রবিউল আখির ১৪৩১   ||   এপ্রিল ২০১০

বাইতুল মুকাররমের মিম্বারে কালেমার অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা - কালেমার মূল দাবীই পরিত্যক্ত

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

গতকাল ২০/০৩/২০১০ ঈ. শনিবার একটি দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে দেখলাম, বাইতুল মুকাররম মসজিদের জুমার বয়ান ছাপা হয়েছে। বয়ানের বিষয়বস্তু ছিল কালেমা তাইয়েবা ও কালেমা শাহাদাতের ব্যাখ্যা। এ প্রসঙ্গে সর্বসাকুল্যে যে কথাগুলি এসেছে তা ওই পত্রিকা থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি।

কালেমা শাহাদাতের ১ম অংশের মর্ম হল-মহান রাব্বুল আলামীন হলেন একক, অবিনশ্বর নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা, যাবতীয় পরিপূর্ণ গুণাবলির আধার, যাবতীয় ত্রুটিপূর্ণ গুণাবলি হতে মুক্ত, পবিত্র বিশ্বের কোন বস্তু তার জ্ঞান ও শক্তির বাইরে নয় এবং তিনি অতি সূক্ষ্মদর্শী ও সর্ব বিষয়ে পূর্ণ অবগত। তিনি হলেন সৃষ্টির প্রতি অতিশয় দয়াবান ও অনুগ্রহশীল, বান্দার উপর চির বিজয়ী ও তার ক্রোধের উপর বিজয়ী, বিরাট ক্ষমাশীল, শিল্প কৌশল মহা বিজ্ঞানময়, অনুপম তিনি বিশেষ কোন স্থানে সমাসীন নন, কাল চক্রের উর্ধ্বে, তিনি আসমান-জমিনের আলো, ভাগ্য নির্ধারণকারী, বান্দার রিযিকদাতা, মৃত্যুদাতা, মহাজ্ঞানী, মহাব্যবস্থাপক, আরও অসংখ্য সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণের অধিকারী। কালেমা শাহাদাতের দ্বিতীয় অংশের মর্ম হল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহ পাকের খাস বান্দা ও তার রাসূল। রাসূল ও নবী সিলসিলার সর্বশেষ রাসূল ও নবী, তিনি সত্যবাদী অদৃশ্য জগত ও শরীয়তের আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রেও বিশ্বস্ত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অন্য কোনো মানুষের তুলনা চলে না। তুলনা করলে তা হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বেয়াদবী। তার উপর অবতীর্ণ কালাম তথা কুরআন হলো আল্লাহ তাআলার কালাম তথা অবিনশ্বর।- দৈনিক ইনকিলাব, পৃষ্ঠা ২

কালেমায়ে শাহাদাতের ব্যাখ্যায় যে কথাগুলি বলা হয়েছে তা ভুল নয়। কিছু জায়গায় যদিও আল্লাহর তাআলার ছিফাত ও গুণাবলির জন্য যথার্থ শব্দ ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি তবে মূল আপত্তি সেখানে নয়। মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, কালেমায়ে শাহাদতে তাওহীদের যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তার দাবি কি শুধু এটুকুই যে, আল্লাহ তাআলাকে খালিক ও রাযযাক (সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা) বলে স্বীকার করা এবং তাঁর গুণাবলি ও আসমায়ে হুসনার প্রতি ঈমান রাখা?

বস্তুত কালেমায়ে তাওহীদ ও কালেমায়ে শাহাদাতের মূল অর্থ এবং এ দুই কালেমার প্রধান দাবিই উপরোক্ত বয়ানে অনুল্লেখিত। তা হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ। তাই কর্মগত, বিশ্বাসগত এবং চেতনাগত যত বিষয় ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত সব একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। যেমন নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব, তাসবীহ-তাহলীল, যিকর, কুরআন তিলাওয়াত, মান্নত, কুরবানী, দুআ, ইসতিগাছা ও ইসতিআনাত ইত্যাদি সকল কিছু একমাত্র আল্লাহরই জন্য হতে পারে, আর কারো জন্য হতে পারে না।

اياك نعبد واياك نستعين

এজন্য গায়রুল্লাহর নাম জপা, গায়রুল্লাহর নামে মান্নত করা, গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রাণী জবাই করা, হজ্বের ‘হাদী’র মতো কোনো দরবারের জন্য প্রাণী উৎসর্গ করে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া, গায়রুল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করা, পার্থিব উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের কোনো বিষয় গায়রুল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, গায়রুল্লাহকে প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদাপদ থেকে মুক্তি দানকারী মনে করা, কবরকে সেজদা করা, কবরের তাওয়াফ করা, কবরে শায়িত ব্যক্তির নিকট হাজত প্রার্থনা করা-এই সকল কাজ হচ্ছে শিরক।

মোটকথা, তাওহীদের অপরিহার্য কিছু বৈশিষ্ট্য, যা বান্দার মধ্যে বিদ্যমান থাকা একান্ত জরুরি তা হচ্ছে

  • ১. একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে খালিক-মালিক ও রাব্বুল আলামীন বলে বিশ্বাস করবে এবং একমাত্র তাঁকেই বিশ্বজগতের সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করবে। একমাত্র তিনিই হায়াত-মওত এবং সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। জগতের কোনো বস্তু ও উপকরণকে স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক মনে করবে না; বরং এই বিশ্বাস রাখবে যে, জগতের সকল উপায়-উপকরণ আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এসবের দ্বারা যে ফলাফল প্রকাশ পায় তা তাঁরই ইচ্ছা ও আদেশে হয়।
  • ২.একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁরই কাছে প্রার্থনা ও ফরিয়াদ জানাবে। ইবাদত ও ইসতিআনাত একমাত্র তাঁরই হক বলে বিশ্বাস করবে। আশা ও ভয় এবং ভরসা ও সমর্পণে অন্য কোনো কিছুকেই তাঁর সঙ্গে শরীক করবে না।
  • ৩. একমাত্র তাঁকেই সর্বোচ্চ বিধানদাতা ও শর্তহীন আনুগত্যের হকদার বলে বিশ্বাস করবে এবং একমাত্র তাঁর শরীয়তকে অনুসরণযোগ্য বলে মনে করবে।
  • কোনো ব্যক্তি তাওহীদের উপর আছে তা প্রমাণ হওয়ার জন্য উপরোক্ত সকল বিষয়ে ঈমান থাকা জরুরি, যা সংক্ষেপে এভাবে বলা যায় যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ তাআলা, হাকিম ও বিধানদাতা আল্লাহ তাআলা, আমাদের সকল কাজের নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সফলতা ও ব্যর্থতা আল্লাহর হাতে এবং আমাদের ইলাহ ও মাবূদ আল্লাহ তাআলা।

    এই সকল কথা কুরআন মজীদের বহু আয়াতে এবং হাদীস শরীফের অসংখ্য জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। কালেমা তাওহীদ ও কালেমায়ে শাহাদাতেও এই বিষয়গুলি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তবে কালেমার ‘ইবারাতুন নস’ বা প্রত্যক্ষ শব্দে যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হচ্ছে ‘তাওহীদে উলূহিয়্যাত’। অর্থাৎ কালেমার সর্বপ্রথম দাবি হচ্ছে, মাবুদ একমাত্র আল্লাহ তাআলা। ইবাদত ও ইসতিআনাত একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য। এজন্য কালেমার ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় এই অংশটিকেই যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে সে ব্যাখ্যা নিতান্তই অসম্পূর্ণ!

    তদ্রূপ কালেমার দ্বিতীয় অংশ -আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদূহু ওয়া রাসূলুহ (এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল) এরও দাবি হচ্ছে একমাত্র তাঁর সুন্নতের ইত্তেবা ও তাঁর আদর্শের অনুসরণকেই নাজাতের পথ এবং সকল বিদআতকে গোমরাহী ও বিপথগামীতা বলে বিশ্বাস করা।

    বাইতুল মুকাররমের মিম্বার ও মিহরাবের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে যার উপর অর্পণ করা হয়েছে এবং যিনি আজ সেই মিম্বার থেকে কালেমায়ে শাহাদাতের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন কত ভালো হত, তিনি নিজেও যদি খালেস তাওহীদের আকীদাকে গ্রহণ করে নিতেন এবং শিরক ও বিদআতের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে তওবা করে কালেমায়ে তাওহীদ ও শাহাদাতে রিসালাতের হক্ব আদায় করতেন! বাইতুল মুকাররমের মিম্বার থেকে যখন কালেমায়ে তাওহীদ ও কালেমায়ে শাহাদাতের অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে তখন পত্রিকাওয়ালাদের মনে হয়েছে যে, এখন মিম্বারের বয়ান পত্রিকায় প্রচার করা যায়! আল্লাহ তাআলা তাদেরকে হেদায়েত দান করুন এবং মুসলমানদের ঈমানকে হেফাযত করুন। আমীন।

 

advertisement