রবিউল আউয়াল ১৪৩৯   ||   ডিসেম্বর ২০১৭

আমার মুহসিন কিতাব-৩

মাওলানা সায়্যিদ তালহা হাসানী রাহ.

[মাওলানা সায়্যিদ তালহা হাসানী রাহ. ১৩০৮ হিজরী/১৮৯০ ঈসায়ীতে টোংকের বিখ্যাত ‘কাফেলা মহল্লা’য় জন্মগ্রহণ করেন। মূলত তিনি ছিলেন রায়বেরেলীর কুতবী হাসানী বংশের। তাঁর বাবার নাম সায়্যিদ মুহাম্মাদ। যিনি হযরত সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রাহ.-এর বড় ভাগিনা মৌলভী সায়্যিদ মুহাম্মাদ আলীর পৌত্র। দশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি টোঁকেই পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে লখনৌ গিয়ে ভর্তি হন দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায়। কয়েক বছর সেখানে পড়াশোনা করেন। তখন নদওয়ার নাযেম ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গেরী রাহ.। আল্লামা শিবলী নুমানী রাহ. ছিলেন শিক্ষক। সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রাহ. ছিলেন ছাত্র। সেখানে তিনি আরবী ভাষার প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন মাওলানা মুহাম্মাদ ফারূক চিরিয়াকুটি রাহ.-এর কাছে, যিনি তখন নদওয়ার সদরে মুদাররিস বা প্রধান শিক্ষক। পরে আবার তিনি টোঁকে ফিরে যান। এবং মাদরাসায়ে নাসিরিয়াতে মাওলানা হায়দার হাসান খান টোঁকী রাহ. ও মাওলানা সাইফুর রহমান ছাহেবের কাছে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এরপর পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে ‘মৌলভী ফাযেল’ ও ‘মুনশী ফাযেল’ পরীক্ষা দেন। একাডেমিক পড়াশোনা সমাপ্ত করে তিনি মাত্র চার মাসে কুরআনে কারীম হিফয করে নেন। এরপর দিল্লীতে হেকীম গোলাম রেযা খান ছাহেবের কাছে হেকিমী শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে শিক্ষকতার পাশাপাশি এই বিদ্যাকে তিনি খুব গুরুত্বের সাথে কাজে লাগান। কর্মজীবনে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৪২ সালে সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর আবার ফিরে যান লখনৌতে। এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে পাকিস্তানে হিজরত করেন এবং করাচিতে আবাস গড়েন। তিনি ছিলেন বিদগ্ধ আলেম ও দক্ষ শিক্ষক। সেইসাথে গভীর অধ্যয়নমনষ্ক ও বিদ্যানুরাগী। আরবী ফার্সী ও উর্দূ ভাষার প্রচুর কবিতা তাঁর মুখস্থ ছিল। আরবী সাহিত্যেও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। সরফ ও নাহব শাস্ত্রে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। ইজাযুল কুরআন বিষয়ে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। ইতিহাস, ইসলামী ইতিহাস ও জীবনী শাস্ত্রে তাঁর উপস্থিত স্মৃতি ছিল তুলনাহীন। জ্যোতির্বিদ্যায়ও তার পারদর্শিতা ছিল। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যেও পর্যাপ্ত পড়াশোনা ছিল। তবে রচনা ও লেখালেখির প্রতি খুব বেশি আগ্রহ তাঁর ছিল না। যুবক বয়সে ভূপালে অবস্থানকালে নবাব সুলতানা জাহান বেগমের আগ্রহে উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাযি.-এর জীবনী লিখেছিলেন। পরে সাহাবা যুগের সংস্কৃতি, জীবনাচার ও তাদের ইলম চর্চার বিষয়ে আরবী ভাষায় অসাধারণ একটি কিতাব লিখেছিলেন ‘আলহায়াত ফিল কারনিল উলা’ নামে। তবে কাজটি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। কিতাবটি সম্পর্কে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. বলেছেন, এই কিতাব যদি সম্পন্ন হত এবং প্রকাশ করা যেত তবে আমার ধারণা সেটি এই বিষয়ের একটি বিশ্বকোষের মর্যাদা লাভ করত। এছাড়া ইজাযুল কুরআন ও বালাগাতুল কুরআন বিষয়ে তাঁর কিছু প্রবন্ধ নিবন্ধ রয়েছে। ১৩৯০ হিজরীর ২৩ রজব /১৯৭০ ঈসাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বরে এই বিদ্বান মনীষী করাচি থেকেই পরপারের সফরে রওয়ানা হয়ে যান। সেখানেই তাঁর সমাধি। -অনুবাদক] [এই লেখাটি মূলত সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর উদ্দেশে লেখকের একটি চিঠি। পড়তে গিয়ে এই কথা মনে রাখলে অনেক জায়গায় বুঝতে সুবিধা হবে ইনশাআল্লাহ।] আরবী ভাষা ও সাহিত্য প্রাথমিক কিতাবাদি যেমন, ‘কায়দা’ ইত্যাদি বড়দের কড়া শাসনের মধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। এরপর সর্বপ্রথম যে কিতাব খুব আগ্রহ ও আবেগ নিয়ে পড়া হয়েছে সেটি মাকামাতে হারীরী। কিতাবটির ছন্দময় গদ্য আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। এভাবে লেখতেও ভালো লাগতো তখন । সেই প্রভাব অনেকদিন ছিল আমার মধ্যে। পরে জাহেযের রচনা ও তৃতীয় শতাব্দীতে লেখা ইতিহাসের কিতাবগুলো আমার খুব ভালো লেগেছে। আবুল ফারাজ ইস্পাহানীর ‘আল-আগানী’, ইবনে কুতাইবার ‘আল-ইমামাতু ওয়াস সিয়াসাহ’ এবং ‘নাহজুল বালাগাহ’ ইত্যাদি কিতাবগুলির দ্বারা আমি খুবই প্রভাবিত ছিলাম। কবিতায় ‘মুআল্লাকাত’ ‘হামাসা’ ও মুতানাব্বির কবিতা খুব পছন্দ ছিল। আর আজকাল আরবী গদ্যে মিসরীয় কয়েকটি পত্রিকার কিছু প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় খুব মন কাড়ে। ছরফ ও নাহু ছরফ শাস্ত্রে ‘শাফিয়া’ ও ‘রযী’ খুব ভালো মনে হয়েছে। একসময় এই কিতাবগুলোর প্রতি আগ্রহ এত বেশি ছিল যে, কখনো খাবারের দস্তরখানেও ‘শাফিয়া’ সামনে নিয়ে বসতাম এবং পড়তে থাকতাম। নাহু বিষয়ে ‘মুফাসসাল’, ‘আওযাহুল মাসালিক’ এবং ‘মুগনিল লাবীব’ নির্বাচিত কিতাব ছিল। খুব গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো সিবাওয়াইহ-এর ‘আলকিতাব’। সেই রেখা এখনো অনুভব করি। কেউ মনে কষ্ট পেতে পারে তবু বলছিÑ কাফিয়া ও শরহে জামি কখনো আমাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। সেটা ধরে নিন আমারই কম যোগ্যতার কারণে। ভাষা সম্পর্কিত কিতাবগুলোর মধ্যে সুয়ূতী রাহ.-এর ‘আলমুযহির’ খুব পছন্দ হত। ইবনে রুশাইকের কিতাব ‘আলউমদাহ’ চমৎকার আরবী কবিতার সংকলন। এটি এবং মুবাররাদের ‘আলকামেল’ তো এককথায় আরবী ভাষার খাযানা। কিতাবদুটি আমার খুবই পছন্দের। ইলমে হাদীস মন চায় এ বিষয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে দিই। কিন্তু আশংকা হয়, আপনি এবং পাঠকবৃন্দ বিরক্ত হয়ে যাবেন। মূলত আরবী ভাষার আগ্রহ থেকেই হাদীসের প্রতি আগ্রহ গতি পেয়েছে। বড় কথা হল, পরিবেশ এবং বংশীয় অবস্থাও এর জন্য আমার সহায়ক ছিল। আর যেই পরিবেশে সায়্যিদ ইরফান ও সায়্যিদ মুস্তফা আছেন সেখানে হাদীসের চর্চা ও আগ্রহ কী করে না হয়! তো সবচে’ বেশি প্রিয় ও আগ্রহের কিতাব ছিলো ইমাম বুখারী রহ.-এর ‘আলজামিউস সহীহ’। কিতাবটির প্রতি যে মুহাব্বত ও টান ছিল সেটা একেবারে ইশকের পর্যায়ে। আমি এই কিতাবের প্রতি মুহাব্বত প্রকাশের ভাষা পাচ্ছি না। তোমার হয়তো মনে আছে, অবচেতন মনেই কখনো তোমার সামনে এই কিতাবের কোনো হাদীস বা সনদ পড়তে শুরু করতাম। কখনো পড়তে শুরু করতাম কোনো তরজমাতুল বাব। কালাল হাসান, কালা ইবনু সীরীন, কালা... এমনিতেই নিজের অজান্তে মুখ থেকে বেরুতে শুরু করত। এই কিতাবের প্রতি মুহাব্বত সৃষ্টি করার পেছনে অনেক বড় অবদান রয়েছে আমার উস্তায মাওলানা সাইফুর রহমান মুহাজিরে কাবুল ছাহেবের। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কবরে রহমতের বারিধারা বর্ষণ করুন। এই কিতাব পড়ার সময়েই ফাতহুল বারীর সঙ্গে পরিচিত হই। তখন ধীরে ধীরে আসমাউর রিজালের প্রতি আগ্রহ এবং তাবাকাতে সাহাবা ইত্যাদির অনুসন্ধান শুরু হয়। তখন কোনো কোনো সাহাবীর জীবনী এতো পরিষ্কার জানা ছিল যে, মনে হতো যেন আমি তাঁকে দেখেছি। কোন্ সাহাবীর সঙ্গে কোন্ সাহাবীর ঘনিষ্ঠতা ছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাঁদের কার কেমন সম্পর্ক ছিল ইত্যাদি টুকরো বিষয়গুলো তালাশ করার প্রতিও খুব আগ্রহ হত। এমনিভাবে তাবিয়ীদের অবস্থা, আইম্মায়ে কেরাম ও হাদীস বর্ণনাকারী মনীষীদের জীবনী, তাঁদের জন্ম, মৃত্যু, কার কত বয়স ইত্যাদি জানার খুব আগ্রহ ছিল। ছাত্র জীবনেই ‘মুসনাদে দারেমী’ ও পুরো ‘মুসনাদে আহমাদ’ নাড়াচড়া করে দেখেছি, মুতালাআ করেছি। ‘মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক’ দ্বারাও খুব প্রভাবিত হয়েছি। হাদীসের এইসব কিতাব ও মুসান্নিফগণের প্রতি দিলের যে অবস্থা ছিল তা স্পষ্ট করতে চাইলে বলা যায়- ইমাম মালেক রাহ.-এর প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর মুয়াত্তার প্রতি মুহাব্বত সমান ছিল। ব্যক্তি ইমাম বুখারীর চেয়ে সহীহ বুখারীর প্রতি আবেগের টান বেশি ছিল। আবার মুসনাদে আহমাদের তুলনায় ব্যক্তি ইমাম আহমাদের প্রতি মুহাব্বত ও টান বেশি ছিল। এসব অবস্থার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা নেই। আফসোস! সহীহ মুসলিমের কোনো প্রভাব দিল দেমাগে তেমন করে পড়েনি। আর হাদীসের এই কিতাবগুলো প্রায় সবকয়টিই আমি আসাতিযায়ে কেরামের কাছে পড়েছি। আমার সকল উস্তায ছিলেন হানাফী। তাই হানাফিয়্যাতের এই ইহসান থেকে কখনো নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারব না। কারণ তাঁদের পাঠদান ও তত্ত্বাবধান আমার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য তৈরী করেছে। ‘যাদুল মাআদ’ যদিও সীরাতের কিতাব, তবে আমার দৃষ্টিতে সেটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীসসমূহের সংক্ষিপ্ত একটি কুতুবখানা। কুরআন ও তাফসীর তুমি তো তাফসীরের শিক্ষক। কুরআন ও তাফসীর সম্পর্কে আমার কাছ থেকে কিছু শুনবে? ভাই! বানানো কথা বলা খুবই অসুন্দর, সত্য কথা শোনো; যখন আরবী ভাষার প্রাথমিক একটা স্তর পার করেছি তখন থেকেই কুরআনের ভাষাসৌন্দর্য আর উপস্থাপন মাধুর্য আমাকে আকর্ষণ করতে শুরু করেছে। আর তাই কুরআন মুখস্থ করার আগ্রহও হয়েছে। এরপর ইলমুল মাআনী ও ইলমুল বায়ান বিষয়ক দরসী কিতাবগুলোর মাধ্যমে সেই আকর্ষণ আরো ঘন ও গভীর হয়েছে। কুরআনের প্রতি আমি দুইভাবে দৃষ্টি দিয়েছি, ফিকহী মাসায়েল ইসতিমবাত ও কুরআনের ভাষাগত সৌন্দর্য। তাই সুয়ূতী রাহ.-এর ‘আল-ইকলীল ফী ইসতিমবাতিত তানযীল’ ও ‘তাফসীরে আহমাদী’ ছিল আমার খুব পছন্দের। আর সেসময় আবু বকর ইবনুল আরাবী ও জাসসাস রাহ.-এর আহকামুল কুরআন হাতে আসেনি। মাসআলা ইসতিমবাতের আগ্রহ এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ما دمت عليه قائما এই আয়াত থেকে প্রেমাসক্তকে বন্দি করার মাসআলা ইসতিমবাত করেছিলাম। এরপর এক কিতাবে এর সমর্থনও পেয়েছি। আবার কখনো পৃথিবী ঘোরার দলীল তালাশ করেছি। আর এসব করেছি ভারসাম্যহীনতার কারণে, কিংবা মনে করতে পার এসব ছিল পরিবেশ ও নেসাবের প্রভাবে। যাইহোক, দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত এই ধরনের আগ্রহ অব্যাহত ছিল। কুরআনের শব্দ-ব্যবহার সংক্রান্ত সৌন্দর্য আত্মস্থ করার জন্য পুরো ‘তাফসীরে কাশশাফ’ মুতালাআ করেছি। সেইসঙ্গে সক্কাকী রাহ.-এর ‘মিফতাহুল উলূম’, এবং ‘আত-তিরায’ ও ‘দালাইলুল ইজায’ মুতালাআ করেছি। কোনো কোনো বিষয়ের জন্য ‘তাফসীরে কাবীর’ও মুতালাআ করেছি। আরেকটি বিষয় হল, বনী ইসরাঈল ও হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এবং এ জাতীয় অন্যান্য ঘটনার চিত্র-কল্পনা কখনো মাথায় আসেনি। এছাড়া ‘গারানীকে’র ঘটনা ‘সুওয়ায়ুল মালিকে’র ঘটনা এসব তাহকীক করার আগ্রহও কখনো সৃষ্টি হয়নি। আয়াতের পারস্পরিক মিল, কসম ও জাওয়াবে কসম ইত্যাদি বিষয় ও তদসংশ্লিষ্ট মাসআলার প্রতিও তেমন আগ্রহ ছিল না। কুরআনের বিষয়ে আমার চিন্তা হল, এটি এক সুমহান ও অত্যুচ্চ মর্যাদার অধিকারী গ্রন্থ, মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ আসমানী কিতাব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার খাযানা। অনন্ত কালের পিপাসা নিবারণের জন্য এ কিতাব যথেষ্ট। এই কিতাব তিলাওয়াত করলে আল্লাহভীতি ও পরকালে বিশ্বাস এত বেশি হয় যে, দুনিয়ার অন্য কোনো বই পড়ে, কোনো বয়ান শুনে কিংবা কোনো প্রবন্ধ নিবন্ধ মুতালাআ করে তা হয় না।... ইলমে তাসাওউফ ইমাম গাযালীর ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ও মাওলানা রুমীর মসনবী নিজে নিজে পড়েছি। খুব ভালো লেগেছে। তোমার আব্বাজান মাওলানা সায়্যিদ আবদুল হাই রাহ.-এর পরামর্শে ‘আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ’, সোহরাওয়ার্দী রাহ.-এর ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ এবং আবদুল কাদের জিলানী রাহ.-এর ‘ফুতূহুল গাইব’ মুতালাআ করেছি। ফুতূহুল গাইব আমার দিল দেমাগে এত বেশি প্রভাব ফেলেছে যে, মানবরচিত অন্য কোনো কিতাব আমার মধ্যে এত প্রভাব ফেলতে পারেনি। এছাড়া মুজাদিদ্দে আলফে সানী রাহ.-এর ‘মাকতূবাত’-এর মাধ্যমেও অনেক প্রভাবিত হয়েছি। তন্মধ্যে বড় একটি প্রভাব এই পড়েছে যে, তাসাওউফের চেয়ে শরীয়তের মহত্ব দিলে বেশি গেঁথে গেছে। মূলত এটি এই মকতূবাতের উসিলায়ই হয়েছে। আর মসনবী এ কারণে বেশি ভালো লাগত যে, তাতে ইলমে কালাম ও ইলমে তাসাওউফ-এর বিষয়াবলীকে বড় চমৎকার উপস্থাপনায় একীভূত করা হয়েছে। গাযালী রাহ.-এর অধিকাংশ রচনাই আমাকে আকর্ষণ করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়- ‘ফাইসালুত তাফরিকাতি বাইনাল ইসলামি ওয়ায যানদাকা’ কিতাবটি। শায়খে আকবরের ‘ফুতূহাত’ কখনো উড়ন্ত দৃষ্টিতে দেখেছি। তার কোনো বিষয় কখনো পছন্দ হয়েছে। তবে তার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল না। আবার আগ্রহ না থাকার কারণে আফসোসও ছিল না। মাকুলাত ও ইলমে কালাম তুমি শুনলে আশ্চর্য হবে, ছাত্র জীবনে দুইটি কিতাব এত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, অন্য কোনো কিতাব এত আগ্রহ নিয়ে পড়িনি। এক. বুখারী শরীফ। দুই. হামদুল্লাহ। বাধ্য হয়ে এ কথাও লিখছি যে, ‘সদরা’র ‘জুযউল্লাযি লা ইয়াতাজাযযা’-এর আলোচনাও অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। ‘শরহে মাওয়াকিফ’ কিতাবের আঙ্গিক উপস্থাপনও আমাকে খুব টানতো। ‘শামসে বাযেগা’ও ভালো লেগেছে। উসূলে ফিকহ ও ফিকহ ফিকহে হাম্বলীর কিতাব ‘আল-মুগনী’ আমার অনেক প্রিয় একটি কিতাব। কিন্তু সেটি ধারাবাহিকভাবে মুতালাআ করার সুযোগ হয়নি। ফিকহে হানাফীর হিদায়াকে এমন কিতাব মনে হত যে, এই কিতাবের মাধ্যমে ফিকহে ইরাকীর সঙ্গে তালিবুল ইলমের পূর্ণ মুনাসাবাত তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। উসূলুল ফিকহ বিষয়ে ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ.-এর ‘আততাহরীর’ এবং ‘আততাওযীহ ওয়াত তালভীহ’ আমার অনেক প্রিয় দুটি কিতাব। তাওযীহের মধ্যে ইজমার যে চমৎকার আলোচনা তুমি পাবে অন্য কোনো কিতাবে তার নমুনা মেলা ভার। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কয়্যিম রাহ.-এর রচনাবলী শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর রচনাবলীর মধ্যে সর্বপ্রথম দেখেছি তাঁর ‘মাজমূউল ফাতাওয়া’। এই কিতাবের মাধ্যমে আমি অনেক প্রভাবিত হয়েছি এবং এর মাধ্যমে তাঁর প্রতি আমার ভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। এরপর তো তাঁর প্রতিটি কিতাবই আমার পছন্দ হয়েছে। ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর কিতাবে বিষয়বস্তুর বিন্যাস খুব চমৎকার নয়। এটা তাঁর দুর্যোগময় জীবনেরই প্রভাব। যাইহোক, এই দুই মুসান্নিফের প্রতি আমার ভক্তি- মুহাব্বত অনেক। তবে আল্লাহর শোকর, কিছু মাসআলায় তাঁদের সঙ্গে একমত হওয়া যায়নি। যেমন এক মজলিসে তিন তালাক ও ইসমতে আম্বিয়া সংক্রান্ত মাসআলা। হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর রচনাবলীর মধ্যে ‘যাদুল মাআদ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আগেই বলেছি যে, এই কিতাবকে আমার মনে হয় হাদীসের সংক্ষিপ্ত একটি কুতুবখানা। তুমি হয়ত জানো না, মাওলানা সায়্যিদ ইরফান ছাহেব রাহ. (আমার মামা, সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রাহ.-এর হাকীকী দৌহিত্র) কখনো কখনো আমার কাছে আসতেন এবং মুতালাআ করার কথা বলে যাদুল মাআদ নিয়ে যেতেন। এরপর আমিও মুতালাআ করতে যেতাম, কিন্তু মজা পেতাম না। তার মূল্যও বুঝতাম না। এখন আলহামদু লিল্লাহ তার কিছুটা মূল্য বোধহয় বুঝি। হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর ‘শিফাউল আলীল’ও আমার পছন্দের কিতাব। কিতাবটি সত্যিই অনেক চমৎকার। সেখানে তকদীর এবং তাকদীরের ভালো মন্দ বিষয়ে খুব চমৎকার আলোচনা আছে। শে‘র ও কবিতা এই শিরোনাম দেখে হয়তো তুমি অবাক হবে। আমার ধারণা, এখনো আমাদের নিসাবে শে‘র বোঝার রুচি তৈরি হবার ব্যবস্থা নেই। অথচ বিষয়টির গুরুত্ব একেবারে কম নয়। আগে মানুষকে বলতে শুনতাম, মৌলভী আবার শে‘র কি বুঝবে? আর বিখ্যাত উক্তি আছে ‘শেরে মান বমাদরাসা কেহ বুরাদ’ (‘আমার কবিতা মাদরাসায় নিয়ে যাবে কে?’ কটাক্ষের উদ্দেশ্যে বলা হতো)। তো আমি নিম্নোক্ত কিতাবগুলোর মাধ্যমে আমার ধারণায়-শে‘র বোঝার কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি। সেজন্য এই কিতাবগুলোর ইহসানও আমি স্মরণ করি। কিতাবগুলো এই- আবে হায়াত, তাযকিরাহ গুলশানে বে খার, গুলে রা‘না, মুকাদ্দামায়ে দেওয়ানে হালী, শে‘রুল আজম। তবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি শেষোক্ত কিতাবটির মাধ্যমে। বাস্তবেই কিতাবটির বর্ণনা ও উপস্থাপনশৈলী অনুপম এবং নির্মাণধর্মী। লেখকের বিরোধীরাও তার এই কিতাবের প্রশংসা করে। গুলে রা‘না কিতাবের নামের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘটনাও মনে পড়ে গেল, যা না বলে সামনে অগ্রসর হতে পারছি না। লাহোর থেকে একবার ছুটিতে এসেছি। তোমার আব্বা আর আমি তোমাদের লখনৌর বর্তমান বাড়ির উত্তর পূর্বের কামরাটিতে দুপুরে বিশ্রাম করছি। তোমার আব্বা বললেন, এই দুই মাসে আমি একটি হালকা কাজ করেছি। সংক্ষিপ্তাকারে উর্দূ কবিদের জীবনী সংকলন করেছি। তাতে বিশেষভাবে মির্যা ছাহেবের প্রসঙ্গে যেখানে যা পেয়েছি জমা করেছি। তো এভাবে একজন মুসান্নিফ তাঁর রচনার গল্প শোনাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি দুপুরে নিয়মিত ঘুমানোর বদঅভ্যাসের কারণে ঘুমকেই প্রাধান্য দিলাম। বুঝতেও পারলাম না এক মুখলিস বুযুর্গ একা একা কখন পরপারে চলে গেলেন। বিবিধ বিষয় নিম্নোক্ত কিতাবগুলোর প্রত্যেকটি বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার এমনকি বলা যায় প্রতিটি কিতাবই স্বতন্ত্র একটি কুতুবখানার মর্যাদা রাখে- যাদুল মাআদ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, মুকাদ্দামাতু ইবনে খালদূন। সবশেষে একটি কথা লিখেই আলোচনা সমাপ্ত করছি। কোনো তালিবুল ইলমের যখন কিতাব বোঝার কিছু যোগ্যতা হয়ে যায় তখন অবশ্যই তার সামনে একটি কুতুবখানা রাখা উচিত। সেখান থেকে প্রয়োজন ও ইচ্ছেমতো যেন সে মুতালাআ করতে পারে। কখনো কখনো তাকে মুতালাআর বিষয়ে কিছু পরামর্শ নির্দেশনাও দেওয়া উচিত। এই পদ্ধতিতে তুমিও অনেক উপকৃত হয়েছো, আমিও। তবে তোমার সামনে ছিল এক শতাব্দীরও বেশি সময়ে জমাকৃত কিতাবের ভাণ্ডার। আমার সামনে ছিল বিভিন্ন প্রয়োজন, ইলমী যোগ্যতা ও মুতালাআর সুরুচি তৈরী করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে জমা করা কিছু কিতাব। ভাষান্তর : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

advertisement