যিলকদ ১৪৩৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৫

এ আলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

[বক্ষমান প্রবন্ধটি জনাব মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম লিখেছেন।

মাদরাসার উপর মহল্লাবাসীর দ্বীনী হক সংক্রান্ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও চিন্তাসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। যদিও সকল হক ও এতদসংক্রান্ত সকল কর্মপন্থার বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বুনিয়াদি আলোচনাই এখানে স্থান পেয়েছে। উদ্দেশ্য হল, দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। প্রবন্ধের প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ শুরু করলে আশা করি অনেক বড় জিম্মাদারী আদায়ের পথ খুলে যাবে। এক্ষেত্রে পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া দিক-নির্দেশনা সামনে রাখা যেতে পারে। যেমন, হাকীমুল উম্মাত থানবী, সদর ছাহেব, হাফেজ্জী হুযুর, হারদুঈ হযরত ও আসআদ মাদানী রাহ.সহ নিকট ও দূর অতীতের আকাবিরের কর্মময় জীবন থেকে সহায়তা নেয়া যেতে পারে। একথা অনস্বীকার্য, কোনো কোনো মাদরাসা এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসছে ও মেহনত করছে। সার্বিক বিবেচনায় মফস্বলের কিছু কিছু মাদরাসা শহরের অনেক মাদরাসার চেয়ে এগিয়ে। এজন্য শহরের মাদরাসাগুলো এ বিষয়ে আরো মনোযোগী ও যতœবান হওয়ার দাবি রাখে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল উদ্যোগে বরকত দান করুন এবং সব শূন্যতা পূরণের তাওফীক দান করুন।  আমীন

 Ñতত্ত্বাবধায়ক]

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তথা উপমহাদেশের যেখানে যতটুকু বিশুদ্ধ দ্বীনী কাজ আছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, প্রধানত দারুল উলূম দেওবন্দ ও তার অনুসারী কওমী মাদরাসাসমূহের মাধ্যমেই তা পরিচালিত হচ্ছে। যদি দাবি করা হয় বিংশ ও একবিংশ শতকে এতদঅঞ্চল এবং বিশ্বের আরো অনেক দেশে দ্বীনের প্রচার-প্রসার, ব্যবহারিক শিক্ষা, তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ, রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কার্যক্রমের জন্য আল্লাহ তাআলা এ ধারার প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেন্দ্রীয় মাহাত্ম্য দান করেছেন, তাকে অতিরঞ্জন বলা যাবে না কিছুতেই। এসব প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক মেহনতেরই ফসল যে, উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতকারী ও মসজিদমুখী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে দ্বীনের সঠিক জ্ঞানাহরণের আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে, শিরক, বিদআত, কুসংস্কার ও অবৈধ রসম-রেওয়াজ বিরোধী সচেতনতা বিস্তার লাভ করছে এবং মানুষ সুন্নতী জীবনবোধে উজ্জীবিত হচ্ছে, বিশেষত যারা এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। এসব মহতি গুণ সঞ্চারের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিজীবন যে অপেক্ষাকৃত সুষ্ঠু ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে তা এক অনঃস্বীকার্য বাস্তবতা। নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় তারা অনেক সৎ ও ভালো মানুষ। যাদের দ্বারা প্রথমত উপকৃত হয় তাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র ও সমাজ। অর্থাৎ উৎকৃষ্ট পরিবার নির্মাণে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে উপকারী জনশক্তি সরবরাহে এসব মাদরাসা বস্তুনিষ্ঠ ভমিকা রাখছে। আর যারা এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে, কুরআন-হাদীস শিখছে, ফিকহ ও ইসলামী অনুশাসন জানছে, আখলাক ও নৈতিকতার পাঠ নিচ্ছে এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ও সাহাবা-তাবিঈনের জীবনাদর্শ থেকে আলো নিয়ে নিজেদের জীবন গঠন করছে, ইনসাফের দৃষ্টিতে বিচার করলে স্বীকার করতেই হবে কওমী মাদরাসার পক্ষ হতে তারা সমাজের শ্রেষ্ঠ উপহার। সমাজ চোখে তারা যত উপেক্ষিতই হোক না কেন মানবতার মুক্তির জন্য তাদের প্রাসংগিকতা কোনও দিন ফুরাবার নয়।

বস্তুত বর্তমান বিশ্বে দ্বীন প্রচার ও মানুষের মানবিকতা গঠনে কওমী মাদরাসার অবদান বিশাল। তার সেই অবদানের বিশদ বিবরণ দেওয়া বা তার বহুমুখী কর্মতৎপরতার ফিরিস্তি দান করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য একটা শূন্যস্থানের দিকে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এত এত কাজ করা সত্তে¡ও যে এ প্রতিষ্ঠান সর্ববাদী স্বীকৃতি লাভ করতে পারছে না এবং সমাজের বৃহত্তর অংশে তার সত্যিকারের ভাবমূর্তি গড়ে উঠছে না, মনে হয় এই শূন্যস্থানটিও তার জন্যে বহুলাংশে দায়ী। শূন্যস্থানটি হল প্রতিটি কওমী মাদরাসার আপন-আপন মহল্লা। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাতির নিচে অন্ধকার’-এর প্রবচনটি এ স্থানে হুবহু মিলে যায়। যেই মহিমান্বিত আলোর দান-গ্রহণে সদা গুলজার এসব প্রতিষ্ঠান, তার সাথে মহল্লাগুলোর যেন বিশেষ পরিচয় নেই।

এমন বহু মাদরাসা আছে যা ত্রিশ-চল্লিশ কি পঞ্চাশ-ষাট বছর যাবৎ তালিমী কার্যক্রম আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে, দূর-দূরান্তের শত-সহস্র তালিবে ইলম তা থেকে ইলমে দ্বীন হাসিল করে বিভিন্ন রকম দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত হয়েছে এবং সেসব খেদমতের সমষ্টিক পরিমাণ এত বিপুল, যা নিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠান ও তার উদ্যোক্তাগণ রীতিমত গর্বই বোধ করতে পারে। কিন্তু দূর-দূরান্তে আলো  বিচ্ছুরণকারী সেসব মাদরাসার আশপাশের মহল্লাগুলোতে যদি নজর বুলানো যায় তবে এক হতাশাকর চিত্রই দৃষ্টিগোচর হবে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এসব মহল্লার যে দ্বীনী অবস্থা ছিল যুগ-যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সে অবস্থার কোনো বদল হয়নি। দূর অতীতে যেই তিমিরে নিমজ্জিত ছিল আজও পর্যন্ত সেখানেই পড়ে রয়েছে। মহল্লার ঘর-বাড়িতে পরিবর্তন এসেছে, রাস্তাঘাটের বদল হয়েছে, বৈষয়িক শিক্ষা-দ্বীক্ষা অনেক দূর এগিয়েছে, মানুষের পার্থিব জীবন-মানের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, কিন্তু দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কোনো মাত্রা স্থির করা সম্ভব হবে না, প্রতিষ্ঠানটি তার প্রতিবেশীদেরকে যেখানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। সক্ষম তো তখনই হত যখন সেই লক্ষে বিশেষ কোনও কর্মসূচী গ্রহণ করা হত। মাদরাসার কর্মানুষ্ঠান সীমাবদ্ধ থেকেছে কেবল তার কোলে সমাগত ছাত্রদের মধ্যে। প্রতিবেশীর হক আদায়ের প্রতি তার বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ হয়নি। বড়জোর সবাহী (প্রভাতী) মকতব চালানো হয়েছে। কিন্তু সেখানেও সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাব রয়ে গেছে। যদ্দরুণ প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রেও কাক্সিক্ষত সুফল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রেরও যদি সুষ্ঠু পরিচালনা করা যেত তবে আম-সাধারণের কাছে পৌঁছা ও তাদের মাঝে মাদরাসার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা সহজ হত।

সারকথা, মানবিক গুণসম্পন্ন আল্লাহওয়ালা তৈরির যে নূরানী শিক্ষা-কার্যক্রম আমাদের কওমী মাদরাসাগুলো চালিয়ে থাকে, তার আলোয় যাতে সংলগ্ন বসতিসমূহও আলোকিত হতে পারে, সে লক্ষে বিশেষ কোনো কর্মসূচী অধিকাংশ মাদরাসা গ্রহণ করেনি। এর ফলে আশপাশের লোকজন তো দ্বীনের আলো থেকে বঞ্চিত থেকেছেই, সেইসংগে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাহাত্ম্য সম্পর্কেও তারা রয়ে গেছে গভীর অন্ধকারে। তারা জানে না এগুলো কি মূল্যবান খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছে। তাই কোনোরূপ সমীহ ও ভক্তিভালোবাসার দৃষ্টি এর প্রতি তাদের নেই। এজাতীয় প্রতিষ্ঠানও যে তাদের জীবনের অংশ, এর সেবা গ্রহণ যে তাদের মানবিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য সেই অনুভতিই তারা রাখে না। উভয়ের মাঝখানে ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে গেছে এক গভীর খাদ, যা উভয়ের পক্ষেই যেন আজ দূরতিক্রম্য। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলেও না হয় কথা ছিল। পারস্পরিক পরিচয়হীনতার পথ ধরে এক ধরনের নেতিবাচকতারও অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে।

নেতিবাচক মনোভাবের প্রাথমিক স্তর ছিল মাদরাসার শিক্ষাকার্যক্রম সম্পর্কিত। মনে করা হত এতে আর এমন কী শিক্ষা দেওয়া হয়! ব্যস, কুরআন মাজীদ পড়ানো, কিছু হাদীস শেখানো আর নামায-রোযা, বিবাহ-তালাক ইত্যাদি সম্পর্কিত মাসাইল মুখস্থ করিয়ে দেওয়া। এর বাইরে যে বহুবিচিত্র পাঠ্য বিষয় আছে এবং আছে ইলমী জ্ঞানজগতের ব্যাপ্তি-গভীরতার সুবিশাল পরিমÐল সাধারণভাবে মানুষ সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই রাখত না। যেমন রাখে না আজও। পরবর্তীকালে এই মনোভাবের সাথে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন মাত্রা। যেমন, এটা এক পশ্চাৎপদ শিক্ষা বা মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যস্থা। এ শিক্ষা বিজ্ঞান-বিমুখ। এটা যারা শেখে তারা সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা সমাজের গলগ্রহ হয়ে বেকার জীবন যাপন করে। এ শিক্ষা সম্পর্কে এই যে নেতিবাচক মনোভাব উত্তরোত্তর গভীর হচ্ছে এবং ইসলাম-বিরোধী শক্তি এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পাচ্ছে, আমরা মনে করি এর একটা বড় কারণ আপন-আপন মহল্লার সাথে মাদরাসাগুলোর সম্পর্কহীনতা।

আধুনিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে তো কতরকম অসামাজিক, অনৈতিক ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ, কিন্তু মানুষ সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করে না। দায়ী করা হয় হানাহানির রাজনীতি, অপসংস্কৃতির ছোবল ও নৈতিকতার অবক্ষয়কে। অথচ ওই শিক্ষায় স্বতন্ত্রভাবে না আছে আখলাক-চরিত্রের পাঠ, না আছে আল্লাহ-ভীতির চর্চা। তা মানুষ অপরাধের দায় ওই শিক্ষাব্যবস্থার উপর চাপায় না কেন? কেবল এ কারণেই যে, ওই শিক্ষায় কী আছে তা মানুষের কাছে স্পষ্ট। তাই তার উপর অপরাধ বিস্তারের দায় চাপানো অত সহজ নয়। অবশ্য নৈতিকতা ও আল্লাহভীতির স্বতন্ত্র পাঠ না থাকাটাও শিক্ষার একটা মৌলিক ত্রæটি। এই পাঠ অপরাধের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষার কাজ করে। সেই প্রতিরক্ষা না থাকায় তারা সহজেই অপরাধপ্রবণতার শিকার হয়ে পড়ে। কিন্তু এই সত্য তাদেরকে কে বোঝাবে বা কিভাবে বোঝানো সম্ভব, ঘুরেফিরে সে দায়ও খানিকটা বর্তায় মাদরাসা-কর্তৃপক্ষের উপর। তারা কেন মাদরাসা শিক্ষাকে জনগণের কাছে নিয়ে গেল না? তা নিয়ে গেলে এখানে কী শেখানো হয় তা তাদের কাছে পরিষ্কার থাকত এবং সেই পথ ধরে এ শিক্ষা পারত সাধারণের আস্থা অর্জন করতে।

বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অপপ্রচার মাদরাসাগুলোকে অস্থির করে তুলছে। তার উপর আঘাত আসছে নানাদিক থেকে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বহু অপশক্তি জেনে শুনেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি ও চাপ প্রয়োগ করে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে মাদরাসার পথ চলায়। সেসবের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে তাকে একাই। তার পাশে দাঁড়ানোর বিশেষ কেউ নেই। নেই তার অনুকলে বলিষ্ঠ কোনো উচ্চারণ। জনগণের সাহায্য-সহযোগিতায়ই মাদরাসা চলছে, কিন্তু জনগণ তার রক্ষাব্যূহ নয়। কারণ যারা সাহায্য করছে তারা ইতঃস্তত ছড়িয়ে থাকা লোকজন, সংঘবদ্ধ মহল্লাবাসী নয়। তদুপরি তারা সাহায্য করছে কেবলই এই আবেগের ভিত্তিতে যে, এখানে ধর্ম-কর্ম হয়, সাহায্য করলে আখিরাতে ছওয়াব পাওয়া যাবে, কিন্তু কী ধর্ম-কর্ম হয়, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনও ধারণা নেই, যা দ্বারা তাদের চিন্তা-চেতনা গড়ে উঠবে এবং চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সবরকম অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে।

মাদরাসাকে তার এই নিঃসংগ অবস্থা থেকে উঠে আসতে হলে তাকে অবশ্যই জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে। নিজেকে আম-সাধারণের কাছে মেলে ধরতে হবে। তাদেরকে বুঝতে দিতে হবে যে মাদরাসা কী ও কেন? এখানে কী শেখানো হয়, কেন শেখানো হয়? ব্যক্তি ও সমাজের জন্য সে শিক্ষার কী প্রয়োজন? এটা করতে পারলে ধোয়াশা কেটে যাবে এবং সুস্পষ্ট বুঝ-সমঝের সাথেই মাদরাসা জনগণের সম্পদ হয়ে থাকবে। যার রক্ষণাবেক্ষণকে তারা ব্যক্তিগত সম্পদের মতই অবশ্যকর্তব্য জ্ঞান করবে। সবচেয়ে বড় কথা তখন মাদরাসার কার্যক্রম পরিপূর্ণতা লাভ করবে এবং তার আলোয় সুনির্দিষ্ট শিক্ষার্থীরাই নয়; বরং সমাজের সর্বস্তরের মানুষই স্নাত হবে।

অবশ্যই এ মেহনতের সূচনা করতে হবে মাদরাসা সংলগ্ন মহল্লা থেকে, কেননা যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে, এটাই এমন এক শূন্যস্থান যা পূরণ করা ব্যতিরেকে কওমী শিক্ষার সার্বজনীন সুফল আশা করা যায় না।

প্রত্যেক কওমী মাদরাসার উচিত তার নিজ মহল্লার সীমা নির্ধারণ করা এবং সেই সীমার অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টির দ্বীনী তরবিয়তের যিম্মা নিজ কাঁধে নিয়ে নেওয়া। ইসলাম প্রতিবেশীর যে হক নির্ধারণ করেছে সে হিসেবে এ যিম্মাদারি এমনিতেও এসে যায়। তারপরও সচেতনভাবেই এ দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে যথোপযুক্ত কর্মসূচী গ্রহণ প্রতিটি মাদরাসার অবশ্য-কর্তব্য।

যথোপযুক্ত কর্মসূচী বলতে এমন পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা বোঝানো হচ্ছে, মহল্লার সর্বস্তরের মানুষ যার আওতায় এসে যাবে। মোটামুটিভাবে যা নি¤œরূপ হতে পারেÑ

এক. মহল্লার শিশুদেরকে প্রাথমিক দ্বীনী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, যার মধ্যে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, কুরআন মাজীদ, ওযু ও নামায-রোযার মাসাইল এবং ইসলামী আদব-কায়দাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর জন্য সহজ ও সংক্ষিপ্ত নেসাব তৈরি করে নেওয়া চাই। মহল্লার প্রতিটি শিশুকে এ শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা থাকতে হবে। এর জন্য সবাহী (প্রভাতী) মক্তব যথেষ্ট নয়; বরং এর বাইরেও সুবিধাজনক এক বা একাধিক সময় নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। শিশু-শিক্ষার জন্য দরকার এমন মুআল্লিম, শিক্ষাদানের কৌশল রপ্ত থাকার পাশাপশি, যার থাকবে দরদী মন এবং শিশুদের সাথে নবীওয়ালা আচরণের প্রতি গভীর দৃষ্টি। নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে এ গুণ অর্জন করা কিছু কঠিন কাজ নয়।

দুই. কিশোর ও যুবকদের জন্য পৃথক তালিমের ব্যবস্থা। তাদেরকে দ্বীনমনষ্ক ও ইসলামী জীবনবোধসম্পন্ন নাগরিকরূপে গড়ে তোলার জন্য সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পাঠচক্র চালু করা যেতে পারে। এর জন্য আকায়েদ, ইবাদত, মুআমালাত, মুআশারাত-আখলাক ও সীরাত বিষয়ক সহজ ও সুখপাঠ্য বই নির্বাচন করতে হবে, যাতে এতে অংশগ্রহণকারী কিশোর ও যুবকগণ একপর্যায়ে ইসলামের সামষ্টিক রূপ সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞানের অধিকারী হয়ে যায়। এতদসংগে রচনা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা এবং এজাতীয় অন্যান্য উদ্দীপনামূলক কর্মসূচীও হাতে নেওয়া যেতে পারে। প্রত্যক্ষ যোগাযোগের মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে, যাতে মহল্লার কোনও একজন যুবকও তালীমীকার্যক্রমের বাইরে থেকে না যায়।

তিন. বয়স্ক শিক্ষা (ক) : বয়স্ক কর্মজীবীদের জন্য তাদের সুবিধাজনক সময়ে তালিমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা চাই। তাতে দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাদান করতে হবে। ইবাদাত-বন্দেগী সংক্রান্ত মাসাইলের সাথে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে হুককুন-নাসবা মানুষের হক (পিতামাতার হক, সন্তানের হক, ভাইবোনের হক, প্রতিবেশীর হক, সাথী-সংগীর হক, আত্মীয়-স্বজনের হক ইত্যাদি) সম্পর্কেও তাদেরকে অবগত করতে হবে।

বয়স্ক কর্মজীবীগণ কর্মক্লান্ত থাকে বিধায় তাদেরকে দ্বীনী তালিমের আওতায় আনা খুব সহজ হবে না, কিন্তু তাই বলে কোনওক্রমেই হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না। পরিবার ও সমাজের কর্তৃত্ব যেহেতু তাদেরই হাতে, তাই তাদের দ্বীনী চিন্তা-চেতনা থাকা না থাকার প্রভাবও অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। স্বাভাবিকভাবেই দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জবাবদিহিতাও বেশি। সুতরাং তাদের নিজেদের ও সমাজের মুক্তির জন্য ইসলামী জীবন সম্পর্কে পরিচয় লাভ করা তাদের পক্ষে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সংগত কারণেই মাদরাসা কর্তৃপক্ষের  তাদের ব্যাপারে হতোদ্যম হওয়ার কোনও অবকাশ নেই।

বয়স্ক শিক্ষা (খ) : অবসরপ্রাপ্ত বয়স্কদের হাতে তুলনামূলকভাবে সময় বেশি। আবার এ অবস্থায় আখিরাতের ঝোঁকও বৃদ্ধি পায়। তাদের এই সুযোগ ও আগ্রহকে কাজে লাগানো চাই। প্রয়োজন মাফিক ফাযায়েল ও মাসাইলের তালিম দেওয়া গেলে তাদের দ্বারা দাওয়াতী কাজ নেওয়া সম্ভব। মহল্লাকে মাদরাসার কার্যক্রমের আওতায় আনার জন্য জোরদার দাওয়াতী প্রচেষ্টা অপরিহার্য। স্থানীয় অবসরপ্রাপ্তদের পক্ষে সেই চেষ্টা চালানো অনেক সহজ। কাজেই তাদের তালিমের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে।

চার. নারী শিক্ষা : সাধারণ মুসলমানদের দ্বীনী শিক্ষায় সামগ্রিক অবক্ষয় তো সকলের চোখের সামনে আছেই, কিন্তু এক্ষেত্রে নারীদের পশ্চাৎপদতা অত্যন্ত ভয়াবহ। বিভিন্ন মাধ্যমে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, কিছু না কিছু দ্বীনী কথাবার্তা পুরুষদের কানে পড়েই যায়। কিন্তু নারীদের সেই সুযোগ বড় কম। তাদের ব্যাপারে আমাদের আচরণ এতটাই শিথিল, যেন অনুচ্চার ভাষায় আমরা জানান দিচ্ছি যে, নারীদের দ্বীনী শিক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই। আজ দুনিয়াবী শিক্ষায় নারীগণ পুরুষদের পাশাপাশি চলছে, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে টপকে যাচ্ছে, অথচ নারী-পুরুষ প্রত্যেকের মানবিক উৎকর্ষ যা দ্বারা সাধিত হয়, সেই দ্বীনী শিক্ষা থেকে নারীগণ বঞ্চিত রয়েছে। এই অবহেলার কাফ্ফারা আদায়ের সময় এখনই এবং মাদরাসাকেই সে ব্যবস্থা নিতে হবে। শরঈ পর্দা রক্ষার সাথে এমন প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে, যাতে পর্যায়ক্রমে মহল্লার প্রত্যেক নারীর কাছে দ্বীনের প্রয়োজনীয় ইলম পৌঁছে যায়। এক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষকদের স্ত্রী-কন্যাগণও মুআল্লিমার ভমিকা পালন করতে পারেন।

পাঁচ. ইসলামী পাঠাগার : মহল্লাবাসীদেরকে ইসলামী জীবনের সাথে পরিচিত করার জন্য একটি পৃথক পূর্ণাঙ্গ পাঠাগার গড়ে তোলা জরুরি। মহল্লাবাসীর দ্বীনী জ্ঞানচর্চার জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। প্রয়োজন তার একটি ভ্রাম্যমাণ শাখারও। উদ্দেশ্য যখন প্রতিবেশীদেরকে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করা, তখন এর পক্ষে যা কিছু সহায়ক তার সবই অবলম্বন করতে হবে বৈকি! একটি পরিকল্পিত পাঠাগার এবং তার সুচিন্তিত ও নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার সমাজ নির্মাণে অভাবনীয় ভূমিকা রাখতে পারে। সুতরাং মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে এদিকেও নযর দিতে হবে।

প্রকাশ থাকে যে, উপরিউক্ত কর্মসূচী খুব ভারী না হলেও এমন লঘুও নয়, যা মাদরাসার সাধারণ বিভাগসমূহের লোকজন দ্বারাই চালিয়ে নেওয়া যাবে। তা করতে গেলে এমন দায়সারা গোছেরই কাজ হবে, যা দ্বারা কাক্সিক্ষত ফল কিছুতেই লাভ করা যাবে না। এর জন্য দাওয়াহনামে আলাদা একটি বিভাগ থাকতে হবে, যা মাদরাসার হিফ্য, কিতাব প্রভৃতি বিভাগের মত স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে। দাওয়াতী কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত সৎ, সদালাপী, চরিত্রবান ও কৌশলী লোকদেরকেই এ বিভাগে নিয়োগ দিতে হবে এবং মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যেই গুরুত্বের সংগে অন্যান্য বিভাগের তত্ত¡াবধান করে সেই সমান গুরুত্বের সাথেই এ বিভাগকে দেখবে। এর ফলে আশা করা যায় একদিন মহল্লাবাসীর কাছে মাদরাসাটি তাদের একান্ত আপনার হয়ে উঠবে এবং যেই পবিত্র বিদ্যাচর্চায় চারদেয়ালের অভ্যন্তর সরগরম থাকে, তার আলোয় বহিরাংগন তথা প্রতিষ্ঠানসংলগ্ন লোকেরাও আলোকিত হয়ে উঠবে। আর এভাবে প্রতিটি মাদরাসা যদি তার চারদিকের মহল্লাকে আলোকিত করার সাধনায় নেমে যায় তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশে ইসলামী সমাজবিপ্লবের ভাবনা নিছক কষ্টকল্পনা হয়ে থাকে না।

প্রিয় পাঠক! এসব আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। তবে মাদরাসাসমূহের মহল্লা সম্পর্কে আমার ভাবনা বোধ করি কারও কাছে অবাস্তব মনে হবে না। আর তা যদি বাস্তবই হয়ে থাকে, তবে চিন্তাশীলদের উচিত এ ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ নির্দেশনা দান করা। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। 

وصلى الله تعالى على سيدنا ونبينا ومولانا محمد و على آله وصحبه و سلم.

 

 

 

advertisement