে তছনছই হয়ে গেল। কে ধরাল তাতে জরা? কারা তা ভেঙে তছনছ করল? অন্যকে যতই দোষারোপ কর না কেন হে মুহাম্মাদ নামের ফেদায়ী, হাতুড়ি তো তোমরাই চালিয়েছ। তোমরা দিয়েছ জাতীয়তাবাদের শ্লোগান। তোমাদের উন্নাসিকতায় পেয়েছিল। নবী-শিক্ষা ছিল- আজমীর উপর আরবীর কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কিন্তু তোমরা সেই শিক্ষা উপেক্ষা করেছ। মাঝখানে টেনে দিয়েছ আরব-আজমের ভেদরেখা। ভেঙে দিলে খেলাফত। তারপর নিজেরাও ভেঙে গেলে। তৈরী হল সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, ইয়েমেন, জর্ডান, লেবানন, ইরাক, সিরিয়া আরও কত কী। একক শক্তি ভেঙে খণ্ড খণ্ড হল। তারপর তার এক খণ্ড আরেক খণ্ডের বিরুদ্ধে শক্তি ক্ষয় করতে শুরু করল। কী পরিহাস! আপনার শক্তি আপনাতেই ক্ষয়। শক্তিক্ষয়ের এই প্রতিযোগিতা কী হেতু? কেন আজ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধকলহ? কার স্বার্থে? যদি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যেই হয়, তবে সে উদ্দেশ্য কি কোনওদিনই এর দ্বারা চরিতার্থ হয়, না হওয়া সম্ভব? ইতিহাস তো বলে, এর দ্বারা মূলত ক্ষমতার ভিত্তিই ধ্বংস হয়ে যায়। এ কলহ শত্রুকে পথ করে দেয়। বন্ধু সেজে শত্রু ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাই তো আজ বর্ণচোরা শত্রুদের খেলার ঘুটিতে পরিণত প্রিয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দেশ। ওহে অদ্যকারের মুহাম্মাদ! তোমার তো সে কথা না বোঝার কারণ নেই। তুমি আজ কাকে বন্ধু বলে গলায় জড়াচ্ছ? প্রিয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রুকে? তাঁর গড়ে যাওয়া জাতির শত্রুকে? তারা কেমন শত্রু, কী তাদের চরিত্র, সারা কুরআনেই তা চিত্রিত করা হয়েছে। আহা! কুরআন নাযিলের দেশ আজ কাদের স্বাগতিক? কুরআনের শত্রুদের নয় কি? যারা ভূপৃষ্ঠ থেকে কুরআন মুছে দিতে চায়, কুরআনের শিক্ষা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চায়, কুরআনবিরোধী কালচার বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চায়, কুরআন নাযিলের দেশে শত্রুসভ্যতার প্রতিষ্ঠা যাদের স্বপ্ন, তাদের কিনা আজ বন্ধুর ভেক আর তাদের কুটচালে বন্দী হয়ে আজ তোমার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা! নিজ দেশে আজ তুমি কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছ? অনেক অবক্ষয়ের পরও আমাদের একটা সান্ত¡নার জায়গা ছিল। অন্ততপক্ষে প্রিয়নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদেশে কিছুটা হলেও তাঁর শিক্ষা মেনে চলা হচ্ছে। এখানকার সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে এবং এখানকার সমাজে ও রাষ্ট্রনীতিতে তাঁর আদর্শের কিছুটা ছাপ আছে। ওই ছাপটুকুর কারণে শত্রুরা নাখোশ ছিল। চারদিকে সমালোচনা ছিল। অন্ধকার যুগের আঁধারচ্ছন্ন দেশ বলে গাল দেওয়া হচ্ছিল। এ যাবৎকাল তাদের সেই অখুশি ও সমালোচনা আমাদের খুশি করত। কারণ শত্রু সমালোচনামুখর হলে ভাববার সুযোগ থাকে আমরা সঠিক আছি। কিছুটা হলেও আমরা জায়গামত আছি। এখন সেই সমালোচনা কমছে। তা কমারই কথা। কারণ আদর্শের অবশেষটুকুও আজ নিজ হাতে মুছে ফেলা হচ্ছে। ওদের মত আমাদেরও ঘরভাঙার আয়োজন চলছে। আমাদের নারীর যে মর্যাদার জায়গা ছিল, সেখান থেকে তাদের উৎখাতের পালা যখন শুরু হয়ে গেল, তখন ঘর ভাঙার বেশি দেরি নেই। ঘর ভেঙে গেলে আর কোনওকিছুই ভাঙার বাকি থাকবে না। এক-এক করে সেই ভাঙা স্থানে পশ্চিমাদের সবকিছুই এসে জুড়ে বসবে। তখন নবীপ্রেমিকদের অন্তরে কেবল রক্তক্ষরণই হবে, কারও সান্ত¡নার কোনও জায়গা থাকবে না। নির্দেশ ছিল, তোমরা ইয়াহূদ ও নাসারাদের বন্ধু বানিও না। কারণ ওদের বন্ধু বানানোর পরিণাম নিজের সবকিছু থেকে হাত ধুয়ে ফেলা। শুরুটা হয় সভ্যতা-সংস্কৃতির অনুকরণ থেকে। সেই শুরু কার্যত হয়েই গেছে। তারপর ক্রমে আইন-কানূন, বিচারব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছুই অন্ধঅনুকরণের শিকার হয়ে যায়। পরিশেষে সমগ্র জাতিসত্তা তথাকথিত বন্ধুজাতির ভেতর বিলীন হয়ে যায়। ছদ্মবেশী বন্ধুদের তো সেটাই কাম্য। সেই লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত তারা সন্তুষ্ট হওয়ার নয়। কুরআন তো বলেই দিয়েছে- وَ لَنْ تَرْضٰی عَنْكَ الْیَهُوْدُ وَ لَا النَّصٰرٰی حَتّٰی تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ . ইহুদী ও নাসারা তোমার প্রতি কিছুতেই খুশি হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। -সূরা বাকারা (২) : ১২০ তাই এ আত্মঘাতী অনুকরণ তুমি কিভাবে করতে পার, যখন তোমার কাছে রয়ে গেছে সম্মানজনক জীবনের পথনির্দেশ? সেই পথনির্দেশের অনুসরণ করে তোমার পূর্বসূরিরা রচনা করেছিল গৌরবময় ইতিহাস। সে এক পথনির্দেশই বটে। তার অনুসরণে ইতিহাসের গৌরবই রচিত হয়। তার বিকল্প খোঁজার মত আত্মপ্রবঞ্চনা হয় না। কারণ সে যে আল্লাহর পথনির্দেশ। আর اِنَّ هُدَی اللّٰهِ هُوَ الْهُدٰی ‘প্রকৃত পথনির্দেশ তো আল্লাহরই পথনির্দেশ’। এর বাইরে কল্যাণ ও মুক্তি এবং উন্নতি ও সমৃদ্ধি খুঁজতে গেলে তাতে কেবল বিভ্রান্তিই বাড়তে পারে- فَمَا ذَا بَعْدَ الْحَقِّ اِلَّا الضَّلٰلُ. সত্য স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বিভ্রান্তি ছাড়া আর কী অবশিষ্ট থাকে? -সূরা ইউনুস (১০) : ৩২ গোটা জাতিকে নিয়ে সেই বিভ্রান্তিতে ঘুরপাক খাওয়ার জোগাড় হচ্ছে না তো? তখন তুমি কার সাহায্য পাবে? আল্লাহর হিদায়াত উপেক্ষা করে আল্লাহর সাহায্য লাভের তো আশা করা যায় না। ইয়াহূদ-নাসারার অনুকরণ করার সর্বাপেক্ষা বড় কুফল তো আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হওয়া। কুরআনের ঘোষণা- وَ لَىِٕنِ اتَّبَعْتَ اَهْوَآءَهُمْ بَعْدَ الَّذِیْ جَآءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللهِ مِنْ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیْرٍ. তোমার কাছে (ওহীর মাধ্যমে) যে জ্ঞান এসেছে, তার পরও যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ কর, তবে আল্লাহর থেকে রক্ষা করার জন্য তোমার কোনও অভিভাবক থাকবে না এবং সাহায্যকারীও না। -সূরা বাকারা (২) : ১২০ অনুকরণপ্রবণতা মানুষকে মেরুদ-হীন করে তোলে। কিংবা বলা যায়, মেরুদ-হীন লোকই অন্যের অনুকরণ করে। ফলে সে এমন এমন কাজ করে বসে, যাতে লাজলজ্জার বালাই থাকে না। আজ ইহুদীদের সংগে গাঁটছড়া বাঁধা কি সেই লজ্জাহীনতারই নগ্ন প্রকাশ? সন্দেহ নেই খোমিনীর ইরান এক পুরানো শত্রু। শিয়া সম্প্রদায় তার জন্মের শুরু থেকেই ইসলামের সাথে শত্রুতা করে আসছে। বরং তার জন্মই ইসলামবিদ্বেষ থেকে, তা সে মুখে যতই ইসলামের নাম নিক না কেন। মহান আবূ বকর রা.-কে যে ঘৃণা করে, সে ইসলামের শত্রু নয় তো কি? ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠায় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা.-এর মত ভূমিকা আর কার আছে? এ উম্মতের দ্বিতীয় মহান ব্যক্তি খলিফা উমর রা.। তাঁর প্রতি যার বিদ্বেষ, সে কতটুকু মুসলিম? মহিয়সী মা আয়েশা সিদ্দীকা রা.। তাঁর প্রতি শত্রুভাবাপন্নকে কে বলে মুসলিম? সাহাবীদের গোটা জামাতকেই যারা বেঈমান ঠাওরায় (নাউযুবিল্লাহ), তারাও বুঝি ঈমানদার? ঈমানদার তারা নয়, এটাই স্পষ্ট। তাই তো তারা চিরদিন ঈমানদারদের সাথে শত্রুতা করে আসছে। বাগদাদে সর্বপ্রথম ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল ওদেরই মদদে। হালাকুখানের সেই ধ্বংসলীলা কোনও মুসলিমের পক্ষে কি ভোলা সম্ভব?... ইসলামের এই ঘোরতর শত্রু ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে চিরদিন শত্রুতা করে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তারা ইরাকে, বাহরাইনে, লেবাননে, ইয়েমেনে যখন যেখানে সুযোগ পাবে, সেখানেই ঘোট পাকাবে, দাঁত বসাবে, থাবা বিস্তার করবে। থাবা বিস্তার তারা করেই যাচ্ছে। সেই লক্ষ্যে করছে উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধি। কাজেই তাদের ব্যাপারে নীরব-নিশ্চুপ বসে থাকার সুযোগ নেই। শত্রুকে শত্রুই গণ্য করতে হবে, তাতে যে যাই মনে করুক না কেন। তাদের ব্যাপারে বিচক্ষণতা ও হুঁশিয়ারীর সাথে বাস্তবমুখী পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে অবহেলার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু তাই বলে তো অপর শত্রু অভিশপ্ত ইহুদীদের সাথে দোস্তী করা চলে না। ওহে মুহাম্মাদ! তুমি আজ দুই শত্রুর মাঝখানে। একদা প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও দুই শত্রুর মাঝখানেই ছিলেন। আজ যেমন একদিকে ইরান অপরদিকে ইসরাঈল, তেমনি সেদিনও দুই দিকে দুই শত্রু ছিল, যদিও সেই দুই শত্রুর রূপ ছিল সময়ভেদে বিভিন্ন। একসময় মদীনার ইহুদী ও মক্কার পৌত্তলিকগণ। পরে ইরানের মাজূসী ও রোমের খৃষ্টানগণ। স্বতন্ত্র কোনও রাষ্ট্রের মালিক না হলেও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী ইহুদীরা ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে হামেশাই তৎপর ছিল। সেই হিসেবে লড়াই ছিল এই ত্রিশত্রুর বিরুদ্ধে, যদিও বড়-বড় যুদ্ধগুলি বৃহত্তম দুই শক্তির সাথেই হয়েছে। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরে সাহাবীগণ কোনও শত্রুর সংগেই আপোষ করেননি। হিজায ভূমিতে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলিমগণ দু’দিকের বৃহৎ দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে। পূবদিকে হযরত সা‘দ ইবন আবূ ওয়াক্কাস রা.-এর নেতৃত্বে ইরানীদের বিরুদ্ধে লড়াই চলেছে, তো পশ্চিমে বোঝাপড়া চলেছে হযরত আবূ উবায়দা রা.-এর নেতৃত্বে রোমানদের সংগে। ইয়ারমুকের রণাঙ্গনে রোমানদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে আর কাদেসিয়ার যুদ্ধে মেরুদ- ভাঙে ইরানীদের। একই সংগে এতবড় দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ইসলামী খেলাফত হতোদ্যম হয়নি। মুসলিম জাতি ও তাদের খলিফা বিন্দুমাত্র হিম্মত হারায়নি। আল্লাহর প্রতি ছিল তাঁদের পূর্ণ আস্থা। নিজেদের ঐক্য ও সংহতি রেখেছিল অটুট। ক্ষমতার মোহ ও ইহজীবনের আসক্তি তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁদের ছিল ইখলাস। ছিল আল্লাহর ভয় ও আখিরাত অভিমুখিতা। আর সেটাই ছিল তাঁদের হিম্মত ও মনোবলের উৎস। ফলে একইসংগে তাঁরা লড়তে পেরেছেন সকল শত্রুর বিরুদ্ধে। একইসংগে উভয় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া আজও সম্ভব। দরকার শুধু ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করা। দরকার ঈমানের বলে বলীয়ান হওয়া। এই শর্তে উত্তীর্ণ হতে পারলে না ইরানকে তোয়াক্কা করা দরকার আছে, না প্রয়োজন আছে ইসরাঈলের সাথে বন্ধুত্বের। ইসরাঈল বা ইহুদীদের সাথে বন্ধুত্ব- এর মত অশ্রাব্য ভাষা আর কি হতে পারে? আজ সেই ভাষাও আমাদের উচ্চারণ করতে হয়! কোথা-কোথা থেকে এই ভবঘুরে অভিশপ্ত জাতি ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে এসে জুড়ে বসেছে। তারা এখানকার মূল বাসিন্দা ফিলিস্তিনী জাতিকে বাস্তুচ্যুত করে নিজেদের বসতবাড়ি তৈরি করেছে। গড়েছে একটি আগ্রাসী রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনের বিস্তৃত ভূমি তাদের আগ্রাসনের শিকার। তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার লক্ষ-লক্ষ ফিলিস্তিনী। বছরের পর বছর তারা নিরীহ-নিরস্ত্র মুসলিমদের হত্যা করছে। নির্বিচারে খুন করছে নারী ও শিশুদের। সেই রক্তপিপাসু হায়েনাদের সংগে দোস্তী করবে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনও অনুসারী? তারা তো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই চেষ্টা তারা করেছিল বার বার। তাঁকে বিষপান পর্যন্ত করিয়েছিল। ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়েছে অব্যাহতভাবে। খুলাফায়ে রাশিদীনের আমলে যখন ইসলামের দিগি¦জয় চলতে থাকে, বাহ্যত সমরশক্তিতে তাদের প্রতিরোধ করা যখন অসম্ভব মনে হতে থাকে, তখনও এই অভিশপ্ত জাতিটি নীরব বসে থাকেনি। আব্দুল্লাহ ইবন সাবা’র নেতৃত্বে তৈরি করেছে ফিতনাবাজ ‘সাবাঈ বাহিনী’। এ বাহিনীটি মুসলিম জাহানে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতা চালায়। তাদের দুর্বৃত্তপনার শিকার হতে হয় মহান খলিফা হযরত উছমান যুন-নূরায়ন রা.-কে। তাঁকে শহীদ করে দেওয়ার পর চেষ্টা করে মুসলিম জাতির ভেতর বিভিন্ন দল-উপদল তৈরীর ও তাদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টির। তৈরি হয়ে যায় ‘খারিজী’ নামক এক উগ্রপন্থী দলের। তৈরি হয় শিয়া ও রাফিযী নামক এক বর্ণচোরা সম্প্রদায়। সেই শুরু ইসলামের ভেতর ফেরকাবাজী বিশৃংখলার। এ বিশৃংখলার বীজ ইহুদী চক্রেরই বোনা, নিজেদের জান-মাল দিয়ে শত-শত বছর যাবৎ যার মাশুল এই মুসলিম জাতিকে দিতে হচ্ছে। এহেন চক্রান্তকারী জাতির সাথে গাঁটছড়া বাঁধা কখনও কি কোনও মুসলিম ব্যক্তির পক্ষে শোভা পায়? আবার সেই ব্যক্তি যদি হয় ‘মুহাম্মাদ’ নামের কেউ? হ্যাঁ, নামের একটা দায় থাকেই। কারও নাম এমনিতেই রেখে দেওয়া হয় না। নামের পেছনে থাকে একটা লক্ষ্য, একটা স্বপ্ন। সেই লক্ষ্য ও স্বপ্ন পূরণে যত্নবান না থাকলে নামকরণ বৃথা হয়ে যায়। উদাহরণত যার নাম ‘আব্দুস সামাদ (বেনিয়াজ আল্লাহর বান্দা), সে যদি কোনও সৃষ্টির কাছে হাত পাতে তবে তার এ নামের কোনও সার্থকতা থাকে কি? প্রকারান্তরে তাতে এ নামের অমর্যাদা হয়। অনেক সময় নাম রাখা হয় কোনও মহান ব্যক্তির নামে। আশা থাকে শিশুটির উপর কালে ওই মহান ব্যক্তির ছায়া পড়বে। কিছুটা হলেও তার মত হবে। কিন্তু বাস্তবে যদি বিপরীত হয়, তবে কি ওই নামটি তার জন্যে তামাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না? যেমন কারও নাম রাখা হল আবুদ-দারদা (হযরত আবুদ-দারদা ছিলেন একজন দুনিয়াবিমুখ সাহাবী), এখন ওই ব্যক্তি যদি হয় দুনিয়ালোভী তবে এই নামটি তার পক্ষে পরিহাস নয় তো কি? কারও নাম রাখা হল বীর সাহাবী হযরত খালিদ রা.-এর নামে। এই লোকটি যদি হয় ভীরু, তবে তার পক্ষে ওই নাম কতটুকু সার্থক হল? নামকে সার্থক করে তোলার দায় মূলত প্রত্যেকের উপরই থাকে। যারই যেই নাম রাখা হয়ে থাকে, সে নামের দাবি- ব্যক্তিটি যেন তার সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। তাই হাতেম নামধারীর উচিত কিছুটা হলেও দান-খয়রাতে মন দেওয়া। উমর ফারূক যার নাম, তার কর্তব্য সত্য-ন্যায়ে আপোষহীন থাকা। মুজাহিদ নামক ব্যক্তির দায় থাকে, আল্লাহর পথে সংগ্রামে অবিচল থাকা। অনুরূপ আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান, ইবরাহীম, ইসমাঈল, আবূ বকর, আবূ হুরায়রা, তাহের, তায়্যিব প্রভৃতি নামের কিছু না কিছু দায় ও দাবি আছেই- তা নামের অর্থের দিক থেকে হোক কিংবা কোনও মহান ব্যক্তির সাথে সম্পর্কের দিক থেকে। অনেক সময় তা থাকে উভয় দিক থেকেই, যখন নামটি হয় তাৎপর্যপূর্ণ, সুন্দর অর্থবোধক, সেইসংগে তা হয় কোনও মহান ব্যক্তির নামে। সেই ধারার শ্রেষ্ঠতম নাম ‘মুহাম্মাদ’। অর্থ ও ব্যক্তিত্ব, উভয়দিক থেকেই এ নামটি তুলনাহীন। সুতরাং এ নামে যার নাম হবে, তার দায় বড় কঠিন। তার এমন কোনও কাজ করা চলবে না, যা তাকে নিন্দিত করতে পারে। কারণ সে তো মুহাম্মাদ- চরম প্রশংসিত। তার দৃষ্টি থাকবে সর্বদা প্রশংসনীয় কাজেরই দিকে। তার পক্ষে বাঞ্ছনীয় এমন এমন কাজে মশগুল থাকা, যা একদিকে আল্লাহর প্রশংসা কুড়াবে, অন্যদিকে মানুষের কাছে তাকে করে তুলবে সমাদৃত। আবার এ নাম যেহেতু সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর নামে, তাই তাকে এ নামের ইজ্জত রক্ষা করতেই হবে। তাকে হতে হবে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশেক। হতে হবে তাঁর আদর্শের বাহক। হতে হবে তাঁর দ্বীনের রক্ষক। আজকের আরাবী মুহাম্মাদের কাছে আশেকানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দাবি থাকা খুবই সংগত যে, তার দ্বারা আরব জাহানে কোনও ভাঙচুর নয়; বরং প্রতিষ্ঠিত হবে ঐক্য ও সংহতি। সেই ঐক্য ও সংহতিতে বাকি মুসলিম জাহানকেও জুড়ে নেওয়ার পেছনে তার ভূমিকা থাকবে। সেই সম্মিলিত শক্তি ব্যবহৃত হবে বিশ^-মানবতার মুক্তিসংগ্রামে। সে মুক্তি মানুষের দাসত্ব থেকে, রক্ত-বর্ণের বৈষম্য থেকে, দুর্বলের প্রতি শক্তিমানের নিপীড়ন থেকে, অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি, অধর্ম ও পাশব প্রবৃত্তি থেকে এবং সে মুক্তি সর্বপ্রকার অন্ধকার ও অশুভত্ব থেকে। নিঃসন্দেহে মানুষের সর্বপ্রকার মুক্তি আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামের অনুসরণের ভেতর নিহিত; বিশ্বব্যাপী যার প্রচার-প্রতিষ্ঠার দায়িত্বসহ পবিত্র আরবভূমিতে প্রেরিত হয়েছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আজকের যত মুহাম্মাদ নামধারী এবং যত আশেকানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সকলেরই কর্তব্য সারাবিশ্বে ওই নামের ঝাণ্ডা ওড়ানো। ওই নামের যশঃগানে ও তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় জানমাল দেওয়া।

 

 

advertisement