রবিউল আউয়াল ১৪৩০   ||   মার্চ ২০০৯

স্ব দে শ : দায়বদ্ধতা কার কাছে?

ওয়ারিস রব্বানী

চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজে দেশ ছেয়ে গেছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন নবনির্বাচিত সরকারের    মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও থানা কম্পাউন্ডে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন। পরদিনের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে তার এ বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেদিন ওই বক্তব্য দেন ওই দিন থেকে নিয়ে তার এক সপ্তাহ আগে ও পরের সংবাদপত্রগুলোতে দেখা গেছে, ঘটনা কেবল চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজের কর্মকান্ডে সীমাবদ্ধ নেই। ছিনতাই, দখল ও হামলা-খুনের ঘটনাও সমানে ঘটে চলেছে। একটি মোটর সাইকেলের জন্য একজন মিডিয়াকর্মীকে খুন করা হয়েছে। রাজনৈতিক রেশারেশির ঘটনায় নির্বাচনের পরের দিন থেকে শাসকদলের কর্মীদের পক্ষ থেকে খুন-জখমের ধারাবাহিকতা পুরোদস্ত্তর বজায় আছে। এটা যেন   অ-শেষ ধারাবাহিক একটি দায়িত্ব। বিজয়ীদলের কর্মীরা এ দায়িত্ব পালনে একদিনের জন্যও শৈথিল্য প্রকাশ করতে চাননি। নতুন সরকার আসার পর  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম কয়েক দিন পরাজিত দলের কর্মীদের হলছাড়া, সিটছাড়া করার কাজ চলেছে বাধাহীনভাবে। ইদানীং বন্দুক উঁচিয়ে নিজেদের মধ্যেই চলছে লড়াই।

মহল্লায় মহল্লায় ঘুমিয়ে থাকা সন্ত্রাসের বরপুত্ররাও আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছেন। আর নামী-দামী গডফাদাররা সম্বর্ধনা নিয়ে আদালতে-এলাকায় নরম-গরম হুংকার দিচ্ছেন। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন-চাঁদাবাজ-দুর্নীতিবাজে দেশ ছেয়ে গেছে তখন তার সত্যকথনের বাধ্যবাধকতা বুঝতে অসুবিধা হয় না। দায়িত্ব পাওয়ার পরপর একটি বিপরীত ও বেফাঁস মন্তব্য করে তিনি আলোড়ন তুললেও এখন সম্ভবত বাস্তবতা আর এড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তবতার এ স্বীকারোক্তির জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু এ স্বীকারোক্তির পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে যেভাবে সক্রিয় ও ক্ষিপ্র করা দরকার তার কোনো লক্ষণ সেভাবে ফুটে উঠছে না; বরং সরকারী দলের অনুগত কোনো কোনো অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম কোথাও কোথাও একমাস-দুমাসের জন্য স্থগিত করে সেটাকেই ব্যবস্থা গ্রহণের নজীর হিসেবে মিডিয়াতে পেশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অন্যায় করলে কাউকে ছাড়া হবে না। বলা হচ্ছে, নতুন করে কারো যোগদানের প্রয়োজন নেই। বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কেবল সরকারী দলের আনুগত্যের সিলমোহর গায়ে লাগিয়ে নিলেই সব ধরনের ছাড় পাওয়া যাচ্ছে। ২৪ ফেব্রুয়ারির একটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম করা হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলাপ্রশাসক ও ম্যাজিষ্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার জন্য সংস্থাপন সচিবের বরাবর আবেদন জানানো হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতিতে তারা মনে করছেন বিচারিক ক্ষমতা ছাড়া এখন আর স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করা এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এসব বিষয়ের দিকেও নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মনোযোগ দেওয়া দরকার। তা না হলে প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা ও দুর্বলতায় পরিস্থিতির অবনতি এমন মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে, যেখান থেকে ভালো কোনো অবস্থার দিকে ফিরে আসা আর সম্ভব হবে না।

এ পর্যায়ে বিনয়ের সঙ্গে একটি বিষয় আমরা নব নির্বাচিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সামনে পেশ করতে চাই। সেটি হচ্ছে, দলের ছাত্র-যুব কর্মীদের অনেক ন্যয়-অন্যায় আবদার-আচরণকে অনেক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো এজন্য সহ্য করে নেয় যে, দলের দুরাবস্থা বা ক্ষমতাহীনতা চলাকালে তারা গায়ে গতরে ভূমিকা রেখে দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এজন্য সরকারী দল একটা দায়ের চাপে থাকে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির এবারকার ক্ষমতাহীনতারকালে (জোট সরকারের পাঁচ বছর ও তত্ত্বাবধায়কের দু বছর) ছাত্র-যুব কর্মীদের কোনো ত্যাগী ও ঝুকিপূর্ণ সার্ভিস তারা পাননি। প্রতিবাদ, সংগ্রাম কোনো পর্যায়েই নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ওয়ান ইলেভেনের পর গ্রেফতার করে নেওয়ার দিন থেকে মুক্তির দিন পর্যন্তও কোনো ছাত্র-যুব গ্রুপ ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামেনি। সুতরাং এখানে দায়বদ্ধতার কোনো বোঝা এবার অন্তত ক্ষমতাসীন দলটির ওপর ছিল না। তারা কিছুটা ঝরঝরে অবস্থায় ক্ষমতায় এসেছেন। এরপর তো তাদের পেছনে কোনো টান অনুভব করার কথা নয়। দিন বদলের ডাকে দেশের যে জনগণ আস্থা রেখে তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছেন, সেই জনগণের প্রতি পুরোপুরি দায়বদ্ধ থেকে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করলে তাই তারা সুফল পেতে পারেন। #

 


 

 

advertisement