শাবান-রমযান ১৪৩৬   ||   জুন-জুলাই ২০১৫

দায়িত্ব : প্রশ্রাব বন্ধে মন্ত্রণালয়!

ওয়ারিস রব্বানী

 

 

উচিত কাজে মন নেই। বাড়তি কাজে পারঙ্গম। এ সমাজে এমন ব্যক্তির সংখ্যা অগণন। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়ও যে এমনসব কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে পারে- ধারণায় ছিল না। কী আর করা যাবে! ধারণাতীত কত বিষয়ই তো এখন ঘটছে। হ্যাঁ আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয় হঠাৎ এমন একটি ধারণাতীত বাড়তি কাজ নিয়েই খুব ব্যস্ত মহড়া শুরু করেছে।

ঘটনা একই সঙ্গে কৌতুককর, বিব্রতকর ও অবমাননাকর। বৃদ্ধ ধর্মমন্ত্রী ভিডিও ফুটেজে বলছেন, আরবী ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষ এখন রাস্তাঘাটে যত্রতত্র প্রশ্রাব করা থেকে বিরত থাকবে। এজন্যই ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে আরবীতে লেখা হচ্ছে-হুনা মামনুউত তাবাওউল। বেশির ভাগ লেখায় বানান ঠিক নেই। নুকতা ঠিক নেই। ঠিকাদারি কাজের আর্টিস্ট বেচারার ভাষাজ্ঞান থাকা-না থাকারও তো একটা ব্যাপার আছে। তা ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ে শামীম আফজালদের মতো প্রাজ্ঞরা থাকতে এসব আরবী লেখার বানান-নুকতার পেছনে নেগরানি করার লোক কোথায়! হায় রে, রাস্তার পাশে প্রশ্রাব বন্ধের দায়িত্ব নিল ধর্ম মন্ত্রণালয়! ওই মন্ত্রণালয়ের এরকম অদ্ভুত দায়িত্বের কথা আগে শোনা যায়নি। এসব তো সিটি কর্পোরেশনেরই সামলানোর কথা। সেই সিটি কর্পোরেশনকে দিয়ে নাকি ধর্ম মন্ত্রণালয়ই কাজটি করাচ্ছে। অথচ দেখুন, হজ্ব-এজেন্সিগুলো উমরাহর ভিসা, হাজ্বীর কোটাসংখ্যা নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে মানববন্ধন করছে। কিন্তু সে-ব্যপারে খবর নেই। পবিত্র রমযান মাসে রমযানের পরিবেশ রক্ষায় (প্রকাশ্যে হোটেল বন্ধ রাখা, প্রকাশ্যে বিড়ি-সিগারেট ও চা-নাস্তা না খাওয়া, মিডিয়া, বিলবোর্ড ও বিচরণে অশ্লীলতা বন্ধ)  ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ চোখে পড়ে না। ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক-বøগারদের অসভ্য উৎপাত বন্ধে আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণ থামানো নিয়ে এই মন্ত্রণালয়ের কোনো ভাবনা আছে বলেও শোনা যায় না। অথচ তারা ব্যস্ত হয়ে গেল মহানগরীর পথে-প্রান্তে প্রশ্রাব বন্ধের অভিনব ও অবমাননাকর একটি পন্থার উদ্ভাবন নিয়ে। আগে শুনতাম, কাজ না থাকলে লোকে খৈ ভাজে। কিন্তু মাথার উপর হাজার কাজের বোঝা নিয়েও এ কোন দেয়াল ভাজার কাজে লাগল ধর্ম মন্ত্রণালয়!

আরবী পবিত্র কুরআনের ভাষা। নবীজীর ভাষা। আরবী ভাষার প্রতি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে শ্রদ্ধা রয়েছে- সে হিসেবে সম্ভাব্য প্রশ্রাবের জায়গায় আরবী লিখে প্রশ্রাব থেকে বিরত রাখার চেষ্টা নিশ্চিত অবমাননার ঝুঁকিপূর্ণ একটি উদ্যোগ। না বুঝেও অনেকে সেই আরবী লেখার মধ্যেই প্রশ্রাব সেরে ফেলতে পারে। এ দেশে ভিন্নধর্মী মানুষও রয়েছে। আরবীর প্রতি যাদের বিশেষ শ্রদ্ধা থাকার কথা নয়। তাদের অনেকের দ্বারা এ-জাতীয় অবমাননা এমনিতেও ঘটতে পারে। তাছাড়া উগ্র ইসলাম-বিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক এবং চুলকানিবাদী জঙ্গি কিছু নাস্তিকের অস্তিত্বও তো এখন শহরজুড়ে অনুভবযোগ্য। একটি শহরের সব কুকুর, প্যাঁচা কিংবা তেলাপোকা যেরকম ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সম্ভব না- তেমনি এসব জঙ্গি নাস্তিকও তো কিছু কিছু থাকবেই। শহর কিংবা জনপদের সব আবর্জনা অথবা বিষ তো একদম দূর করা যায় না। তো সেই নাস্তিক গোষ্ঠী তো ইচ্ছা করেই ওই আরবী লেখা দেয়ালের প্রতি অবমাননাকর আচরণ করতে অনুপ্রাণিত বোধ করতে পারে। বার বারও করতে পারে। সেজন্যই প্রশ্রাবের জায়গায় এভাবে আরবী ভাষা ব্যবহার বন্ধের দাবি জানিয়েছেন অনেক সুধীজন। আলেম-উলামা, ইসলামী চিন্তাবিদগণ এ ঘটনায় ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অবশ্য আরবী ভাষার প্রতি জনতার শ্রদ্ধার দাবি করেই এ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তাদের এ কথার ভেতরে যে অনেক ফাঁক রয়েছে সে বিষয়ে কেউ চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। যেমন : গর্বিত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংবিধান থেকে ইসলাম ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে দ্বিধা করলেন না যারা- তারাই আরবী ভাষার প্রতি সম্মান ও দরদ থেকে এমনটা করবেন- এটা হিসাবে মিলে না। চরম ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক বøগারদের প্রতি প্রকাশ্য সহানুভতিশীল সরকারের মন্ত্রণালয় কুরআনের ভাষার মর্যাদা রাখার প্রেরণা থেকে প্রশ্রাব বন্ধের পদক্ষেপ নেবে- এটাও কল্পনীয় নয়। তবে কেউ কেউ যেমন বলেন যে, সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক একটি পদক্ষেপ অবশ্যই নেওয়া যেতে পারে। আমরা সেটি বলি না। তারা বলেন, ওসব প্রশ্রাবের জায়গায় কুরআনের ভাষা আরবী না লিখে জাতির জনকের ছবি এঁকে দেয়া যায়। তাতে হিন্দু-মুসলিম, নাস্তিক-শয়তান কেউ সেই দেয়ালের দিকে তাক করে প্রশ্রাব করার সাহস পেত না। সংবিধান তো আছেই, কোর্ট-কাচারি, র‌্যাব, পুলিশ আর নগরজুড়ে কর্তৃত্ববাদী দুরমুজবাহিনীর ভয়ে কারো প্রশ্রাবের বেগই পেতো না। চেতনার সামনে কীসের প্রশ্রাব! দু-একদিন ভরা তলপেট নিয়ে হেসে খেলেই মানুষ অনায়াসে পারে করে দিতে পারতো। যারা এভাবে বলেন, তারা হয়তো কোনো যুক্তিতেই বলেন। কিন্তু আমরা এমন কথা বলি না।

আমরা বরং বলি, আরবী ভাষার অবমাননার দরকার নেই। জাতির জনকের ছবিকেও প্রশ্রাববিদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। বরং উপযুক্ত পদক্ষেপ হল, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নগরজুড়ে বেশি পরিমাণে গণশৌচাগার (অ-বাণিজ্যিক, বেদখলমুক্ত ও নোংরামিমুক্ত) পরিচালনার ব্যবস্থা করা। নিজের করণীয় কাজে হাবুডুবু খাওয়া ধর্ম মন্ত্রণালয়কে এ-জাতীয় প্রশ্রাববন্ধের অযাচিত কৌশলথেকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হোক। বর্ষীয়ান ধর্মমন্ত্রীর প্রতি আমাদের অনুরোধ, খৈ ভাজার দরকার কী, আপনার উপযুক্ত কাজেরই তো অভাব নেই। সেসব কাজে সময় ও মন দিন। খৈ ভাজার মতো নাই-কাজের লোক আপনার কলিগদের মধ্যে কি কম আছে? 

 

 


 

 

 

 

advertisement