সফর ১৪৩৯   ||   নভেম্বর ২০১৭

সাম্প্রদায়িকতা : চীনে ধর্মকর্মে বিধি নিষেধ

আব্দুল্লাহ নাসীব

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে অব্যাহত রয়েছে মুসলিম নিপীড়ন। প্রকাশ্যেই লঙ্ঘন করা হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার। কয়েক মাস আগে এ বছরের ১লা এপ্রিল মুসলিম পুরুষদের লম্বা দাড়ি ও মেয়েদের বোরকা নিষিদ্ধ করেছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। প্রদেশের আইন প্রণেতারাও এ নিষেধাজ্ঞায় সম্মতি দিয়েছিলেন এবং তা প্রদেশটির সরকারী ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছিল।  (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২ এপ্রিল, ২০১৭)

এখন আবার আদেশ জারি করা হয়েছে, মুসলিমেরা নিজেদের কাছে কুরআনে কারীম ও জায়নামায রাখতে পারবেন না। জায়নামায, কুরআন মাজীদ, তাসবীহসহ সকল ধর্মীয় সরঞ্জাম পুলিশের কাছে জমা দিতে হবে। অন্যথায় কঠোর শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে। শুধু হুকুম ও হুমকিই নয়, প্রদেশের পুলিশ গ্রামে-শহরে সব জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ

উঠেছে। (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৪ অক্টোবর, ২০১৭)

এ যেন একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়েও ইসলাম চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা। ইসলামের কোনো চিহ্নই কি এরা ধরে রাখতে দিবে না মুসলমানদের? চীনা প্রশাসনের এই অন্যায় পদক্ষেপের এক সাহসী জবাব দিয়েছেন সেনেগালের জাতীয় দলের তারকা ফুটবলার ডেম্বা বা। এখন লোনে তুর্কির ক্লাব বেসিক তাসে খেললেও মূলত তিনি  চীনের ফুটবল লিগের ক্লাব সাংহাই সেনহুয়ার একজন খেলোয়ার। এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘যদি তারা (চাইনিজরা) জানত যে, মুসলিমরা মেঝেতেই নামায পড়তে পারে এবং লাখ লাখ মুসলিম কুরআন না খুলেই মুখস্থ পড়তে পারে, তাহলে সম্ভবত তারা মুসলমানদেরকে তাদের হৃৎপি- খুলে হস্তান্তরের আদেশ দিত।’ (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৪ অক্টোবর, ২০১৭, পৃ.৫)

তার এই জবাবটি হাজার হাজার বার রি-টুইট হয়েছে। ইতিহাসও বারবার এই সত্য প্রমাণ করেছে যে, জুলুম-অত্যাচার করে মুসলমানদের দমানো যায় না। খোদ গণচীনের ইতিহাসও কি এটাই প্রমাণ করেনি?। মুসলিমেরা কি চীনের ভয়াবহ ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবে’র যুগ অতিক্রম করে আসেননি? এইসব বিধি-নিষেধ চীনের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণœ করবে এবং এসবের দ্বারা সংখ্যালঘু মুসলিমদের বীতশ্রদ্ধ করা ছাড়া আর কোনোই লাভ হবে না।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দশকের পর দশক ধরে জিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিমদের উপর নানা প্রকারের জুলুম-অত্যাচার হলেও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। যেন মানবাধিকার, ধর্মীয় অধিকার ইত্যাদি কোনো কিছুই মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

বিশ^ব্যাপী ইসলাম ও মুসলিম-বিরোধী প্রচার-প্রচারণা দ্বারা দেশে দেশে মুসলমানদের প্রতি এই যে শীতল মনোভাব তৈরি করা হয়েছে এটি বর্তমান সভ্যতার কপালে অঙ্কিত এক ‘কলংক-রেখা’। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীর অন্য সকল জাতি গোষ্ঠীর তুলনায় মুসলিমরাই সবচেয়ে উদার ও মানবতাবাদী জাতি। ইসলামের শৌর্য-বীর্যের যুগে অপরাপর জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি মুসলিমেরা যে উদারতা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছেন তা অন্য কোনো জাতি-গোষ্ঠীর ইতিহাসে পাওয়া যায় না। চীনের যে অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে তা প্রধানত মুসলিম মুবাল্লিগণের উন্নত জীবনযাত্রা ও উন্নত আখলাকের দ্বারা হয়েছে। ইসলামে কাউকে ইসলামগ্রহণে বাধ্য করার বিধান নেই এবং তা করাও হয়নি। যেসকল অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে তা ইসলামের সত্যতা ও সৌন্দর্যের কারণে বিস্তার লাভ করেছে বলেই সীমাহীন জুলুম-অত্যাচারের পরও ইসলাম সেখানে টিকে আছে।

জিনজিয়াং-এর মুসলিমদের উপর সাম্প্রতিক বিধি-নিষেধ চীনের কম্যুনিস্ট শাসন ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সেই কুখ্যাত যুগের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, যার লৌহ যবনিকা থেকে চীনারা বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে বিগত আশির দশক থেকেই। চীনের ইতিহাসে প্রসিদ্ধতম মামলাটিও তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নৃশংসতা ও অরাজকতার বিরুদ্ধেই। আশির দশক থেকেই ওখানে মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যেসকল ‘সংস্কার’ সূচিত হয়েছে জিনজিয়াংয়ের মুসলিমদের উপর আরোপিত এই সকল বিধি-নিষেধ কি তাতে কালিমা লেপন করছে না?

এখানেও মুসলিম নিপীড়িনে ব্যবহৃত হচ্ছে সেই বহুল ব্যবহৃত ‘জঙ্গিবাদ দমনের’ অস্ত্র। বলা হচ্ছে, আঞ্চলিক রাজধানী উরুমকিতে একের পর এক দাঙ্গায় প্রায় ২০০ লোকের প্রাণহানির পর ২০০৯ সালে চীন সরকার এ অঞ্চলের মুসলমানদের উপর...।

এই সকল দাঙ্গা-হাঙ্গামার যথাযথ তদন্ত হচ্ছে কি? সঠিক তদন্তে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার ন্যায়সঙ্গত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, কিন্তু তা না করে একটি গোটা জাতির বিরুদ্ধে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ কখনোই শান্তির অনুকূল ব্যবস্থা হতে পারে না।

মনে পড়ছে অস্ট্রেলিয়ার ‘ওয়ান নেশন’ দল থেকে নির্বাচিত উগ্রবাদী নারী সিনেটর পলিন হ্যানসনের ঘটনাটি। এ বছরেরই ১৭ই আগস্ট পলিন হ্যানসন বোরকা পরে সিনেটে যোগ দিলে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল জর্জ ব্র্যান্ডিস তাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘সিনেটর হ্যানসন! আজ আপনার বোরকা পরে চেম্বারে অবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি আমি এড়িয়ে যেতে পারছি না। কারণ, আমরা সবাই জানি, আপনি ইসলামের অনুসারী নন। আমি আপনাকে শ্রদ্ধার সাথে সতর্ক করতে ও পরামর্শ দিতে চাই, আপনি অস্ট্রেলিয়ানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে যে অপরাধ করেছেন সে ব্যাপারে সতর্ক হোন।’

জর্জ ব্র্যান্ডিস আরো বলেন, ‘ইসলাম ধর্মে বিশ^াসী পাঁচ লাখ অস্ট্রেলিয়ান রয়েছেন আমাদের অস্ট্রেলিয়ায়। এদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ভালো অস্ট্রেলিয়ান। আর সিনেটর হ্যানসন, চরমভাবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ভালো অস্ট্রেলিয়ান আর কঠোর অনুসারী মুসলিম হওয়ার মাঝে কোনো দ্বন্দ নেই।’

এর পর জর্জ ব্র্যান্ডিস ঐ সিনেটরকে লক্ষ্য করে যে কথাটি বলেছেনÑ তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে তার ‘প্রি-এমিনেন্ট পোর্টফলিও রেসপন্সিবিলিটি’ রয়েছে। আর গোয়েন্দা বাহিনীর পরামর্র্শও সুস্পষ্ট, চরমপন্থা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন ইসলামী সমাজের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা। এই কমিউনিটিকে উপহাস করা, এক কোণে ঠেলে দেয়া, এর ধর্মীয় পোশাক নিয়ে তামাশা করা ইত্যাদি হচ্ছে মর্মাহত করার মতো বিষয়। আমি আপনাকে বলব, আপনি আপনার আচরণের উপর নজর দিন। (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২১ আগস্ট, ২০১৭)

পাঁচ লক্ষ মুসলিমের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় যদি জর্জ ব্র্যান্ডিসের মতো একজন সুবিবেচক  আইন কর্মকর্তা থাকতে পারেন তাহলে পাঁচ কোটিরও বেশি মুসলিমের দেশ চায়নাতে কি এরকম দু-চারজন জর্জ ব্র্যান্ডিসও নেই, যারা সংখ্যালঘু মুসলমানদের ব্যাপারে তাদের রাষ্ট্রকে সুপরামর্শ দিতে পারেন?

পরিশেষে আল্লামা মুফতী তাকী উসমানীর একটি পরামর্শ এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। তিনি ১৯৮৫-এর নভেম্বরে চীন সফরের যে সফরনামা লিখেছেন তাতে এক জায়গায় লিখেছেনÑ

‘এইসব বিষয়ের সাথে এদিকটিও সামনে থাকা জরুরি যে, মুসলমানদের বর্তমান স্বাধীনতাটুকুও এসেছে দীর্ঘ নির্যাতন-নিপীড়নের পর। কাজেই আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা  উচিত হবে না, যা এই স্বাধীনতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এখন মুসলমানদের এগিয়ে যেতে হবে গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সাথে।’ (জাহানে দীদাহ, পৃ. ৪৭১)

 

 

advertisement