জুমাদাল উলা ১৪৩৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আমাদের রাজ্য শাসন-১৬

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

মুসলমানদের মাঝে বিশৃঙ্খলা ও উসমান রা.-এর শাহাদত

উসমান রা.-এর খেলাফতের শুরুটা বেশ ভালই ছিল। চতুর্দিকেই মুসলমানগণ অগ্রসর হতে থাকে। দু-চার বছর এ ধারা অব্যাহত থাকলে সারা দুনিয়ায় ইসলামের বিজয় কেতন উড়তে পারত। কিন্তু কতক বিশৃঙ্খলাকারী যেন সবকিছুই এলোমেলো করে দিল।

আমরা জানি যে, ইহুদীরা ইসলামের কত বড় শত্রু। প্রথমে তারা তলোয়ার দিয়েই মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে। এজন্য সব রকমের চেষ্টাই তারা করেছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই যখন কাজ হল না তখন তারা মুসলমানের বন্ধু সেজে তাদের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হল।

আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ইয়েমেনের এক কট্টর ইহুদী। ইসলামের অগ্রযাত্রা তার সহ্য হত না। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কারণ প্রকাশ্যে মোকাবেলার মতো শক্তি তার ছিল না। শেষমেষ অনেক ভেবেচিন্তে সে মুসলমান হওয়ার ভান ধরল। কিন্তু তার দিনরাত একই চিন্তা, মুসলমানদের মাঝে কীভাবে বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায়। ভাবতে ভাবতে একটি উপায় তার মাথায় আসে। সে চিন্তা করে দেখল, আলী রা. হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খুবই নিকটের ও প্রিয়। তাছাড়া মুসলমানদের মাঝেও তার রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। ফলে আলী রা.-এর নামে উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে কিছু একটা রটানো গেলে খুব সহজেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। কিন্তু সমস্যা হল, আরব অঞ্চলে সাহাবীদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য লাভ করেছেন এবং ইসলামকে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাই এখানে এমন কথায় খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে ইরাকের অঞ্চলগুলো সবেমাত্র বিজিত হয়েছে। এতদঞ্চলে ইসলামের যথেষ্ট প্রচার-প্রসার ঘটলেও মানুষের মন থেকে সম্রাট-পূজা পুরোপুরি দূর হয়নি। আবদুল্লাহ ইবনে সাবা এটাকেই মোক্ষম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। সে তাৎক্ষণিকভাবে ইয়েমেন ছেড়ে বসরায় চলে আসে এবং নিজের কাজ শুরু করে।

আবদুল্লাহ ইবনে সাবা মানুষের সাথে দেখা করে বলত, কী আশ্চর্য! আল্লাহর রাসূলের পর তাঁর সবচেয়ে কাছের ও প্রিয় মানুষগুলো বঞ্চিত থাকল। আর আশপাশের লোকেরা খলীফা হয়ে বসল! এখনও সময় আছে, উসমানকে সরিয়ে আলীকে বাদশাহ বানিয়ে দাও। সাহাবীদের সামনে এ কথা বলা হলে তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য এসেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তো আসেননি। তিনি ঘোষণা করেছেন, নবীগণ কাউকে উত্তরাধিকার রেখে যান না। বিদায় হজ্বের সময় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন, বংশ-পরিচয় দিয়ে কারো সম্মান হয় না; ব্যক্তির সম্মান তার তাকওয়া ও কর্মগুণে। সবচেয়ে মুত্তাকী ব্যক্তিই সম্মানের বেশি উপযুক্ত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে এতই কঠোরতা প্রদর্শন করেছেন যে, নিজ বংশের জন্য যাকাত গ্রহণও নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং কারো একথা বলার সুযোগ থাকল না যে, এরা আল্লাহর নাম বলে নিজ সম্প্রদায়ের জন্য ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায়।

কিন্তু এখানে তো এমন জবাব দেওয়ার কেউ ছিল না। ইরাক-ইরানের সাদাসিধে নওমুসলিমেরা তো এসব বুঝতই না। তাদের অতীত জীবন কেটেছে বাদশাহর চৌকাঠে কুর্নিশ করে। তারা জীবনভর দেখেছে, পিতার পর পুত্র আর পুত্রের পর পৌত্র মসনদের অধিকারী হয়। তারা তো জানেই না যে, গোত্র-বংশ ও রক্তের এই পক্ষপাত ইসলাম বাতিল করে দিয়েছে। ইসলাম এমন এক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে বাদশাহ বা আমীর উত্তরাধিকার কিংবা গোত্রীয় প্রভাবে নয়; নিজ যোগ্যতা ও পরামর্শের ভিত্তিতেই নির্বাচিত হবে। যাইহোক, ফলাফল এই দাঁড়াল যে, আবদুল্লাহ ইবনে সাবার কথায় ঐসব লোকেরা সহজেই প্রভাবিত হয়ে গেল।

একপর্যায়ে বসরার গভর্নর বিষয়টি জানতে পেরে তাকে শহর থেকে বের করে দেন। বসরা থেকে বের হয়ে সে কূফায় চলে আসে। সেখানেও এ ধরনের অপচেষ্টা চালাতে থাকে। কিছুদিন পর সেখান থেকেও বের করে দেওয়া হয়। এবার বিতাড়িত হয়ে সে শামে চলে যায়। কিন্তু সেখানে আমীরে মুআবিয়া থাকায় তার অপচেষ্টা কোনো কাজে আসেনি। উপরন্তু সেখান থেকে পালিয়ে মিসরে চলে যায়। মিসরে গিয়েও সে গোপনে তার কার্যক্রম চালাতে থাকে এবং অল্প দিনেই বড় একটা জামাত প্রস্ত্তত করে ফেলে।

 অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

 

advertisement