যিলকদ ১৪৩৭   ||   আগস্ট ২০১৬

শাসকের সঙ্গে জনতা : একটি দৃষ্টান্ত

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

বিগত ১৫ জুলাই শুক্রবার রাতে তুরস্কে একটি সেনাঅভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর বিপথগামী একটি অংশ ট্যাংক নিয়ে পথে নেমে এসেছিল। শুধু তাই নয়, যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের উড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপও নেওয়া হয়। বিভিন্ন সরকারি ভবনে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু অল্প সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান রক্ষা পান। গোপন খবর পেয়ে অবকাশ যাপনের হোটেল ত্যাগ করে তিনি সরে যাওয়ার পরই সেখানে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ হয়। এ যেন ছিল রক্তক্ষয়ী অতি ধ্বংসপ্রবণ একটি অভ্যুত্থান। সধারণত দেখা যায়, অভ্যুত্থানকারী সেনারা কাজ হাসিলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় না। তারা রাস্তায় নেমে আসে। বিভিন্ন সরকারি ভবন ও কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। কিন্তু এ অভ্যুত্থানের চিত্রটা শুরু থেকেই ভিন্নরকম ছিল। ট্যাংক নিয়ে পথে নামা আর ভবন দখলেই তারা সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বিমান থেকে উপর্যুপরি বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছিল। কিন্তু এতসব বিধ্বংসী তৎপরতা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হয়নি। অভ্যুত্থানকে সফল করে তোলা সম্ভব হয়নি অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে। বরং ঘটে যায় অভূতপূর্ব এক ঘটনা।

অভ্যুত্থান চলা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরদোগান-এর একটি ঘোষণা সে দেশের একটি টিভিতে প্রচারিত হয়। সে ঘোষণায় তিনি সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। এতেই আম জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। রাষ্ট্রপতির সামান্য একটি ঘোষণায় সশস্ত্র বাহিনীর সুসজ্জিত ট্যাংক-কামানের মোকাবেলায় মানুষ দলে দলে দাঁড়িয়ে যায়। অনেকে সাঁজোয়া যানের সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। গভীর রাতে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত পথে নেমে আসে। অভ্যুত্থানকারী সেনাসদস্যরা প্রথমদিকে জনগণের উদ্দেশে গুলি ছুড়লেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা দমে যায়। কারণ পথে নেমে আসা অভ্যুত্থানবিরোধী জনগণের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। জনশ্রোত ও জন প্রতিরোধের মুখে সেনাসদস্যরা পালাতে শুরু করে। কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করে। অনেকে পলায়নরত অবস্থায় জনতার হাতে ধরাও পড়ে। এভাবেই ব্যর্থ হয়ে যায় তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থান। সশস্ত্র সেনাদের সামনে নিরস্ত্র জনগণের এক অভাবিতপূর্ব প্রতিরোধের দৃশ্য তৈরি হয়। দেশের পরিচালকের প্রতি দেশের জনগণের ত্যাগী একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। তাই এ ঘটনা নিয়ে অনেকেই অনেক রকম ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণ পেশ করেছেন।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর বহু সেনা কর্মকর্তা হেলিকপ্টারে এবং সামুদ্রিক জাহাজ নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে গ্রিসে ও দুবাইয়ে ধরা পড়েছে। অপরদিকে দেশের ভেতরে অভ্যুত্থানকারী সেনাবাহিনীর কিছু লোক দু-তিন দিন পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় হামলা চালিয়ে গেছে। দৃশ্যত অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরও তারা অভ্যুত্থান চেষ্টা কিংবা আক্রমণ থেকে নিজেদের পুরোপুরি নিবৃত্ত করেনি। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এই অভ্যুত্থান চেষ্টা নিছক ক্ষমতা দখলের জন্য ক্ষমতাসন্ধানী কিছু মানুষের ছিল না; বরং এর পেছনে স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ও মতাদর্শ কিংবা আবেগের সম্পৃক্ততা ছিল। বাহ্যিক বিবেচনায় অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরও কোনো কোনো জায়গায় অভ্যুত্থানকারীরা লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় প্রমাণিত হয় তারা ভিন্ন কোনো মত ও চিন্তার জন্য আবেগ নিয়ে লড়েছে এবং সেই মতকে তুরস্কের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। তুরস্কবাসীকে আল্লাহ তাআলা হেফাযত করেছেন। পরিস্থিতি সেখানে এখনও সম্পূর্ণ স্থিতিশীল হয়নি। এ পরিস্থিতির শেষ দেখতে হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এতসব কিছু সত্ত্বেও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর অস্ত্রের মুখে সেদেশের নিরস্ত্র জনগণের রাস্তায় নেমে আসার ঘটনাটি একটি বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। বর্তমান সময়ে এরকম উদাহরণ জনগণের পক্ষ থেকে খুব একটা দেখা যায় না। রাজনৈতিক কারণেও দেখা যায় না, ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো নৈতিক কারণেও এমন ঘটনা বর্তমানে কমই পরিলক্ষিত হয়। 

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এই প্রতিরোধ দেখে মনে পড়ে গেছে গত শতাব্দীর আশির দশকের পাকিস্তানের একটি ঘটনা। তখন খতমে নবুওত আন্দোলনে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে এক পর্যায়ে পাকিস্তানে হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নৌরি রাহ. ও মুফতী মাহমুদ রাহ.-এর নেতৃত্বে পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। উলামায়ে কেরামের আহ্বানে হরতাল বা বন্ধ আহ্বান করা হয়েছিল। লাখ লাখ জনতা তখন রাস্তায় এসে শুয়ে পড়েছিল। তাদের একটিই কথা- হয় আমাদের ঈমানী দাবি মানো না হয় আমাদের গায়ের উপর গাড়ী চালিয়ে দাও। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তখন পাকিস্তান পার্লাামেন্ট কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। সরকার প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টোও সেদিন তার বক্তব্যে ঐক্যবদ্ধ জনদাবির মুখে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার আইন পাশের পক্ষে সম্মতি ব্যক্ত করেছিলেন। যাই হোক, পাকিস্তানের খতমে নবুওত আন্দোলনে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত পথে নেমে আসার পেছনে তো ছিল মহব্বতে নবী এবং ইশকে রাসূলের এক মহান দাস্তান। সেজন্যই সেই ত্যাগ দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। সে তো ছিল অপার্থিব ও পরকালীন এক আবেগের বিষয়। কিন্তু তুরস্কে এরদোগানের মতো একজন প্রেসিডেন্টের একটি সামান্য আহ্বানে এমন সাড়া কীভাবে পড়লো? তিনি তার মোবাইল ফোনের একটি অ্যাপ ব্যবহার করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন। সেই বক্তব্য সিএনএন তুর্কে প্রচার হলো। আর অস্ত্রের মুখেও জনগণ রাস্তায় নেমে এল। এটা কীভাবে সম্ভব হলো। এ এক বিস্ময়ের বিষয়। সাম্প্রতিককালে এর কোনো নযীর পাওয়া যায় না। গত প্রায় অর্ধ শতাব্দীতে তুরস্কে চারটি সেনা অভ্যুত্থান হলো। ৬০ সালে, ৭১ সালে, ৮০ সালে এবং ৯৩ সালে। আর প্রতিবারই অভ্যুত্থান সফল হলো। তখন জনগণ রাস্তায় নামেনি। সশস্ত্র বাহিনীর সামনে নিরস্ত্র জনতা এসে দাঁড়ায়নি। এবার কেন সেটা সম্ভব হলো? এ বিষয়ে দুনিয়ার বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। এদের বেশিরভাগের বিশ্লেষণে যে কথাগুলো ঘুরেফিরে সামনে এসেছে, তার একটি চিত্র এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এর আগে আমাদের দেশের একশ্রেণীর সংবাদপত্রের অভিনব আচরণের কথা উল্লেখ করা যায়। তারা মূল কারণের দিকে না গিয়ে বিভিন্নভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে তুরস্কের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পেছনে আজব আজব কারণ বের করছে। তাদের ভাবে মনে হচ্ছে, অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় তারা খুব আশাহত হয়েছে। তারা যেন একটি সফল অভ্যুত্থানের অপেক্ষাতেই ছিল। এখন তাদের মনের কষ্ট ও জ্বালা দূর হচ্ছে না। তারা একেকবার এরদোগানকে সুলতান, একনায়ক, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করছেযদিও তারা বাড়ির পাশের কাশ্মীরের সংঘটিত বর্বরতা নিয়ে টু শব্দটি করতেও রাজি নয়।

আসল কথা হল, রজব তাইয়েব এরদোগানের এমন কিছু অবদান-উপহার তুরস্কবাসীর উপর রয়েছে, যে কারণে তারা তার সামান্য-আহ্বানে জীবনবাজি রেখে রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে। দেখার বিষয় হলো- এরদোগান বিভিন্ন সময় দেশের ও দেশের মানুষের জন্য কী করেছেন? প্রথমে ১৯৯৪ সালে তিনি ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র নির্বাচিত হন। ইস্তাম্বুল হচ্ছে এশিয়া-ইউরোপের মিলনস্থল। ইতিহাসের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী এ শহর। সালতানাতে উসমানিয়ার (অটোম্যান সা¤্রাজ্য) পতনের পর বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সরকারের আমলে দিনে দিনে শহরটি অপরিচ্ছন্ন, নোংরা, অপরাধপূর্ণ একটি শহরে পরিণত হয়েছিল। এরদোগান মেয়র হওয়ার পর এ পরিস্থিতি উত্তরণে পূর্ণ মনোযোগ দেন। ইস্তাম্বুল তার পূর্বের ঐশ্বর্য্য, সৌন্দর্য ও জৌলুস ফিরে পায়। বিশেষত ইস্তাম্বুল থেকে ক্রাইমের শেকড় উপড়ে ফেলার পর ইস্তাম্বুলে আবার হাজার হাজার পর্যটক ভিড়তে শুরু করে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়। ২০০২ সালে এরদোগান রাষ্ট্রীয় মূল পদ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্দুল্লাহ গুল। এরদোগানের আগের দল ছিল নাজমুদ্দীন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন রেফাহ পার্টি (ওয়েলফেয়ার পার্টি) একটি উন্নয়নমুখী গণতান্ত্রিক দল হওয়া সত্ত্বেও একসময় সেনাবাহিনী ও বিচারবিভাগের যোগসাজশে ওই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর নতুন দল জাস্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি গঠন করা হয়। এ দলের হয়েই তিনি ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু তখনো ধর্মনিরপেক্ষ নামধারী জেনারেল ও বিচারকদের চোখরাঙানি বন্ধ হয়নি। এরদোগান ধৈর্য্যরে সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যান। একসময় প্রভাবশালী ও দুর্নীতিগ্রস্ত জেনারেল ও বিচারকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। উপরে উপরে ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান দিয়ে এসব জেনারেল ও বিচারকরা ছিল আপাদমস্তক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তাই অনেকেই বড় বড় সাজা ভোগ করেন। কোনো তাড়াহুড়া কিংবা বিশেষ ট্রাইবুনাল ছাড়াই ধীরে-সুস্থে এরদোগান এদের বিচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দুর্নীতির বরপুত্ররা সাধারণ নিয়মেই বড় বড় শাস্তি পেতে বাধ্য হন। এ ছিল এক বিরাট সাফল্য।

প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এরদোগান মনোযোগ দেন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে। ২০০২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৬ বিলিয়ন ডলার। সেটি বর্তমানে ৯২ বিলিয়ন ডলার। তুরস্কের ওপর আইএমএফের বিশাল অংকের ঋণ ছিল। তিনি সেটা পরিশোধ করেন। অর্থনীতির পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। সরকারিভাবে বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষালয় গড়ে তোলেন। ২০০২ সালে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। বহু নতুন হাসপাতাল কায়েম করেন। তৃণমূল পর্যন্ত বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসাসেবার প্রাপ্তি সহজলভ্য করে তোলেন।

এরদোগানের অন্যতম বড় সফলতা তুরস্কের বৈদেশিক নীতি। ইউরোপের ভেতরে থেকে ইউরোপের চোখরাঙানিকে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সাথেই সামাল দিয়েছেন তিনি। ইউরোপের দেশগুলো থেকে চাপ এসেছে কূটনীতির ধারা বদলানোর, ফৌজদারি আইন পরিবর্তনের। এমনও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, অমুক অমুক আইন বদল করলে সারা বছরের জন্য পুরো ইউরোপ সফরের ফ্রী ভিসা দিয়ে দেওয়া হবে তুরস্কবাসীকে। এরদোগান এসব প্রস্তাবে মাথানত করেননি। ২০০৯ সালে গাজায় ইসরাঈলী বোমা হামলার সময় এরদোগানের সাহসী ভূমিকা মুসলমানদের অন্তর জয় করেছে। এভাবেই ২০০২ সাল থেকে ২০১৬- চৌদ্দ বছরের শাসনামলে দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য এরদোগান বড় খেদমত আঞ্জাম দেন। বহু প্রতিরোধ ও দেশ-বিদেশের চাপ সত্ত্বেও জনগণকে যাবতীয় নাগরিক সুবিধা দিয়ে তিনি তাদের প্রিয় নেতা হয়ে উঠেন।

এসব অসাধারণ সাফল্যের সাথে সাথে আমাদের দৃষ্টিতে অবশ্য সবচেয়ে বড় বিষয়, যেটি জনগণকে নেতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং তার প্রতি গভীর অনুরাগী করে তুলেছে সেটি হচ্ছে- ধর্মীয় স্বাধীনতা। যে দেশটি কয়েকশ বছর পুরো মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে সে দেশেই কি না এক সময় ইসলাম হয়ে গিয়েছিল এক প্রকার নিষিদ্ধ ধর্ম। কুরআনী বর্ণমালা ও আযানের শব্দ পর্যন্ত সেখানে বে-আইনী ঘোষিত হয়েছিল। সরকারি চাকরিজিবীদের ক্ষেত্রে মুসলিম পুরুষের মুখে দাড়ি রাখা এবং মুসলিম মেয়েদের মাথায় ইসলামী হিজাব ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আর অন্য সবাইকেই দাড়ি ও হিজাবের কারণে নানা রকম যুলুম ও অন্যায় আচরণের শিকার হতে হত। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় বিষয়ে পড়ার জন্য শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠাতে হত অজপাড়াগাঁয়ে কিংবা কোনো গুপ্ত গুহায়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল স্তম্ভগুলো (প্রতিরক্ষা, বিচারব্যবস্থা) তুলে দেওয়া হয়েছিল কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী লোকদের হাতে। এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তুরস্কের ধর্মপ্রাণ জনগণকে তাদের ধর্মীয় অধিকার ফেরত দিতে শুরু করেন। বহু বছর পর আবার তুরস্কের জনগণ সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহের নাম শুনতে শুরু করে ক্ষমতাবানদের মুখে। তুরস্কের মসজিদগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান ধ্বনিত হয়। জনগণ নির্বিঘ্নে তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেন। অবশ্য একথা সত্য যে, এরদোগান ও তার অনুসারীদের পথচলা এখনও অনেক বাকি। এখনও আইনের দৃষ্টিতে তুরস্ক সেক্যুলার রাষ্ট্র। এখনও সেই দেশের অনেক কিছুই ইসলাম পরিপন্থী। কিন্তু পূর্বের এজাতীয় বিরূপ ও প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকে তাকানো হলে এরদোগানের বর্তমান সাফল্যকে অসামান্যই বলতে হয়।

এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করার মত যে, এরদোগানের এই ধীরলয়ের ইসলামী অনুশাসন-মুখি পথচলা কিংবা মুসলিম জনসাধারণকে নির্বিঘেœ ধর্ম পালনের ন্যূনতম সুযোগ করে দেওয়ার কর্মপ্রয়াসও সুপার পাওয়ারদের কাছে শোভন মনে হয়নি। তারা বরাবর প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বজায় রেখেছে। কিছুদিন আগে তুরস্কে রাশিয়ার একটি বিমান ভূপাতিত করার ঘটনা নিয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। একপর্যায়ে দেশ দুটির ঐতিহাসিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরে গোয়েন্দা তথ্যে প্রকাশ হয়েছে, ঐ বিমানটিতে অপর একটি সুপার পাওয়ারের ইন্ধনে কোনো কোনো অফিসার কর্তৃক আক্রমণ চালানো হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের বিরাজমান সম্পর্ককে চক্রান্ত করে নষ্ট করার জন্য। পরবর্তীতে দুদেশের মাঝে উত্তেজনা প্রশমিত হয়। এতে একটি জিনিস প্রমাণিত হয়, মুসলমানদের কোনো একটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে, সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশিলতা তৈরি হলে এবং এর সাথে শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিম ধর্মীয় অধিকারের প্রতি ন্যূনতম সম্মান ও মূল্যবোধ প্রদর্শন করলে পশ্চিমা সুপার পাওয়াররা সেটা বরদাশত করতে চায় না। সে রাষ্ট্রটিকে কিছুতেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে দিতে চায় না। বিগত কয়েক মাস ধরে তুরস্কের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত গুপ্ত ও আত্মঘাতী হামলাগুলো এরই প্রমাণ বহন করে। এবং সবশেষে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানও সে কথাই জানান দেয়।

আমরা অবশ্য এ কথা বলতে চাই না যে, এরদোগান কোনো বড় আলেম কিংবা খলিফাতুল মুসলিমীন। তার কোনো ভুল ত্রুটি নেই, কিংবা তিনি ইসলামী হুকুমাত কায়েম করে ফেলেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সব কিছুই ঠিকমত করেন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার কোনো ভুল ভ্রান্তি হয় না। তবে এটা সত্য যে ইউরোপের মধ্যে বসে সুপার পাওয়ারদের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে মুসলিম স্বকীয়তা তিনি ধরে রেখেছেন। তার ধর্মপ্রাণ জনগণকে ইসলামী ইবাদত ও জীবনধারা পালনে ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমান সময়ে এতটুকু অগ্রগতিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তুরস্কবাসী তাদের জীবনবাজি রেখে তাদের নেতাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রেখেছেন। তারা এখন এরদোগানের কাছে নিশ্চয় আরো বেশি কিছু আশা করবে। তারা চাইবে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের বিধি-বিধানগুলো চালু হোক। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেজবান হযরত আবু আইয়ূব আনসারী রা.-এর স্মৃতিবিজড়িত সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহের দেশে শত শত বছর সুলতানাতে উসমানিয়ার নেতৃত্বদানকারীর রাষ্ট্রটির জনপ্রিয় এ নেতা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য আর কী কী করতে পারেন সে দিকে নিশ্চিয় বিশ্ব মুসলিমের নযর থাকবে এখন।

সর্বশেষ কথা, জনগণ যে শাসকের সাথে থাকে বিজয় তারই হয়। এরদোগান জনগণের জন্য কাজ করেছেন। তাদের মনের ভাষা বুঝেছেন। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছেন। অর্থনীতি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক উন্নতি করেছেন। জনগণ তার প্রতিদান দিয়েছে। জীবনবাজি রেখেও অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। দেশে দেশে ক্ষমতাসীনদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। এ যুগের নাগরিকরা তাদের সাধারণ নাগরিক পাওনার সামান্য পেলেই অনেক খুশি হয়ে যায়। তাদের ধর্মীয় বোধ ও অধিকারের জায়গার প্রতি শাসকদের সম্মান দেখলে আপ্লুত হয়। ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে, বক্তৃতার কথামালা দিয়ে জনগণের মনের উপর রাজত্ব করার ব্যর্থ চেষ্টা আসলে কোনো সুফল দেয় না। জনগণের পক্ষে কাজ করলে নাগরিকরা নিজেদের পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকে। বিশ্বের সকল দেশের শাসকগণ এ সত্য যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই তাদের নিজের ও তাদের জনগণের মঙ্গল তরান্বিত হবে। 

 

 

 

advertisement