যিলহজ্ব ১৪২৯   ||   ডিসেম্বর ২০০৮

হযরত মাওলানা আতাউর রহমান খান রাহ. : কিছু গুণ, কিছু বৈশিষ্ট্য

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেফাকুল মাদারিস প্রতিষ্ঠার সময় থেকে তিনি এর সাথে ছিলেন। এর প্রথম সেক্রেটারি (মহাসচিব) শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব। দ্বিতীয়ত সেক্রেটারি ছিলেন তিনি ১৯৮২-১৯৯১ পর্যন্ত এবং এটাই হল বেফাকের সবচেয়ে কার্যকর ও গঠনমূলক সময়। বেফাক তো এখন একটা সিস্টেমের উপর চলে এসেছে। এখন বেফাক অটোমেটিক চলছে। কিন্তু যখন এই সিস্টেমটা ছিল না তখন মাদরাসাগুলো-কে এক করা, একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ভিতরে আনা, একটা পরীক্ষা পদ্ধতির আওতায় আনা, একটা এন্তেজামিয়ার মধ্যে আনা, একটা মুরাকাবার আওতায় আনা সবই তাকে করতে হয়েছে। বেফাকের সিস্টেমটা গড়ে তুলেছেন তিনি। তাঁর ৯ বছর হল গঠনের সময়। বেফাকের প্রথম চেয়ারম্যান হাজী ইউনুস সাহেবের সাথে কাজ করতে পেরে তিনি খুব আনন্দিত ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন খুব উদার মনের। হাজী ইউনুস সাহেব ও তাঁর মাঝে খুব মানসিক মিল ছিল। এজন্য কাজ অনেক অগ্রসর হত।

এম.পি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেফাকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন।

অনেকে বলত যে, এখন আপনি বেফাকের খেদমত আরো বেশি করতে পারবেন। কিন্তু আমাকে তিনি বলেছেন, বেফাক ছেড়ে দেওয়ার কারণ দুইটা। একটা হল, আমি এম.পি হয়েছি, বেশি কাজ হয়তো করতে পারব, কিন্তু মানুষরা উল্টা বলবে যে, বেফাকের ক্ষমতায় তিনি এম.পি হয়েছেন কিংবা বেফাককে তিনি ব্যবহার করেছেন বা বেফাকের নামে তিনি সুবিধা নিয়েছেন। আর বস্ত্তত আমি এগুলো করব না, কিন্তু কোনো এক সময় এমন হবে যে, আরেকজন লোক বেফাকের সভাপতি বা মহাসচিব থাকাবস্থায়  এম.পি হয়ে অন্যান্য মাদরাসা-সংগঠনের মতো করবে। কাজেই আমি এটা থেকে সরে গেলাম। আমি দূর থেকে খেদমত করব। কিন্ত বেফাককে ব্যবহার করার মতো সুযোগ যেন আর না হয় সেজন্য আমি আগেই একটা ঐতিহ্য তৈরি করে গেলাম। কারণ একজন মানুষ যদি বেফাকের মহাসচিব থাকে তাহলে সরকারের কাছে তার অনেক কিছু বলার থাকে যে, আমি হলাম কওমী মাদরাসা বোর্ডের তথা উলামা সংগঠনের প্রধান। এটা দিয়ে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। এ রকম যাতে না হতে পারে এজন্য এটা বাদ দিলাম। আরেকটা হল আমি বেফাকের পরিচয়ে ভালো ব্যবহার ও উত্তম খেদমত করলেও আমাদের দেশের মানুষের স্বভাব হল মন্দটা বলা। কাজেই আমি এটাতে নেই। যেহেতু সরকারী দলের এম.পি হয়েছি যেহেতু সরকারী লোক হয়ে গেছি। মাদরাসা শিক্ষার উপর এর কোনো প্রভাব না পড়ুক।

তিনি খুব চিন্তাশীল এবং বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর খুব মুতালাআ ছিল। একটা বিষয়ের উপর অনেক অনেক কিতাব পড়া, এরকম না। সাধারণভাবে ইসলামী তারীখের যতগুলো কিতাব মশহুর, যত ব্যক্তিত্ব মশহুর, যতগুলো ফন মশহুর, তার জানার বাইরে তেমন কিছুই ছিল না। তার যামানায় বাংলাদেশে যে পরিমাণ কিতাবাদি এসেছে ঐ যামানার ছাত্র হিসেবে তিনি অনেক কিছু জানতেন। এখন মালুমাত আসান হয়ে গেছে, কম্পিউটার হয়েছে, ইন্টারনেট হয়েছে। আরব আজমে যাতায়াত বেড়েছে এবং অনেক বিরল কিতাব নতুন  ছাপা হ&&চ্ছ। এগুলো কেনাও সম্ভব। ঢাকাতে বা চিটাগাং-এ এমন লাইব্রেরি আছে যেখানে দুনিয়ার সব কিতাবই পাওয়া যায়। তিনি যখনকার ছাত্র-ধরেন ১৯৬২ তে তার লেখাপড়া শেষ। ঐ সময় দুনিয়া এত অগ্রসর হয়নি। কিন্তু এর পরও তার যে পড়ালেখা ছিল ঐ পড়ালেখার সঙ্গে আমরা নিজেদের তুলনা করতে পারি না এখনও।

কুরআন শরীফের পাশাপাশি তার একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল সীরাতের সাথে। এ ব্যাপারে অনেক বেশি জানতেন। আমরা সীরাতের এক দুইটি কিতাব পড়ি। পরে হাদীসের ছবক পড়ার সময় আমরা আলাদাভাবে সীরাত পড়ি। রেওয়ায়েতের সাথে মিলানোর জন্য মাগাযী, তারীখ পড়ি। কিন্তু আববা, আমার মনে হয়, সীরাতের যতগুলো মশহুর কিতাব দুনিয়ায় আছে এগুলোর অধিকাংশই মনোযোগ সহকারে পড়েছিলেন এবং এগুলো তার ইয়াদ থাকত। সীরাতের সব তারীখ, হালত, ব্যক্তির নামসহ, রিজালসহ। সাহাবী হোক কিংবা অমুসলিম, কোনো ওয়াফদের সদস্য হোক, কোনো কবিলার লোক হোক সব তার মনে থাকত। এলাকাতে অনেক সময় এমন হত যে, ধারাবাহিক সীরাত বর্ণনার জন্য তাকে লোকেরা ডাকত। সাত দিন ধরে তিনি একাই বয়ান করতেন। তিন দিন তিনি একাই বয়ান করতেন। একবার এমন হয়েছে ১৪ দিনব্যাপী তিনি একাই বয়ান করেছেন। একাধারে প্রতিদিন এক দেড় ঘন্টা মাগরিব থেকে এশা। সেখানে যারা শুনত তারা খুব বেশি খুশি হত। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনী একাধারে কোনো কিছু বাদ না দিয়ে অনেকেরই শোনার সৌভাগ্য হয় না। আমাদের অঞ্চলের ঐ সমস্ত মাহফিলের যারা শ্রোতা এখনও তারা বলেন।

আমরাও সীরাত সম্বন্ধে তার বক্তৃতা থেকে অনেক কিছু জেনেছি। কারণ আমাদের তো কিতাব পড়ার সুযোগ হয় না। আর পড়লেও এক রকম  কিতাব পড়া হয়। কিন্তু তার মুতালাআ ছিল দশ রকম কিতাব। যখন বলতেন তখন একটাই মনে হত। আর তার সীরাতের বক্তৃতা খুব জীবন্ত হত। আলোচনার সময় তিনি কাঁদতেন। তিনি আবার প্রকাশ্যভাবে খুব জোরে আওয়াজ করে কোনো ভাব প্রকাশ করতেন না। খুব চাপা ছিলেন। সাহাবীদের যে কুরবানী এগুলোর আলোচনা আসলে তিনি কাঁদতেন এবং মাহফিল শেষে খুব সুন্দর দোয়া হত। দোয়ার মধ্যে আল্লাহ কবরের আযাব মাফ কর, হাশরের দিন পুলসিরাত বিদ্যুত গতিতে পার করিয়ে দাও, মীযানের পাল্লা ভারী করে দিও,  ডান হাতে আমলনামা দিও। একটা একটা করে ভবিষ্যতের যে ঘাটিগুলো আছে সেগুলোর কথা দোয়ার মধ্যে বলতেন। আর দোয়ার খুব তাছীর হত। আমরাও মনে করতাম যে, দোয়া কবুল হয়ে গেছে। #

 

 

 

advertisement