যিলহজ্ব ১৪২৯   ||   ডিসেম্বর ২০০৮

কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের প্রতি

হযরত মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.

আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ইসলামিয়াত বিভাগ আমাকে তাদের প্রিয় ছাত্রদের সম্বোধন করার সুযোগ দিয়েছে। আমিও একজন তালিবে ইলম এবং শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত এভাবেই আমার জীবন অতিবাহিত হয়েছে। আপনারা জানেন যে, তালিবুল ইলম হওয়ার অর্থ স্কুল-মাদরাসার নির্ধারিত সিলেবাস সমাপ্ত করা নয়; বরং এটা এমন এক ব্যাধি, যে এর শিকার হয়েছে, মৃত্যু পর্যন্ত তার আর নিষ্কৃতি নেই। হযরত ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর মূল্যবান উক্তি সম্ভবত আপনারা জানেন, যার অর্থ আমাদের এই সাধনা অর্থাৎ ইলম-অন্বেষণ, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত।

মাসতূরাত-এর পর্দারক্ষা

আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি যে, এ বিভাগের দায়িত্বশীলরা সঠিক ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করেছেন এবং সহশিক্ষার পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদের আলাদা পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। আমার বক্তৃতায় আমি যদিও ছাত্র শব্দ ব্যবহার করব, কিন্তু ছাত্রীরাও তাতে  অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। একে কুরআনী পদ্ধতি মনে করেই আমি তা অবলম্বন করেছি। কুরআন মজীদ বিভিন্ন জায়গায় হে মুমিনগণ, হে লোকসকল ইত্যাদি শব্দে সম্বোধন করে মা-বোনদের পর্দারক্ষা করেছে। যদিও মুমিন ও মুমিনা উভয়ই ওই সম্বোধনে শামিল।

 

কুরআনের এই বিশেষ ভঙ্গির কারণে কোনো স্বল্পবুদ্ধি লোকের মনে যদি এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, এতে নারীর মর্যাদা কমানো হয়েছে, তাহলে কুরআন মজীদেই এর খন্ডন রয়েছে। কিছু আয়াতে মুমিনদের পাশাপাশি মুমিনাদেরও উল্লেখ করা হয়েছে। একস্থানে ইয়া নিসাআন নাবী বলে বিশেষভাবে নারীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে।

কুরআন মজীদের এই ভঙ্গি নারীদের জন্য পর্দা ও লজ্জাশীলতার সূক্ষ্ম পয়গাম বহন করে।

আমি এই মজলিসে কিছু নিরস কথা; বরং কিছু তিক্ত কথা পেশ করার ইচ্ছা করেছি। প্রয়োজনের তাগিদে বিষয়বস্ত্ত নির্ধারণ করলেও কিছুটা লজ্জিত বোধ করছি এই ভেবে যে, জ্ঞানীদের মজলিসে জ্ঞানগর্ভ কথারই চাহিদা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আহারের চেয়ে ঔষধের দিকটাকেই প্রাধান্য দিয়েছি। আমার পূর্বে মুহতারাম দোস্ত আলেমে রববানী মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ ছাহেব বিন্নুরী তাঁর গভীর জ্ঞানের কিছু উপহার এই মজলিসে দান করে আমার লজ্জা কিছুটা দূর করেছেন।

দ্বীন ও দুনিয়ার ভিন্নতা

 

ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী হিন্দুস্তানের ইসলামী হুকুমতের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ইসলামী শান-শওকত ও ইসলামী রীতি-নীতি বিলুপ্ত করার জন্য যে কাজগুলো করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় এই ছিল যে, তারা গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ থেকে শুধু শূন্যই করেনি; বরং তার প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে। যার কারণে দ্বীনদার শ্রেণী কুরআন ও সুন্নাহর ইলমের হেফাযতের জন্য আলাদা দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে দ্বীনী উলূম ও দুনিয়াবী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ইতোপূর্বে গোটা ইসলামী ইতিহাসে এই বিভাজনের কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।

পাশ্চাত্যের ভোগবাদ ও নাস্তিক্যবাদ দিন দিন এই বিভাজনকে গভীর করেছে। ফলে মুসলিমজাতির অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, তাদের নেতৃত্বদানকারী শ্রেণী কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে এই জ্ঞানের অধিকারীদের পয়গামও তাদের কাছে পৌঁছতে পারে না।

আজ আমি যে কথাগুলো আরজ করতে চাই, তা শুধু এই বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যেই নয়; বরং গোটা দেশের কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত সকল ছাত্রের উদ্দেশ্যেই এই পয়গাম। ইসলামিয়াত বিভাগের ছাত্রবন্ধুদেরকে যোগসূত্র মনে করে আমি কথাগুলো তাদের সামনে পেশ করছি। সম্ভবত তাদের মাধ্যমে এই পয়গাম সবার কাছে পৌঁছে যাবে।

তারুণ্যের দায়িত্ব

ইসলামের হেফাযতের জন্য এ দেশের তরুণরা যদি সংকল্পবদ্ধ হয় তবে তা সেনাবাহিনীর শক্তির চেয়ে কম নয়। সেনাবাহিনী যেমন দেশের সশস্ত্র শক্তি তেমনি তরুণসমাজ দেশের নৈতিক শক্তি, যা অনেক বেশি অপরাজেয়। গোটা ইসলামী ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই পাওয়া যাবে যেখানে মুসলমান তার প্রতিপক্ষের চেয়ে লোকবল ও অস্ত্রবলের দিক দিয়ে অগ্রগামী ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের দুশমনদের তুলনায় দুর্বল ছিলাম, কিন্তু যা আমাদেরকে প্রতি রণাঙ্গনে বিজয়ের বরমাল্য দান করেছে তা হচ্ছে  ঈমান ও আমলের দুর্দম শক্তি। এই শক্তিকে জাগ্রত করার জন্য আমাদের তরুণরা যদি সংকল্পবদ্ধ হয় তবে সেদিন খুব দূরে নয় যখন গোটা জাতি ইসলামী আদর্শের উত্তম নমুনা হয়ে যাবে। তারা এমন অপ্রতিরোধ্য শান ও শওকত অর্জন করতে সক্ষম হবে যে, দুশমনের পক্ষে এদিকে মুখ তুলে তাকানোরও হিম্মত হবে না। কখনও যদি নির্বুদ্ধিতার কারণে এমন কাজ করেও বসে তবে আমরা তার উত্তর সীমান্তে নয়, তাদের ঘরে পৌঁছে দিতে পারব।

তরুণ ছাত্ররা যেমন গোটা দেশে আদর্শিক চেতনা বিতরণ করতে পারে তেমনি দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। শর্ত শুধু এই যে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পুরনো চাহিদা ও অভ্যাসের কিছু কুরবানী দানে সংকল্পবদ্ধ হবেন এবং চেতনা ও কর্মে যে দুর্বলতাগুলো আছে তা দূর করতে সচেষ্ট হবেন।

লর্ড মেকলের প্রবর্তিত শিক্ষা-ব্যবস্থা আমাদের কর্মের উদ্যম ও নৈতিক পবিত্রতাকে যেমন বিনষ্ট করেছে, তেমনি আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে পদ ও পদবীর পূজারী বানিয়ে দিয়েছে। আর আমাদের চিন্তা-চেতনাকেও এত বিষাক্ত করে দিয়েছে যে, আমাদের চিন্তার ধারাই বদলে গেছে। এই শিক্ষায় দ্বীন শুধু অনুপস্থিত নয়, এর জন্য যে পরিবেশ নির্বাচন করা হয়েছে তা একে দ্বীনের প্রতিপক্ষ ও ঈমান বিনষ্টকারী বানিয়ে দিয়েছে। যার অপরিহার্য ফলাফল এই হয়েছে যে, আমাদের ছাত্রদের   চিন্তা ও হৃদয় ঈমানী চেতনা থেকে ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাহাত্ম্য ও মুহাববত এবং তাঁদের আনুগত্যের প্রেরণা আমাদের জাতীয় শিক্ষাঙ্গণগুলো থেকে   শুধু নিঃশেষই হয়ে যাচ্ছে না; বরং এই পবিত্র ও কল্যাণকর প্রেরণা বিলুপ্ত করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। উপরন্তু প্রাচ্যবিদ গবেষকদের নানামুখী চক্রান্ত সন্দেহ ও সংশয়ের এমন জাল বিছিয়ে দিয়েছে যে, দ্বীন ও ঈমানকে রক্ষা করা বাস্তবিক পক্ষে মর্দে মুজাহিদের কাজ।

নিঃসন্দেহে ছাত্রভাইদের মধ্যে এমন অনেক মর্দে মুজাহিদ আল্লাহ তৈরি করেছেন, যারা এইসব চক্রান্ত ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু সময়ের দাবি এই যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শিতা অর্জন যেমন আমাদের ভাইদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে রয়েছে তেমনি গুরুত্বের সঙ্গে; বরং আরো অধিক গুরুত্ব দিয়ে ইসলাম ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমরা যদি মুসলমান না হই তবে কিছুই হতে পারিনি। আর মুসলমান একটি সাম্প্রদায়িক উপাধী নয়; বরং ইসলামী জীবন-দর্শন, ইসলামী চেতনা এবং ইসলামী কর্ম ও চরিত্রের যারা অধিকারী তাদেরই নাম মুসলিম। বলাবাহুল্য, এর জন্য কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান পূর্ণ আগ্রহের সঙ্গে অর্জন করা জরুরি।          

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement