শাওয়াল ১৪৩৮   ||   জুলাই ২০১৭

দেশপ্রেম : নদী হত্যা

আব্দুল্লাহ নাসীব

বাস্তব অনুশীলন প্রমাণ করে যে, আমাদের দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি উৎকণ্ঠা আমাদের কথায় ও আবেগে যতটা উপস্থিত, বাস্তব কর্ম ও প্রয়োগে ঠিক ততটাই অনুপস্থিত। এমনটা না হলে  দেশের ভেতরে দেশের স্বার্থহানীকর কাজের এমন ব্যাপক বিস্তারও যেমন সম্ভব হত না তেমনি দেশের স্বার্থ রক্ষায় বাইরের শক্তিগুলোর সাথে বোঝাপড়াও হত আরো শক্তিশালী, আদান-প্রদানও হত আরো ভারসাম্যপূর্ণ। এ কারণে মনে হয় আমাদের দেশপ্রেমে কোথাও কোনো বড় রকমের খুঁত রয়ে গেছে, যার কারণে এই চর্চাটা যতটা না কর্ম ও প্রয়োগে তার চেয়ে বেশি কথায় ও উচ্চারণে।

 

এর এক মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো। সম্প্রতি তিস্তার পানিচুক্তি ছিল এক ব্যাপক আলোচনার বিষয়। তিস্তা আমাদের অন্যতম প্রধান নদী। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪ টি অভিন্ন নদ-নদীর একটি। ভারতের সিকিম রাজ্যে এর উৎপত্তি, এরপর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে এটি প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের নিলফামারী জেলায় এবং মিলিত হয়েছে যমুনায়। বাংলাদেশের তিস্তার অববাহিকা ১২৪ কিলোমিটার বিস্তৃত। এই অববাহিকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা এই নদীর সাথে জড়িত। আর তাই এই নদীর পানিতে বাংলাদেশের রয়েছে ন্যায্য হিস্যা। সেই পাওনা প্রাপ্তির ব্যাপারটাই ঝুলে রয়েছে বছরের পর বছর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরেও এ বিষয়ে কোনো চুক্তি সাক্ষরিত হয়নি এবং আমাদের দেশপ্রেমিক মিডিয়াগুলোতেও এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য দেখা যায়নি। অথচ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না-পাওয়াটা কোনো দৈব কারণবশত নয়। ভারত সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে উজানে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। তিস্তার উজানে ভারতের রয়েছে বহু সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প। এছাড়া আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের অধীনে ডাইভারশন খালের মাধ্যমেও তিস্তার পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মহানন্দা নদীতে। ফলে ভাটি অংশে শুকিয়ে যাচ্ছে তিস্তা আর চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমত শুকনা মওসুমে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং রংপুর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশংকাজনক মাত্রায় নীচে নেমে যাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, তিস্তা অববাহিকায় হাজার হাজার জেলে পরিবার বেকার হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে।

তৃতীয়ত বর্ষার মওসুমে পানির ¯্রােত নদীর মূল গতিপথ ছেড়ে দুই তীরে আছড়ে পড়ে। ফলে নদীভাঙ্গনে হাজার হাজার মানুষ পথের ভিখিরিতে পরিণত হন।

এছাড়া তিস্তার সাথে সংযুক্ত প্রায় ত্রিশটি ছোট-বড় নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার পথে।

দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দেশের জনগণের জীবন ও জীবিকার পক্ষে চরম ক্ষতিকর ব্যাপারগুলোতেও যদি বাস্তব ভূমিকা না রাখা যায় তাহলে দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আবেগী কথাবার্তার কী অর্থ থাকে?

তিস্তা একটি উদাহরণ মাত্র, ইতিপূর্বে গঙ্গায় ফারাক্কা বাধের কারণে পদ্মা নদী শুকিয়ে গেছে। হাসিনা-দেব গৌড় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের যে পানি পাওয়ার কথা বাংলাদেশ তা পাচ্ছে না। সম্প্রতি আরো শোনা যাচ্ছে যে, ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের অধীনে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে দক্ষিণ ভারতের কাবেরী নদীতে। এটা বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গার পানি হ্রাস পাবে। আর যেহেতু গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে আছে ফারাক্কা পয়েন্টের পানি ভাগাভাগীর কথা, কাজেই বাংলাদেশও পানি পাবে না।

কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেছেন, পানি বণ্টন হতে হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে। কারণ বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র, ভারত একটি রাষ্ট্র। কাজেই অভিন্ন নদীগুলোতে সারা বছর যে পানি প্রবাহিত হয় সেই হিসেবে বাংলাদেশ তার হিস্যা পাবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যে পানি আসছে সেই পানি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ভাগাভাগী করার পদ্ধতি যেমন অন্যায় তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্তার পক্ষেও অবমাননাকর। তাছাড়া ভারত যদি আন্তনদী সংযোগের মাধ্যমে উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পানি ভাগাভাগীর চুক্তিও একপ্রকার অর্থহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

বিশ্লেষকদের আরো প্রশ্ন, তিস্তা যেহেতু সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, কাজেই পানি বণ্টনে সিকিমকে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। যাই হোক, এ সকল বিষয় বিশ্লেষকেরাই ভালো বলতে পারবেন, কিন্তু সাদা চোখে এইসব জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ খুব শক্তিশালীভাবে দেখা যাচ্ছে না।

শুধু বাইরের কথাই বলি কেন? আমাদের ভেতরের পরিস্থিতি কী? ১৪-০৪-২০১৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, ‘চোখের সামনে খুন হচ্ছে নদী।’ ঐ প্রবন্ধে লেখক বলেন, ‘বাংলাদেশের নদীগুলো যেভাবে খুন হচ্ছে তা তিন ভাগে ভাগ করা যায় : ১. ভারতের একতরফা আগ্রাসী তৎপরতা, ২. বাংলাদেশের নদী বিদ্বেষী উন্নয়ন কৌশল এবং ৩. রাজনৈতিক ক্ষমতায় নদী-দখলদারদের আধিপত্য।’

এরপর বিস্তারিত আলোচনার একপর্যায়ে তিনি লেখেন, ‘নদীর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সুবিধাভোগীও আছে। তাদের প্রধান অংশ সম্পদ ও ক্ষমতায় শক্তিশালী। নদী দুর্বল হয়ে গেলে নদী ক্রমাগত জমিতে রূপান্তরিত হয়। তখন তা দখল করা অনেক লাভজনক। নদী বাঁচলে তার মূল্য টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু মরলে তার দাম শত হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। ...তাছাড়া এসব বাঁধ বা নির্মাণকাজ প্রধানত বিদেশি ঋণের টাকায় হয়। ফলাফল যা-ই হোক, ঋণদাতা, কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, আমলা ও ভূমিদস্যুদের লাভ অনেক।’

এইসকল বাস্তবতা সামনে রেখে আমাদের দেশপ্রেমের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। দেশপ্রেমের প্রায়োগিক রূপ কী হওয়া উচিত আর বাস্তবে কী হচ্ছে?

অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ’ যারা চালান, তাঁরা জনগণের স্বার্থ কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ননীতি সাজালে এই নদী ও খাল-বিলগুলোর জীবনও সচল করতেন এবং ভারতের এসব আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা গ্রহণ করতেন।’

‘জনগণের স্বার্থ’ যদি দেশপ্রেমের অংশ না হয় তাহলে আর কী এর অংশ হবে? দুর্নীতি, ক্ষমতার লালসা, ব্যক্তি-স্বার্থের কাছে সমষ্টির স্বার্থের জলাঞ্জলির মতো ব্যাধিগুলোর সাথে ‘দেশপ্রেম’ কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে? এটা খুব সহজ কথা যে, এইসকল ব্যাধির নিরাময় ছাড়া দেশপ্রেম কথাটি কার্যত অর্থহীন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এই মরণব্যাধির নিরাময় হবে?

 

 

advertisement