যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

আরো কিছু কথা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

গত সংখ্যায় বন্ধুদের খেদমতে আটটি বিষয়ে দরখাস্ত করেছিলাম। এ সংখ্যায় এ ধরনের আরো কিছু বিষয় আরয করার ইচ্ছা করেছি।

৯. শুদ্ধ বলা ও শুদ্ধ লেখার বিষয়ে মনোযোগী হোন

প্রথম দিন থেকেই প্রমিত বাংলায় ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করুন। এতে যদি কেউ হাসে তবে তাকে হাসতে দিন, কিন্তু আপনার প্রতিজ্ঞায় আপনি অটল থাকুন। তদ্রূপ যে ভাষাতেই আপনি কিছু লিখবেন তা শুদ্ধভাবে লেখার চেষ্টা করুন। বানানে যেন ভুল না হয় সেদিকে লক্ষ রাখুন। উর্দূ ও আরবীতে বানানের জটিলতা কম, তবুও দেখা যায়, আমাদের ছাত্রভাইরা বানানে ভুল করেন। এজন্য প্রয়োজনে বানান শুদ্ধ করার পিছনে আলাদা সময় দিন। প্রতিদিন অন্তত তিনটি শব্দের বানান নির্ভরযোগ্য অভিধানের সাহায্যে শুদ্ধ করার চেষ্টা করুন। আরবী বানান শুদ্ধ করার জন্য সামান্য মনোযোগই যথেষ্ট হতে পারে। বাংলা বানান শুদ্ধ করার জন্য যদি আলাদা সময় বরাদ্দ করতে হয় তবে তা করুন, একে সময় নষ্ট করা বলে মনে করবেন না।

 

১০. নিজের যোগ্যতা যাচাই করতে থাকুন

ইলমী যিন্দেগীর জন্য কিতাব বোঝার যোগ্যতা অত্যন্ত বুনিয়াদী বিষয়। কিন্তু এ বিষয়ে অনেক বেশি বিভ্রান্তি হয়ে থাকে। অনেক তালিবে ইলম, যারা নিজেদের সম্পর্কে এই সুধারণা রাখেন যে, তারা কিতাব বোঝেন, পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, তারা কিতাব বোঝেন না। এজন্য তালিবে ইলমের কর্তব্য এই যে, নিজেকে কোনো উস্তাদের সামনে, বিশেষত তালীমী মুরববীর সামনে পেশ করবে এবং ইসতিদাদ পরীক্ষা করার দরখাস্ত করবে। উস্তাদ দেখবেন, সে শুদ্ধভাবে ইবারত পড়ে কি না, তরজমা-তরকীব বোঝে কি না, অর্থ ও মর্ম উদ্ধার করতে পারে কি না, ইবারতের যে মর্ম সে বয়ান করছে তা কি অনুমান করে বলছে, না পঠিত ইবারত থেকেই মর্ম আহরণ করতে পারছে, ইবারতে পারিভাষিক শব্দ থাকলে সেগুলো কি শাস্ত্রীয় আঙ্গিকে বুঝতে সক্ষম  হচ্ছে, না শুধু আভিধানিক অর্থের উপর আন্দাজ করে অর্থ বলছে। এভাবে উস্তাদ গভীরভাবে পরীক্ষা করে বলবেন, তার মধ্যে কিতাব বোঝার যোগ্যতা তৈরি হয়েছে কি হয়নি। যদি না হয়ে থাকে তবে কোন বিষয়ে তার দুর্বলতা রয়েছে তা চিহ্নিত করবেন।

 

যে বন্ধুরা তাখাসসুসের পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা অগ্রসর করতে আগ্রহী তাদের খেদমতে আরয এই  যে, এ বিষয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। এমন অনেক তালিবে ইলম ভাইয়ের মুখোমুখি হয়েছি, যাদেরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, হিদায়া ছালিছের সঙ্গে কী মুতালাআ করেছেন, তারা উত্তর দিয়েছেন, আশরাফুল হেদায়া! আমি জিজ্ঞাসা করেছি, ফাতহুল কাদীর বা আলবিনায়া (বদরুদ্দীন আলআইনী) অধ্যয়নের সুযোগ হয়েছে?

 

: জ্বী হাঁ। মাঝে মাঝে কোনো কোনো স্থান অধ্যয়ন করেছি।

: যে স্থানগুলো অধ্যয়ন করেছেন তা কি বুঝে আসত?

 

: জ্বী হাঁ।

কেউ কেউ এর সঙ্গে যোগ করেছেন, কিছু কিছু বুঝে আসত।

কিন্তু এই কথোপকথনের পর যখন তার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে তখন দেখা গিয়েছে যে, ইবারতের শুধু শাব্দিক অর্থটুকুই তার বোধগম্য হয়েছে, এর বেশি নয়।

এজন্য যদি ফিকহ ও ইফতা বিভাগে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে নুরূল ইযা এর সঙ্গে মারাকিল ফালাহ, কুদুরীর সঙ্গে আল জাওহারাতুন নাইয়েরা কিংবা আততাসহীহ ওয়াত তারজীহ আলমাওযূ আলা মুখতাছারিল কুদুরী কানযুদ দাকায়েকের সঙ্গে আলবাহরুর রায়েক কিংবা অন্তত আননাহরুল ফায়েক শরহুল বিকায়ার সঙ্গে উমদাতুর রিয়ায়া হিদায়ার সঙ্গে ফাতহুল কাদীর, আলইনায়া, আলবিনায়া মুতালাআ করুন। ফতহুল কাদীরের সঙ্গে মুনাছাবাত সৃষ্টি হওয়া এবং তার সাধারণ আলোচনাগুলো বোঝার যোগ্যতা অবশ্যই পয়দা হওয়া উচিত। আর হিদায়ার আলোচনাগুলোর পরিপূর্ণ (অর্ধেক নয়) মর্মার্থ পরিষ্কারভাবে বোঝা তো (অন্তত লাখনোবী রাহ. কিংবা হাসান সাম্ভলী রাহ.-এর হাশিয়া ও আলইনায়ার সাহায্যে) ফরযের পর্যায়ে। তবে সঠিক ও সম্পূর্ণ বুঝছেন কি না তা কোনো যোগ্য  উস্তাদকে শুনিয়ে জেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিজস্ব ধারণা  যথেষ্ট নয়।

একইভাবে যে বন্ধুরা উলূমুল হাদীস নিয়ে পড়াশোনা করতে চান তারা প্রথম জামাতগুলোতে থাকা অবস্থাতেই ইমাম নববী রাহ.-এর আল আরবায়ীন কিতাবের হাদীসগুলো ইয়াদ করে ফেলুন, এরপর মুহিউদ্দীন আওয়ামা সংকলিত আলআহাদিসুল কিসার মুখস্থ করুন এবং হাদীস শরীফের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করুন।

শরহে বেকায়ার বছর আছারুস সুনান-এর মতন অধ্যয়ন করুন, হিদায়ার বছর নসবুর রায়া মুতালাআ করা সম্ভব না হলে অন্তত ইলাউস সুনান-এর মতন এবং ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার মুতালাআ করুন। আছারুস সুনান দ্বিতীয়বার হাশিয়াসহ অধ্যয়ন করুন।

জালালাইনের সঙ্গে আলইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর মুতালাআ করুন।

 

মিশকাতের বছর কম ছে কম মিরকাতুল মাফাতীহ আদ্যোপান্ত মুতালাআ করুন। কোনো ছুটিতে ইবনে মাজা আওর ইলমে হাদীস এবং আছারুল হাদীস পড়ে ফেলুন।

দাওরায়ে হাদীসের বছর অন্তত ফাতহুল বারী, মাআরিফুস সুনান এবং ফাতহুল মুলহিম তাকমিলাসহ অবশ্যই মুতালাআ করা উচিত। অপারগতার ক্ষেত্রে এক করণীয় এই হতে পারে যে, প্রসিদ্ধ ও ইলমী শরাহগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে বার বার অধ্যয়ন করে এগুলোর আলোচনার ভঙ্গি ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করুন এবং একটা বা দুইটা শরাহ নির্বাচন করে তা আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন করুন। তবে সর্বাবস্থায় উস্তাদের রাহনুমায়ী অনুযায়ী এ বিষয়টা ভালোভাবে জেনে নিন যে, আপনার মধ্যে কিতাব বোঝার ইসতিদাদ পয়দা হয়েছে কি না। এমন যেন না হয় যে, ফাতহুল বারী ও মাআরিফুস সুনানের ভাষা ও পরিভাষার সঙ্গেই আপনার পরিচয় হয়নি, অথচ আপনি ভাবছেন যে, এই  দুই কিতাব আপনি খুব ভালো বুঝেছেন।

 

মোটকথা, এখানেও আমি সেই পুরানো কথা পুনরায় আরয করছি যে, তাখাসসুসের শ্রেণীতে ভর্তির প্রস্ত্ততি দাওরায়ে হাদীসের সালানা ইমতেহানের পরে নয় প্রথম জামাত থেকেই শুরু করা জরুরি।

১১. বুযুর্গদের সোহবত গ্রহণ করুন

আপনার নিজ প্রতিষ্ঠানে কিংবা জুমআর দিন অন্য কোথাও কোনো ইসলাহী মজলিসের আয়োজন থাকলে তাতে শরীক হওয়ার চেষ্টা করুন। এখন থেকেই বুযুর্গদের সোহবতে যাতায়াতের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। এতে নূরানিয়ত ও রূহানিয়ত পয়দা হয় এবং মেহনত-মুজাহাদার হিম্মত বৃদ্ধি পায়।

সর্বশেষ দরখাস্ত এই যে, বিগত সংখ্যাগুলোতে তালিবে ইলমের প্রতি আকাবিরের পয়গাম শিরোনামে যে কথাগুলো আরয করা হয়েছে তা পুনরায় স্মরণ করে সে অনুযায়ী আমল করার চেষ্টা করুন।#

 

 

advertisement