রবিউল আখির ১৪৩০   ||   এপ্রিল ২০০৯

প্র চা র ণা : তিল যখন তাল হয়

খসরূ খান

ভোলার বোরহানউদ্দীনের রামকেশব গ্রামের গ্রিন ক্রিসেন্ট থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে প্রথম দিন খুব উল্টাপাল্টা মাতামাতি হয়েছে। গ্রিনক্রিসেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানটিকে মাদরাসা এবং এর ছাত্র-শিক্ষককে মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক হিসেবে প্রচার দেওয়া হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারের দিন (২৪ মার্চ ০৯ মঙ্গলবার) ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে এবং পরের দিন প্রায় সবকটি দৈনিক পত্রিকায় ভোলার বোরহানুদ্দীনে মাদরাসার জঙ্গি ঘাটি থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের খবর ছবিসহ প্রচার হয়েছে। এর পরপরই শুরু হয়েছে মাদরাসাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো এবং জঙ্গিতৎপরতার ক্ষেত্র হিসেবে মাদরাসাগুলোকে টার্গেট করার ব্যাপক চিৎকার। অনেক মিডিয়ায় এ-নিয়ে এক রকম উৎসব শুর হয়। গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ডাকা মিডিয়া সম্পাদকদের বৈঠকে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই দুসম্পাদকের তর্কাতর্কির মাঝে প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলে ফেলেন-মাদরাসাগুলোর বদনাম হয়েছে। সে বদনাম দূর করতে হবে।

কিন্তু ঘটনার পর তিন-চার দিন অতিবাহিত হতে হতেই বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সেই গ্রিনক্রিসেন্ট যে আদৌ কোনো মাদরাসা ছিল, তারই কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। রিপোর্টগুলোতে ফুটে উঠেছে-এটি মাদরাসা নয়, এখানে যে বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া হতো, সেখানেও মাদরাসায় পাঠ্য কোনো কিতাবপত্র পাওয়া যায়নি। মাদরাসার সিলেবাস সম্পন্ন করা কোনো আলেমও তার শিক্ষক ছিলেন না। অথচ এই গ্রিনক্রিসেন্টের ওপর ভিত্তি করেই ভোলা এবং গোটা দেশজুড়ে কওমী মাদরসাগুলোর দিকে অভিযোগ ও সন্দেহের আঙুল তোলা হচ্ছে। গ্রিন ক্রিসেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানটি থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও মাদরাসাকে জড়িয়ে প্রচারণার বিষয়টি দিন দিন নতুন রহস্য ও সংশয়ের সৃষ্টি করছে। ২৯ মার্চের ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপানো রিপোর্টটির শুরুতেই লেখা হয়েছে-ভোলার বোরহানউদ্দীনের গ্রিন ক্রিসেন্ট এনজিও ভবন এলাকা কোনো মাদরাসাও নয় এতিমখানাও নয়। সকল অবৈধ কর্মকান্ড আড়াল করার জন্য কিছু নয়-দশ বছর বয়সী শিশু ধরে এনে মাদরাসার আদলে পড়াশুনা করানো এবং আবাসিক ব্যবস্থা রেখে প্রশাসনের চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র। আরো বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টে ফুটে উঠেছে যে, এটি কোনো মাদরাসা নয়, মাদরাসা ছিলও না। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এটিকেই মাদরাসা বলে চালানো হয়েছে এবং এটিকে ভিত্তি করেই সব কওমী মাদরাসাকে চাপে ও আতংকে রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

অপরদিকে দৈনিক আমার দেশ-এর ৩০ মার্চ ও ৩১ মার্চ সংখ্যাদুটিতে গ্রিনক্রিসেন্ট বিষয়ক রিপোর্টে আরো সব পিলে চমকানো তথ্য ছাপানো হয়েছে। ৩০ মার্চের রিপোর্টের শিরোনাম হল : গ্রিন ক্রিসেন্টে অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক উদ্ধারে স্থানীয় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। রিপোর্টের ভিতরে যেসব সাক্ষীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সাক্ষাতকার নিয়ে জানানো হয়েছে-তারা সেখানে গিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করতে দেখেননি, অস্ত্রগুলো সাজিয়ে রাখা অবস্থায় দেখেছেন। রিপোর্টটিতে আরো লেখা হয়েছে-সবাই ধারণা পেয়েছিলেন এটি একটি মাদরাসা এবং এখানে ছেলেদের কেবল ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু প্রকৃত তথ্য তা নয়। এটি মাদরাসা নয়। এটি একটি

এনজিওর এতিমখানা। ৩১ মার্চের রিপোর্টের শিরোনাম ছিল : গ্রিন ক্রিসেন্টে অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক উদ্ধারের আগেই সংবাদ প্রচার। রিপোর্টে লেখা হয়েছে-অস্ত্র উদ্ধারের সংবাদ প্রচার হয়েছে বেলা দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে। আর এজাহারে বলা হয়েছে, তাদের অভিযান শুরু হয়েছে বেলা ২ টা ১০ মিনিটে। এটা কিভাবে সম্ভব হল? এতে বড় রকম প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি কি তাহলে পূর্ব থেকেই সাজানো ছিল?  নাকি আসামীদের বাঁচানোর জন্য এজাহারে ইচ্ছাকৃত ত্রুটি ঘটানো হয়েছে? নাকি মূল বিষয়ের চেয়ে প্রচারণা চালানোটাই মুখ্য বিষয়? ২৯ মার্চ আমার দেশ-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে-গ্রিন ক্রিসেন্টের অবস্থান জনবসতি থেকে দূরে ও নির্জন স্থানে বলে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা ভুল। সেটা জনবসতির মধ্যেই। চারপাশে খনন করা খাল নিয়ে যে রহস্যের গন্ধ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেটাও বাস্তবসম্মত নয়। ওই এলাকায় প্রায় বাড়িতেই সীমানায় এরকম খালখনন করা আছে। স্থানীয় শিশুদের

পরিবর্তে দূরবর্তী অঞ্চলের শিশুদের গ্রিনক্রিসেন্টে পড়ানো হতো বলে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা-ও অসত্য। ওখানে পড়াশুনা করা সবকটি শিশুর বাড়িই ওই ইউনিয়নের ভিতরেই। গ্রিনক্রিসেন্ট কোনো কওমী মাদরাসা কিংবা মাদরাসাই নয়, সেখানে তল্লাশি করে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে-এটাও প্রমাণিত নয়। লোকজন এসে দেখেছে-একটি ঘরের বারান্দায় অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এতসব কিছু সত্ত্বেও ওই ঘটনাটিকে ধরে সব মাদরাসাকে তটস্থ করে তুলতে চাওয়া মূলত তিলকে তাল বানানোরই চেষ্টা।

এমন তিলে তালে মিলিয়ে পদক্ষেপ নিলে দ্রুতই পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। দেশের ক্ষতি হবে। বিদেশী আগ্রাসনকামী শক্তির স্বার্থ চমৎকারভাবে পুরা হবে। দেশের ভেতরে কারো কারো রাজনৈতিক বদ উদ্দেশ্যও হাসিল হবে। সরকারের উদ্দিষ্ট জঙ্গিদমনের কাজ কিছুই হবে না। এ সত্যটি কি প্রশাসন একদমই বুঝেন না? বুঝি না। #


 

 

advertisement