যিলকদ ১৪২৯   ||   নভেম্বর ২০০৮

হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রাহ : কিছু গুণ, কিছু বৈশিষ্ট্য

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তিনি অনেক বেশী লিখতেন না, অনেক বেশী বলতেনও না। ইলমে দ্বীনের চর্চা আমাদের দেশে আছে। কিন্তু দ্বীনের বুঝ, দ্বীনের ফিকির এবং দ্বীনের সঠিক সমঝওয়ালা লোকের সংখ্যা খুবই কম। ইসলাম কি, এটাই বুঝে না যদিও কিছু মাসআলা মাসায়েল জানা আছে। তাঁর মধ্যে অনেক মৌলিক ইলম ছিল, জ্ঞান ছিল। বিশেষত কুরআনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অনেক বেশী। শুধু কুরআন শরীফ তিনি সবসময়ই পড়তেন এবং তাফসীরের আলোকেও ছাত্র জীবন থেকেই পড়তেন। নতুন তাফসীর প্রকাশিত হলেই পড়তেন। যত তাফসীর আছে উর্দূ-আরবী, প্রায় সবই তিনি পড়তেন, দেখতেন এবং ভাল রকম মন্তব্য করতে পারতেন কোনটার খুসুছিয়াত কি। অন্ধের মতো সব পড়তেন, এরকম না। কুরআনের সাথে তার সম্পর্ক খুব মুহাববতের ছিল এবং অনেক বেশী ছিল। জনসাধারণের ফায়েদার জন্য কুরআন মজিদ সামনে নিয়ে তাফসীর করতেন। সারাজীবনই করতেন। তিনি যখন কর্ম জীবনে কিশোরগঞ্জে ছিলেন, তখন দেখা গেল তেমন কোন কাজ নেই, মহল্লার কোন কোন মসজিদে তাফসীর করতেন। এবং তাফসীরের বিষয়বস্ত্ত এটাই, আখেরাতের দিকে মানুষকে মনোযোগী করা। দুনিয়ার দিক থেকে মানুষকে দূরে রাখা, কিভাবে মানুষের মাঝে ঈমান আসে, আর দ্বীনী জিন্দেগীর মধ্যে শান্তি অন্য কোন জায়গায় শন্তি নেই-এ কথাগুলো মৌলিকভাবে বলতেন। তাফসীরের দ্বারা দল, রাজনীতি ইত্যাদি করতেন না। মানুষকে আখেরাতমুখি করার জন্য এ ধরনের আয়াত ও সূরাগুলি বাছাই করে তাফসীর করতেন। আখেরাতের বর্ণনা, জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা তাফসীরে পেশ করতেন।

 

আসলে হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ. এর জীবনীর একটা বড় অংশ হলেন আববা। তাঁর লেখা, তাঁর বক্তৃতা, তাঁর সফর তাঁর যত কাজ সব করতেন। প্রাইভেট সেক্রেটারী বলা যায়। এ শব্দের দ্বারা অবশ্য তা আদায় হয় না তিনি হযরতের আরও কাছের ছিলেন, আরও বেশি কিছু ছিলেন। এরপর যখন তিনি দুনিয়া থেকে চলে গেছেন তারপর থেকে বাকী জীবনটা আববার মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল না। বলতেন যে, তাঁর সাথে কাজ করব। এ ধরণের একটা হতাশা এসেছিল। তাঁর মতো একজন ওলীয়ে কামেল, এরকম লোকও পাই না। এত বড় আলেমও আর পাই না। আর এত বেশী সমাজসচেতন এবং দ্বীনের ব্যাপারে দাওয়াতের ব্যাপারে এত মুকাম্মাল চিন্তা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, রাজনৈতিক পর্যায়ে এরকম লোকও পাই না!

 

আতহার আলী রাহ. যখন ময়মনসিংহ জামিয়া ইসলামিয়ায় গিয়েছেন তখন আর তিনি যাননি। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন, মাদরাসা মসজিদের তদারকির জন্য তুমি থাক। এটাকে আবার কিভাবে চালু করা যায় তার জন্য তুমি কাজ কর। কিশোরগঞ্জের জন্য তিনি দোয়া করতেন, কিভাবে সেখানে পরিবেশ তৈরী করা যায়। জামিয়া ইসলামিয়াতে তিনি গিয়েছেন একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে। কারণ এই শহরে তখন তার থাকার অবস্থা ছিল না। বাড়িঘর দখল হয়ে গিয়েছিল, তিনিও জেলখানায় তাঁর পরিবারবর্গও হিজরত করে চলে গেছেন ময়মনসিংহে। সেখানে তারা জামিয়া ইসলামিয়ায় গিয়েছেন, সেটা আমার নানার মাদরাসা। এর বানী ও মুহতামিম হলেন আমার নানা, মাও: আশরাফ আলী সাহেব। এটা একটা সাময়িক অবস্থা।

 

তারপর হুজুরের ইন্তেকাল ওখানে হয়ে গেছে এবং তাঁর লাশও ওখানে রাখা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের এই প্রতিষ্ঠানগুলো পূনরুদ্বার করা এবং এগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আববা এখানে থাকতেন এবং হুজুরের নির্দেশেই থাকতেন পরে এগুলো পূন:প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হযরতের বড় ছাহেবজাদাকে আববার উসিলায় আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। ঐ মসজিদের অন্য ইমামকে সরিয়ে এলাকাবাসীদের নিয়ে জুমার সময় সাহেবজাদাকে আববা দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। খুৎবা একটা তার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি পড়। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে, যেহেতু হুজুর এটা বানিয়েছেন। এভাবে তিনি নিজের হাতে এগুলোকে আবার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন এবং কমিটিগুলো ভেঙে নতুন কমিটি করেছেন। মজলিসে-শুরা ও আমেলা করেছেন। এগুলোর সম্পত্তিও উদ্ধার করিয়েছেন যা অন্যরা নিয়ে গিয়েছিল। আয়ের জন্য মার্কেট, বাসা-বাড়ি, হোটেল সবকিছু সচল করেছেন। কিন্তু মূল পদটা নিজে নেননি। দাদার যা ইচ্ছা ছিল এ পদ হযরতের ছেলেকে দিবেন, আববা তা-ই করেছেন। আর আববার ব্যাপারে দাদার কথা ছিল, তোমার কোন চিন্তা নেই, আল্লাহ তোমাকে ভালই চালাবেন।

 

এভাবেই তিনি তাঁদেরকে পূনরায় কিশোরগঞ্জে এনেছেন এবং মসজিদ-মাদরাসা, বাসা-বাড়ি পূনরুদ্ধার করেছেন। এজন্য আববা জেলখানায়ও গিয়েছেন। মানে তখন রাতদিন তিনি এ সংগ্রামই করতেন। এ জন্য তাকে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জের এবং শহিদী মসজিদের ‘‘নাশআতে ছানিয়া’’-এর রূপকার তথা দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। কিন্তু এটা তিনি কখনও বলতে দেননি। তিনি বলতেন, এটা আমার একটা দায়িত্ব, একসময় এটা নষ্ট হয়েছে, পরে এটা আবার আল্লাহ আমাকে দিয়ে করিয়েছেন।

 

তিনি মনে প্রাণে একজন আল্লাহ ওয়ালা ছিলেন। তার মাঝে লোক দেখান বলতে কিছু ছিল না। তিনি নিজে যেটা পছন্দ করতেন সেটা করতেন। অন্যরা এরকম করছে, এখন এরকম একটা পাগড়ী চালু হয়েছে, বা নতুন একটা বিদআত চালু হয়েছে। যা কিছু হয় হোক, আমি আমার তাহকীকের উপর বা অবস্থার উপর অটল। শুধু এটা আকাবিরীনের লাইনে হলেই চলত। এমন না যে তিনি নতুন কোন লাইনে চলে গেছেন, যা আমাদের দেশে অনেক সময় হয়। তাঁর আরেকটা বিষয় ছিল তা হলো, ফেরাসাত, ফেরাসাতে ঈমানী ছিল। অনেক আলেম দেখা গেছে যে, একটা নতুন তাহরীকের মধ্যে শরীক হয়ে গেছেন। দুই তিন চার পাঁচ বছর পরে দেখেন যে এটা আসলে কিছু না। সময়ও নষ্ট হয়েছে, দরস ও তাদরীসের মধ্যে ব্যাঘাতও হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, দাওয়াতের কাজেও ব্যাঘাত হয়েছে। তিনি এগুলিতে যেতেন না। অনেকে বলত, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তিনি কেন নেই? ঢাকাতে আলেম-উলামারা এক মঞ্চে উঠে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ফেলছেন, তিনি কেন নেই? তিনি এই জিনিসগুলোর শুরু এবং শেষ কি হবে সব বুঝতেন। যারা করছে তাদের যোগ্যতার পরিমাণ, তাদের এখলাছ আছে কি না, করা উচিৎ কিনা এগুলো তিনি খুব বুঝতেন। বুঝার কারণে এগুলিতে শরীক হতেন না। নাদামাত হবে বা লজ্জিত হতে হবে এজন্য মনে কষ্ট পেতেন যে, লোকে মনে করবে, আমি নেই। সবাই মনে করবে। পুরনোরা তো জানেই আমি কি? কিন্তু নতুন প্রজন্ম হয়তো ভাববে যে, তিনি এগুলোতে শরীক হন না কেন? তাহলে কি ইসলামের প্রতি তাঁর দরদ নেই? অথবা তিনি কি তাহলে সাহসী লোক নন? এই চিন্তাগুলো তিনি করতেন এবং বলতেন, আমি যেহেতু এগুলো বুঝি সুতরাং আমার সিদ্ধান্ত হলো, আমার যাওয়া উচিৎ নয়। আর তিনি যে এগুলো বুঝতেন, কিন্তু এগুলো বুঝার মতো কোন সাথী পেতেন না। এটা ছিল তার আরেকটা কষ্ট। এরকম যদি দুই চার দশজন লোক থাকত যে, আসলে কাদের এই কাজটা করা উচিৎ তারা তা বুঝত। অনেক সময় দেখা যায় যে, বড় বড় নাম দিচ্ছে অমুক তাহরীক। বা বিদেশে একটা সংগঠন হলো, ঢাকাতে তার একটা শাখা বানালো।

আসলে এটার সঙ্গে ওটার কোন তুলনাও নেই। এদের ওদের মতো ঐরকম যোগ্যতাও নেই। একটা নাম শুনলো পাকিস্তানে, এখানেও একটা দিয়ে দিল। একটা মিছিলের একটা নাম দিয়ে দিল। বা একটা ইস্যুতে ১৫ দিনের একটা আন্দোলন-এটার একটা বিরাট নাম ব্যবহার করল। এসব কারণে নামের মূল্যও কমে যায়। অথবা কোন সময় একটা নিষিদ্ধ সংগঠন, জংগী সংগঠন হয়তো আমেরিকাতে এটা দোষী বা পাকিস্তানে ইন্ডিয়াতে এটা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের আলেমরা আবেগের কারণে সেই নামটা ব্যবহার শুরু করল। ফলে দেখা যায়, তাদের নামও ওদের সঙ্গে ঢুকে পড়েছে। অথচ তাদের সেরকম যোগ্যতা বা কোন কার্যক্রমই নেই। ভালোরও যোগ্যতা নেই, খারাপেরও যোগ্যতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নামটাও বিদেশীরা লেখে দেয় যে, এরাও আছে। এই বাজে কাজ ও তাড়াহুড়াগুলি তিনি খুব অপছন্দ করতেন।

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement