মুহাররম ১৪৩০   ||   জানুয়ারী ২০০৯

দুটি কবর একটি পয়গাম

ইবনে নসীব

বাইতুল মুকাদ্দাসের দেয়ালঘেরা বিস্তৃত এলাকার দক্ষিণ দিকে মূল মসজিদ অবস্থিত। পশ্চিমে বেশ কিছু ভবন রয়েছে। এগুলো ছিল মাদরাসা ও ছাত্রাবাস। এখানে দুটি কবর রয়েছে কাছাকাছি। একটি কবর উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহরের (১২৯৬ হি.-১৩৪৯ হি. মোতাবেক ১৮৭৮ ঈ.-১৯৩১ ঈ.)। অন্যটির কথা পরে বলছি।

১৯৩০ সালে লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে পরাধীন ভারতের যে নেতৃবৃন্দ অংশ গ্রহণ করেছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর তাদের অন্যতম। ওই বৈঠকে তিনি তার ঐতিহাসিক ভাষণগুলো প্রদান করেছিলেন। এরপরই ভারতবর্ষের এই অনলবর্ষী বক্তা চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যান!

তিনি বলেছিলেন, আমি শুধু একটি উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছি। তা এই যে, আমি মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাই আযাদীর পরওয়ানা হাতে নিয়ে। কোনো পরাধীন ভূখন্ডে আমি ফিরে যাব না। যদি ভারতের স্বাধীনতা আপনারা আমাকে না দেন তাহলে এখানেই একখন্ড ভূমি দিন আমার কবরের জন্য।

৪ জানুয়ারি ১৯৩১ ঈ. লন্ডনেই তার  ইন্তেকাল হয়ে যায়।

লন্ডনের মুসলিম-অমুসলিম ভক্তদের আগ্রহ ছিল তাঁকে এখানেই দাফন করা হোক, অন্যদিকে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বলা হচ্ছিল, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। কিন্তু তাঁর জন্য নির্ধারিত ছিল বাইতুল মুকাদ্দাসের পবিত্র ভূমি।

হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী রাহ. তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এভাবে : তুমি মিল্লাতের জন্য ব্যথিত ছিলে অতএব এই তো স্বাভাবিক যে, গোটা মিল্লাত তোমার জন্য ব্যথিত হবে, তুমি ছিলে উম্মাহর জন্য শোকাকূল  অতএব গোটা উম্মত তোমার জন্য শোক করবে। তুমি মুসলিম বিশ্বের জন্য মাতম করেছ অতএব তারা আজ তোমার জন্য মাতম করছে। যে ছিল ভারতের ব্যথায় ব্যথিত, ইরাকের দুঃখে কাতর, তারাবলুসের শোকে শোকাকূল, বলকানের অশ্রুতে যার চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে, শাম ও আংকারার জন্য যে করেছে আহাজারি, আর হিজায ও বাইতুল মুকাদ্দাসের জন্য যে ছিল দগ্ধচিত্ত-তোমার অধিকার তো মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি ভূখন্ডে প্রসারিত। অতএব এই তো স্বাভাবিক যে, ইসলামের প্রাচীন কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস দুহাত বাড়িয়ে তোমাকে বুকে তুলে নিবে। 

তাঁর জানাযা জাহাজে করে ফিলিস্তিনের  উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। মিসরের পোর্টসাঈদে অসংখ্য আরব, উলামা-মাশায়েখ তাঁর ইস্তেকবাল করলেন। বাইতুল মুকাদ্দাসে বিপুল সংখ্যক  ফিলিস্তিনী আরব এই পরদেশী মুসাফিরের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিলেন। সেখানে পৌঁছার পর তার জানাযা হল। লক্ষাধিক মুসলিম তাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

যে হুজরায় মাওলানা সমাহিত হলেন তা ছিল একজন ফিলিস্তিনী মুসলিমের অধিকারে। উত্তরাধিকার সূত্রে এই অমূল্য ভূমিটুকু তিনি লাভ করেছিলেন।

দ্বিতীয় কবর এমন একজন দুর্ভাগা আরবের, যে মুসলিম জাতিকে আমেরিকা ও ব্রিটেনের গোলামীতে আবদ্ধ করার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে হীন কাজটা করেছে।  

তার গাদ্দারীর কারণে হিজায খিলাফতে উছমানিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আরব ভূখন্ড টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

তার নাম শরীফ হোসাইন। মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহরের কবরের অদূরেই তার কবর। কিন্তু ফিলিস্তিনী মুসলিমগণ ওই কবরের নিকটবর্তী হওয়াকেও যিল্লতী বলে মনে করেন।

তার গাদ্দারী শুধু আরব মুসলমানদেরই নয় হিন্দুস্তানের মুসলমানদেরও চরম ক্ষতিসাধন করেছিল। হযরত শায়খুল হিন্দ রাহ. পরিকল্পনা করেছিলেন উছমানী সালতানাতের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদেরকে ভারত উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করার। কিন্তু শরীফ হোসাইন তাঁকে হিজায থেকে গ্রেফতার করে ইংরেজদের হাতে সোপর্দ করেছিল। সে সময় যদি শায়খুল হিন্দ রাহ. তাঁর পরিকল্পনায় সফল হতেন তাহলে আজ মুসলিম বিশ্বের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লিখিত হত।

এদিকে শরীফ হোসাইনের পরিণতি কী হয়েছিল? তাকে হিজায থেকে পলায়ন করে সিরিয়ায় আশ্রয় নিতে হয়। মৃত্যুর পর ইংরেজ মনিব তার ওফাদারীর স্বীকৃতি দিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসের এক স্থানে তারও কবরের ব্যবস্থা করে। কিন্তু কোনো আত্মমর্যাদাশালী মুসলিম সেদিকে মুখ তুলেও তাকায় না।

দুটি কবর কাছাকাছি। যেন দুটি জীবন্ত দৃষ্টান্ত জাতির ওফাদার আর গাদ্দারের শেষ পরিণামের। কবর দুটি যেন ঘোষণা করছে, মিথ্যার জয় নেই, আর সত্যের ক্ষয় নেই। যাদের জীবন আদর্শের জন্য নিবেদিত মৃত্যু তাদেরকে করে অজর-অমর। আর যারা পার্থিব স্বার্থের দাস তাদের তো মৃত্যু হয়েছে মৃত্যুর আগেই। অতএব যত বড় সৌধই তাদের জন্য নির্মিত হোক, সেটা তাদেরকে সম্মান দিতে পারে না।

এটাই ইতিহাসের শ্বাশ্বত শিক্ষা। কিন্তু স্বার্থের বেদিতে যারা আদর্শকে বলি  দেয় তারা ইতিহাসের পাতা থেকে ওই পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করে না যে পর্যন্ত না তারাই হয়ে যায় ইতিহাসের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। #

 

 

advertisement