রবিউল আখির ১৪৩০   ||   এপ্রিল ২০০৯

প্র তি কূ ল তা : চাই যোগাযোগ ও বোঝাপড়া

আবু তাশরীফ

বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব সমাজের একটি অংশকে যেকোনো সময়ে সংশয়ের মুখোমুখি করে দিতে পারে। সংশয় থেকে ঝুঁকি ও বিপদের ঘনঘটা শুরু হয়ে যেতে পারে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে মাদরাসাগুলো এবং ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আলেমসমাজের যে কারো জন্য সমাজ-বিচ্ছিন্নতার কিছু কিছু বিষয় বিগত কয়েক বছর যাবত বিভিন্ন রকম পেরেশানি ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে এসেছে। অবশ্য মাদরাসা কিংবা আলেমদের পক্ষে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন সম্ভবও নয়। কারণ, মাদরাসা

এবং আলেম-ওলামার সেবা বা পেশার ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতার হাত এগিয়ে আসে সমাজের ভেতর থেকেই। তবে, সমাজের কিছু বিত্তবান এবং বহুলাংশে সাধারণ মানুষের সে সহযোগিতাটি আসে কিছুটা বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়েই। দূর থেকে দিয়ে যাওয়ার মতো।

প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা তাদের সবার সঙ্গে হয় না। অতি অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এটিই সাধারণ চিত্র।

এখন এমন একটি সময় যাচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী ব্যক্তিগণ সন্দেহ-সংশয়ের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছেন। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনো রকম নেতিবাচক ধারণার অবকাশই নেই তাদেরকেও যখন তখন সংশয়ের শিকার ও নাজেহাল করাটা ডালভাত হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটা বেশিমাত্রায় ঘটলেও উন্নয়নশীল মুসলিম দেশগুলোর ভেতরেও এটা ঘটে চলেছে অল্পবিস্তর। এক্ষেত্রে প্রথমে স্থানীয় মিডিয়া, তারপর আন্তর্জাতিক মিডিয়া তারপর কূটনৈতিক চাপ এবং প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ পুরো পরিস্থিতিকে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোলাটে করে দিতে পারে এবং দিচ্ছে। এসব পরিস্থিতিতে সবচেয়ে মারাত্মক যে বিষয়টি লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠে সেটি হচ্ছে, প্রশাসনের কোনো স্তর কিংবা সমাজের ভেতর থেকে সাধারণ মানুষের কোনো একটি অংশ এবং প্রতিনিধিত্বশীল বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ ও স্থানীয় মিডিয়াকে সংশয়াক্রান্ত ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যায় না। বরং উল্টোটাই বেশি ঘটে। সন্দেহে ও আতংকে সবাই আরো দূরে সরে যায়। এই বেদনাদায়ক চিত্রের পেছনে অনেক কারণ লুকায়িত থাকতে পারে, কিন্তু প্রধান যে কারণটিকে এর জন্য দায়ী করা যায়, সেটি হচ্ছে সমাজের এসব ফ্যাক্টর শ্রেণী বা মহলের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের গভীর ও পরিষ্কার একটি সমঝোতা বা বোঝাপড়ার সেতু পূর্ব থেকেই না থাকা। তাই কোনো ইনভেস্টিগেশনগত পদক্ষেপের ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সংশয়গ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত হতে থাকলে সমাজের ফ্যাক্টর শ্রেণীগুলোর কেউ এগিয়ে আসতে চান না। স্পষ্ট ধারণা ও অবগতি না থাকায় এবং পরিষ্কার ও গভীর যোগাযোগ না থাকায় সেই শ্রেণী বা মহল প্রোপাগান্ডার স্রোতের মুখে দাঁড়িয়ে ঝুঁকি নিতে চান না। বরং প্রচার- প্রোপাগান্ডায় তারা কিছুটা বিভ্রান্তই হয়ে যান। মেকি রহস্যময়তার চাদর দেখে থমকে দাঁড়ান। এরপর যখন আসল সত্য উদঘাটিত হয়, উষ্কানো উত্তেজনা থিতিয়ে আসে তখন অনেক ক্ষতি ও দুর্ভোগের ঘটনা সম্পন্ন হয়ে যায়।

যোগাযোগ ও বোঝাপড়া যেমন সমাজের অপরাপর অংশের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরের সঙ্গেও স্থাপন করতে হবে। বিশেষত জেলা, থানা ও ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী মহলের সঙ্গে সংশয় কাটানো, স্বচ্ছ ও আস্থাপূর্ণ যোগাযোগ থাকা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মহল ও ব্যক্তিবর্গের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মাদরাসা, মসজিদে তাদরকে দাওয়াত করে আনা, প্রায়ই আনাগোনা ও যোগাযোগ বজায় রাখা উভয় মহলের জন্য সুফলদায়ক।  এ ক্ষেত্রে আত্মমর্যাদা, শৃঙ্খলা ও সৌজন্যের নীতি বজায় রাখাও প্রত্যাশিত।

এ পর্যায়ে আরেকটি বিষয়ে নজর দেওয়া যায়। জাতীয়, স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো স্পর্শকাতর ধর্মীয় ইস্যুতে সমর্থন দান কিংবা ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করা মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। আলেমসমাজের মাঝে এ দায়িত্বের অনুভূতি তুলনামূলক বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের পক্ষ থেকে এসব ক্ষেত্রে সমর্থন দান কিংবা ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ব্যক্ত হওয়াও যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সুতীক্ষ্ম নজর ও মনোযোগ রাখতে হবে-যেন কোনো অবস্থাতেই হঠকারী ও উগ্রতা প্রকাশক কোনো ঘটনার সূত্রপাত না ঘটে। বিশেষত আইন হাতে তুলে নেওয়া কিংবা আইন ভঙ্গের ঘটনা ঘটানো কিছুতেই সুফল ও সফলতা নিয়ে আসতে পারে না। এতে প্রতিবাদকারীদের মনোযোগ একদিকে নিবদ্ধ থাকলেও বড় ইস্যু দাঁড়িয়ে যেতে পারে তাদের প্রতিকূলে। এটা এমনিতেই উচিত নয়। তাছাড়াও দেশ, সমাজ, দুনিয়া, পরিস্থিতি এবং জনমতের সার্বিক চিত্র বিবেচনায় নিলে এ বিষয়ে অধিক সতর্কতা বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। চারদিকের অবস্থার নাজুকতা না বুঝলেই কেবল এ বিষয় সতর্কতা রাখার বিষয়টিতে গা-ছাড়া ভাব প্রকাশ করা যেতে পারে, অন্যথায় নয়। সাধারণ মানুষের মাঝে কোমল পদ্ধতিতে, ইসলাহ ও হেদায়েতের শাশ্বত ধারায় ইসলাম, শ্লীলতা, শুদ্ধতা ও শাশ্বত কল্যাণের পক্ষে মনোভাব গড়ে তোলার কাজটি করার এখন বেশি উপযোগী সময়। প্রতিবাদী ভাষা ব্যক্ত করার মতো ক্ষেত্র আসলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এগিয়ে যাওয়াই কাম্য।

বিপরীত দিক থেকে দেখলে সমাজের যত মহল ও ব্যক্তি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের আওতায় আসবেন তত লোকের জীবনে দ্বীনী প্রভাব ও পরশ লাগবে। সেদিক থেকে যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার বিষয়টি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের কাছে ব্যাপকভাবে কাঙ্খিতই হওয়ার কথা। আর এ যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার কারণে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সবকিছুই প্রভাব সম্পন্ন স্তর ও শ্রেণীর কাছে থাকবে স্বচ্ছ ও সংশয়াতীত। ভালোর পক্ষে সহজাত অবস্থানের মতোই যেকোনো সংকট, সংশয় ও ষড়যন্ত্রের সময় এ শ্রেণীগুলোর সক্রিয় সমর্থন লাভ তখন দুরূহ বিষয় হয়ে থাকবে না। দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের ইতিবাচক ও সুন্দর সব প্রোগ্রামে অধিকতর মানুষ ও মহলের অংশগ্রহণ বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে আনুকূল্য ও সহযোগিতা ও আত্মমর্যাদা ও সৌজন্য বজায় রেখে তাই সর্বাত্মক বোঝাপড়া ও যোগাযোগের সেতু নির্মাণ করা এখন মাদরাসা ও মাদরাসা সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্র ও মহলের জন্য একটি দরকারী বিষয় বলা যেতে পারে। এমনিভাবে অন্যান্য দায়িত্বশীল মহলেরও কর্তব্য সমাজের এ বিশাল ও অপরিহার্য অংশটিকে অযথা হয়রানী না করে বা সন্দেহের চোখে না দেখে তাদের সাথে মেশা এবং তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া, তাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে সঠিক অবগতি হাসিল করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া।

 

 

 

 

advertisement