জুমাদাল উলা ১৪৩১   ||   মে ২০১০

আপন পেশায় যেন থাকে শ্রদ্ধার দৃষ্টি

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

দুনিয়ায় জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষকে কোনও না কোনও কাজ করতে হয়। এতে যা উপার্জন হয় তা দ্বারাই প্রত্যেকে তার নিজের ও পোষ্যবর্গের প্রয়োজন মেটায়। সম্মানজনকভাবে প্রয়োজন মেটানো ও বেঁচে থাকার সামগ্রী সংগ্রহের জন্য এটাই দুনিয়ার চিরাচরিত নিয়ম। আল্লাহ তাআলা চাইলে এ নিয়মের বাইরেও রিযিক দিতে পারেন। কেননা, প্রকৃত রিযিকদাতা তিনিই এবং রিযিক দানের জন্য তিনি কোনও নিয়ম বা মাধ্যমের মুখাপেক্ষী নন, কিন্তু দুনিয়া যেহেতু পরীক্ষার সন্তান এবং আল্লাহ তাআলা মানুষকে সর্বাবস্থায় পরীক্ষা করে থাকেন তাই মানুষের রিযিক প্রাপ্তিকে উপরিউক্ত নিয়মের অধীন করে দিয়েছেন। এটাও তাঁর পরীক্ষারই একটি পদ্ধতি। অর্থাৎ মানুষ কোনও একটা উপায় অবলম্বন করবে, কোনও না কোনও পেশায় নিয়োজিত থাকবে এবং তার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে রিযিক হাসিল করবে। এ কারণেই কুরআন-হাদীসে মানুষকে রিযিকের জন্য যে কোনও বৈধ উপায় অবলম্বনের প্রতি নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর ফযল সন্ধান করবে।’ (সূরা জুমআ : ৯) মুফাসসিরীনে কেরামের মতে এ আয়াতে ‘ফযল’-এর সন্ধান দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রিযিক সংগ্রহ করাকে বোঝানো হয়েছে। অন্য আয়াতে আছে, ‘যখন তোমরা ইহরামমুক্ত হবে, তখন শিকার করবে।’ (সূরা মায়িদা : ২) এভাবে সালাত ও হজ্ব আদায়ের পর ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিকার কার্যে লিপ্ত হওয়ার আদেশ দিয়ে এসব ফরযের পর রুজি-রোজগারের চেষ্টা করাও যে ফরয সে দিকেই ইশারা করা হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসে এ ইশারা আরও সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হালাল রুজি উপার্জন করা অপরাপর ফরযের পর একটি ফরয কাজ।’ হালাল রুজি উপার্জনের বিভিন্ন মাধ্যম হতে পারে। তার মধ্যে কে কোনটা গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে তার যোগ্যতা, সুবিধা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। এসবের ভিত্তিতে যে ব্যক্তি যে কাজই বেছে নিক, হৃদয়ে ঈমান ও তাকওয়ার ঐশ্বর্য থাকলে তার জন্য কোনওটিই তুচ্ছ নয়। কাজেই যথাযথ বিবেচনার পর যে ব্যক্তি যে পেশাই গ্রহণ করবে, তার কর্তব্য সে পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক থাকা। নিজ পেশার প্রতি যদি শ্রদ্ধার দৃষ্টি থাকে, তবে কাজ সুষ্ঠু ও সুচারু হতে বাধ্য। কিন্তু আজকাল এ জিনিসের বড় অভাব। কাজে ফাঁকি দেওয়া কিংবা দায়সারাভাবে আঞ্জাম দেওয়া শ্রদ্ধাহীনতারই আলামত। এ আলামত আজকাল কোন ক্ষেত্রে না চোখে পড়ে? অথচ প্রতিটি পেশার ভেতরই এমন উপাদান নিহীত রয়েছে, যা শ্রদ্ধা কুড়ানোর ক্ষমতা রাখে। একটু চিন্তা করলেই আমরা সে ক্ষমতার স্পর্শ পেতে পারি এবং অন-রে জাগাতে পারি আপন পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। চিন্তার শুরুটা এভাবে করা যায় যে, প্রত্যেকের পেশা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে তার রিযিক লাভের অছিলা। এ অছিলা অবলম্বনের আদেশ আল্লাহ তাআলাই তাকে করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে কাজ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু পাওয়ার মাধ্যম বা অছিলা হয় সে কাজে শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক থাকা ঈমানের দাবি। ঈমানদার ব্যক্তি চিন্তা করবে যে, আপাত দৃষ্টিতে যদিও তার পেশাটি সে নিজেই বেছে নিয়েছে এবং কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাকে সে কাজে নিয়োগ দান করেছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলাই তার নিয়োক্তা। তাঁর ওয়াদা রয়েছে যে, বান্দাকে তিনি রিযিক দান করবেন। সেই ওয়াদা পূরণেরই এটা এক ধরন যে, তিনি তাকে এ কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং প্রকৃত নিয়োগদাতা যখন আল্লাহ তাআলা তখন তাঁর অসীম মর্যাদার কারণে এ নিয়োগও বিশেষ মর্যাদার হকদার। বিষয়টি এভাবে চিন্তা করলে তখন আর পেশাটা কী, মৌলিকভাবে তা বিবেচ্য থাকে না। সে বিবেচনার দরকার এজন্যও পড়ে না যে, পেশা যাই হোক তা অবলম্বনের লক্ষ্য তো আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে রিযিক লাভ করা। রিযক আল্লাহ তাআলার অমূল্য দান, মহা নিআমত। পেশা যখন এই অমূল্য নিআমত হাসিলের মাধ্যম তখন নিআমতের মর্যাদায় পেশাও মর্যাদার বিষয় হবে বৈকি। অর্থাৎ মৌলিকভাবে বিবেচনা করতে হবে কাজের লক্ষবস্তুকে। লক্ষবস্তুর মহত্বের কারণে কাজও মহৎ হয়ে যায়। জগতে বহু কাজ আছে, এমনিতে যার বিশেষ কিছু গুরুত্ব নেই, কিন্তু যেই না তা কোনও মহান লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয় অমনি তা সেই লক্ষ্যের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠে। পেশার বিষয়টিও সে রকম। যেমন পেশা যদি হয় মৎস-শিকার, তবে সাদামাটাভাবে দেখলে এর বিশেষ মূল্য নেই। জেলে নদীতে মাছ ধরে, সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে এবং তার আয় দ্বারা নিজের ও পরিবারের খরচ মেটায়। ব্যস, এই এতটুকুমাত্র চিন্তা করলে সমাজের-চোখে জেলে অবজ্ঞাত হবে এবং হচ্ছেও তাই। কিন্তু যদি দৃষ্টিকে গভীরে নিয়ে যাওয়া যায় এবং চিন্তা করা হয়, জেলে একজন মানুষ, যে কি না সৃষ্টির মধ্যমণি, তার সত্তা আল্লাহ তাআলার অসীম গুণ-বৈচিত্রের বিকিরণ-পাত্র ও তাঁর মারিফাতের আধার, সে তার পেশা মৎসশিকার দ্বারা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে রিযকের ব্যবস্থা করছে ও তার মহিমাপূর্ণ মানবিক জীবিকা রক্ষার রসদ সংগ্রহ করছে, তবে গুণগ্রাহী দৃষ্টির কাছে তার পেশা অবজ্ঞা করার মতো বিষয় থাকবে না। জেলে নিজেও যদি বিষয়টাকে এভাবে ভাবতে শেখে, তবে সে নিজ পেশাকে কখনো খাটো মনে করবে না। তথাকথিত উঁচু পেশার লোক নিজ পেশাকে যেই দৃষ্টিতে দেখে-যদি যথার্থ দৃষ্টিতে দেখে থাকে-তার দৃষ্টিতেও নিজ পেশা তাদৃশ মর্যাদাকর হয়ে উঠবে। এতে করে সে নিজ কাজ ও পেশার প্রতি সশ্রদ্ধ ও আন্তরিক হয়ে উঠবে এবং পরিণামে তার মানবীয় মর্যাদাও সুরক্ষিত হয়ে যাবে। বিষয়টাকে আমরা এভাবেও চিন্তা করতে পারি যে, মানুষ যেহেতু সামাজিব জীব, তাই সমাজের বহুমুখী প্রয়োজন ও সামষ্টিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য দরকার বিভিন্ন গুণ ও বিচিত্র যোগ্যতাসম্পন্ন লোকসমষ্টির। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মহা হিকমতওয়ালা স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টিও করেছেন সেভাবেই। একেকজন মানুষের একেক রকম যোগ্যতা, একেক রকম দক্ষতা। মানুষ বর্ণ ও রূপে যেমন বৈচিত্রময়, তেমনি যোগ্যতা ও গুণেও বহুরঙ্গা। কারও আছে নেতৃত্বের গুণ, কারও চাষাবাদের। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের সমঝদার, কেউ স্থাপত্যের নিশানবরদার। কারও নেশা শিল্পকলায়, কারও বাক্যচর্চায়। এভাবেই মানব-সমাজ কামার-কুমার, জেলে-ছুতার, শিক্ষক-চিকিৎসক, উকিল-বিচারক নানা পেশার মানুষ দ্বারা গুলেগুলজার। মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষেরই প্রয়োজনে তার এককসমূহকে এভাবে বিভিন্ন কাজের কাজি বানিয়েছেন। এ না হলে মানবসমাজ পূর্ণ ও সমৃদ্ধ হয় না। সুতরাং বলতে পারি, মানবসমাজের পূর্ণতা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রত্যেকের যোগ্যতা তার সত্তায় গচ্ছিত এক পবিত্র আমানত। আমানতমাত্রই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে আমানতের আমানতকারী স্বয়ং রাব্বুল আলামীন, তার গুরুত্ব কি পরিমাপ করা যায়? প্রত্যেক পেশাদারই বিষয়টাকে তার ভাবনায় আনতে পারেন। ধরুন, আপনি একজন শিক্ষক। আপনার স্বভাবে শিক্ষাদানের বিশেষ ক্ষমতা নিহীত আছে, যা আর সকলের নেই। সমাজ আপনার এই ক্ষমতার মুখাপেক্ষী। এর যথাযথ ব্যবহার দ্বারা মানব-শিশুরা শিক্ষিত ও সুনাগরিক হয়ে ওঠবে, যেমন অন্য কারও এ জাতীয় শ্রমের বদৌলতে আপনি শিক্ষিত ও সুনাগরিক হয়ে উঠেছেন। অর্থাৎ আপনার যে যোগ্যতা তা মানবসমাজের এক চিরায়ত প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে সৃষ্টিগতভাবে আপনাকে বেছে নেওয়া হয়েছে এবং এই যোগ্যতা আপনার ভেতর গচ্ছিত রাখা হয়েছে। সুতরাং এ যোগ্যতা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পবিত্র আমানত, যা রক্ষা করা আপনার নৈতিক কর্তব্য। এই বোধ যে শিক্ষকের অন্তরে থাকবে, নিঃসন্দেহে সে নিজের পেশাকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখবে। ফলে সে তার কাজে অনেক বেশি আন্তরিক থাকবে। এ ভাবনার আরও এক দৃষ্টিকোণ আছে। যে কোনও কর্মজীবী ব্যক্তি তার কাজ দ্বারা যেমন নিজের জীবিকা নির্বাহ করে তেমনি অন্যরাও তার কাজের সুফল ভোগ করে। অর্থাৎ একই সাথে সে একজন মানব-সেবকও বটে। সে যে কাজই করুক, তা ছাড়া তো অন্যের চলবে না। নরসুন্দর চুল কেটে না দিলে সভ্য মানুষের বন্যতে পরিণত হওয়ার যোগাড় হবে। লৌহজীবী যদি তার পেশা ছেড়ে দেয়, তবে সভ্যতার চাকা চলমান থাকবে কীভাবে? সভ্যতার নির্মাণে ছুতারের ভূমিকা কী অস্বীকার করা যাবে? হাল আমলে মানুষ অন-ত নামে হলেও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। তাই আধুনিক কেতায় যারা দুরস্ত, পরিবহন-সেবা, চিকিৎসা-সেবা প্রভৃতি শব্দবন্ধে তারা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিষয়টা যখন এ রকম, অর্থাৎ পেশা যখন সেবারও মর্যাদা রাখে, তখন নিজ কাজে সেবাসূলভ দৃষ্টিভঙ্গিরও স্পর্শ থাকা চাই। ইসলামে মানব-সেবা অত্যন- মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। সে সেবার ধরন যাই হোক না কেন। অত্যন্ত বিশুদ্ধ এক হাদীসে মানুষের যাতায়াত-পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তুর অপসারণকে ঈমানের একটি শাখা সাব্যস্ত করা হয়েছে। অপর এক হাদীসে আছে, শ্রেষ্ঠ মানুষ সেই, যে অন্যের উপকার করে। প্রত্যেক পেশা দ্বারাই যখন মানুষের কোনও না কোনও উপকার সাধিত হয়,তখন পেশাদার ব্যক্তিমাত্রই একজন মানবসেবক। সুতরাং প্রত্যেকের উচিত নিজ পেশাকে সেই দৃষ্টিতে দেখা। মোটকথা, পেশা যেটাই গ্রহণ করা হোক, তাতে যদি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ছোঁয়া থাকে, তবে ব্যক্তির চোখে সে পেশা মহৎ হয়ে ওঠতে বাধ্য। তখন আর কোনও পেশাদারের চোখেই আপন পেশা হীন মনে হবে না। হ্যাঁ, অপেক্ষাকৃত একটি অপেক্ষা অন্যটি শ্রেষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু মাহাত্মের বহুমুখী উপাদান দৃষ্টে তুচ্ছ নয় কোনওটিই। কাজেই শ্রেষ্ঠটি কেন হস্তগত হল না, সেই আক্ষেপ না করে উচিত আপন কাজের মর্যাদা উপলব্ধি করা। অন্তরে সেই উপলব্ধি এসে গেলে হীনম্মন্যতা বিদায় হবে এবং আপন পেশার প্রতি দৃষ্টি হয়ে উঠবে শ্রদ্ধাশীল, যা দায়িত্ব পালনে যত্নবান হওয়া ও কার্যে সুষ্ঠুতা আনয়নের জন্য অপরিহার্য।

 

advertisement