রবিউল আউয়াল ১৪৩৯   ||   ডিসেম্বর ২০১৭

স্বদেশ : ধর্ম অবমাননা

হারিছ তাবীল

কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তা দমনে গড়িমসি করা আরো অপরাধ জন্ম দিতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে নানা জটিলতার। রংপুরের ঘটনাই ধরা যাক, এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম অবমাননার অভিযোগ আসল। মানুষ প্রতিবাদ করল। পুলিশের কাছে মামলা নিয়ে গেল। মামলা নিতে পুলিশের যথারীতি গড়িমসি। মামলা নেয়ার পর শুরু হল তদন্তে ঢিলেমি, অপরাধী ধরতে গড়িমসি। বিক্ষুব্ধ জনতা দফায় দফায় আন্দোলন করল, আল্টিমেটাম দিল। সংশ্লিষ্ট কর্তাদের কোনো রা নেই। তাদের বোধোদয় হল তখন, যখন ঝরে গেছে তাজা ক’টি প্রাণ, আহতদের আর্তনাদে ভারি হয়েছে হাসপাতাল, আগুনে পুড়েছে কত অভাগার ঘর। এখন ব্যস্ততার শেষ নেই আইনশৃঙ্খলার কর্তাদের। পুরো দেশের মনোযোগ এদিকে আকর্ষিত হওয়ার পর টনক নড়েছে তাদের। দায়ের হয়েছে বহু মামলা। গ্রেফতারের ভয়ে শত-সহস্র পুরুষ হয়েছে ঘরছাড়া। এখানেও উপরি কামাই- গ্রেফতারবাণিজ্য। মামলা দেখিয়ে গ্রেফতার, এরপর টাকার বিনিময়ে মুক্তি। নিরীহ জনতার নাভিশ্বাস। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এসব ঘটনার মূল অপরাধীকে কখনো শাস্তির মুখোমুখি করা হয় না। কক্সবাজারের রামু, পাবনার সাঁথিয়া কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর- সবর্ত্র একই কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। যেই একটা (অ)মানুষের কারণে এতগুলো মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হল তাকে দণ্ডিত না করে যদি পরবর্তীতে ধর্মীয় আবেগের বশবর্তী হয়ে অ্যাকশনে যাওয়া জনতার নামে মামলা করা হয় তাহলে এটাকে বলা হবে ভেতরে ক্যান্সার রেখে বাইরে চর্মরোগের চিকিৎসা করা। আসল জায়গায় হাত না দিয়ে এভাবে সমাধানের আশা করা নিছক বোকামি। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম অবমাননাকে কেন্দ্র করে এসব সহিংসতায় যে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেক্ষেত্রে সংখ্যালঘু হিন্দু, সংখ্যাগুরু মুসলমান এবং সরকার- তিন পক্ষেরই দায়বদ্ধতা আছে। ইসলাম সহনশীলতার ধর্ম, মানবতার ধর্ম। ফলে এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা মুসলমানদের কাছে মানবতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আশা করতেই পারে। কিন্তু তাদেরও তো কিছু কর্তব্য আছে। এসব কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা এবং কোনো ধরনের কটূক্তি, উত্তেজনাকর বক্তব্য কিংবা আপত্তিকর মন্তব্য থেকে বিরত থাকা। আমরা চরম হতাশ হয়ে লক্ষ করেছি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা অংশ তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এসব কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মাঝেমধ্যেই তাদের কারো কারো থেকে এমন অন্যায় সংঘটিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তাদের ধর্মগুরুদের কর্তব্য ছিল যে কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘাত এড়াতে দেশের আপামর হিন্দু সম্প্রদায়কে এমন গর্হিত কাজ থেকে নিষেধ করা এবং এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করা। তাদের ধর্মগুরুরা কি এই কর্তব্যটুকু পালন করতে পেরেছেন বা পারছেন? আর আমরা যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, নিজেদের দ্বীন-ঈমানকে যেমন দুষ্টদের আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে, তেমনি এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, নিরপরাধ কোনো অমুসলিম যেন আমাদের হাতে জুলুমের শিকার না হয়। এই সীমাটুকু রক্ষা করার তালীম তো শরীয়ত আমাদের যুগ যুগ ধরে দিয়ে আসছে। তাছাড়া এদের অনেকেই যে তিলকে তাল বানাতে এমনকি এক বিন্দু তিল ছাড়াও আস্ত তাল প্রস্তুত করতে পারঙ্গম তা-ও তো স্মরণে রাখা কর্তব্য। এই তো কিছুদিন আগে বিবিসি সংবাদ দিল যে, ভারতে খোদ হিন্দুরাই বাছুর মেরে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছিল। ঘটনাটি ভারতের উত্তর প্রদেশের গোণ্ডা জেলার। জেলার পুলিশ সুপার উমেশ কুমার সিংয়ের জবানিতে ঘটনার বৃত্তান্ত হচ্ছে, শনিবার রাতে কাটরা বাজার এলাকার একটি গ্রাম থেকে দুটি বাছুর চুরি হয়ে যায়। পরে বাছুর দুটোর গলা কেটে ফেলে রাখা হয়। কিন্তু স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা মঙ্গল ও রামসেবক নামক দুজনকে ঘটনাস্থল থেকে পালাতে দেখে ফেলে। তারা গিয়ে মরা বাছুর দেখে পুলিশে খবর দেয়। সোমবার দুজনকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। মরা বাছুর দুটির ফলে সাময়িকভাবে এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল বলেও স্বীকার করেন পুলিশ সুপার। তিনি আরো বলেন, অনেক পুলিশ পাঠাতে হয়েছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। দুজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৫ অক্টোবর, ২০১৭) এই রকমের ঘটনা আমাদের দেশেও তো ঘটেছে। নিজেরা মূর্তি ভেঙে নালিশ দায়ের করার ঘটনা বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায়ও এসেছে। এই যাদের চরিত্র তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা তো অনেক বেশি প্রয়োজন। রাষ্ট্র যারা পরিচলনা করেন সাম্প্রদায়িক সংঘাতে হতাহতের দায়ভার তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি বর্তায়। ধর্ম অবমাননাকারীদেরকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা আমাদের প্রবলভাবে পীড়া দেয়। অভিযোগ আসার সাথে সাথে অপরাধীকে গ্রেফতার করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের মুখোমুখী করলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়! সরকারের কিছু মন্ত্রীকে টেকো মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে শোনা যায়, ‘বিশেষ একটা মহল (!) মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’ সব জায়গায় তারা ‘বিশেষ মহলে’র গন্ধ পান। কথা হচ্ছে অপরাধীকে সময়মত শায়েস্তা করলে তো তারা এই সুযোগটা পায় না! এই কাজে গড়িমসি করে আপনারাই তো ‘বিশেষ মহল’কে মানুষের আবেগ পুঁজি করার সুযোগ করে দিচ্ছেন!? রংপুরের ঘটনায় দাদাবাবুদের দেশ ভারতের মায়াকান্না দেখে আমাদেরও চোখে জল এসে পড়েছে। বাংলাদেশে বিগত পাঁচ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তিনটা ঘটনা ঘটেছে। আর ভারতের খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সেখানে প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ভারত আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের রূপ-প্রকৃতি একেবারে ভিন্ন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন মানে মূর্তির ভাঙ্গা মাথা কিংবা কয়েকটা পোড়া ঘরবাড়ি। পক্ষান্তরে ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন মানে ১৯৪৮ সালে হায়দরাবাদে ১০ লক্ষ মুসলিম হত্যা, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দিয়ে ভারতজুড়ে লাখ লাখ মুসলিমের রক্ত নিয়ে হোলিখেলা, ২০০২ সালে মোদি-আদভানিদের প্রত্যক্ষ মদদে মহাত্মা গান্ধীর এলাকা গুজরাটে গণহত্যা আর যুগ যুগ ধরে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করা। সাইয়েদ আরশাদ মাদানী (দা. বা.) অত্যন্ত আফসোস করে বলেছিলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে সারা ভারতে হিন্দুদের হাতে লাখ লাখ মুসলিম নিহত হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই অপরাধে একজন হিন্দুরও মৃত্যুদ- হয়নি।” সুতরাং নিরীহ মানুষের ছোপ ছোপ রক্তে যেই ভারতের চেহারা বীভৎস হয়ে আছে তারা যদি বিশ্বের কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে, মুরুব্বী সেজে নির্দেশনা দিতে আসে তবে তা যথেষ্ট পরিমাণে কৌতুক উৎপাদন করবে। নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে যে অন্যের বাড়ির আগুন নেভাতে দৌড়ঝাঁপ করে সে হয় বোকা, নয় স্বার্থবাজ। ভারত হোক আর বাংলাদেশ, হিন্দু হোক আর মুসলিম- সংখ্যালঘু নির্যাতন সবখানেই যেমন অন্যায়, তেমনি এক ধর্মের অনুসারী হয়ে অন্য ধর্মকে অবমাননা করাও মারাত্মক অপরাধ। এতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয় এবং বহু নিরপরাধ মানুষের জানমাল হুমকির মুখে পড়ে। অতএব এসব ক্ষেত্রে দ্রুত ন্যায়বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি না করলে সরকার ও বিচারব্যবস্থা থেকে মানুষ আরো বেশি আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিবে। রংপুরের ঘটনা এর জলজ্যান্ত উদাহরণ। সুতরাং দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সরকার ধর্ম অবমাননাকারীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে এমনটা কি আমরা আশা করতে পারি?

 

 

advertisement