রবিউল আউয়াল ১৪৩১   ||   মার্চ ২০১০

তাযকিয়া ও ইহসান এবং ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ. – ২

মাওলানা সাঈদ আহমদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসরণ

শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানীকৃত ‘মাআছিরে হযরত আরেফী’ গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কিছু অংশের ধারাবাহিক অনুবাদ পেশ করা হচ্ছিল। বর্তমান আলোচনার শিরোনাম ‘শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসরণ।’ এ প্রসঙ্গে হযরত শাইখুল ইসলাম বলেন : হযরত ডা. আবদুল হাই আরেফী রাহ.-এর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পবিত্র জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল-শরীয়তের অনুসরণ এবং সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুশীলন। এ বিষয়টি হযরতের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। প্রতি কদমে কদমে শরীয়তের সূক্ষ্ম বিধি-বিধানের প্রতি দৃষ্টি থাকত। হযরত রাহ. নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোনো মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপন করেননি। কিন্তু হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর সোহবতের বরকতে শরীয়তের এমন অনেক মাসআলা তাঁর সর্বদা ইয়াদ থাকত যা অনেক সময় মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপনকারী ভালো ভালো আলেমদেরও স্মরণ থাকে না। তা সত্ত্বেও হযরত রাহ. অনেক সময় ব্যক্তিগত বিষয়ে আপন ভক্তবৃন্দের নিকট থেকে শরীয়তের বিধান জেনে নিতেন এবং তদনুযায়ী আমল করতেন।

অধমের পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর মৃত্যু হলে আমাদের সান্ত্বনার জন্য হযরত রাহ. একাধারে কয়েক দিন দারুল উলূম করাচিতে আগমন করলেন। একদিন হযরতের চোখে মুখে স্পষ্টত ক্লান্তি ও দুর্বলতার ছাপ দেখা যাচ্ছিল। তখন শ্রদ্ধেয় ভাই হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী দা.বা. অধমকে বাসা থেকে ‘খামীরা’ (এক প্রকার শক্তিবর্ধক খাবার) নিয়ে আসার জন্য বললেন। আমি ‘খামীরা’ এনে হযরতকে দিলে তা হাতে নিয়ে বললেন, এই খামীরা কি হযরত মুফতী (শফী) ছাহেব রাহ.-এর মালিকানায় ছিল? আমি হ্যাঁ উত্তর দিলে হযরত বললেন, এখন তো এতে সকল ওয়ারিশের অধিকার রয়েছে। সুতরাং আপনি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে এটা হাদিয়া করতে পারেন না। অধম হযরতকে আশ্বস্ত করে আরজ করল যে, আলহামদুলিল্লাহ! সকল ওয়ারিশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং সকলে এখানে উপস্থিতও রয়েছে। সর্বোপরি হযরত তা গ্রহণ করবেন, এতেই সকলের আনন্দ! তখন হযরত রাহ. তা আহার করলেন। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এটা এমন এক সূক্ষ্ম মাসআলা যে, বর্তমানে ভালো ভালো আলেম ও মুফতীরাও বাস্তব ক্ষেত্রে এদিকে কমই দৃষ্টিপাত করেন। কিন্তু যেহেতু শরীয়ত অনুযায়ী আমল হযরতের সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল তাই প্রয়োজনীয় সকল বিধি-বিধান কেবল জানা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং সর্বদা তদনুযায়ী আমলও করতেন।

সুন্নতের অনুসরণের বিষয়ে হযরত বিশেষভাবে যত্নবান ছিলেন। প্রত্যেক কাজে অনুসন্ধান করতেন যে, এ ক্ষেত্রে সুন্নত পদ্ধতি কোনটি? এরই ফলশ্রুতি যে, হযরত ‘উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ নামে একটি চমৎকার কিতাব রচনা করেন, যাতে জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রিয় নবীজীর উসওয়ায়ে হাসানা তথা উত্তম আদর্শের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উর্দূ ছাড়াও আরবী, ফার্সি, ইংরেজি, সিন্ধি, পশতু এবং আরো বহু ভাষায় বইটির লক্ষ লক্ষ কপি মুদ্রিত হয়েছে। এককথায় আল্লাহ তাআলা কিতাবটির আশ্চর্য কবুলিয়ত ও গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন। নফল আমলের গুরুত্ব সুন্নত ও মুস্তাহাব আমলের গুরুত্ব এবং (কুরআন-হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন আমলের) ফযীলতসমূহ লাভ করার আকাঙ্খা হযরতের জীবনের সকল পর্যায়ে ছিল লক্ষ করার মতো। যতদিন পর্যন্ত শারীরিক সামর্থ্য ছিল, প্রথম কাতারে জামাতের সাথে নামায আদায় করেছেন। এ পরিমাণ সময় থাকতে মসজিদে চলে যেতেন যে, তাহিয়্যাতুল মসজিদ ও ফরযের পূর্বের সুন্নত উভয়টি আলাদাভাবে পড়তে পারেন। ফরযের পূর্বের সুন্নতের সাথে তাহিয়্যাতুল মসজিদের নিয়ত করে নেওয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু হযরত রাহ. সাধারণত প্রত্যেকটি আলাদাভাবে আদায় করতেন। হযরত রাহ. বলতেন, ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করা তো প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর এটা আবদিয়ত (তথা আল্লাহর বান্দা হওয়ার) দাবি। কিন্তু নফল ও মুস্তাহাব আমলসমূহ হচ্ছে আল্লাহ-প্রেমের দাবি! সুতরাং এগুলোর অবমূল্যায়ন করা ঠিক নয়; বরং যথাসাধ্য তা আদায় করার প্রতি যত্নশীল হওয়া চাই।

একটি ঘটনা

একবার হযরত রাহ. দারুল উলূম নানকওয়াড়ার পরিচালনা পরিষদের সভায় অংশগ্রহণের জন্য মাগরিবের পূর্বে বাড়ি থেকে রওয়ানা হলেন। অধম ও অধমের ভাই হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী (দা.বা.) সঙ্গে ছিলেন। মাগরিবের পর পরই সভার সময় নির্ধারিত ছিল। এদিকে পথিমধ্যেই মাগরিবের সময় হয়ে গেল এবং পথের এক মসজিদে আমরা মাগরিবের নামায পড়ে নিলাম। কিন্তু সময়-স্বল্পতার কারণে ফরযের পর শুধু সুন্নতে মুয়াক্কাদাই পড়লাম। আওয়াবীন না পড়েই নানকওয়াড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। সভা শেষ হলে সেখানেই এশার নামায আদায় করা হল। নামাযের পর আমরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলাম। তখন হযরত রাহ. গাড়িতে বসতে বসতে অধমকে জিজ্ঞাসা করলেন, মৌলবী তকী! আজকে আওয়াবীন নামাযের কী হল? আমি আরজ করলাম, হযরত! তাড়া থাকার কারণে আজ তা পড়া হয়নি। হযরত বললেন, কেন পড়া হল না? সময়মতো পড়া সম্ভব হয়নি ঠিক, কিন্তু এশার পর পড়ে নিতে? এরপর বললেন, ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে যদিও নফলের কাযা করতে হয় না, কিন্তু সুলূকের পথে ধাবমান একজন ব্যক্তির জন্য উচিত হল এমন ক্ষেত্রেও সুযোগ পাওয়া মাত্রই দৈনন্দিনের (ছুটে যাওয়া) নফল আমলগুলো আদায় করে নেওয়া। আজকে আমিও যথাসময়ে আওয়াবীন পড়তে পারিনি। তবে আলহামদুলিল্লাহ, এশার পর সুন্নতের সাথে অতিরিক্ত ছয় রাকাত পড়ে নিয়েছি। আর এটাই আমার নিয়ম। হযরতের শেষ জীবনেও নফল আমল, যিকির-আযকার ও অন্যান্য ওযীফা পূর্বের মতোই অব্যাহত ছিল। অথচ বয়স তখন আশির কোঠা অতিক্রম করে গেছে। তাছাড়া দুর্বলতা ও বিভিন্ন রকমের অসুখ-বিসুখ তো ছিলই। একবার আমাদেরকে উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের ঘটনা শোনালেন যে, এক রাতে আমি জ্বরে ভুগছিলাম। জ্বরের প্রচণ্ডতায় মনে হচ্ছিল, সারা শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে। শেষরাতে প্রতিদিনের মতো চোখ খুলে গেলে অলসতা এমনভাবে পেয়ে বসল যে, উঠতে পারব বলে মনেই হচ্ছিল না। মনে এ কথাও উদয় হল যে, দুর্বলতা ও অসুস্থতা দুটোই বিদ্যমান। সুতরাং এমন অবস্থায় এ রাতে নিয়মিত আমল ছুটে গেলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি নফসকে বুঝালাম যে, এ হচ্ছে মাওলার নৈকট্য লাভের বিশেষ মুহূর্ত। তাই নামায না হোক, কিছু দুআ-দরূদ পড়ে শুয়ে যেও। এ কথা ভেবে আমি উঠে বসলাম। এরপর ভাবলাম যে, আল্লাহ পাক উঠে বসার তাওফীক যখন দিয়েছেন সুতরাং বসে হলেও কয়েক রাকাত নামায পড়ে নেওয়া উচিত। জনৈক কবি বলেছেন, (অর্থ) এখন তো তাঁর পায়ের আওয়াজে চোখ খুলে যায়। তখন কী অবস্থা হবে যখন এটাও সম্ভব হবে না? যাই হোক, বসা থেকে উঠে আমি গোসলখানা পর্যন্ত গেলাম। এরপর জায়নামাযে এলাম। এখন ভাবলাম, দাড়িয়ে গোসলখানা পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়েছে তো নামায বসে পড়া কেন? সুতরাং দাড়িয়েই নামাযের নিয়ত বেঁধে নিলাম। আর আলহামদুলিল্লাহ, এভাবে প্রতিদিনের আমল আদায় হয়ে গেল। রুখসতের উপর আমল করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন হযরত বলতেন, যে সকল ক্ষেত্রে রুখসত (আল্লাহপ্রদত্ত অবকাশ) আছে সেখানে রুখসত অনুযায়ীই আমল করা চাই। কেননা আযীমত (শরীয়তের মূল বিধান) আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্মের দাবি, আর রুখসত হচ্ছে আল্লাহর মহাব্বতের দাবি। এজন্য রুখসত অনুযায়ী আমল করতে দ্বিধা না হওয়া উচিত। হাদীস শরীফে আছে (অর্থ) আল্লাহ তাআলা তাঁর দেওয়া রুখসতের উপর আমল করা পছন্দ করেন, যেরূপ পছন্দ করেন আযীমতের উপর আমল করাকে। কিন্তু তালাশ করে করে রুখসত বের করার পরিবর্তে হযরত এ ব্যাপারে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। এ কারণেই জীবনের শেষ রমযান পর্যন্ত রোযা রেখে গেছেন। একবার হযরত খুবই দুর্বল ছিলেন। গরমও ছিল প্রচণ্ড। এ অবস্থায় রমযান শুরু হলেও হযরত রোযা রাখলেন। একদিন আমি আরজ করলাম, হযরত! এ অবস্থায় রুখসত অনুযায়ী আমল করতে পারতেন। হযরত বললেন, হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে অবশ্যই রুখসতের উপর আমল করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখেছি, আমি রোযা রাখতে সক্ষম!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement