রবিউল আখির ১৪৩৬   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৫

রণক্লান্ত এক সেনাপতির শয্যাপাশে

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালের নবম তলায় যখন তাঁর কেবিনের সামনে পৌঁছলাম, তখন বুক আমার দুরু দুরু করছে। লিফট থেকে নেমে করিডোর ধরে যখন হাঁটছি তখন ছেলেরা অভ্যাসমত শক্ত করে আমার হাত ধরে রেখেছিল। পাশে আহলিয়া আমাদের সবাইকে সতর্ক টেককেয়ারে রেখে দৃপ্ত পায়ে এগুচ্ছিলেন। স্বাভাবিক গতিতে বড় পুত্রের হাত ধরে হেঁটে যাই ৯৭৩ নাম্বারের দিকে। ছোট পুত্র তার মাকে সাথে করে প্রবেশ করে ৯৭২-এ, যেখানে রয়েছেন এই ক্লান্ত সেনানায়কের মুহতারামা জীবনসঙ্গিনী। ৯৭৩-এ সেনাপতি নিজে। ঘটনাক্রমে তাঁরা দুজনই এখন রোগী হয়ে হাসপাতালে।

দরোজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করা মাত্রই হুযুর আমাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। চেহারায় তাঁর ভেসে উঠে আনন্দের উজ্জ্বলতা। কিন্তু আমি বুঝি তাঁর রোগযন্ত্রণা, তাঁর বিষণ্ণতা। তাঁর ভেঙ্গে যাওয়া স্বাস্থ্যের বিপন্নতা। অতি সুদর্শন নূরানী মুখাবয়বে বয়স ও রোগস্পর্শের ছাপ। পরিশ্রান্ত অভিযাত্রীর এলিয়ে দেয়া দেহ যেন শয্যার আশ্রয় ছাড়া নিরুপায়। ক্ষীণকণ্ঠে বলতে লাগলেন, তুমি এসেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার শরীরে নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে, বিছানায় শুয়ে আলস্নাহ আলস্নাহ করেই সময় কাটে। দীর্ঘ কোনো লেখা ধৈর্য ধরে পড়ার শক্তি নেই। তোমার কোনো লেখা হাতে পেলে কষ্ট করে হলেও পড়ি। মনে শামিত্ম পাই। খাদেমকে বলেন, নাশতা ও ফল-ফ্রুট দিতে। তাগাদা দেন, চা করে দিতে।

আমি তাঁর শিয়রের দিকে চেয়ারে বসে টুকটাক কথা বলি, তাঁর কষ্ট করে বলা কিছুটা অস্পষ্ট কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনি। আর বারবার কিছু লাগবে না, কিছু করতে হবে না ইত্যাদি বলতে থাকি। কিন্তু তিনি একজন সেণহময় পিতার মতই সন্তানের মুখে একটা কিছু তুলে দেয়ার অস্থিরতা নিয়ে খাদেমকে কেবলই তাগাদা দিয়ে যান। আমি নীরবে তাঁর কথা শুনতে থাকি। হাত দু’টো ছুঁয়ে দেখি, মাথা ও মুখে আলতো স্পর্শ দিই। এরিমধ্যে ছোট ছেলেটিকেও তিনি পাশের কেবিন থেকে ডেকে পাঠান। খাদেমকে বলেন, আমার দাদাভাইদের আঙুর বের করে দাও। ওদের মুখে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন আর সুন্দর জীবনের জন্য দুআ করতে থাকেন।

চেয়ে দেখি ট্রলি টাইপের টেবিল লাগিয়ে কমলা, আঙুর, বিস্কিট আর চা দেয়া হয়ে গেছে। আমি একটু চা নিলাম। বললেন, চিনি ছাড়া চা। তোমারও তো ডায়াবেটিস, ফ্লাস্ক থেকে আরেকটু চা নিয়ে খাও। তাঁর কথা মত আরেকবার চা নিলাম। মনে হল, চায়ের কাপে আমার প্রতিটি চুমুক যেন তাঁকে স্বসিত্ম দিচ্ছে। দুই আহমাদকেও বললাম, খেতে ইচ্ছে না করলেও তোমরা দু’একটা কমলার কোয়া ও আঙুরের দানা মুখে দাও। তোমাদের দাদা ছাহেব মনে তৃপ্তি পাবেন।

এরিমধ্যে সেবিকা এসে রক্তের চিনি মাপল। সুঁই ফোটানোর শিল্প তারা ভালোই জানে। হাসিমুখে এসে বলল, নানা! একটু কষ্ট দিচ্ছি। হুযুর কষ্টের হাসি মুখে এনে বললেন, তোমাদের তো একটাই কাজ। আমি ভাবতে লাগলাম, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক কিছুই উন্নত ও সহজ হয়েছে কিন্তু সুঁই দিয়ে শরীর ফুটো করার কোনো বিকল্প বের হয়নি। নার্স যাওয়ার পর এলেন প্রফেসর ও সহকারী চিকিৎসকদল। রোগী সম্পর্কে তারা যা বললেন, এককথায় তা হচ্ছে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

ডাক্তাররা চলে গেলে আমি হুযুরের পাশে বসে সুন্নত অনুযায়ী রোগমুক্তির দুআ পড়লাম, সঙ্গীরা আমীন আমীন বলল। হুযুর আমাকে মরহুম খতীব ছাহেবের উপর প্রকাশিত একটি স্মারকগ্রন্থ দেখতে দিলেন। এতে তাঁর একটি নিবন্ধ ছিল, আমি সেটি পাতা উল্টে বের করে দিলে তিনিও চোখ বুলিয়ে দেখলেন।

 দুই

 বাংলাদেশের ইসলামী জ্ঞান ও সাহিত্য জগতে বিশেষ অবদানের জন্য খ্যাত বিশিষ্ট লেখক-সম্পাদক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাহেব বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় দীর্ঘদিন যাবৎ চিকিৎসাধীন। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় যাবৎ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদনার কৃতিত্ব তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। পশ্চাৎপদ বাঙালী মুসলমানের ঈমান-আকীদা, ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা, সামগ্রিক সচেতনতা এবং উন্নয়নের সংগ্রামে তরুণ বয়স থেকেই নিজেকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অশীতিপর জীবনে সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, কুরবানী ও অধ্যবসায়ের সময়টিও ষাট বছরের বেশি। প্রায় পঁচিশ বছর আগে আমি যেদিন প্রথম সাংবাদিকতা ও সম্পাদনার কাজকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করি, সেদিন তিনি বলেছিলেন, তুমি আজ শুরু করলে আর আমার এ কাজে ৪০ বছর পূর্ণ হলো।

ইসলামী দাওয়াহ-তালীম, মুজাহাদা ও বর্ণিল কর্মতৎপরতার প্রায় প্রতিটি অঙ্গনেই তাঁর প্রতিভাদীপ্ত সাহসী নেতৃত্বসুলভ ও মেধাবী অংশগ্রহণ ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে একবিংশের বিশের দশক জুড়ে মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এদেশের সামগ্রিক দ্বীনী আন্দোলনের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর যোগ্যতর সপ্রাণ উপস্থিতি এদেশের ইসলামী কর্মযজ্ঞে চিরদিন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তিনি একজন ব্যক্তিমাত্র নন। তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সংগঠন, একটি আন্দোলন। তিনি তাঁর চেষ্টা-সাধনা-সাহায্য ও প্রেরণায় শত শত চিন্তাবিদ, গবেষক এবং অসাধারণ কলমসৈনিক তৈরি করেছেন। এ অঙ্গনে তিনি অন্তত তিনটি প্রজন্মের শিক্ষক।

মৌলিক সৃষ্টি তাঁর অসাধারণ। মাসিক মদীনার অসংখ্য সম্পাদকীয় নিবন্ধ বাংলাভাষায় ইসলামী চিন্তার জগতে অনাগত বহু শতাব্দীব্যাপী মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। নানা বিষয়ে তাঁর সাময়িক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বিষয়ভিত্তিক গবেষণামূলক উদ্ভাবনী চরিত্রের লেখা জাতির জীবনে দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করে যাবে। তিন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা এই সাহিত্যগুরু ও কলমসৈনিকের মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থ (প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মিলিয়ে) হিসেব করলে এর সংখ্যা দাঁড়াবে শত শত। তাঁর শতাধিক প্রকাশিত গ্রন্থ এ দেশের মননশীল পাঠকশ্রেণীকে যুগ যুগ ধরে তৃপ্ত করে এসেছে। বৈরি পরিবেশে জীবন-সংগ্রামের সফল ও অনুসরণীয় প্রতিচ্ছবি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। দুই শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে বাংলার মাটিতে অতীত যুগের সংগ্রামী সাধকদের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি তিনি। মহান আলস্নাহ তাঁর স্বাভাবিক মানবীয় ত্রম্নটি মার্জনা করে তাঁর জীবনের সকল আবেগ-অনুভূতি, কর্ম-সাধনা ও নিবেদন কবুল করুন। আমীন

তিনি আজ জীবনের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে অনেকটাই ক্লান্ত। বয়সের ভারে যত না কাবু তার চেয়ে শর্করাজনিত নানা জটিলতায় আরো বেশি পর্যুদস্ত। এ সমস্যাটি মানুষকে নানামুখী উপসর্গের দিকে ঠেলে দেয়। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে দূরে। অনেকটা ঘরেই বসা, এমনকি বলা যায় প্রায় শয্যাগত। যদিও তাঁর ঈমানদীপ্ত তাজাপ্রাণ মেধা, চিন্তা, স্মৃতি ও চেতনা সুস্থ-সবল সক্রিয় রয়েছে। আল্লাহ তাঁকে আরো রহমত ও বরকতে বিভূষিত করুন।

নানা কারণে দীর্ঘদিন তাঁর সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি। ক’দিন আগে একটু সময় করে বিবি-বাচ্চাসহ তাঁর বাসভবনে গিয়ে শুনতে পাই তিনি বাসায় নেই। শারীরিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘটনাক্রমে তাঁর আহলিয়ার স্বাস্থ্যও খুবই খারাপ হওয়ায় তিনিও হাসপাতালে।

আমি বাসায় গিয়ে হুযুর এবং তাঁর আহলিয়া দুজনকেই না পেয়ে ফিরে আসি। এরপর বেশ কিছু কর্মব্যসত্মতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে গত ২৩ জানুয়ারি শুক্রবার সকালের দিকে তাঁদের দেখতে হাসপাতালে যাই। জুমার আযান হলে আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসি। হুযুর আমার বাচ্চাদের অন্তর খুলে দুআ ও শুভকামনা দান করেন। আমার জন্য তাঁর স্বভাবজাত হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, শুভকামনা ও অফুরন্ত নেক দুআর বাণী পুনরুচ্চারণের মাধ্যমে কিছু মূল্যায়ন, কিছু উপদেশ, কিছু ওসিয়ত, কিছু স্মৃতি তর্পণ করে আমাদের বিদায় জানান। আমরা পান্থপথের পাশে হাসপাতালের কেবিনে রণক্লান্ত এক শয্যাশায়ী সেনাপতিকে সালাম ও শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেদের ডেরায় ফিরে আসি।

 তিন

 ফিরতি পথে গাড়িতে বসে হুযুরের আহলিয়ার অবস্থা সম্পর্কে শুনছিলাম। ময়মনসিংহের এক ঐতিহ্যবাহী দরবেশ পরিবারের কন্যা এই বিদুষী পরহেযগার নারী বহু বছর ধরেই আমাকে পুত্রবৎ সেণহ মায়া-মমতায় জড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু একমুহূর্তের জন্যও আমার সামনে আসেননি। কঠোর শরয়ী ও সামাজিক পর্দা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

বহু বছর আগে আমার প্রথম হজ্বের সময়কার ঘটনা। মদীনা শরীফে হুযুর এবং তাঁর আহলিয়া রাজকীয় অতিথি হিসাবে পাঁচতারকা হোটেলে অবস্থান করছিলেন। আমি ছিলাম অন্য এক হোটেলে। রাতে জানতে পারলাম, তাঁরা পাঁচতারকা হোটেল ছেড়ে মসজিদে নববী সংলগ্ন মুসাফিরখানায় চলে আসতে চান। গভীর রাতে কক্ষে ফিরতেই ম্যানেজার এসে বলল, আপনার হুযুর এবং খালাম্মাকে রাজকীয় প্রটোকলের কর্মকর্তারা মুসাফিরখানায় নিয়ে এসেছেন। হুযুর খুবই অসুস্থ, মসজিদে নববী থেকে আপনি ফেরামাত্রই তিনি আপনাকে দেখতে চান বলে কাউন্টারে বলে রেখেছেন। আমি চোখের পলকে তাঁর কক্ষে গিয়ে হাজির হই। ভেতরে একটি বেডশিট টানিয়ে খালাম্মা আড়ালে চলে যান। হুযুর তখন জ্বরে কাঁপছিলেন। জ্বর মাপালাম ১০৩। হুযুর তখন আমাকে কিছু রিয়াল দিয়ে বললেন, নাসীম, বাবা তুমি এসেছ। আমি তিনদিন ধরেই জ্বরে ভুগছি। তোমার খালাম্মা মসজিদে যেতে পারছে না। তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও। আর আমার জন্য একটা কম্বল কিনে আন, কিছু নাশতা, ফল-ফ্রুট ও ওষুধ এনে রাখ, তোমার খালা বেচারির যেন খুব বেশি কষ্ট না হয়ে যায়। আমি তাঁর কথা মত সব কাজ করলাম। মুসাফিরখানার কিছু মহিলাকে খালাম্মার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলাম, তারা অবশ্যই যেন তাকে মসজিদে খুব খেয়াল করে আনা-নেয়া করেন, সে অনুরোধ জানালাম। মনে মনে ভাবলাম, এ যুগে এমন মা ফাতিমা ধরনের পর্দানশীন আর বিবি যয়নাব ধরনের ইবাদতগুযার মহিলা দুনিয়ায় খুব বেশি কি পাওয়া যাবে? হুযুরকে নিয়ে বাবে জিবরীল হাসপাতালে যাই, তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে যান। সেখানে ভারতের জৈনপুরের পীর ছাহেবকে দেখার সুযোগ হয়।

একটু সুস্থ হয়েই হুযুর আমাকে নিয়ে গাড়ি করে বের হন তাঁর স্বপ্নের পাক মদীনা ভ্রমণে। খালাম্মার জন্য পান সংগ্রহ করে দেন মদীনাপ্রবাসী ঢাকার এক আলেম। শেষরাতে আমরা মুসাফিরখানায় ফিরে আসি। এদিন পাকিস্তানের কিছু সিনেটর, আরবদেশীয় কয়েকজন আমির ও শেখ হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে ফিরে যান। অবশ্য পরদিন তাদের অনেকের সাথে আমাদের মসজিদে নববীতে দেখা হয়। এ সময় বসনিয়া হারজেগোভিনায় মুসলিম নিধন চলছিল। মদীনার ইমামগণ নিয়মিত কুনূতে নাযেলা পড়তেন।

দু’দিন পর হুযুর এবং খালাম্মাকে তাঁদের ছোট পুত্র এসে মক্কা শরীফ নিয়ে যান। তিনি তখন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি মদীনা শরীফ থেকে কয়েকদিন পর দুবাই চলে যাই। সুনির্ধারিত কিছু সেমিনারে বক্তৃতাসহ সপ্তাহখানেক বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগদান শেষে ঢাকায় ফিরি।

যতই বিস্ময়কর মনে হোক, কথাটি পাঠকের শুনে রাখা প্রয়োজন যে, তাঁকে আমি এ ক’দিনের ভেতর বোরকাবৃত অবস্থায়ও দেখার বা কে আমার খালাম্মা, তা বোঝার কিংবা চেনার সুযোগ পাইনি। এমনই তাঁর তাকওয়া ও সতর্কতা। অথচ আমি তাঁর তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ বছর কাটিয়েছি। বাসায় যাতায়াত করেছি, তাঁর ঘরের খানা দীর্ঘদিন খেয়েছি। হুযুর এবং খালাম্মাকে আল্লাহ দ্রুত সুস্থ করুন, দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। আমীন

 

চার

 

স্মৃতির পটে ভেসে উঠতে লাগল, তারুণ্যের আইকন, পৌরুষদীপ্ত সাহিত্যিক-সাংবাদিক গবেষক আলেম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। হাসপাতালের বেডে যে খান ছাহেবকে আমি দেখে এসেছি ইনি কি সেই মাসিক মদীনা-সম্পাদক যাকে আমরা জীবনভর দেখেছি। আমার সামনে ছবির মত ভেসে উঠল গত ২০/৩০ বছরের কিছু দৃশ্য।

এই তো বিমান অফিসের সামনে তাঁকে কেতাদুরস্ত পোশাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি সাইপ্রাস যাওয়ার টিকেট নিয়ে বের হয়েছেন, আববা ও আমার সাথে হোটেল পূর্বাণীতে লাঞ্চ করলেন। এই ইসলাম চেম্বারেই তো বারবার তাঁর সাথে দেখা। আলহাজ্ব জহুরুল ইসলামের সাথে দুপুরের খানা। আলহাজ্ব শফিউল ইসলাম কামাল সাহেবের সাথে কত শত বৈঠক ও আলোচনা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা পরিচালক ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুরের কাছে আমাকে পত্র লিখে দিয়ে প্রেরণ; ছেলেটির লেখার হাত ভাল, গফুর ভাই, তাকে লেখালেখির সুযোগ করে দিলে খুশি হব। মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দীকিকে বলে দেয়া, এই ছেলেটির লেখা আজাদে ছেপে দেবেন। ইরাক সফরের প্রোগ্রাম দিয়ে বায়তুল মোকাররমের খতীব চেম্বারে বসে দুপুরে খানা খাওয়ানো। বিসিআইসি মিলনায়তনে আলস্নামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর শেষ সফরের সময় সেমিনারে আমাকে দিয়ে মূল প্রবন্ধ তৈরি ও পাঠ করানো। দীর্ঘ দশ বছর তার মালিকানাধীন পত্রিকা সাপ্তাহিক মুসলিমজাহানে নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে লেখালেখি ও সাংবাদিকতা, বিশেষ করে সম্পাদনার কাজে হাত পাকানোর সুযোগ করে দিয়ে বলা যায় আমাকে নির্মাণ করা হয়েছে। কোনোরূপ পূর্ব প্রস্ত্ততি ছাড়াই দেশের অন্যতম প্রধান ও শীর্ষ একটি দৈনিকে প্রথম দিন থেকেই সহকারী সম্পাদকের পদ পেয়ে সুনাম ও দক্ষতার সাথে কাজ করার সাহস ও প্রেরণা তাঁরই ফয়েজ শুভাশিস।

পাঁচ

তিনি আমাকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম, টেকনাফ, কক্সবাজার, মহেষখালির সাগর-পাহাড়, জীবন-জগৎ যেমন ঘুরে ফিরে দেখিয়েছেন; জীবনের দুরূহ পাঠও তিনিই আমায় রপ্ত করিয়েছেন। স্বতন্ত্র লেখায় দীর্ঘ এসব আলোচনা সুযোগ হলে করব বলে আশা রাখি। আমি তাঁর কৌতূহলী জ্ঞান-গবেষণা, অসাধারণ অধ্যয়নস্পৃহা, অপরিসীম কর্মক্ষমতা, সরল জীবনযাপন, সাহসী, উদার ও ঐক্যকামী মনোভাব এবং শত শত অনুসরণীয় গুণ, সৌন্দর্য আর আদবকেতা থেকে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছি। আমার সকল কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি নিবেদিত, তাঁকে আমার দেয়ার তেমন কিছুই নেই। আমি তাঁর শুভস্মৃতি তর্পণ করতে পারি, তাঁর জন্য দুআ করতে পারি আর পারি তাঁর জীবনের মিশনকে আমার সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে নিতে, যদি আমি তাঁর আগেই চলে না যাই কিংবা নির্ধারিত সময়ে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার পরও আমি দুনিয়ায় বেঁচে থাকি।  হাসপাতালের বেডে শুয়ে বিদায়ের আগে তিনি আমায় বলেছেন, দুটি কথা তোমায় বলি বাবা শোন, আমার ‘মদীনা’র দিকে একটু নজর রেখো। মাঝেমধ্যে দু’একটি লেখা দিও। আর ময়মনসিংহের ওলামা-মাশায়েখ গ্রন্থে যে ক’জন মনীষীর আলোচনা সংযুক্ত হয়নি, তুমি সংশ্লিষ্টদের বলে সেসব যুক্ত করো। মুনশী আজিমুদ্দীন, ‘আসরারুস সালাত’-এর রচয়িতা মুনশী আব্দুর রহীম, আমার আববা মরহুম হাকীম মৌ. আনসারুদ্দীন খান প্রমুখ।

বললেন, গত রাতে বাদশাহ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল আযীয মারা গেলেন। সউদী আরবের অবস্থা কী দাঁড়াবে? নতুন বাদশাহ সম্পর্কে দু’একটি কথা বললেন। এরা সবাই তাঁর পরিচিত। বললেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানের কথা। বহুবার তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। এক সম্মেলনে এরদোগান তাঁর লাগোয়া চেয়ারে বসে অনেক কথাবার্তা বলেছিলেন। তিনি তুরস্কের এই নেতার ব্যাপারে খুব আশাবাদী। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়েও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য করলেন। একসময় তাঁর আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি তাকে নিবৃত্ত করে বিদায়ের কথা পাড়লাম। স্মৃতি আর ছবি নিয়ে শুধু ভেবেই যাচ্ছি। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি বাসায় পৌঁছে যায়। গাড়ির দরোজা খুলে ছেলেরা আমায় নামতে বললে আমি সম্বিত ফিরে পাই। 

 

 

advertisement