সফর ১৪৩০   ||   ফেব্রুয়ারী ২০০৯

বাইতুল্লাহর ছায়া থেকে

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

মৌখিক ও লিখিত নসীহতের ধারা অত্যন্ত প্রাচীন। বড়  ছোটকে,  পিতা  সন্তানকে,  উস্তাদ শাগরিদকে এবং শায়খ তার মুরিদকে নসীহতের মাধ্যমে রাহনুমায়ী করে থাকেন। কুরআন হাকীমে আল্লাহ রাববুল আলামীন বান্দাদের হেদায়েতের জন্য তাঁর খাছ বান্দাদের অনেক অছিয়ত ও নছীহত উল্লেখ করেছেন। হাদীস শরীফেও এর নমুনা বিদ্যমান রয়েছে। সালাফে সালেহীন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এই ধারা চলমান রয়েছে। তারীখ ও আদাবুল ইলম বিষয়ক গ্রন্থাদিতে বিদ্যমান লিখিত নসীহতের সংখ্যা কম নয়। এই বছর আমার সৌভাগ্য হয়েছে, তালীম ও তারবিয়তের অঙ্গনে অত্যন্ত খামুশীর সঙ্গে মুজাদ্দিদানা খিদমত আঞ্জাম দানকারী ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম-এর একটি পত্র বহন করার। বাইতুল্লাহ থেকে একটি মূল্যবান নসীহতনামা তিনি আমার হাতে মাদরাসাতুল মদীনার তালিবে ইলমদের জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং ছাত্রদের সামনে পড়ে শোনানোর দায়িত্বও আমার উপর অর্পণ করেছিলেন।

ইতিপূর্বে এই ধরনের অনেক চিঠি আমি পড়েছি। কিন্তু এটির মতো গভীর, সমৃদ্ধ ও দূরদর্শী নসীহতনামা খুব কম পড়েছি। যদিও তা মাদরাসাতুল মদীনার তালিবে ইলমদের উদ্দেশ্যে লিখিত হয়েছে কিন্তু সকল আলিম ও তালিবে ইলমের জন্যই তা হতে পারে আলোকবর্তিকা। ছাহেবে রিসালার অনুমক্রিমে তা আলকাউসারের শিক্ষার্থীদের পাতায় পেশ করা হল। বি.স.

মাদরাসাতুল মদীনাহর প্রিয়

তালিবানে ইলম!

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ

আল্লাহর ঘরের সামনে বসে তোমাদের জন্য কয়েকটি কথা লিখছি। আল্লাহ যেন মেহেরবানী করে এই কথাগুলোকে আমার জন্য এবং তোমাদের সকলের জন্য নূর বানিয়ে দেন, আমীন। তোমাদেরকে আমি মুহাববত করি আল্লাহর ওয়াস্তে এবং তোমাদের যিন্দেগীর কামিয়াবি আমার আন্তরিক কামনা। পিছনের, বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের মাদরাসাতুল মদীনার সকল তালিবে ইলমকে আল্লাহ কবুল করুন, আমীন। বাইতুল্লাহর যিয়ারত এবং রওযা শরীফে হাযিরি নছীব করুন। কবুলিয়াত ও মাকবুলিয়াত দান করুন, আমীন।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে এবং সর্ব বিষয়ে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে। আল্লাহ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। আল্লাহ ছাড়া আমাদের কোনো আশ্রয়স্থান নেই। আল্লাহর চেয়ে আপনও আমাদের কেউ নেই। আনন্দ কিংবা বেদনা, সুখ কিংবা দুঃখ, সচ্ছলতা কিংবা অনটন যা কিছু আল্লাহ দেন আমাদের কল্যাণের জন্যই দেন যদি আমরা তা শোকর ও ছবরের সাথে গ্রহণ করতে পারি। তিনিই শুধু দান করতে পারেন সুখ, শান্তি এবং তিনিই শুধু দূর করতে পারেন দুঃখ ও অশান্তি। আল্লাহ যেন আমাদের ভালোবাসেন এবং আমরা যেন আল্লাহকে ভালোবাসতে পারি। মানুষের প্রতি আমাদের ভালোবাসাও যেন শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে হয়।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আমাদের যিন্দেগীর জন্য উসওয়া এবং আদর্শ। আমাদের আখলাক ও চরিত্র এবং আমাদের চিন্তা ও কর্ম সবকিছু যেন হয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক ও চরিত্র এবং চিন্তা ও কর্মের প্রতিবিম্ব। এজন্য মাদরাসাতুল মদীনাহর প্রতিটি ছাত্রের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হল সীরাতুন্নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুতালাআ, যাতে আমরা তাঁর নূরানী যিন্দেগী অনুসরণ করতে পারি।

আমলের গোমরাহীর মতো চিন্তার গোমরাহীও ভয়াবহ; বরং চিন্তার গোমরাহী আরো বেশি ভয়াবহ। কারণ তা অনেক সময় ইরতিদাদ পর্যন্ত নিয়ে যায়। চিন্তার গোমরাহী থেকে বাঁচার জন্য অতি জরুরি হল, সালাফে ছালিহ-এর অনুসরণ করা। নিকট যুগের তিনজন মহান ব্যক্তিকে মাদরাসাতুল মদীনাহর তালিবে ইলমের জন্য আমি অনুসরণীয় মনে করি। কারণ সম্মিলিতভাবে তাঁরা সালাফে ছালিহীনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিনিধিত্ব করছেন। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ., দাঈ ইলাল্লাহ হযরত মাওলানা ইলয়াস রাহ. এবং মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রাহ.। এই তিন মহান ব্যক্তির মাধ্যমে তোমরা যদি সালাফে ছালিহীনের এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে সুন্নতে নববীর অনুসরণ করতে পারো তাহলে এই ফিতনা-ফাসাদের যুগেও ইনশাআল্লাহ সমস্ত গোমরাহী থেকে, আমলের গোমরাহী, আখলাকের গোমরাহী এবং চিন্তা ও ফিকিরের গোমরাহী থেকে নিরাপদ থাকবে।

যিন্দেগীতে যদি কামিয়াবি চাও তাহলে মা-বাবার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা কর। মায়ের সাথে (এবং বাবার সাথে) এমন আচরণ কর যাতে তোমার কথা মনে হলে তাদের চোখে পানি এসে পড়ে। খুশির কারণে এবং সন্তুষ্টির কারণে। কখনও মা-বাবার মনে কষ্ট দিও না, যদি তাদের দিলে কষ্ট এসে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মাফ চেয়ে নাও এবং তাদের মনের কষ্ট দূর করার চেষ্টা কর। সবসময় তাদের জন্য এই দুআ করতে থাকো :

 

 

ক্রোধ, ঝগড়া-বিবাদ এবং হিংসা-হাসাদ এগুলো মানুষের ভিতরের ও বাহিরের সকল সৌন্দর্য নষ্ট করে ফেলে। সুতরাং ক্রোধকে দমন করার চেষ্টা কর। পরিচিত-অপরিচিত, ছোটবড় সকলের সঙ্গেই ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাক। কারো ভালো কিছু দেখে তার প্রতি হিংসা কর না, কারণ সেটা তাকে আল্লাহ দিয়েছেন। আর আল্লাহর দানের প্রতি হিংসা হবে বরবাদির কারণ। তুমি গিবতা কর অর্থাৎ আল্লাহর কাছে চাও যেন তোমাকেও তিনি তা দান করেন।

কখনও অহংকার কর না, অহংকারী ব্যক্তি হল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত। অহংকার মানে নিজেকে বড় মনে করে, অন্যকে ছোট মনে করা, নিজের দোষ সম্পর্কে বেখবর থাকা এবং অন্যের দোষ চর্চা করা। আল্লাহ যে সকল গুণ দান করেছেন সেগুলোকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে না করে নিজের যোগ্যতা দ্বারা অর্জিত মনে করা। অহংকারের বিপরীত গুণ হল বিনয়। অর্থাৎ নিজেকে ছোট মনে করা এবং অন্যকে বড় মনে করা, আর নিজের যাবতীয় গুণকে শুধু আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করা। আল্লাহ যেন মাদরাসাতুল মদীনাহর প্রতিটি তালিবে ইলমকেই বিনয়ের গুণ দান করেন। বিনয় যেন হয় তাদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য। যা কিছু ক্ষুদ্র, তুচ্ছ ও হীন সেগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখবে, আর যা কিছু বড়, মহৎ ও সুন্দর সেগুলো অর্জন করার চেষ্টা করবে।

বাইতুল্লাহর মুসাফির বাইতুল্লাহর সামনে বসে দিলের দরদের কালি দিয়ে এই কথাগুলো তোমাদের জন্য লিখে পাঠালো, আরো অনেক কথা লেখার ছিল তবে আমলের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

আমার আদরের ছোট ছোট তালিবানে ইলম, ফুল বাগানে ফুলকলি যেমন তেমনি তোমরা হলে মানব বাগানের মানবকলি, মানব বাগানে একদিন তোমরা ফুল হয়ে ফোটবে এবং ইলমের, আমলের এবং চিন্তা-চেতনার সুবাস ছড়াবে-এ আশাই করছি আল্লাহর কাছে। আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার সময় তোমাদের জন্য এবং তোমাদের পরে তোমাদের মতো যারা আসবে তাদের জন্য আমি দুআ করেছি। তোমরা শুধু আমার তিনটি নছীহতের উপর আমল করার চেষ্টা কর, মা-বাবাকে খুশি কর, তাদের মনে কখনও কষ্ট দিও না, কখনও মিথ্যা কথা বলো না এবং অভদ্র কোনো আচরণ করো না, সময় নষ্ট করো না এবং লেখাপড়ায় অবহেলা করো না। এই তিনটি উপদেশ যদি মেনে চলো তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমাদের জীবন হবে ফুলের মতো সুন্দর। আমি তোমাদের সবার জন্য দুআ করি এবং সবার কাছে দুআ চাই, আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে কবুল করেন। আমীন। 

তোমাদের খাদেম

আবু তাহের মেছবাহ

১৫-১২-২৯ হি.

 

 

 

advertisement