রজব ১৪৩৭   ||   এপ্রিল ২০১৬

দেখে এলাম হযরত পাহাড়পুরী হুযূরকে

মাওলানা আশরাফ হালিমী

আমার পরম প্রিয় উস্তায, উস্তাযে মুহতারাম, শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুম। হুযূর দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ। গত রমযান মাসে গুরুতর ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি শয্যাশায়ী। হুযূরের বাড়ীর খুব কাছেই আমার কর্মস্থল ও বাসগৃহ। কাছাকাছি থাকার সুবাদে আলহামদুলিল্লাহ মাঝেমধ্যেই এক নযর দেখে আসার সুযোগ হয়। আজকে আছরের নামায পড়ে হুযূরের কাছে গেলাম। হুযূরের মাথার কাছে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হুযূরের সুঠাম সুদীর্ঘ দেহ একেবারেই শুকিয়ে গেছে। মুখে কোনো কথা নেই। চোখদুটি বন্ধ। নিথর দেহ। শুধু বুকটায় একটু উঠানামা। নাকে খাবারের নল লাগানো। যেন সেখানে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই। দৃশ্যটা সহ্য করা কঠিন। যে ঘরটায় হুযূরকে রাখা হয়েছে, চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। ঘরের এক কোণে একটি অক্সিজেনের সিলিন্ডার রাখা। আরেক কোণে রাখা কী একটা মেশিন। জানা গেল, এটা কফ পরিষ্কারের মেশিন। হুযূরের যখন কাশি আসে, গলায় কফ আসে। হুযূর পারেন না কফটা বের করতে, তখন এ যন্ত্রের সাহায্যে কফ বের করে আনা হয়। পশ্চিমের দেয়ালে একটি দেয়াল আলমারি। হুযূর নিজেই বানিয়েছিলেন কিতাবাদি রাখার জন্য। এখন সেটা ঔষধপত্র, সেলাইন, সিরিঞ্জ ইত্যাদিতে ঠাসা। একটা নেবুলাইজারও দেখা যাচ্ছে। এর মানে শ্বাসযন্ত্র পরিষ্কার রাখার একটা ব্যবস্থা। হুযূর যে খাটে শুয়ে আছেন, খাটের মাথার দিকটা উঁচু করা। পিঠের নিচে বৈদ্যুতিক বিছানা। নিথর নিশ্চল রোগীদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা।

আপন শায়েখ ও মুরশিদ, হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ.-এর সমাধিস্থলের খুব কাছেই একটি তিন তলা বাড়ী। বাড়ীর তৃতীয় তলার এ ছোট্ট কামরাটায় শুয়ে আছেন (বরং বলা দরকার, নিথর পড়ে আছেন,) আমাদের লক্ষ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের প্রাণ, আমাদের হৃদয় ও আত্মার প্রশান্তি, শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুমুল আলিয়া।

দুই

আমার দুপাশে দাঁড়ানো হুযূরের দুই ছেলে আশরাফ ও আবরার। দুজনই সার্বক্ষণিক হুযূরের কাছে থাকে।  দুজনেরই ঘর সংসার আছে। মাদরাসায় তাদরীসের যিম্মাদারি আছে। সে কাজগুলো এখন তাদের যিন্দেগীর দ্বিতীয় কাজ। আসল কাজ অসুস্থ বাবার সেবা। তারা ভুলতে পারে না, তাদের উপর তাদের বাবার ঋণ। এতকালের এত আদর এত শাসনÑ সব তাদের মনে পড়তে থাকে। হুযূরের তৃতীয় ছেলে, মাহমুদ। এখনো নিয়মতান্ত্রিক তালিবুল ইলম। মাদরাসাতুল মাদীনায় পড়ছে। প্রতিদিন বিকেলে একবার এসে বাবাকে দেখে যায়। বাবার অবিকল ছবি। আল্লাহ তাদের সবাইকে তাদের বাবার স্বপ্নের মত করেই কবুল করুন।

হুযূরের দুই ছেলে আমার দুপাশে। আমি তাদের চোখের দিকে তাকালাম। আমার ভেতরটা কেমন করে উঠল। মনে চাইল তাদেরকে সান্ত¡না দেই। কিন্তু তাদেরকে শান্ত¡না দেওয়ার কোনো ভাষা তো আমার কাছে নেই। সান্ত¡না লাভের উদ্দেশ্যে তাদেরকে শোনালাম সান্ত¡নার কথাÑদেখ, তোমাদের আব্বা, আমাদের পাহাড়পুরী হুযূর, এমন গুরুতর অবস্থায় আছেন, এতে তাঁর কোনো অসুবিধা নেই। তিনি তো তাঁর আজর পেয়েই যাচ্ছেন। তিনি অন্য কোনো জগতে আছেন।

أشد الناس بلاء الأنبياء ثم الأمثل فالأمثل

চিন্তা তো তাদের জন্য যারা হুযূরের খেদমতে আছ। হুযূরের আশপাশে আছ। আল্লাহ না করুন, তোমাদের যবান দিয়ে না আবার এমন কোনো কথা বের হয়ে আসে, যা আল্লাহ তাআলার ফায়সালায় রাযী থাকার পরিপন্থী। কারণ একই দুর্দশার হালত দীর্ঘদিন দেখতে দেখতে হঠাৎ মানুষের বেসবর হয়ে পড়ার আশংকা থাকে। তখন যবানে এমন এমন শব্দও উচ্চারিত হয়ে যায়, যা পিছনের সমস্ত খেদমত, সমস্ত সবরের ছওয়াব নষ্ট করে দেয়। তোমরা হুযূরের কাছে সবসময় থাকছ, হুযূরের খেদমত করছ, তাই তোমাদেরকে শুধু সবরে জামীলের উপদেশ দিই, সবরে জামীলের তাওফীকের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করি

সম্ভাবনা রয়েছে যে, আমাদের বেশুমার গুনাহের কারণে হয়ত আমাদের উস্তাযের এমন সীমাহীন কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ চাইলে এর বিপরীতটিও করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের মন যে দুর্বল! আমাদের সহনক্ষমতা যে সামান্য! আমরা যে পরীক্ষায় পাশ করতে পারব না! তাই আমাদের প্রতি দয়া করে তিনি তা করেননি। অতএব, তোমরা যারা হুযূরের খেদমতে আছ, তোমরা সর্বদা সতর্ক থাকবে, ‘হুযূরের অসুস্থতার কারণ আমরা নিজেরাইÑ এ অনুভূতি নিয়ে হুযূরের খেদমত করবে। হুযূর আমাদের মুহসিনÑ এ আকীদা পোষণ করে হুযূরের খেদমতে নিয়োজিত থাকবে। মোটকথা, হুযূর সুস্থ থাকলে, হুযূর তোমাদের দেখলে এবং তোমাদের জন্য দুআ বাণী পাঠ করলে যেমন আন্তরিকতা ও মুহাব্বত নিয়ে তাঁর খেদমত করতে, এখনো সেরকম আন্তরিকতা ও মুহাব্বত নিয়েই খেদমত করবে। তাহলে সুস্থ পাহাড়পুরী হুযূরের সান্নিধ্য থেকে তোমরা যে ফায়দা লাভ করতে, অসুস্থ পাহাড়পুরীর সান্নিধ্য থেকে তোমরা আরও বেশী ফায়দা লাভ করতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

তিন

বুযুর্গানে দ্বীনের  অসুস্থতার কথা শোনার পর কেউ কেউ মন্তব্য করে থাকেন, “গুনাখাতা যা ছিল আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেই এগুলো সাফ সুতরা করে দিচ্ছেন। কেউ বলেন, “ভুল চুক সবাই করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের গুনাহগুলো দুনিয়াতেই এভাবে মাফির ব্যবস্থা করে দেন। এভাবেই একেকজন একেক মন্তব্য করেন। সবগুলো মন্তব্যের মধ্যে অকৃত্রিম ভালোবাসাই ফুটে ওঠে। তারপরও মনে হয়, এরকম মন্তব্য না করাই ভালো ।  আল্লাহ তাআলা কি শুধুই গুনাহ মাফির জন্য অসুস্থতা ও পেরেশানী দিয়ে থাকেন? আল্লাহ তাআলা কি কারো মর্যাদা বাড়ানোর জন্য অসুস্থতা দেন না?

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা যে কথা বলেছেন, (তরজমা)  তোমাদের কৃতকর্মের কারণেই তোমাদের উপর মুসিবত আসেপ্রত্যেক মুসলমানকে সতর্ক হওয়ার জন্য বলেছেন, পরস্পর সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য বলেননি।

আরেকটা চিন্তা আমাকে আরো বেশী পেরেশান করে। পাহাড়পুরী হুযূরের অসুস্থতা, এটা কি শুধু পাহাড়পুরী হুযূরের পেরেশানী, না গোটা উম্মতের পেরেশানী। বিপদটা কি শুধুই পাহাড়পুরী হুযূরের, নাকি তাদেরও, যাদের জন্য পাহাড়পুরী হুযূর জীবনটাকে তিলে তিলে ক্ষয় করেছেন। পাহাড়পুরী হুযূরের জন্য তো বরং এ এক পরম সাআদাতের বিষয় যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে সেই মুআমালাই করছেন যা তিনি তাঁর প্রিয়তম বান্দাগণের সাথে করে থাকেন। বিপদটা তো বরং আমাদের, যাদের জন্যই ছিল হুযূরের আজীবনের শ্রম-সাধনা। আমাদের তো চিন্তা করা উচিত, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন। পাহাড়পুরী হুযূর নামক যে মহা নিআমত আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দিয়েছিলেন, আমরা সেই নিআমতের কদর করিনি বলে নিআমত উঠিয়ে নিচ্ছেন। না না, এটা পাহাড়পুরী হুযূরের জন্য মুসিবত নয়। মুসিবত আমাদের, আমরা এখন যারা জীবনের জটিল কঠিন পেরেশানীর মধ্যে পড়ে হয়রান হয়ে কতখানে কত জায়গায় ছুটে বেড়াই, কোথাও পাই না সেই সমাধানগুলো, যা আমরা পেতাম আমাদের পাহাড়পুরীর যবান থেকে। আমার মনের অবস্থা তো হল, পাহাড়পুরী হুযূরের সুস্থতার দুআর। আগে তো বরং আমাদের তাওবা করতে হবে, “আল্লাহ, ভুল হয়েছে। আপনি যে মহান নিআমত আমাদেরকে দিয়েছিলেন, সেই নিআমতের কদর আমরা করতে পারিনি। আপনি আমাদের মাফ করুন। আমাদের নিআমত আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে দিন। এ যবান কত দামি, হুযূর খামুশ হয়ে যাওয়ার পর আমরা বুঝতে পারছি। আল্লাহ! উম্মতের জন্য এ মানুষটার অন্তরে যত ব্যথা, যত দরদ ছিল, আমাদেরকে কতভাবে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, আমরা বুঝিনি। হে আল্লাহ! আমাদের ভুল হয়েছে, আপনি আমাদের মাফ করে দিন। এই দরদভরা দিলের ব্যথাগুলো বোঝার মত অবস্থা আবারো আপনি আমাদের জন্য তৈরি করে দিন

আমরা যদি আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা করি, আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওবা কেন কবুল করবেন না?! কেন আমাদের পাহাড়পুরী হুযূর আমাদের মাঝে আবারো ফিরে আসবেন না’?

চার

সময় কম ছিল। আছরের নামাযের পর। মাগরিবের নামাযের তাড়া। এরমধ্যেই তাদেরকে  শোনালাম পাহাড়পুরী হুযূরের এমন কিছু কথা, যা তিনি আমাকে  বলেছিলেন; জীবনের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন হালতে, বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে।

দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর আমার মনের মায়লান ছিল, তাখাস্সুস পড়ব, দারুল উলূম দেওবন্দ যাব। সেই উদ্দেশ্যে পাসপোর্টও তৈরি করে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার  হুযূরের পরিকল্পনা ছিল, আমাকে তখনই তাদরীসের খেদমতে লাগাবেন। হুযূর আমাকে ডেকে বললেন,  আশরাফ! তোমার তাখাস্সুস পড়া লাগবে না। ইনশাআল্লাহ তোমার ছাত্ররা তাখাস্সুস পড়বে। তোমার দেওবন্দ যাওয়া লাগবে না, ইনশাআল্লাহ, তোমার ছাত্ররা দেওবন্দ যাবে

আমি হুযূরের কথাকে মেনেছি। না বুঝেই মেনেছি। আলহামদুলিল্লাহ আমার ছাত্ররা এখন তাখাস্সুস পড়ে, দারুল উলূম দেওবন্দ যায়, মিশরের জামিআ আযহারে যায়, মদীনা ভার্সিটিতে যায়, বড় বড় সনদ অর্জন করে। আমার খুশি লাগে এবং পাহাড়পুরী হুযূরের কত বছরের আগের সেই কথা, কথার প্রতিটি শব্দ, এমনকি কথা বলার সেই আজিমুশশান কাইফিয়্যতÑ সবকিছু যুগপৎভাবে মনে পড়ে। কেমন জীবন্ত নসীহত! তোমার তাখাসসুস পড়া লাগবে না। ইনশাআল্লাহ তোমার ছাত্ররাই তাখাসসুস পড়বে। কেমন জীবন্ত তার প্রতিফলন!

আমার ব্যাপারে পাহাড়পুরী হুযূরের পরিকল্পনা ছিল, আমি শুধুই ছাত্র গড়ার পেছনে মেহনত করব। আমার মেহনত মুজাহাদার পুরোটা সময় আমি শুধুই তালিবে ইলমদের পেছনে ব্যয় করব। আমার একসময় তাসনীফ-তালীফের প্রতি প্রচ- আগ্রহ ছিল। হুযূর জানতে পারলেন আমার আগ্রহের কথা। হুযূরের স্বভাবসুলভ স্নেহমাখা কণ্ঠে আমাকে বলে দিলেন, “আশরাফ, মুর্দা কিতাব লেখার প্রয়োজন নাই। যিন্দা কিতাব হও, যিন্দা কিতাব। আলহামদুলিল্লাহ, এটা ছিল আমার প্রতি হযরত পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুমের বহুত বড় এহসান ও অনুগ্রহ। এ এহসানের বদলা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হুযূর বুঝতে পেরেছিলেন। হুযূরের অন্তর্দৃষ্টি ছিল যে, তালীফাতের যৎসামান্য যোগ্যতা যদিও আমার মধ্যে থেকে থাকে, কিন্তু আমার দ্বীনী খেদমতের উপযুক্ত ক্ষেত্র হল তাদরীস। তালিবে ইলমদের পেছনে সরাসরি মেহনত। আলহামদুলিল্লাহ, আমি মাঝে মাঝে খেয়াল করি, তাদরীসের মেহনতের পেছনে যে পরিমাণ কুরবানী পেশ করতে হয়, যশ, খ্যাতি ও সম্মানের মোহকে যেভাবে বিসর্জন দিতে হয়, উস্তাযে মুহতারাম হযরত পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুমের দুআ ও নেক তাওয়াজ্জুহের বরকতে আল্লাহ তাআলা আমার জন্য সব কিছুই সহজ করে দিয়েছিলেন।

পাঁচ

মাদরাসায়ে নূরিয়ার কথা মনে পড়ে। এখন আমি যেখানে পড়াই, মাদরাসায়ে নূরিয়ার কাছেই আমার মাদরাসা। হযরত পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুমের কী আজিমুশশান বিচরণ ছিল নূরিয়ার দরসগাহগুলোতে। উস্তাযদের মশওয়ারার মজলিসগুলোতে। তালিবে ইলমদের সাথে মুশফিকানা মুআমালায় হুযূরের চেহারায় এবং সমস্ত অস্তিত্বে স্বভাবজাত গাম্ভীর্য সর্বদা বিরাজমান ছিল। হযরতের গাম্ভীর্যের সামনে আমরা বিলকুলই চুপসে যেতাম। হুযূরের উপস্থিতিই আমাদের জন্য এক নীরব শাসকছিল। মাদরাসায়ে নূরিয়ার যে কামরায় হুযূর থাকতেন, সেই কামরার দরজা দিয়ে বের হলে পুরো মাদরাসায়ে নূরিয়া একসাথে দেখা যেত এবং মাদরাসার যেকোনো কামরা থেকে হুযূরের কামরার দরজাটা পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হত। হুযূর যখন কামরা থেকে বের হতেন, দরসগাহে যেতেন, এক দরস শেষ করে অন্য দরসে যেতেন, বারান্দা দিয়ে হুযূরের এ আসা যাওয়ার সময়টা আমাদের জন্য চরম সতর্কতার মুহূর্ত ছিল। মাঠের ঠিক মাঝ বরাবর পায়ে হাঁটা পথ। সবুজ মাঠ। মাঝখানটায় বারবার হাঁটাচলার কারণে ঘাস উঠে গিয়েছিল। অযথা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে মাঠ পার হওয়া, অনেকেই পছন্দ করেন না। আমরা ঐ মাঝের পথ দিয়েই চলাচল করতাম। কিন্তু  আমাদের পাহাড়পুরী হুযূর যখন ওযু করতেন, হুযূরের ওযুর জলচৌকিটা ছিল একেবারে সেই মেঠো পথ বরাবর। জলচৌকিটায় বসলে পুরো মেঠো পথটা এ মাথা ও মাথা একসাথে দেখা যেত। আমরা নিশ্চিত জানতাম, হুযূর নিবিষ্ট মনেই উযু করছেন। তাঁর নযর এ পথের দিকে না। ওযুর পানি এবং হাতে ধরা মেসওয়াকের দিকে। তবু হুযূরের ওযু করার সময় এ পথটা, এই একটুখানি পথ পাড়ি দেয়া আমাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। এতটা রুব ও হাইবাতওয়ালা, এতটা ওয়াকার ও গাম্ভীর্যওয়ালা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের পাহাড়পুরী হুযূর শুধুই আমাদের তারবিয়তের স্বার্থে এ স্বভাবজাত গাম্ভীর্যের উপর মাঝেমাঝে নিয়ন্ত্রণের চাদর টেনে দিতেন। কখনো হাসিমাখা নূরানী চেহারা দিয়ে। কখনো নিষ্পাপ হাস্য কৌতুক দিয়ে। যার ফলে এমন গাম্ভীর্যমাখা মানুষটাই ছিলেন আমাদের যত দুঃখ কষ্ট, যত রকম অনুভব অনুভূতির প্রকাশস্থল। যত পেরেশানীর কথা আমরা হুযূরকেই জানাতাম। আর হুযূরের কথা শোনার এমন আজীব কাইফিয়্যত ছিল, সে কাইফিয়্যতেই আমাদের মন নরম হয়ে যেত। মনের সমস্ত বরফ গলে যেত। চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা নিয়ে হুযূরের কামরায় প্রবেশ করতাম। হাসিমাখা নির্ভয় চেহারা নিয়ে ফিরে আসতাম। হুযূরের এটা এক আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতা ছিল। মাদরাসায়ে নুরিয়ার বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, মাঠের উত্তর-পূর্ব কোণের ঐ কামরা, কামরার মধ্যে বসে থাকা গুরুগম্ভীর ঐ মানুষটাÑ একসময় আমরা লক্ষ্য করলাম, আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেল। যখনই মনটা ভারি হয়ে যেত, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা যে কোনো কারণেÑ আমাদের চোখদুটি চট করে ঐ দরজাটার দিকে চলে যেত। সুযোগ খুঁজতে থাকতাম, কখন যাওয়া যায় ঐ মানুষটার কাছে। মনের দরদ বোঝার কী আজীব এক যোগ্যতা আল্লাহ তাঁকে দিয়েছিলেন। চোখ দুটিতে কী যে মায়া ছিল। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সান্ত¡নার সেই হাসিটা কী যে ¯িœগ্ধ ও হৃদয়কাড়া ছিল! হুযূরের শ্রবণপদ্ধতির বর্ণনা আমি কীভাবে দিব বুঝতে পারছি না। জগৎ সংসারের সবকিছু বিস্মৃত হয়ে হুযূর শুধু আমাদের কথাই শুনতেন। একেবারে শতভাগ নববী আদর্শ। কথা শোনার সময় অন্য কোনো কাজ করতেন না। কারো কথা শোনার সময় তাঁর একমাত্র কাজ হত শুধুই তার কথা শোনা। কথার মাঝে ভুল ধরতেন না আমাদের পাহাড়পুরী হুযূর। আমরা মন খুলে বলতে পারতাম আমাদের মনের যত কথা, যত ব্যথা। কী বলতে কী বলে ফেলিজাতীয় শংকা আমাদের মধ্যে থাকত না। আমাদের সব কথা হুযূর শুনতেন। শুনে আগে আমাদের দিলটাকে শান্ত করতেন। তারপর প্রয়োজনে কথার ভুলগুলো শুধরে দিতেন। আখলাকে হাসানার এ এক অতি উচ্চ স্তর। যার নাগাল পাওয়া, যার ধারে কাছে যাওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

বেশিদিন আগের কথা না। তবু মনে হয়, কত কাল পার হয়ে গেল। এই তো সেদিনের কথা। এই যে এই মাটি, এই যে সবুজ ঘাসÑ সবই তো ছিল। কিন্তু সবুজের সজীবতা! যেন অনেক যুগ হল হারিয়ে গেছে। হাতড়েও যেন পাওয়া যায় না সে যুগের নাগাল। মাঝেমাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। দম আটকে আসতে চায়। এখন, এই কালে কী যে এক অসহ্য আবদ্ধতা আমাদেরকে গ্রাস করে রেখেছে। কোথাও একটু আশ্রয় খুঁজে পাই না। মহাকালের গর্ভেই যেন হারিয়ে গেছে সেইসব সুন্দর অনুভূতি, সেই সব মধুর সম্পর্ক। বুক ভরে শ্বাস নেয়া এখন কেবলই যেন ইতিহাস।

ছয়

পাহাড়পুরী হুযূর এবং আদীব হুযূরÑ তাঁরা উস্তায শাগরেদ। দুজনই আমার উস্তায। মাদরাসায়ে নূরিয়ায় এ দুই উৎস থেকেই ইলম শেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। উভয় উস্তাযই মন উজাড় করে, প্রাণ খুলে আমাদের মাঝে ইলম বিতরণ করেছেন। মনে হলে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। শূন্যতার অনুভূতি হৃদয়টাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। আহা, তখন আমরা কী দেখেছিলাম! আহা, কী সজীব, কী প্রাণবন্ত ছিল সে দিনগুলো। উস্তায শাগরেদের মাঝে সম্পর্কের কী বে-মেছাল দৃশ্য ছিল। তখন দুজনই নূরিয়ার অগ্রজ উস্তায। প্রথম সারির শিক্ষক। অথচ সেই আদীব হুযূরকেই দেখতাম, কীভাবে পাহাড়পুরী হুযূরের জুতা জোড়া নিজের দখলে রাখার জন্য অস্থির হয়ে থাকতেন। কারণ একটাই ছিল। কারণটা ছিল, হযরত পাহাড়পুরী ছিলেন আদীব হুযূরের উস্তায। আমাদের এ যুগে এসব কথা সত্যি কল্পকাহিনী মনে হবে। আজকে পাহাড়পুরী হুযূরকে দেখে আসার পর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। চোখের পানি আমার কাছে একটি লুকানো সম্পদ। চাই না কেউ দেখে ফেলুক। তবু আমার ছোট ভাই আবরার, হুযূরের মেঝো ছেলেটা বারবার অবাক হয়ে আমার ভেজা চোখের দিকে তাকাচ্ছিল। অতীতের স্মৃতিগুলো বুকটাকে অসম্ভব ভারি করে তুলছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত শক্তি পাচ্ছিলাম না। সম্পূর্ণ অতীত একসাথে এসে ভীড় করছিল। পাহাড়পুরী হুযূরকে যখন মনে পড়ে, একই সাথে সমান্তরালে মনে পড়ে পাহাড়পুরী হুযূরের কলিজার টুকরা, আমাদের মুশফিক মুহসিন উস্তায আদীব হুযূর দামাত বারাকাতুহুমকে। নূরিয়া মাদরাসার সেই দিনগুলোতে আমরা খেয়াল করতাম, পাহাড়পুরী হুযূরের কাছে আমাদের এ নির্বিঘœ যাতায়াত, মন খুলে কথাবার্তাÑ আদীব হুযূরকে আনন্দ দিত। একদিন তো আদীব হুযূর আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য একথাও বললেন, “আশরাফ, আমার যদি কোন ভুল তোমাদের নযরে পড়ে, আমাকে জানানোর প্রয়োজন নাই, পাহাড়পুরী হুযূরকে জানিয়ে দিয়ো। হুযূর আমার ইসলাহ করে দেবেন।এমন কথা, একজন উস্তায তাঁর শাগরেদকে এমন কথা বলছেনÑ এ যুগের আমাদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হবে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, আমরা কী হতে পেরেছি জানি না, কিন্তু এমন কথা শোনার, এমন দৃশ্য দেখার এবং উস্তায ও শাগরিদের এমন স্বর্গীয় সম্পর্ক অবলোকন করার তাওফীক আমাদের হয়েছিল।

সাত

মনে পড়ে, পাহাড়পুরী হুযূরের তাদরীসের স্মৃতি। হুযূর যেভাবে আমাদেরকে পড়াতেন, আমাদের প্রত্যেক তালিবুল ইলমের কাছে মনে হত, হুযূর শুধু আমাকে খেতাব করেই কথা বলছেন। প্রত্যেক তালিবুল ইলমের প্রতি হুযূরের সীমাহীন আদর ও যত্মমাখা মনোযোগ আমাদেরকে দারুণভাবে বিমোহিত করত এবং অনেক বেশী প্রভাবিত করত। হুযূরের কাছে যেসব কিতাব পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, এখন এত বছর পর সে কিতাবগুলো যখন আমি আমার ছাত্রদেরকে পড়াই, আমার কাছে মনে হয়, এই তো কিছুক্ষণ আগেই যেন আমি এ সবকটা হুযূরের কাছে পড়ে এসেছি। এখন আমার ছাত্রদের নিয়ে স্রেফ তাকরার করছি। বিলকুল মুবালাগা করছি না, হুযূরের প্রত্যেক তালিবুল ইলমের কাছে এমনটাই মনে হয়। তালিবুল ইলমদেরকে এতটা আপন করে নেয়া, এতটা নিবিড়ভাবে তাদেরকে মমতার বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

এখন আমরা যারা শিক্ষক, আমাদের জন্য হযরত পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুমের ছবক পড়ানোর পদ্ধতি একটি আদর্শ নমুনা হতে পারে। আমার মনে চায়, শুধু হুযূরের উসলূবে তাদরীসের উপর সুদীর্ঘ কলেবরের একটি রচনা তৈরি করে ফেলি। সে রচনা তৈরি করতে আমাকে কোনো কিতাব মুতালাআ করতে হবে না। কোনো বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় চিন্তা ভাবনা করতে হবে না।

হুযূর আমাকে যে কিতাবগুলো পড়িয়েছেন, যেভাবে যে উসলূবে পড়িয়েছেন, যদি শুধু তার সরল সহজ বিবরণও দিয়ে যাই, একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়ে যেতে পারে। হুযূর কোন্ দিন কোন্ ছবক কী পরিমাণ পড়িয়েছেন, কোত্থেকে শুরু করেছেন, কোথায় শেষ করেছেন, ছবক বোঝানোর জন্য কী কী কথা বলেছেন, কোন কথা কত বার বলেছেনÑ এখনো যেন আমার স্পষ্ট মনে আছে। কোনোদিন দেখিনি, হুযূর কোনো ছবক বোঝানোর জন্য তাড়াহুড়া করছেন। নেসাব শেষ করার জন্য তড়িঘড়ি করছেন। বছরের প্রথম দিনের ছবক যেভাবে যে গতিতে পড়িয়েছেন, বছরের শেষ দিন পর্যন্ত একইভাবে একই গতিতে পড়িয়ে ঠিক সময়মত, অনেক সময় সময়ের বেশ আগেই নেসাব শেষ করেছেন। এমন মজবুত নিয়মানুবর্তিতা এবং একদিনের জন্যও ছবক নাগা না দেয়ার কারণে হুযূরের ছবকের মধ্যে বরকত ছিল। হুযূর যেদিন যে ছবকটা পড়াতেন, মনে হতো, এ কিতাবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবক বুঝি এটাই। এক কথাকে যে কতবার বলতেন, হিসাব নাই। এমনকি যে কথা পিছনে অসংখ্যবার বলা হয়ে গেছে, কোনো ছাত্র যদি সে বিষয়ে আবারো প্রশ্ন করত, হুযূর কোনো রাগ না করে, পূর্ণ এহতেমামের সাথে একই কথা তাকে আবারো বুঝিয়ে দিতেন। হুযূরের এ সময়ানুবর্তিতা, ছবক বোঝানোর অদ্বিতীয় উসলূব, প্রত্যেক তালিবুল ইলমের অবস্থার বিবেচনা করা এবং একটি ছবককে বারবার করে বুঝিয়ে দিতে থাকার কারণে আমাদের প্রত্যেক তালিবে ইলমের কাছে হুযূরের পড়ানো কিতাবগুলোর শুরু-শেষ একই রকম স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকত।

তালিবুল ইলমরা ছিল হুযূরের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন। ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রত্যেক তালিবে ইলমের তিনি খোঁজখবর রাখতেন।

মনে চায়, অনেক কথা বলি, অনেক কিছু লিখি, পরক্ষণে ভাবি... যাক্ কিছুই তো বলা হল না। কিছুই তো লেখা হল না। কী লিখব তাঁকে নিয়ে। আমরা শুধু তাঁকে দেখেছি, কাছ থেকে দূর থেকে তাঁকে অবলোকন করার সৌভাগ্যটুকু অর্জন করেছি। তাঁকে নিয়ে লেখার কী সাধ্য আছে আমাদের?

দুআ করি, আল্লাহ তাআলা হযরতকে শেফায়ে কামেল নসীব করুন এবং আমাদের জন্য এস্তেফাদার দরজা পুনরায় উন্মুক্ত করে দিন। আমীন।  

 

 

 

advertisement