মুসলিম জাতির গৌরব ইমাম মালিক রাহ.
এক.
শৈশব থেকে ইলমের প্রতি ছিল তার প্রবল অনুরাগ। ছাত্রজীবনে পার্থিব সম্পদ বলতে তেমন কিছু ছিল না। ঘরের ছাদ ভেঙ্গে তার কড়িকাঠ বিক্রি করে কিতাবপত্র ক্রয় করেন। ১ পরবর্তীতে ইলমের আকাশে তিনি যখন প্রদীপ্ত সূর্যের মতো উদিত হলেন তখন পার্থিব আরাম-আয়েশের সর্বপ্রকার উপায় উপকরণ তার পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর উপায় উপকরণের জন্য মহান ইমামের কোনো আকর্ষণ ছিল না। সে বৈভব তাকে মুহূর্তের জন্যও আখিরাতবিমুখ করতে পারেনি। প্রকৃত মহামানবদের এটাই বৈশিষ্ট্য। প্রখর ধী-শক্তির অধিকারী ইমাম মালিক রাহ. মাত্র সতের বছর বয়সে পবিত্র হাদীস শরীফের দরস (পাঠ) দান শুরু করেন। ২ এ সময় থেকেই বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে। জা’ফর বিন আবদুল্লাহ রাহ. বর্ণনা করেন, আমরা একদা ইমাম মালিকের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘পরম দয়ালু আরশে অধিষ্ঠিত হলেন’-এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে আপনি কী বলেন? এই অধিষ্ঠানের স্বরূপ কী?’ ইমাম মালিক রাহ. তার প্রশ্ন শুনে খুবই ব্যথিত হলেন এবং মাথা নত করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার ললাট ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। তারপর তিনি জবাব দিলেন, الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة أخرجوا عني هذا المبتدع ‘অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি জ্ঞাত, তার স্বরূপ অজ্ঞাত, তৎপ্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদআত। এ বিদআতীকে আমার নিকট থেকে বের করে দাও।’ ৩ আরেকবার এক ব্যক্তি তার মজলিসে প্রবেশ করে প্রশ্ন তুলল, কুরআন মাখলুক হওয়া-না হওয়া সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? (অর্থাৎ অন্যান্য সৃষ্টির মতো কুরআনও একটি নশ্বর সৃষ্টি নয় কি?) ইমাম মালিক রাহ. বললেন, ‘এই যিনদীনককে হত্যা কর। এর এই বক্তব্য হাজার ফিতনার জন্ম দিবে।’ ৪ সত্যিই ইমাম মালিক রাহ.-এর ইন্তিকালের পর এ নিয়ে তুমুল ফিতনার সৃষ্টি হয়। সত্যপন্থী অসংখ্য আলিম এই ভ্রান্ত মতবাদের প্রশ্নে নির্যাতিত হন। এমনকি শহীদও করা হয় অনেককে। ইমাম মালিক রাহ.-এর আরো কয়েকটি প্রজ্ঞাদীপ্ত উক্তি তুলে ধরছি। ১. তিনি বলেন, বর্ণনার আধিক্যের নাম ইলম নয়, ইলম হচ্ছে নূর, যা আল্লাহ মানুষের অন্তরে দান করে থাকেন। ৫ ২. একবার তাকে প্রশ্ন করা হল, ইলম অন্বেষণ সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন, অতি উত্তম ও সুন্দর কাজ, তবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপন কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও কর্তব্য সম্পাদনে মশগুল থাকতে হবে। ৬ ৩. একদা তিনি বললেন, ইলমের কথা উপলব্ধি করার যোগ্যতা যাদের নেই তাদের কাছে ইলমের কথা বলা আলিমের জন্য উচিত নয়, কারণ তাতে ইলমের অবজ্ঞা ও অবমাননা হয়।
দুই.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের প্রতি ছিল ইমাম মালিক রাহ.-এর গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ভালবাসা। তার বিখ্যাত শাগরিদ, হাদীস জগতের আমীরুল মুমিনীন আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ. বর্ণনা করেন, ‘একদা আমি ইমাম মালিকের খেদমতে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন হাদীস শরীফের পাঠদানে মশগুল। একটি বিচ্ছু তাকে পরপর দংশন করতে থাকে। আর ইমাম সাহেবের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। প্রায় দশবার এরূপ ঘটল। কিন্তু ইমাম সাহেব হাদীসের পাঠদান বন্ধ করলেন না, এমনকি তার কথাবার্তা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে কোনো ভুলভ্রান্তি বা অসংলগ্নতাও পরিলক্ষিত হল না। মজলিস শেষ হওয়ার পর আমি তাকে একান্তে প্রশ্ন করলাম, হুজুর! আজ দরস চলাকালে আপনার চেহারায় বারবার যে পরিবর্তন লক্ষ করলাম তার কারণ কী?’ ইমাম সাহেব তখন বিচ্ছুর দংশনের বিষয়টি তাকে খুলে বললেন এবং এ কথাও বললেন যে, আমার এ ধৈর্য্যধারণ আমার সহ্যশক্তির বলে নয়; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের সম্ভ্রমবোধের বলেই সম্ভব হয়েছে। ৭
তিন.
ইমাম মালিক রাহ.-এর হাদীসের দরসে বিরাজ করত পিনপতন নিস্তব্ধতা। একটু জোরে কথা বলারও কারো সাহস হত না। বিশ্ববিখ্যাত আলিম সুফিয়ান ছাওরী একবার মালিক রাহ.-এর দরসে উপস্থিত হন। দরসের ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ আর শান শওকতের কারিশমা লক্ষ করে তিনি কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করলেন, যার অর্থ ‘তিনি যদি জবাব না দেন তাহলে প্রশ্নকারীরা সকলেই মাথা নিচু করে বসে থাকেন। কারো পুনরায় প্রশ্ন করার সাহস হয় না। তিনি তাকওয়ার রাজ্যে রাজত্বের আসনে মর্যাদার সঙ্গে সমাসীন। তিনি বাদশাহ নন, তবুও (বাদশাহর মতোই) তার আনুগত্য করা হয়।’ ৮ বিখ্যাত সুফী সাধক বিশর হাফী বলেন, পার্থিব নেয়ামত ও শান শওকতের মধ্যে কোনো ব্যক্তির ‘হাদ্দাছানা মালিক’-ইমাম মালিক আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন বলাটাও একটি বড় নিয়ামত ছিল। অর্থাৎ ইমাম মালিক রাহ.-এর শান শওকত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ তার শিষ্যত্বের পরিচয়কে পার্থিব গৌরবের বিষয় বলে মনে করত। অথচ বিষয়টি তো ছিল আখিরাতের ওসীলা এবং দ্বীনী ব্যাপার। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তার এক বিখ্যাত ভাষণে মাদরাসার শান প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ইমাম মালিক রাহ.-এর মর্যাদার কথা তুলে ধরেন এভাবে-‘‘ইমাম মালিকের যুগ। সারা পৃথিবীতে ইলম-চর্চার ধুমধাম। তখন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কারো পক্ষে এ কথা বলা বিরাট গৌরবের বিষয় বলে বিবেচিত হত যে, ‘হাদ্দাছানা মালিক’ অর্থাৎ ইমাম মালিক আমাদের নিকট এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ছিল তদানীন্তন কালের সবচাইতে বড় মর্যাদার বিষয়। পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যদি কেউ বলত, ‘হাদ্দাছানা মালিক’ তাহলে সবার কর্ণ সচকিত হয়ে উঠত। সবাই মাথা তুলে তাকে দেখা শুরু করত আর ভাবত, কোন্ সে ভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি ইমাম মালিকের শিষ্যত্ব লাভের গৌরব অর্জন করেছেন। ইমাম মালিক রাহ. উমাইয়া শাসনামলের সমাপ্তি ও আব্বাসী শাসনের সূচনাকালে দরসের মসনদে সমাসীন হয়েছিলেন। পবিত্র মদীনা নগরীতে তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন। খেলাফতের দরবার হতে (খলীফা হারুনুর রশীদ) তার কাছে প্রস্তাব এল যে, আপনি দরবারে আগমন করুন এবং দুই শাহজাদা আমীন ও মামুনকে কিছু শিক্ষা দান করুন। তিনি জবাব দিলেন, ‘আপনার গৃহ থেকে ইলমের মর্যাদা ও ইজ্জত দানের ধারা শুরু হয়েছে। এখন আপনার হাতেই তার অবমাননা শোভা পায় না। ইলমের কাছে আসতে হয়, ইলম কারো কাছে যায় না।’ ইমাম মালিকের এ মন্তব্যের ফলে আমীন ও মামুন ইমাম মালিকের দরবারে যান এবং তার নিকট থেকে হাদীস শ্রবণ করেন।’ ৯ (পা জা ছুরাগে যিন্দেগী) ইমাম মালিক রাহ. বলতেন, ‘জীবনে আমি কোনোদিন কোনো নির্বোধ ব্যক্তির সাহচর্য গ্রহণ করিনি।’ ১০ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলতেন, ‘আলেমগণের জন্য এর চাইতে বড় মর্যাদার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। কারণ নির্বোধের সাহচর্যে ইলমের আলো ম্লান হয়ে পড়ে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরানুকরণের নিম্নস্তরে নিক্ষিপ্ত হয়। ফলে তার ইলমের প্রখরতা বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়।’
চার.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের আদবের প্রতি পুরোপুরি খেয়াল রাখতেন ইমাম মালিক রাহ.। দরস চলাকালে জানু পর্যন্ত পরিবর্তন করতেন না; বরং যে অবস্থায় উপবেশন করতেন মজলিস শেষ হওয়া পর্যন্ত সে অবস্থায়ই উপবিষ্ট থাকতেন। তিনি তার সুস্থ জীবনে কখনো মদীনা শরীফের হারাম সীমার মধ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেননি। অবশ্য অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি এক্ষেত্রে অপারগ ছিলেন। হাদীস পাঠদানের দরসে তার জন্য পৃথক চৌকির ব্যবস্থা থাকত। তিনি উত্তম পোশাক পরিধান করে আতর মেখে অত্যন্ত বিনীতভাবে এসে সেই চৌকিতে উপবেশন করতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত মজলিসে হাদীসের পঠন-পাঠন-এর ধারা অব্যাহত থাকত ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পার্শ্বে রক্ষিত আতরের পাত্রে লোবান ও আগরকাঠ নিক্ষেপ করে মজলিসের পরিবেশকে সুরভিত রাখতেন। ১১ দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, আজ আমাদের মাঝে হাদীসের প্রতি সেই মহব্বত ও মাহাত্মবোধ নেই। যত্রতত্র যেনতেন প্রকারে আমরা হাদীসের দরস অনুষ্ঠিত করে থাকি। মদীনা শরীফের সাথে ছিল ইমাম মালিকের আত্মার সম্পর্ক। সে কারণেই তিনি কখনো মদীনা শরীফ থেকে বের হতেন না এই আশঙ্কায় যে, মদীনা শরীফের বাইরে তার মৃত্যু এসে যায়। কথিত আছে যে, এ কারণে ইমাম মালিক রাহ. একবারের বেশি হজ্ব করেননি। ফরয হজ্ব আদায় করার পর আর মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ গমন করেননি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারা এ শহরদ্বয়ের কোনটিতে বসবাস করা প্রিয়তর মনে করেন? উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, আমি কেন মদীনায় অবস্থান করাকে প্রিয়তর মনে করব না, যার অলিতে গলিতে দোজাহানের বাদশাহ হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলাচল করেছেন এবং যে শহরে হযরত জিবরাঈল আ. বার বার অবতরণ করেছেন। ইমাম মালিক আজীবন মদীনা শরীফে অবস্থান করেছেন। এ পুণ্যভূমিতেই মৃত্যুবরণ করেছেন এবং এর পবিত্র মাটিতেই সমাহিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ মূলত পরম সৌভাগ্যের বিষয়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীতেই এর ফযীলতের সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. প্রায়ই এই বলে দুআ করতেন, اللهم ارزق شهادة في سبيلك واجعل موتي في بلد رسولك ‘ধন্য আমায় করো প্রভু তোমার পথের শাহাদাতে/মৃত্যু হয় গো যেন তোমার নবীর মদীনাতে’ ইমাম মালিক রাহ. এর সময়ে এক ব্যক্তি মদীনা শরীফের মাটিকে ত্রুটিযুক্ত বলেছিল।ইমাম মালিক রাহ. তাকে ত্রিশটি বেত্রাঘাত করে বন্দি করে রাখার ফতোয়া প্রদান করেছিলেন। ইমাম সাহেব মদীনায় সওয়ারিতে আরোহণ করতেন না। তিনি বলতেন, যে পুণ্যভূমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবর মুবারক বুকে ধারণ করেছে তাকে সওয়ারির খুর দ্বারা দলিত করতে আমার লজ্জাবোধ হয়।
পাঁচ.
ইমাম মালিক রাহ. কে আল্লাহ তাআলা অন্তর্গত সৌন্দর্যের পাশাপাশি দৈহিক সৌন্দর্যও দান করেছিলেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘাকৃতির হৃষ্টপুষ্ট দেহের অধিকারী। আয়তলোচন এবং সুন্দর সুতীক্ষ্ণ নাক বিশিষ্ট। ললাটে ছিল অল্প কেশ। হযরত ওমর রা. এবং হযরত আলী রা.ও এরূপ স্বল্প কেশ-ললাটের অধিকারী ছিলেন। তার দাড়ি ছিল অত্যন্ত ঘন এবং আবক্ষ লম্বিত। ওয়াকিদী বর্ণনা করেন, ইমাম মালিক রাহ. দীর্ঘ নব্বই বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনো দাড়িতে খিযাব ব্যবহার করেননি। তিনি অত্যন্ত সুবেশধারী ছিলেন। ইয়েমেনের এ্যডন শহরের কাপড় পরিধান করতেন। এ্যডেনের কাপড় হত অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের এবং উচ্চ মূল্যের। খোরাসান এবং মিশরের দামি কাপড়ও ব্যবহার করতেন। তার পোশাক হত শুভ্রোজ্জ্বল। গোফের যে অংশ ঠোটের ওপর নেমে আসত তা ছেটে ফেলবেন। তাঁর গোফও ছিল প্রচুর। এ ব্যাপারে তিনি আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর রা. এর অনুকরণ করতেন। তিনি আর ব্যবহার করতেন। তিনি প্রাই বলতেন আল্লাহ যাকে প্রাচুর্য দান করা সত্ত্বেও তার পোশাক-আশাকে নিয়ামতের চিহ্ন থাকে না তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে আমি ভালবাসি না । কারণ সে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতকে গোপন করে অকৃজ্ঞতারই পরিচয় দিচ্ছে। ১৪ শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. বলেন, পূর্ব যুগের বুযুর্গগণ শুদ্ধ নিয়তে সাধারণ ও উন্নত উভয় শ্রেণীর কাপড়ই পরিধান করতেন। তাদের উদ্দেশ্য হত।আল্লাহ তাআলার নেয়ামতের চিহ্ন প্রদর্শন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং খ্যাতিবিমুখতা। উভয় শ্রেণীর বুযুর্গদের আচরণই প্রশংসনীয়। নিজ নিজ নিয়তের দরুণ তারা সওয়াবের অধিকারী হবেন। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, যার অর্থ হল- প্রেমের পথে রয়েছে নানান ধারা। ১৫ ইমাম মালিক রাহ. এর আংটি ছিল রূপার এবং নাগীনা ছিল কালো পাথরের। তাতে অঙ্কিত ছিল - حسبنا الله ونعم الوكيل আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতইনা উত্তম ব্যবস্থাপক।’ ১৬ ইমাম সাহেবের এক শিষ্য তাকে আংটির পাথরে এ আয়াত অঙ্কিত করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, মহান আল্লাহ মুমিনদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেছেন, (তরজমা) ‘তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম ব্যবস্থাপক।’ আমার আন্তরিক ইচ্ছা হল এ আয়াতের প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা এবং এর মর্মার্থ অন্তরে বদ্ধমূল রাখা। ইমাম মালিক রাহ.-এর দরবারে লিখিত ছিল ما شاء الله জনৈক প্রশ্নকারী এর তাৎপর্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, (তরজমা) তুমি যখন তোমার উদ্যানে প্রবেশ করলে তখন কেন বললে না, আল্লাহ যা চান তাই ঘটে?-সূরা কাহাফ আর আমার বাগান হচ্ছে আমার ঘরটাই। তাই আমি চাই যে, যখনই আমি ঘরে প্রবেশ করি তখনই আমার মুখ দিয়ে আল্লাহ তাআলার এই বাণী উচ্চারিত হোক। মদীনা শরীফের যে গৃহে তিনি অবস্থান করতেন তা ছিল রাসূলের প্রিয় সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর গৃহ। মসজিদে নববীতে তিনি সেই স্থানটিতেই আসন গ্রহণ করতেন যেখানে সাধারণত আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর রা. আসন গ্রহণ করতেন। ১৭
ছয়.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি, তাঁর পবিত্র হাদীসের প্রতি এবং তাঁর প্রিয় মদীনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার বরকতে ইমাম মালিক রাহ. কে আল্লাহ তাআলা এমন একটি বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যা পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ অর্জন করতে পেরেছেন বলে জানা যায় না। তা হল, তিনি প্রতি রাতেই রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখতেন। একবার ইমাম মালিক রাহ. কেয়ামতের দিনক্ষণ সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের জবাব নিয়ে ভাবছিলেন। তখন তার মনে হল, আজ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করব। রাতের বেলা স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করলে তিনি তার প্রশ্ন পেশ করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আপন পাঁচ আঙ্গুল মোবারক প্রদর্শন করেন। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি পবিত্র কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেন, في خمس لا يعلمهن إلا الله এ হল সেই পাঁচের একটি, যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।-ফয়যুল বারী আবু নুয়াইম ইস্পাহানি ‘‘হিলয়াতুল আউলিয়া’’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, বিখ্যাত আবিদ সাহাল বিন মুজাহিদ রাহ. একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার বরকতময় যুগ তো অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন ধর্মীয় ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিপতিত হলে কার কাছে জিজ্ঞাসা করে সমাধান গ্রহণ করব? জবাবে তিনি বললেন, মালিক ইবনে আনাসকে জিজ্ঞাসা করে নিও। ১৮ একই কিতাবে আরো একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আবু আবদুল্লাহ নামক জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করি। আমি দেখতে পাই যে, তিনি মসজিদে অবস্থান করছেন। তাঁর চতুর্দিকে লোকজনের সমাগম। নবীজীর সম্মুখে কিছু কস্তুরি রাখা আছে, তিনি তা অঞ্জলি ভরে ইমাম মালিককে দিচ্ছেন। আর ইমাম মালিক তা উপস্থিত জনতার মাঝে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমার বিবেক বুদ্ধি অনুসারে এই হতে পারে যে, (ইমাম মালিকের যুগে) ইলমে নববী প্রথমে মালিক রাহ.-এর বক্ষদেশে স্থান গ্রহণ করে, পরে তাঁর মাধ্যমে অন্যদের কাছে পৌঁছে। ইমাম মুসলিম রাহ. এর উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনে রুম্হ রাহ. বর্ণনা করেন যে, আমি স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দর্শন লাভে ধন্য হই এবং তার নিকট বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করি, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইমাম মালিক ও লায়সের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? এ নিয়ে তো আমরা প্রায়ই বাদানুবাদে লিপ্ত হই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মালিক আমার মসনদের উত্তরাধিকারী। তখন আমার আর বুঝতে বিলম্ব হয়নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই পবিত্র বাণীর অর্থ হচ্ছে, মালিক হচ্ছেন আমার ইলমের উত্তরাধিকারী (এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ)। ১৯
সাত.
ইমাম মালিকের বিশেষ স্নেহধন্য শাগরিদ ইয়াহইয়া বর্ণনা করেন, ইমাম মালিক রাহ. যখন জীবনসন্ধ্যায় উপনীত হলেন তখন তার শেষ উপদেশ শ্রবণ ও শেষবারের মতো তার ফয়েজ অর্জন করার জন্য মদীনা শরীফ ও অন্যান্য শহরের আলিম-ওলামা দলে দলে তার বাসভবনে এসে সমবেত হলেন। আমি গণনা করে দেখলাম তাদের সংখ্যা একশত ত্রিশ। আমিও তাদের একজন ছিলাম। আমি ইমাম সাহেবের কাছে যেতাম, সালাম করতাম এবং তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমি তাঁর নিকটে দণ্ডায়মান ছিলাম এমন সময় ইমাম সাহেব চোখ খুললেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রশংসা সেই আল্লাহ তাআলার যিনি কখনো হাসিয়েছেন কখনো কাঁদিয়েছেন, তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেছেন। তারপর বললেন, ‘মৃত্যু সন্নিকটে আর আল্লাহর সাথে মুলাকাতের সময় দূরে নয়।’ তখন উপস্থিত ওলামা-ফুকাহা আরো নিকটবর্তী হয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন, হে আবু আবদুল্লাহ! আপনি কেমন বোধ করছেন? ইমাম মালিক রাহ. জবাব দিলেন, ‘অত্যন্ত প্রফুল্ল বোধ করছি। কারণ আল্লাহ তাআলা আমাকে তার অলীগণের সাহচর্য দান করেছেন। আমার মতে আহলে ইলমই হচ্ছেন আউলিয়া। আমি আরো প্রফুল্লবোধ করছি এ কারণে যে, আমার সারা জীবন ইলমের অন্বেষণ এবং তার প্রচার প্রসারে অতিবাহিত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে, আমার সাধনা বিফলে যায়নি। আমি অবশ্যই আল্লাহ তাআলার কাছে এর পুরস্কার পাব। কারণ আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত আমলের কথা, নবীজীর সুন্নতসমূহের কথা এবং সেসবের সওয়াবের কথা আমরা নবীজীর মাধ্যমে জ্ঞাত হয়েছি। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যত্নসহকারে রীতিমতো নামায আদায় করবে তার জন্য অমুক অমুক সওয়াব রয়েছে। যে ব্যক্তি কাফিরদের মোকাবিলায় জিহাদ করবে তার জন্য আল্লাহর নিকট অমুক অমুক সওয়াব রয়েছে। এসব বিষয়ের বিশুদ্ধ ও বিস্তারিত জ্ঞান হাদীসের শিক্ষার্থীগণ ব্যতীত অন্যদের খুব কমই আছে। তাই এই ইলম নবীগণের উত্তরাধিকার। কারণ পার্থিব বিভিন্ন শাস্ত্রের জ্ঞান নবুয়ত ছাড়াও অর্জন করা যায়। পক্ষান্তরে দ্বীন ও শরীয়তের কোন কাজে সওয়াব আর কোন কাজে আল্লাহর অসন্তোষ নেমে আসে তা নবুওয়তের ইলম ব্যতীত জানা অসম্ভব। তাই যে ব্যক্তি ইলমের অন্বেষণে আত্মনিয়োগ করে সে অনেক অলৌকিক বিষয় প্রত্যক্ষ করে, যার তাৎপর্য শুধু আল্লাহ তাআলাই যথার্থরূপে অবগত।’ এরপর ইমাম মালিক রাহ. আরো তিনটি মূল্যবান কথা বলেন, যার প্রতিটিই স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। যার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : ১. তিনি তাঁর উস্তাদ রবীআহ রাহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর নামে শপথ করে তিনি (রবীয়াহ) বলতেন, কোনো অজ্ঞ ব্যক্তি যদি নামাযে ভুল করে এবং সে আমাকে সে বিষয়ের মাসআলা জিজ্ঞাসা করার পর তাকে নামাযের ফরয সুন্নত ও আদবসমূহ শিখিয়ে দিই তবে আমার মতে তা সারা পৃথিবীর মালিকানা লাভ করে আল্লাহ পথে বিলিয়ে দেওয়ার চাইতেও উত্তম। ২. আল্লাহ শপথ, কোনো মাসআলা বা রেওয়ায়েতের ব্যাপারে আমার মনে যদি দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং তা নিরসনের জন্য আমি আমার অন্তরকে নিমগ্ন করে দিনরাত স্বস্তিহীনতার মধ্যে কাটিয়ে প্রত্যুষে কোনো আলিমের কাছে গিয়ে এর সমাধান লাভ করি তবে তা আমার নিকট একশটি হজ্বের চাইতেও উত্তম। ৩. আমি ইমাম ইবনে শিহাব যুহরীর নিকট অনেকবার শুনেছি, তিনি বলতেন, মহান আল্লাহ শপথ, যদি কোনো ব্যক্তি আমার কাছে কোনো পরামর্শ চায় এবং আমি তাকে যথার্থ পরামর্শ দিতে পারি আর তাতে তার শুদ্ধি লাভ হয়, আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক ক্ষুণ্ন না হয় তাহলে তা একশ’টি জিহাদ-যাত্রার চাইতেও উত্তম মনে করি। ইয়াহইয়া বলেন, এটাই ছিল ইমাম মালিক রাহ.-এর কাছ থেকে আমার শ্রুত সর্বশেষ বাণী। ২০ এভাবেই ইলমে নববীর খিদমতে মশগুল থেকে ১৭৯ হিজরীর কোনো এক শোকবিহ্বল দিনে সত্য ও সৎকর্মের মহান সাধক, ইলম-গগণের প্রদীপ্ত সূর্য ইমাম মালিক রাহ. জান্নাতের চির স্নিগ্ধ ছায়ার দিকে যাত্রা করেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইমাম মালিক রাহ.-এর রূহানী ফয়য লাভে ধন্য হওয়ার এবং তার জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফীক দান করুন।
তথ্যসূত্র
১. তারতীবুল মাদারেক ১/১৩০; বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ১৬২. তারতীবুল মাদারেক ১/১৪০; বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ১৬
৩. সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/৪১৫
৪. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৫৫
৫. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৪৮
৬. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৪৯
৭. তারতীবুল মাদারেক ২/১৬
৮. তারতীবুল মাদারেক ২/৩৪
৯. তারতীবুল মাদারেক ২/২০
১০. তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ১১/১৭৮; বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ১৫
১১. তারতীবুল মাদারেক ২/১৫
১২. তারতীবুল মাদারেক ১/১২৩
১৩. তারতীবুল মাদারেক ১/১২২; বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ১৩
১৪. তারতীবুল মাদারেক ১/১২৩
১৫. বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ১৪
১৬. তারতীবুল মাদারেক ১/১২৩
১৭. তারতীবুল মাদারেক ১/১২৪; বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ১৪-১৫
১৮ ও ১৯. হিলইয়াতুল আউলিয়া ৬/৩৪৬
২০. আখবারুল ফুকাহা ওয়াল মুহাদ্দিছীন, মুহাম্মাদ ইবনে হারেছ কায়রাওয়ানী পৃ. ২৭৭; বুস্তানুল মুহাদ্দিছীন পৃ. ৩৬-৩৯