রবিউল আউয়াল ১৪৩৯   ||   ডিসেম্বর ২০১৭

আমাদের রাজ্য শাসন-২১

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

সিফফীনের যুদ্ধ

এক যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই আরেকটি বড় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হল। হযরত আমীরে মুআবিয়া রা. তখন শামের গভর্ণর (শাসক)। হযরত আলী রা. তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে দিলেন। হযরত আমীরে মুআবিয়া রা. তা মেনে নিতে পারলেন না। তিনি আলী রা.-এর বিরুদ্ধে চলে গেলেন। তাছাড়া আমীরে মুআবিয়া রা. ছিলেন হযরত উসমান রা.-এর খুব কাছের মানুষ। উসমান রা.-এর শাহাদতের ক্ষত তাঁর মনে তখনও জীবন্ত। এদিকে উসমান রা.-এর হত্যাকারীরা আলী রা.-এর সাথে যোগদান করেছে। ফলে আমীরে মুআবিয়া রা. একটি সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি হযরত আলী রা.-এর বিরোধিতা করতে শুরু করলেন। হযরত আলী রা. তাঁকে বাইআত হতে বললেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, উসমান রা.-এর হত্যাকারীদেরকে সোপর্দ না করা পর্যন্ত বাইআত গ্রহণ করবেন না। কিন্তু হত্যাকারীদের ব্যাপারে আলী রা.-এর কী-ইবা করার ছিল? চার-পাঁচ হাজার বিদ্রোহীকে শাস্তি দেওয়ার শক্তি তাঁর ছিল না। ফলে একপর্যায়ে আমীরে মুআবিয়া রা. সৈন্য নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। হযরত আলী রা.-ও অগ্রসর হলেন। ৩৭ হিজরীতে সিফফিন নামক স্থানে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েক মাস পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শেষ দিনে রাতভর সংঘর্ষ চলার পর পরবর্তী সকালে শামের লোকেরা পিছু হটতে শুরু করে। এমনকি তাদের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ বর্শার উপর কুরআন মাজীদ উঁচু করে ঘোষণা আসে- ‘আমাদের ও তোমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাবই মীমাংসা করবে’। হযরত আলী রা. সাথীদেরকে বারবার সতর্ক করলেন যে, এটি একটি অপকৌশলমাত্র। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও। আমাদেরই জয় হতে চলেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এরা তো হযরত উসমান রা.-কে শহীদ করে বাঘ সেজেছে। হযরত আলী রা. চাপ সৃষ্টি করলে তারা উল্টো হুমকি দিয়ে বসল যে, এখনই যুদ্ধ বন্ধ করুন। অন্যথায় আপনাকেও উসমান রা.-এর পরিণতি বরণ করতে হবে। অগত্যা আলী রা. সৈন্য ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর প্রায় নিশ্চিত জয় ছেড়ে পরাজয় মেনে নিলেন। উভয় পক্ষ থেকে একজন করে দু’জনকে বিরোধ মীমাংসা করার জন্য নির্ধারণ করা হয়। হযরত আলী রা.-এর পক্ষে হযরত আবু মূসা আশআরী রা. মনোনীত হন। আর হযরত মুআবিয়া রা.-এর পক্ষে হযরত আমর ইবনুল আস রা.। এরপর হযরত মুআবিয়া রা. (দিমাশক) দামেশকে চলে যান। আর হযরত আলী রা.-ও কূফায় ফিরে আসেন। আলোচনার পর উভয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা. উভয়কে খেলাফত থেকে সরিয়ে তৃতীয় ব্যক্তিকে খলীফা বানানো হবে। উভয় পঞ্চায়েত যথাসময়ে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। আবু মূসা আশআরী রা. উভয়কে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘোষণা দিলেন। আমর ইবনুল আস রা. ঘোষণা দিলেন, আমি আলী রা.-কে ক্ষমতাচ্যুত করছি। কিন্তু মুআবিয়া রা. যেহেতু উসমান রা. হত্যার ওলি এজন্য তাকে তার পদে বহাল রাখছি। বাহ্যিকভাবে এই সিদ্ধান্ত আলী রা. কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। এজন্য তিনি পুনরায় শাম আক্রমণের ইচ্ছা করলেন। কিন্তু সৈন্যদের মাঝেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে নতুন খারেজী দলের আবির্ভাব ঘটল। যারা স্বয়ং আলী রা.-এর বিরুদ্ধে চলে গেল। অবশ্য এর পেছনেও ছিল সাবায়ীদের (আবদুল্লাহ ইবনে সাবার অনুসারী) ষড়যন্ত্র। আগেই বলা হয়েছে, যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাকÑ এটা তারা কখনোই চাইত না। জঙ্গে জামাল (হযরত আয়েশা রা.-এর যুদ্ধ) এদের কারণেই সংঘটিত হয়েছে। সিফফিনও (হযরত আলী রা. ও হযরত মুআবিয়া রা.-এর মধ্যকার যুদ্ধ) এদের কারণেই বেঁধেছে। আবার এরাই যখন দেখল যে, হযরত আলী রা.-এর জয় প্রায় নিশ্চিত আর এরপরই তাদের পালা তখন তারা কুরআনকে ঢাল বানাল। এরাই হযরত আলী রা.-কে জেতা যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করল। এরপর পঞ্চায়েত গঠিত হয়ে যখন সমঝোতা হতে চলল এবং তারা বুঝতে পারল যে, এর দুর্ভোগ তাদেরকেই পোহাতে হবে তখন তারা এটিকে কুফরি আখ্যা দিল। তারা হযরত আলী রা.-কে এই গুনাহ থেকে তাওবা করার আহ্বান জানাল। অন্যথায় তারা দলত্যাগের হুমকি দিল। কিন্তু হযরত আলী রা. তাদের দাবি অগ্রাহ্য করলেন এবং শামে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। তারা ভাবল, যদি আলী রা. এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন তবে তারাই হবে পরবর্তী লক্ষ্য। এজন্য তারা এরও বিরোধিতা করতে লাগল। শামে আক্রমণ করার পরিবর্তে তারা হযরত আলী রা.-এর বিরুদ্ধে চলে গেল এবং বিশৃঙ্খলা শুরু করল। হযরত আলী রা. তাদেরকে বোঝানোর জন্য এবং তাদেরকে নিবৃত্ত করার জন্য শত চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা কিছুতেই তা শুনতে চাইল না। আর শুনবেই বা কেন? তাদের লক্ষ্যই তো ছিল মুসলমানদের মাঝে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রাখা। অবশেষে বাধ্য হয়ে হযরত আলী রা. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। নাহরাওয়ান নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং খারেজিরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এদের দিকটা সামলে নেওয়ার পর হযরত আলী রা. পুনরায় শামে আক্রমণের ইচ্ছা করলেন। কিন্তু এবারও কেউ তাঁর সাথে যেতে প্রস্তুত হল না। বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের ঘরেই বসে থাকল। হযরত আলী রা. এ অবস্থা দেখে কূফায় ফিরে গেলেন। এখানে এসে প্রতিনিয়ত ভাষণ-বিবৃতি দিতে লাগলেন। মানুষদেরকে উৎসাহ ও সাহস দিতে লাগলেন। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হল না। অবশেষে অপারগ হয়ে শাম আক্রমণের ইচ্ছা থেকে ফিরে এলেন। পরিশেষে অনেক হুমকি-পাল্টা হুমকি ও চিঠি চালাচালির পর ৪০ হিজরী সনে উভয় পক্ষ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, শাম ও এর আশপাশের এলাকা হযরত আমীরে মুআবিয়া রা. শাসন করবেন। আর ইরাক ও এর সংলগ্ন হিজায, খুরাসান ইত্যাদি এলাকা হযরত আলী রা. শাসন করবেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

<pসিফফিনের></pসিফফিনের>

 

 

advertisement