সফর ১৪৩৬   ||   ডিসেম্বর ২০১৪

তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-৪

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

***

হায়দারাবাদ এখান থেকে কোন্ দিকে? মানচিত্রটা আবার মেলে ধরলাম। সত্যি বিশাল এক দেশ! বর্তমান পাকিস্তানের আয়তন বাংলাদেশের কয়েকগুণ, মানচিত্রে সেই পাকিস্তানও ভারতের কাছে যেন ছোট্ট একটুকরো ‘গরুর গোশত’!

এই যে হায়দারাবাদ, যার নাম বদলে ওরা রেখেছে অন্ধ্রপ্রদেশ। দিল্লী থেকে সোজা দক্ষিণে। সড়কপথে দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার। নাহ, দাদারা খাঁচায় যদি আটকে নাও রাখতো হায়দারাবাদ যাওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু আজ না হোক, কাল ইনশাআল্লাহ হায়দারাবাদ আমি যাবো; আমার প্রিয় ‘হিন্দুস্তান’ ঘুরে ঘুরে আমি দেখবো। দেওবন্দ, সাহারানপুর গিয়ে চোখের জ্বালা জোড়াবো; আবারও বলছি, ইনশাআল্লাহ! হৃদয়ে স্বপ্ন যদি থাকে, সত্যিকারের স্বপ্ন, আল্লাহ তা অবশ্যই পূর্ণ করেন।

মানচিত্রে তাকিয়ে আছি হায়দারাবাদের দিকে, আর ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায় ভাসছে আমার চোখের সামনে। হায়দারাবাদের কাহিনী সত্যি বড় মর্মামিত্মক। কাশ্মীরকে তো গিলতে গিয়েও ওরা গিলতে পারেনি, একটা অংশ আযাদ, আরেকটা অংশ আটকে আছে ওদের গলায়, কিন্তু

হায়দারাবাদ! দিব্বি গিলে হযম করে ফেললো! অবশ্য এটাই ছিলো স্বাভাবিক পরিণতি। হায়দারাবাদী শাসকদের বলা হতো নিযাম। শেরে মহীসূর সুলতান ফাতেহ আলী খান টিপু যখন পুরো হিন্দুস্তানের আযাদীর জন্য ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জান বাজি রেখে লড়াই করছেন, তখন নিযাম বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজ ও মারাঠাদের পক্ষ নিয়ে সুলতান টিপুর পিঠে ছুরি বসিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসঘাতকতারই মাশুল সর্বশেষ নিযামকে দিতে হয়েছে। দুঃখ শুধু এই যে, সে মাশুল একা নিযামের ছিলো না, ছিলো হায়দারাবাদের পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর।

হায়দারাবাদের আয়তন কত? মানচিত্র বলছে, ২৭৫০০০ বর্গ কিলোমিটার, অর্থাৎ বাংলাদেশের  প্রায় দ্বিগুণ।

শুরু থেকেই হায়দারাবাদ ছিলো অতি সম্পদশালী রাজ্য। এমনকি নিযামের নিজস্ব সম্পদের পরিমাণও ছিলো মানুষের কল্পনার বাইরে, যা প্রায় সবটাই চলে গেছে ভারতের উদরে। সামান্য কিছু বিমানযোগে পাকিস্তানে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছিলো। ইংরেজ সেনাপতির অধীন হায়দারাবাদের সরকারী বাহিনী ভারতের আগ্রাসনের মুখে ছিলো সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। লড়াই যা করার করেছে জিহাদি চেতনায় উদ্দীপ্ত হায়দারাবাদের মুসলিম তরুণরা, প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায়, যাদের পরিচয় ছিলো মিলিশিয়া তথা রাজাকার। তারাই বুকের তাজা খুন ঢেলেছে হায়দারাবাদের আযাদীর জন্য। পারেনি, পারা সম্ভবও ছিলো না; তবে নেহরুজীকে বলতে হয়েছে, ‘গোলাপ পেয়েছি, তবে সাদা গোলাপ নয়!

***

দিল্লীর জামে মসজিদ কোন্ দিকে, দ্বিতীয় মানচিত্র থেকে নির্ণয় করার চেষ্টা করলাম। এই যে! বিমানবন্দর থেকে উত্তরপূর্ব  দিকে, মাত্র সতেরো কিলোমিটার দূরে, ত্রিশ মিনিটের দূরত্বে।

 

মনটা কেমন করে উঠলো! একটু আগে এই মসজিদেই নামায পড়েছি মধুর স্বপ্নের মধ্যে! আহ, যদি তা বাস্তব হতো! দিল্লীর এই শাহী মসজিদে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী রহ. নামায পড়তেন এবং ওয়ায করতেন। বিশাল চত্বর তখন উপচে পড়তো মানুষের সমাগমে। এখানে নামায পড়েছেন বালাকোটের অমর শহীদ সৈয়দ আহমদ বিন ইরফান এবং শাহ ইসমাঈল রহ.। এই দিল্লীর জামে মসজিদেই এক গোপন মজলিসে তৈরী হয়েছিলো ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পরিকল্পনা, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলো মুসলিম-নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং হিন্দু-নেতৃত্বের ধূর্ততার কারণে, যা শেষ পর্যন্ত ডেকে এনেছিলো দিল্লীর মুসলমানদের কতলে আম। পুরো ইতিহাস যেন চোখের সামনে ভাসছে আমার। 

ভারত বিভাগের পরপর দিল্লীসহ সমগ্র ভারত যখন মুসলিম রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছে তখন এই মসজিদে দাঁড়িয়েই আযাদী আন্দোলনের সিপাহসালার মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনের শেষ ভাষণটি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন-

‘শাহজাহানের এ মসজিদে তোমাদের সামনে দাঁড়ানো এটাই আমার প্রথম নয়। এখান থেকে আগেও আমি তোমাদের ডাক দিয়েছি, যখন তোমাদের চেহারায় ছিলো হতাশার পরিবর্তে ইতমিনানের ছাপ। প্রতিটি দুর্যোগের মোড়ে আমি তোমাদের সতর্ক করেছি, কিন্তু তোমরা ছিলে গাফেল; পরিণতি আজ তোমাদের সামনে। ... এই যে পলায়নপরতা, যা তোমরা হিজরতের পবিত্র নামে গ্রহণ করছো, ভেবে দেখো, এর পরিণতি কী হতে পারে! এ দেশ ছেড়ে তোমরা কোথায় যাচ্ছো এবং কেন যাচ্ছো? এই দেখো, মসজিদের মিনার তোমাদের কাছে জানতে চায়, নিজেদের ইতিহাসের গৌরবময় পাতাগুলো কি তোমরা ছিঁড়ে ফেলেছো? এই তো কালকের কথা, যমুনার তীরে তোমাদের কাফেলা অযু করেছে, আর আজ তোমরা এখানে থাকতে ভয় পাচ্ছো! এই দিল্লী তো তোমাদেরই রক্তে সিঞ্চিত হয়েছে!

পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমি বলছি, তোমরা যদি বিতাড়িত হতে না চাও, কোন শক্তি তোমাদের বিতাড়িত করতে পারে না। .... আজ তোমরা ভূমিকম্পে ভয় পাও, অথচ তোমরাই ছিলে একদিন মহাভূমিকম্প! আজ এই সামান্য অন্ধকারে তোমরা ভীত, তোমাদের কি মনে পড়ে না, তোমরা নিজেরাই ছিলে জগদ্ব্যাপী আলো ও উজ্জ্বলতা! .... আমার যা বলার ছিলো বলেছি, শেষবারের মত আবার বলছি, নিজেদের সাহস ও মনোবল অটুট রাখো, স্থির ও অবিচল থাকো। তোমাদের জন্য নতুন কোন ব্যবস্থাপত্র আমার কাছে নেই, বহু শতাব্দীর সেই পুরোনো ব্যবস্থাপত্রই তোমাদের বাঁচার একমাত্র পথ, আর তা হলো কোরআনের সেই ঘোষণা-ولا تهنوا ولا تحزنوا وأنتم

ولا تهنوا ولا تحزنوا وأنتم الأعلون إن كنتم مؤمنين

الأعلون إن كنتم مؤمنين

‘তোমরা হীনবল হয়ো না এবং হয়ো না দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তোমরাই হবে বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও।’

এই হিম্মত ও সাহস দিল্লীর দোকানে পাওয়া যায় না যে আমি তোমাদের খরিদ করে এনে দেবো, এটা শুধু পাওয়া যায় দিলের দোকানে, যা খরিদ করতে হয় ঈমান ও আমলের নগদ মুদ্রা দিয়ে, ওয়াসসালাম।’

***

এই যে, কুতুব মিনার! এখান থেকে পূর্বদিকে, সড়কপথে মাত্র ১২ কিলোমিটারের দূরত্বে। দিল্লীতে এখন পাতাল রেল চালু হয়েছে। আমীর ছাহেব যখন শেষবার হিন্দুস্তান সফর করেন তখন পাতাল রেলের কাজ পুরোদমে চলছে। পাতাল রেলে আরো অল্পসময়ে এবং নির্বিঘ্নে কুতুব মিনার যাওয়া যায়। বহু শতাব্দীর ইতিহাসের অনেক উত্থান-পতন এবং দুর্যোগ-মহাদুর্যোগের নীরব সাক্ষী এই কুতুব মিনার, তবে যাদের শোনবার মত কান আছে তারাই শুধু শুনতে পায় কুতুব-মিনারের কান্না। কুতুব মিনার তাদের কাছে ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ.-এর একটি মর্মস্পর্শী লেখা হচ্ছে-المنـارة تتحدث

 

المنـارة تتحدث

কুতুব মিনার কথা বলছে

শুরুটা ছিলো এরকম যে, এক সন্ধ্যায় লেখক শহরের কোলাহল হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য দিল্লী থেকে বের হয়ে কুতুব মিনার গেলেন। লোকজন ছিলো না, অন্যসময় যেমন থাকে, সেই নির্জনতার মধ্যে হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন একটি কোমল বিষণ্ণ কণ্ঠ, ‘দাঁড়াও পথিক, আমার কিছু কথা শোনো ...’

একটি বাক্য এখনো মনে পড়ে, কুতুব মিনার বলছে, ‘এত শতাব্দী ধরে এত উত্থান-পতন দেখেছি যে, আমার দিল যদি পাথরের না হতো, ফেটে চৌচির হয়ে যেতো।’

শেষ বাক্যটি ছিলো এরকম, ‘যাও হে পথিক, তোমার কাউমকে আমার সালাম বলো, আর বলো, আমি কুতুব মিনার আজো দাঁড়িয়ে আছি তোমাদের ঘুম থেকে জেগে ওঠার প্রতীক্ষায়!’

বড় ভালো মানুষ ছিলেন এই আবুল হাসান আলী নাদাবী। বুকের মধ্যে একটা দিল ছিলো, বড় দরদী দিল। চিরকাল তা উম্মাহর জন্য ব্যথিত হয়েছে এবং উম্মাহর জন্য কেঁদেছে! তিনি আজ শুয়ে আছেন রায়বেরেলীর মাকবারায় তাঁর মহান পূর্বপুরুষদের পাশে। রায়বেরেলী এখান থেকে কতদূরে?! আবার মানচিত্র দেখি; এই যে লৌখনো, তার পাশে এই যে রায়বেরেলী। বিমানবন্দর থেকে উত্তর-পূর্বদিকে প্রায় ছয়শ কিলোমিটারের দূরত্বে।

আরেকটি মাকবারার কথা মনে পড়ে, দারুল উলূম দেওবন্দের মাকবারা কাসেমী, যেখানে মাটির নীচে গচ্ছিত রয়েছে হিন্দুস্তানের কত শত কোহে নূর!!! এখান থেকে কোন্দিকে এবং কত দূরে দারুল উলূম দেওবন্দ? মানচিত্র বলছে, উত্তর দিকে, একশ সত্তর কিলোমিটার দূরে।

***

যারা ভারত সফর করেছেন তাদের লেখা (উর্দূ ও বাংলা) সফরনামাগুলো আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ি এবং বারবার পড়ি। আমার কাছে ঐসব সফরনামার ভালো একটি সংগ্রহও রয়েছে। যখন লালকেল্লা আর কুতুব মিনারের কথা পড়ি, ভিতরে সত্যি যেন রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তবে তাজমহলের কথা পড়তে আমার ভালো লাগে না, একদম না। আমার বন্ধু মাওলানা ইয়াহয়া তাজমহল দেখে এসে শোনাতে চেয়েছিলো তাজমহলের কথা; শুনিনি। তাকে বলেছিলাম, শাহজাহানের তাজমহলই তো ডেকে এনেছে আমাদের দুর্গতি। ভারতে শাহজাহান যখন রাজকোষ শূন্য করে তাজমহল তৈরী করেছেন ব্রিটেনের রাজা তখন অস্ত্রের কারখানা তৈরী করেছেন। যিনি বলেছেন সত্য বলেছেন ‘তাজমহলই কেড়ে নিয়েছে আমাদের মাথার তাজ।’ তবু একবার তাকালাম মানচিত্রের দিকে ...।

***

হঠাৎ শুনি ফজরের আযান! নতুন ঢাকায় যেখানে আযানের আওয়াজ শোনা যায় না সেখানে এই নতুন দিল্লীতে একেবারে ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে আযানের আওয়ায! যেমন অবাক হলাম তেমনি পুলকিত হলাম। তবে ঘটনাটা বুঝতে দেরী হলো না। কিছুটা দূরে আমাদেরই মত এক ট্রানজিট যাত্রীর ঘড়িতে আযান হচ্ছে। যাক, যেভাবেই হোক, ভারতের মাটিতে আযানের আওয়ায তো কানে এলো! কোন কোন অমুসলিম দেশে, শুনেছি, লাউডস্পিকারে আযান দেয়া নিষিদ্ধ। এটা নাকি ধর্মীয় অধিকারের আওতায় পড়ে না, বরং শব্দদূষণের আওতায় পড়ে! তবু তো ওরা নাগরিক আইনের আশ্রয় নেয়। কিন্তু আমাদের দেশের কবি শামসুর রাহমান! কী সুন্দর নাম! মানুষটা এখন দুনিয়াতে নেই, যদি ঈমান নিয়ে কবরে গিয়ে থাকেন, কামনা করি, আল্লাহ তাকে মাফ করুন, আযান সম্পর্কে এমন গান্দা-গলিয কথা উচ্চারণ করেছেন যে, আল্লাহ পানাহ! সম্ভবত কোন অমুসলিমও এমন আস্পর্ধা দেখাতে পারেনি। ভারতের অবস্থা আমার ঠিক জানা নেই। হয়ত মুসলিমপ্রধান জনপদগুলোতে আযানের আওয়ায শোনা যায়।

আমীর ছাহেব ও মাওলানা আব্দুল মতীন জেগে উঠেছেন।

চার নম্বর ডেস্কে হাজিরা দেয়ার কথা বললাম। তারাও অবাক হলেন এবং কিছুটা পেরেশান। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে খুঁজে খুঁজে চার নম্বর ডেস্কের সামনে হাজির হলাম। হাতের ব্যাগপত্র খুব করে খুঁজলো। কিছু পাওয়ার কথা নয়, পায়ওনি। মনে হলো, তবু কোন একটা ছুতো চাই। ভদ্রমহিলার জিজ্ঞাসা, ‘তুরস্কে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্যটা কি বলুন তো! ‘ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন আছে নিশ্চয়’!

লে বাবা! এখন তো আমাদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছে, তোমার প্রশ্নের আসল মতলবটা কী বলো তো!

আমাদের সহজ-সরল উত্তরের প্রতিউত্তরে একটা রহস্যপূর্ণ হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, আচ্ছা আগে বাড়ুন, দেখা যাক।

আমরা কিছুটা হতবিহবল অবস্থায় অগ্রসর হলাম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে লেখা ও তীরচিহ্ন অনুসরণ করে ডান দিকে অগ্রসর হলাম। কিছু দূর গিয়ে আবার ডান। এটা সম্ভবত ডিউটি ফ্রি শপিং এরিয়া। বিদেশীদের পকেট বা মানিব্যাগ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নেয়ার চমৎকার ব্যবস্থা! ঢাকা বিমানবন্দরেও আছে, তবে এমন কায়দা করে নয়। বেনিয়ার জাত বলে কথা!

আরো কিছু দূর গিয়ে আবার ডান দিকে, তারপর সোজা সামনে। অনেক দূর হাঁটতে হলো। এখানে চলন্ত সিঁড়ি নেই; থাকলে কিছুটা আরাম হতো। নির্দিষ্ট সারিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। একজন একজন করে পার হচ্ছে এবং নির্বিঘ্নে। হঠাৎ দেখি সেই ভদ্রমহিলা, যার ‘কাঁটা ঘায়ে নুন ছিটানো’ বক্রহাসিটা আমরা পিছনে ফেলে এসেছি বলে ধরে নিয়েছি, সামনে এসে হাজির। ছোঁ মেরে পাসপোর্ট-টিকেট নিয়ে গেলেন, আর মেয়েলি গলা যতটা কর্কশ করা যায়, করে বললেন, ‘লাইন থেকে বাইরে ওখানে দাঁড়ান।’ ভদ্রমহিলার চেহারা দেখে তখন মনে হলো, ভারত দেখতে যত ‘সুন্দর’ আসলে ততটা ‘সুন্দর’ নয়!

আমার এই প্রথম যাকে বলে বুক দুরু দুরু করা, করতে লাগলো। মোটামুটি ধরে নিলাম, ইস্তাম্বুল যাওয়া আর হচ্ছে না। তা না হয় না হলো, কিন্তু তারপর! নিরাপদে দেশের মাটিতে ফিরে যেতে পারবো তো?! জানি, আমরা কোন অপরাধ করিনি, কিন্তু অপরাধ না করার ‘অপরাধ’ তো করেছি!

পাঁচ মিনিট পরে কী হবে, জানি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসীম উৎকণ্ঠার সঙ্গে শুধু দু‘আ ইউনুস পড়া ছাড়া আর তো কিছু করার ছিলো না। তাই পড়ছি, আর কর্তাবাবুদের ‘নড়াচড়া’ দেখে মতলব আন্দায করার চেষ্টা করছি। মহিলাটাকে মনে হলো আমাদের পাকড়াও করার জন্য  মরিয়া। অবাক ব্যাপারই বটে! এমন ক্ষিপ্ত হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে। বাড়া ভাতে ছাই দেয়া বলে একটা কথা আছে, আমরা তো তা করিনি। করার সুযোগই বা কোথায়! হাঁ, টেরোরিস্ট ধরার কৃতিত্ব লাভের বিষয় থাকতে পারে। এতে নাকি খুব সহজে পদোন্নতি বাগানো যায়। আমাদের দেশে পুলিশ- গোয়েন্দারা এমন কর্ম যথেষ্ট করে বলে শোনা যায়। এমন কি শুধু নামের মিল থেকেই নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতনের চূড়ান্ত করে ছাড়ে। বেচারা তখন ‘কড়াই থেকে উনুনে ঝাঁপ দেয়’, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য সন্ত্রাসের অভিযোগ স্বীকার করে নেয়। আমাদের দেশের সি আই ডি অফিসার আব্দুল কাহহার আখন্দের কথা মনে পড়লো। এধরনের কর্মে বেশ পটু ছিলো। নাম আব্দুল কাহহার, কর্মকাণ্ডে মনে হতো, ক্ষুদে ‘কাহ্হার’! আবার মনে পড়লো মধ্যএশিয়ার সেই নিরীহ যাত্রীদের কথা। আমাদের কপালে কি তাহলে ...! নাহ, ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। দয়া করো হে আল্লাহ!

যাত্রীরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। কারো দৃষ্টিতে নিছক কৌতূহল, কারো দৃষ্টিতে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য, এমনকি কারো দৃষ্টিতে ছিলো কেমন একটা ভীতি, হয়ত ভাবছে, নিশ্চয় আমরা ‘কাশ্মীরী জঙ্গী’, জাতীয় কিছু।

এই নয়া দিল্লী বিমানবন্দরেই তো কিছু দিন আগে ঘটেছে এমন অমানবিক ঘটনা। অজানা আশঙ্কায় মনটা তখন সত্যি বেশ অস্থির হয়ে পড়েছে।

ঠিক এরকম অবস্থারই সম্মুখীন হয়েছিলো কিছুদিন আগে মাওলানা সালমান, প্রথমবার জার্মানীতে গিয়ে। যাত্রীরা একে একে বিমান থেকে নামছে। সেও এগুচ্ছে দরজার দিকে নিশ্চিন্ত মনে। কিন্তু তাকে আটকে দেয়া হলো দরজায়। বলা হলো, একপাশে দাঁড়াও। বেচারা তালিবে ইলমের লেবাসে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। যাত্রীরা যায়, আর ফিরে ফিরে তাকায়; কারো চোখে কৌতূহল, কারো চোখে ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, বা ভীতি। হয়ত ভাবে, নিশ্চয় বেটা তালেবান, আলকায়েদা!

সব যাত্রী একে একে নেমে গেলো, আর সে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর শুরু হলো ‘বান্তর-অবান্তর’ সব প্রশ্ন। সমস্ত কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে দেখে শেষে অবশ্য ছোট্ট একটা ‘স্যরি’ বলে ছেড়ে দিয়েছিলো। ফোনে যখন সালমান আমাকে ঘটনা জানালো, তাকে সাস্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, ‘এটা হচ্ছে তোমার তালিবে ইলমের যে লেবাস, তার যাকাত। এটা তো আদায় করতেই হবে, পৃথিবীর যেখানেই তুমি যাবে।’

অন্যকে সান্ত্বনা দেয়া সহজ, আসল পরীক্ষা হয় তখন যখন পরিস্থিতিটা নিজের উপর দিয়ে যায়। নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, তালিবে ইলমের লেবাস যখন ধারণ করেছি, তার যাকাত তো দিতেই হবে। নিশ্চয় আল্লাহ সাহায্য করবেন।

এখন তো বাংলাদেশ থেকে তুর্কী এয়ার লাইনস্-এর সরাসরি ফ্লাইট পরিচালিত হয় ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল। তখন ইস্তাম্বুলের ফ্লাইট ধরতে হতো নয়া দিল্লী, অথবা করাচী থেকে। একবার মনে হলো। কাজটা হয়ত আমরা ভুলই করলাম। ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তান হয়ে যাওয়াই ভালো ছিলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, পাকিস্তান মুসলিম দেশ, ঠিক। কিন্তু এখন তো পাকিস্তান শাব্দিক অর্থেই আমেরিকার কব্জায়।  তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার দোসর। নিছক সন্দেহের বশে, কিংবা কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই নিরীহ মানুষকে ধরে ধরে তুলে দেয় মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে। এমনকি তাবলীগ জামাতে আসা বিদেশী মুসলমানরাও নিরাপদ নয়। এটা নাকি পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের ডলার রোজগারের একটা আকর্ষণীয় মাধ্যম। একজন বন্দীর বিনিময়ে তিনহাজার ডলার পর্যন্ত আয় হয়। ড. আফিয়া সিদ্দীকীর কথা না হয় বাদ, তিনি একজন সুপরিচিত, কিন্তু তাবলীগ জামাতের সঙ্গে আসা তুরস্কে জন্মগ্রহণকারী জার্মান নাগরিক মুহাম্মাদ আসলাম! তার মত সাধারণ ও নিরীহ একজন মুসলমানকে শুধু টুপি-দাড়ির কারণে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে  গেলো এবং তুলে দিলো মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে! দীর্ঘ তিন বছর বন্দীশিবিরে লোমহর্ষক নির্যাতন ভোগ করার পর শুধু আল্লাহর পক্ষ হতে গায়বি সাহায্যের কারণেই তিনি মুক্তি পেয়েছেন। সে হৃদয়বিদারক কাহিনী পড়েছিলাম পাকিস্তানের উর্দূ ডায়জেস্ট- এর কোন এক সংখ্যায়। সেসব কথা মনে পড়ে মনটা আরো দমে গেলো।

এরকম একজন তালিবে ইলমের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো তুরস্কে। তিনি এখন তরুণ তুর্কী আলিম, দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের খিদমতে নিয়োজিত। তিনি পাকিস্তান গিয়েছিলেন দ্বীনী মাদরাসায় ইলম হাছিল করার উদ্দেশ্যে। দারুল উলূম করাচীতে কয়েক বছর পড়েছিলেন, তারপর ‘পড়েছিলেন’ পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের হাতে এবং হাতবদল হয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতে। আফগানিস্তানের গোপন বন্দী-শিবিরে তিনি যে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, ভাবতেও শরীর শিউরে ওঠে। অথচ তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই ছিলো না। মার্কিন গোয়েন্দাদের হাস্যকর একটা দাবী ছিলো তার কাছে, ‘নিজেকে তুমি নির্দোষ প্রমাণ করো’, আর সেটা তিনি পারেননি। হায় রে মানবতা! হায়রে মানবাধিকার!!

এখন যদি আমাদের বলা হয়, নিজেদের তোমরা নির্দোষ প্রমাণ করো!

***

মহিলাটাকে এখন আর ‘ভদ্র’ না বলে শুধু ‘মহিলা’ বলতে ইচ্ছে করছে। বড় কর্তাকে হাত নেড়ে নেড়ে মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করে বোঝাতে চেষ্টা করছে, স্যর, কোন সন্দেহ নেই, এরা ‘আতঙ্কবাদী’, ধরে ‘পুছগ্যছ’ করলেই সব বেরিয়ে আসবে। স্যর, এদের ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না।’

সম্ভবত তারই সমস্তরের গোয়েন্দা অফিসার, হাতে ওয়ারলেস আছে, তিনি শান্ত স্বরে বললেন, স্যর, মনে হয় না, এরা ‘খতরনাক’ কিছু, শুধু শুধু হয়রানি করে কী লাভ। ছেড়ে দিন স্যর।

দূর থেকেই লোকটার উদ্দেশ্যে চোখ দু'টো কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয়ে উঠলো। বড় কর্তাটি এতক্ষণ একটানা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, জানে দো।

‘জানে দো’ কথাটা যে কত মিষ্টি হয়ে বাজলো কানে তা ভাবলে এখনো অন্তরে প্রশান্তির কোমল পরশ অনুভূত হয়। ইচ্ছে হচ্ছিলো সেখানেই শোকরের সিজদায় লুটিয়ে পড়ি। কিন্তু তখন সংযমের প্রয়োজন ছিলো। তাই মনে মনেই আল্লাহর শোকর আদায় করলাম।

মহিলাটির সেই হিংস্র ক্রুদ্ধ চাহনী আমি এখনো ভুলতে পারিনি, সহসা পারবো বলেও মনে হয় না। কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায় সে চাহনীর! মুখ থেকে শিকার ফসকে যাওয়া নেকড়ে যে ভাবে তাকায় শিকারের দিকে, এ যেন সেই চাহনী। পুরুষ কর্মকর্তাটি তাড়া দিয়ে বললেন, চলো, ভাগো, ওয়াক্ত ক্যম হ্যয়।

তার ‘চলো, ভাগো’-এর মধ্যেও যেন কিছুটা সমবেদনার সুর ছিলো, আমার অন্তত তাই মনে হলো। তার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমরা দ্রুত ‘ভাগলাম’।  যাত্রীরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছে। আমরা তিনজন ছাড়া আছে একদু’জন। সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমে কিছু দূর গিয়ে বিমানে প্রবেশের ব্রিজ। সিঁড়ির গোড়ায় দু’জন ভারতীয় কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, বললাম, আমরা এখানেই ফজরের নামায পড়ে নিতে চাই। সুন্দর একটি হাসি উপহার দিয়ে বললেন, জরুর পড় লীজিয়ে, কিবলা ইসতরফ হ্যয়।

পোশাক-চেহারায় তো বোঝার উপায় নেই, তবে মুখের উদ্ভাসে মনে হলো, মুসলিম। কথার সঙ্গে হাতের ইশারায় যেভাবে কেবলার দিক দেখালেন তাতে কেবলার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার আভাস ছিলো।

আল্লাহর শোকর এমন সময়ও আমীর ছাহেব জামাত করার কথা বললেন এবং জামাতের সঙ্গে ফজরের দু’রাকাত আদায় করলাম।

আমাকে যদি এখন বলা হয়, আল্লাহর কাছে কিছু চাও, আমি চাইবো; সেদিনের ঐ ফজরের দু’টি রাকাত যেন আবার পড়তে পারি। শব্দের তুলিতে হৃদয়ের চিত্র ফুটিয়ে তোলা কি সম্ভব! অন্তত কাছাকাছি! যদি সম্ভব হয় তাহলে বলবো, ‘তাড়াহুড়া’র ঐ দু’রাকাত নামাযের মধ্যে আমার অন্তরে বিরাজমান ছিলো ‘প্রশান্তির ব্যাকুলতা, কিংবা ব্যাকুলতার প্রশান্তি’, যা জীবনে ঐ একবারই পেয়েছি! ‘আল্লাহ আমাদের দেখছেন’ এ অনুভূতি অন্তরকে বারবার যেন দোলা দিয়ে যাচ্ছিলো! ইনসানের যিন্দেগিতে মুছিবতের তারবিয়াত সত্যি বড় মূল্যবান সম্পদ! চেয়ে আনতে নেই, তবে এলে অবহেলা করতে নেই।

নামায শেষে অশ্রুসিক্ত চোখে বিমানের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম এবং শেষ যাত্রী হিসাবে আমরা তিনজন বিমানে প্রবেশ করলাম।

জীবনে এই প্রথম তুরস্কের বিমানে আমাদের আরোহণ। দোরগোড়ায় যিনি ‘ওয়েলকাম’ বললেন, মনে হলো, তাতে পেশাদারিত্ব ছাড়াও কিছু একটা ছিলো। আমরা সালাম দিলাম, তিনি বেশ শুদ্ধ উচ্চারণে জওয়াব দিলেন।

বিমানের ভিতরে নিজেদের আসনে গিয়ে বসার আগ পর্যন্ত বেশ কিছু দৃষ্টি, মনে হলো, আমাদের বিদ্ধ করলো। দৃষ্টিগুলোর তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায়, ‘জঙ্গিগুলো তাহলে বিমানে উঠে গেলো!’

অবশ্য এর মধ্যে একটি সুখকর অভিজ্ঞতাও হয়েছিলো। বিমান যখন তুরস্কের উদ্দেশ্যে আকাশে উড়ছে তখন আমি বিমানের করিডোরে হেঁটে হেঁটে যাত্রীদের দেখছিলাম। এটি আমার, বলা যায়, প্রিয় একটি অভ্যাস, শুরু হয়েছে সেই বাইতুল্লাহর প্রথম সফর থেকে, যখন ঢাকা থেকে করাচী গিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিমানে করে। যাত্রীদের অধিকাংশ ছিলো বাংলাদেশে আটকা পড়া বিহারী। তখন দেখা হয়েছিলো মধ্যবয়স্ক এক বিহারী মুসলিমের সঙ্গে। তার কাছে শুনেছিলাম তার জীবনের করুণ কাহিনী। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং সমৃদ্ধ ব্যবসা সব হারিয়ে তিনি তখন নিঃস্ব। তার কথা এখনো ভুলতে পারি না, বিশেষ করে সেই বাক্যটি, ‘হিন্দুদের হাতে যখন ‘কতলে আম’ হলো তখন শুধু জানটা হাতে করে বিহার থেকে মা-বাবার সঙ্গে এলাম মাশরেকি পাকিস্তানে। মা-বাবার ‘হাড্ডি’ মিশে আছে এই দেশের যামীনে, তাই দেশটাকে আপনা মুলুক মনে করে মুহববত করেছিলাম। কিন্তু ‘বদলে ম্যাঁ কেয়া পাইলাম’? বলছেন, আর চোখ থেকে পানি ঝরছে।

তার কাঁধে হাত রেখে শুধু বলেছিলাম, ‘আমরাও তো তোমাদেরকে মজলূম ভাই মনে করে বুকে নিয়েছিলাম। দোষ আমাদের দু’তরফেই ছিলো। ভাই-ভাই হয়ে থাকতে পারলাম না।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পাকিস্তান যাচ্ছেন কীভাবে? কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলেন, ‘ভাই, রায কী বাত হ্যয়, প্যর আপসে কেয়া ছুপানা, পাসপোর্ট-ভীযা স্যব নকলী হ্যয়।’

সম্ভব হলে পাকিস্তানে থেকে যাবেন, নইলে আবার ফিরে আসতে হবে বাংলাদেশে।

তুর্কী বিমানে দেখা হলো ভারতের মধ্যপ্রদেশের এক দম্পতির সঙ্গে। বিমানের একেবারে শেষ দিকে তারা বসেছিলেন। আমাকে দেখামাত্র ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। উষ্ণভাবে করমর্দন করে বললেন, ‘ব্যড়ী খুশী হুয়ী, ভগওয়ান কা শোকর, কি আপ আগ্যয়ে। আপ লোগুঁকে লিয়ে হাম বহুত হী চিন্তিত্ থে, অ্যওর ভগওয়ান সে প্রার্থনা ক্যর র‌্যহে থে কি আপ কো ছুটকারা মিল যায়ে’।

সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মানুষটির কাছ থেকে এমন হামদর্দির কথা শুনে কি চোখে পানি না এসে পারে! যখন বিপদে পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন কত চোখে কত রকম দৃষ্টি দেখেছি, আশ্চর্য, এমন হামদর্দিও ছিলো কোন কোন চোখের দৃষ্টিতে, অথচ আমরা দেখতে পাইনি! এটাকেই বলে ইনসানিয়াত! এরই নাম মানবতা!! পৃথিবীতে এখনো আছে মানবতা; পরিমাণে কম হলেও হিন্দুস্তানে এখনো আছে ইনসানিয়াত।

‘বাংলাদেশী’ পরিচয় পেয়ে ভদ্রলোক বললেন, মাশাআল্লাহ আপ আলিম দিখতে হ্যাঁয়, হামারে ইয়াহাঁ ভী বহুত আচ্ছে আচ্ছে আলিম হ্যাঁয়। ...

বাঙ্গালী হিন্দুদের সঙ্গে এই হিন্দুদের এখানেই বড় তফাৎ। বাঙ্গালী বাবুরা চিরটাকাল ‘জল’ ঘোলা করেই কাটিয়ে দেন, কখনো ‘পানি’ পান করে দেখেন না। ওরা ‘জল ভী পীতে হ্যাঁয়, পানি ভী’; পানিটাই বরং বেশী ব্যবহার করেন। ‘সোয়ার্গ-ন্যর‌্যক’, এর চেয়ে জান্নাত-জাহান্নাম বেশী উচ্চারণ করেন। বাঙ্গালী বাবুরা স্বর্গ-নরক ছাড়া আর কিছু বুঝতেই চান না। ওরা প্রার্থনা যেমন বলেন তেমনি দু‘আ বলতেও কুণ্ঠা বোধ করেন না। হিন্দি উপন্যাসে এধরণের বাক্য অনেক পড়েছি, ‘মাঁ, তেরে ক্যদমূঁ কে নীচে মেরী জান্নাত হ্যয়।’ বাঙ্গালী বাবুদের লেখা তো আর কম পড়া হলো না, কিন্তু এমন একটি বাক্য কল্পনাও করা যায় না।

স্বীকার করি, ‘মাতৃচরণে স্বর্গ’ কথাটা পড়েছি, তবে দুঃখ এই যে, তারা স্বীকার করতে চান না, এ বিশ্বাসটুকু কোন্ ধর্ম থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন!

ভদ্রলোক ও তার শ্রীমতীকে বহুত বহুত শুকরিয়া জানিয়ে ফিরে এলাম নিজের আসনে, অন্তরে অভূতপূর্ব আনন্দের স্নিগ্ধ পরশ নিয়ে।

***

নাশতা পরিবেশন করা হলো। মানে ও পরিমাণে বেশ সন্তোষজনক। তৃপ্তির সঙ্গেই খাওয়া হলো। একটা কথা মনে হলো, জেট এয়ারে পেয়েছিলাম আতিথ্য, এখানে পেলাম মেহমানদারি। এটা শুধু শব্দেরই পার্থক্য নয়, সংস্কার ও সংস্কৃতিরও পার্থক্য। ‘অনেক কিছুই আমাদের হারিয়ে গেছে, সবকিছু প্রায় একাকার হয়ে গেছে; তারপরো এমন কিছু এখনও আছে যা পার্থক্য স্মরণ করিয়ে দেয়।’ কথাটা আমার নয়, বহু যুগ আগের এক আরব পর্যটকের।

সময় খুব বেশী নেই। তুরস্কের ইতিহাস বইটা হাতে নিলাম। ইতিহাস অংশটা পড়া হয়ে গেছে, বাকি আছে ‘আধুনিক তুরস্ক’ অংশটা। আধুনিক তুরস্ক মানে হলো উছমানি খেলাফতের বিলুপ্তির পর মুস্তফা কামাল পাশা-এর নেতৃত্বে তুরস্কের নতুন যাত্রা। ১৯২২ এ কামাল তুর্কী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। কখনো কখনো মনে হয় লোকটার উদ্দেশ্য হয়ত মন্দ ছিলো না। হয়ত তার লক্ষ্য ছিলো ‘ইউরোপের দুর্বল পুরুষ’ নামে পরিচিতি পাওয়া তুরস্ককে উন্নতি ও অগ্রগতির দিক থেকে পাশ্চাত্যের সমকক্ষ করে তোলা। কিন্তু প্রথমেই তিনি ইসলামকে আধুনিক তুরস্কের উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকরূপে চিহ্ণিত করে বসলেন। কথিত আছে, উছমানি খেলাফতের সর্বশেষ শায়খুল ইসলামের মাথার উপর পবিত্র কোরআন ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, তুরস্কের উন্নতির পথে এটাই হলো সবচে’ বড় বাধা! আল্লামা তাকি উছামানিও তাঁর সফরনামায় সংক্ষেপে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। কামাল পাশা একটি একটি করে ইসলামের পরিচয়সূত্রগুলো তুরস্কের জাতীয় জীবন থেকে মুছে ফেলতে শুরু করেন। পর্দাপ্রথা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেন, পুরুষদের জন্য তুর্কীটুপি পরা নিষিদ্ধ করেন। আরবী ভাষায় আযান দেয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়। সবচে’ গুরুতর যে কাজটি তিনি করেন তা হলো তুর্কী ভাষা থেকে আরবী বর্ণমালা বিদায় করে দেয়া এবং তার স্থানে রোমান বর্ণমালা গ্রহণ করা। এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত তুরস্কের নতুন প্রজন্মকে তাদের গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সমগ্র ইসলামী কুতুবখানা তাদের কাছে হয়ে পড়ে একেবারে আজনবী। এগুলো খুব সহজেই যে হতে পেরেছে তা নয়। এজন্য তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতার উপর যে ভয়ঙ্কর নিপীড়ন নির্যাতন নেমে এসেছিলো তার কিছু বিবরণ রয়েছে তুরস্কের ইতিহাস বইটিতে। আল্লামা তাকী উছমানী তার সফরনামায় লিখেছেন, ‘তুর্কী জাতির মাথা থেকে তুর্কী টুপি নামানোর জন্য কত মাথা যে দেহ থেকে নামানো হয়েছে তার হিসাব নেই।’

আসলে এই একটি বাক্যেই সেই দীর্ঘ ও ভয়াবহ নির্যাতনের রক্তাক্ত ইতিহাস উঠে এসেছে।

এত কিছু করেও কামাল পাশা কিন্তু ইউরোপের মন গলাতে পারেননি, এমনকি এখনো ইউরোপ তুরস্ককে তার পরিবারভুক্ত স্বীকার করতে নারায। আর উন্নতি! তুরস্ক যে তিমিরে ছিলো, সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছিলো কামাল পাশার জীবদ্দশায় তো বটেই, এমনকি তার মৃত্যুর পরো। তাই দেখা যায় ১৯৫০ এ অনুষ্ঠিত তুরস্কের প্রথম নির্বাচনে ইছমত উনূনুর নেতৃত্বে কামাল পাশার রিপাবলিকান পাটি পরাজিত হয়েছিলো। পক্ষান্তরে ইসলামপন্থীদের ঘটেছিলো বিস্ময়কর উত্থান। সারা বিশ্ব এখন স্বীকার করে, তুরস্কের বর্তমান উন্নতির পিছনে রয়েছে নাজমুদ্দীন এরবাকানের অগ্রণী ভূমিকা, যা এখন এরদোগানের হাতে পূর্ণতা লাভ করছে।

***

বইটা রেখে জানালা পথে তাকালাম। ভাসমান মেঘ সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে। এ দৃশ্য অনেক দেখেছি, তুরস্কের আকাশে এই প্রথম দেখলাম। নীচে সাগর দেখে বুঝতে পারলাম ইস্তাম্বুল এসে গেছে। ঠিক তাই। একটু পরেই ঘোষণা হলো, প্রথমে তুর্কীতে, তারপর ইংরেজিতে, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান ইস্তাম্বুলে অবতরণ করবে। তাই সিটবেল্ট বেঁধে নিতে হবে।’ আমরা সিটবেল্ট বেঁধে প্রস্তুত হলাম।

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ. তুরস্কে প্রবেশ করেছিলেন স্থলপথে সিরিয়ার সীমান্ত দিয়ে। ইস্তাম্বুলে এসেছিলেন আঙ্কারা হয়ে রেলপথে। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন, ভূমি থেকে দেখা পথের দু’পাশের সৌন্দর্যের, কিন্তু তাতে আকাশ থেকে দেখা ইস্তাম্বুলের সৌন্দর্যের কথা নেই। আল্লামা তাকী উছমানী এসেছেন জিদ্দা থেকে এথেন্স হয়ে আকাশপথে। তাই তিনি আকাশ থেকে দেখা ইস্তাম্বুলের সৌন্দর্যের কথা লিখেছেন চমৎকার ভাষায়। আসলেও আকাশ থেকে ইস্তাম্বুল দেখতে অপূর্ব। ছড়িয়ে আছে পাহাড়ে সমতলে ঢেউ খেলানো পুরো শহর; যেন একটা সবুজ গালিচা বিছিয়ে রাখা হয়েছে! মাঝখানে ঐ যে, বসফরাস থেকে বের হয়ে ভিতরে চলে গেছে স্বর্ণশৃঙ্গ। মাঝে মধ্যেই জলভাগ ভিতরে চলে এসেছে, অথবা স্থলভাগ চলে গেছে সাগরের ভিতরে। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সত্যি কল্পনায়ও পাওয়া দুর্লভ। শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে, আর মুখ থেকে যেন নিজের অজামেত্মই বের হয়ে আসে, ‘সুবহানাল্লাহ’!

বিমান ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসছে। সবকিছু আরো স্পষ্ট হয়ে এসেছে। একসময় মনে হলো, এই বুঝি বিমান সাগর ছুঁয়ে ফেলে!

বিমান আরো নীচে নেমে এলো এবং স্পষ্ট অনুভব করলাম, বিমানের চাকা তুরস্কের মাটি স্পর্শ করেছে। আলহামদু লিল্লাহ! এক মধুর স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সত্য হতে চলেছে।

হাঁ, ‘সত্য হতে চলেছে’, এখনো পূর্ণ সত্য হয়নি। আমরা তুরস্কে এসেছি। কিন্তু তুরস্কের বাতাসে এখনো শ্বাস গ্রহণ করা হয়নি, এখনো পাইনি ইস্তাম্বুলের মাটির স্পর্শ।

কি কারণে যেন বিমানের দরজা খুলতে বেশ বিলম্ব হলো। যাত্রীরা যার যার সামান হাতে নিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, তবে কারো আচরণে ব্যস্ততা নেই, তাড়াহুড়া তো মোটেও নেই। ভালো লাগলো।

বিমানের দরজা খুলে গেলো। যাত্রীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। আমরা মোটামুটি সামনের দিকে ছিলাম। দরজায় এসে দাঁড়ালাম। ভেবেছিলাম, ইউরোপীয় শীতের ঝাপটায় কাবু হয়ে যাবো, কিন্তু না, হিমেল বায়ুর স্পর্শে দেহমন জুড়িয়ে গেলো। তুরস্কের বাতাসে প্রথম শ্বাসগ্রহণের আনন্দটুকু অন্তরের গভীরে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম এবং তুরস্কের মাটির প্রথম স্পর্শ গ্রহণ করলাম। যদিও আসল মাটি নয়। আসল মাটির স্পর্শ তো পেয়েছি হোটেলের সামনে গাড়ী থেকে নামার পর। সে কথায় পরে আসছি।

প্রথম বাসেই আমাদের জায়গা হয়ে গেলো। বেশ বড় বাস। আসলে দু’টো বাস একসঙ্গে জোড়া দেয়া হয়েছে। তুরস্কেই প্রথম দেখলাম। এখন অবশ্য ঢাকার রাস্তায়ও দেখা যাচ্ছে।

অবাক বিষয়, পুরো বাসে আমরা তিনজন ছাড়া সবাই ভারতীয়; এবং পশ্চিমবঙ্গের বাবুরাই সংখ্যায় বেশী!

বাস চলছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বাংলা ‘কিচিরমিচির’। তবে পরিষ্কার বোঝা যায়, বাংলাভাষার মাঝখানেও আছে একটা সীমান্তরেখা। দুই বাংলা-ভাষা যেন পাশাপাশি দু’টি নদী, কিন্তু মাঝখানে রয়েছে একটি জলরেখা! এপাশের ‘পানি’ যেতে পারে না ওপাশে, আবার ওপাশের ‘জল’ আসতে পারে না এপাশে। এ যেন-

بينهما برزخ لا يبغيان

দাদা-দিদিরা ভেবেছেন, আমরা বাংলা জানি না, হয়ত পশ্চিম দেশীয় হিন্দুস্তানী। তাই চুটিয়ে গল্প করছেন; অত্যন্ত ঘরোয়া বিষয়ও বাদ যাচ্ছে না, এমনকি আমাদের প্রতিও ‘ইশারাটিশারা’ হচ্ছে। শেষে আমীর ছাহেব কতকটা যেন বাধ্য হয়েই বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি’।

নাহ, আমীর ছাহেবের রুচিবোধ সত্যি অতুলনীয়, ‘আমরা বাঙ্গালী, বা বাংলা বুঝি’ না বলে বললেন, ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি’।  কোন উত্তর অবশ্য পাওয়া গেলো না, এমনকি সৌজন্যমূলক সামান্য সলজ্জ হাসিটুকুও না, তবে আলাপের ধরনটা সংযত হয়ে গেলো।

আশ্চর্য, তুরস্কের শ্রমবাজারে ভারতীয়দের সংখ্যা নাকি বিপুল, বাংলাদেশীরা নগণ্য, এমনকি পাকিস্তানীদের সংখ্যাও খুব একটা বেশী নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন পদে ভারতীয়দেরই প্রভাব; তারপর আছে পাকিস্তানীরা। এটা কি আমাদের কূটনীতির দুর্বলতা, না ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব?

বাস থেকে নেমে আবার দীর্ঘ পথ হাঁটা। তবে চারদিকে তাকিয়ে বেশ ভালোই লাগছে। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সবকিছুতে অত্যন্ত পরিপাটিতার ছাপ। অতীতে যারা তুরস্ক সফর করেছেন তাদের দু’একজনের সফরনামা পড়েছি। তারা লিখেছেন, বিমানবন্দরে নেমে প্রথম যে জিনিসটি আপনার চোখে পড়বে তা হলো মুস্তফা কামাল পাশা (আতাতুর্ক)-এর বিশাল আকারের প্রতিকৃতি। বোঝা যায়, এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে, এবং যে ক’দিন ছিলাম শহরের কোথাও তার ছবি নযরে পড়েনি।

লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম।  কোন কোন বুথে মহিলাকর্মকর্তা। পোশাক হচ্ছে স্কার্ট, তবে মিনি নয়, একজনের মাথায় স্কার্ফও দেখতে পেলাম, একসময় তুরস্কে যা কল্পনাও করা সম্ভব ছিলো না। কারণ সরকারিভাবেই তা নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিলো। হিজাব পরার অপরাধে পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারানো তো এই সেদিনের ঘটনা। এমনকি বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল-এর স্ত্রীকে পর্যন্ত বেশ নাজেহাল হতে হয়েছে, তবে প্রেসিডেন্ট ও তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন।

আমাদের বুথে অবশ্য পুরুষ কর্মকর্তা, দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, যথেষ্ট চৌকশ; কাজ হচ্ছে দ্রুত। তিনজনের মধ্যে আমি ছিলাম পিছনে, আমার গায়ের সঙ্গে লেগে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাংলায় প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে আমি কী করি। বিরক্তিবোধ হলো। সাধারণত এধরনের প্রশ্ন হয় সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে; সে প্রয়োজন তো এখানে নেই! তার উপর উত্তর শুনে এমনভাবে উত্তমকুমারীয় ঢংয়ে ‘অ’ বললেন, যে মেজাযটাই বিগড়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি জানতে চাইনি, গায়ে পড়ে বললেন, তিনি ইস্তাম্বুলে ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছেন দশ বছর হলো। আবার অর্থহীন প্রশ্ন, ‘তা কী কাজ নিয়ে ইস্তাম্বুল আসা হলো?’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উত্তরটা তির্যক হয়ে গেলো, বললাম, ‘ভয় নেই, শ্রমবাজার দখল করার মতলব নেই। চারপাঁচদিন থেকেই চলে যাবো।’

পানির অভাবে শুকিয়ে মরা নিরীহ বাংলাদেশীর কাছে এমন চোখা উত্তর হয়ত ভদ্রলোক আশা করেননি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, কি যে বলেন! কি যে বলেন!

কী যে বলি, তা কী আর বাবুর বুঝতে বাকি ছিলো! তবে কথা আর আগে বাড়লো না দেখে স্বস্তি বোধ করলাম।

একটু পর শুনতে পেলাম একটি নারীকণ্ঠ অনুচ্চ স্বরে ভদ্রলোককে তিরস্কার করছে, ‘খামোখা কেন বিঁধতে গেলে, বেশ করে বিঁধিয়ে দিলো তো!’

আমীর ছাহেব পাসপোর্ট এগিয়ে দিয়ে সুন্দর করে সালাম দিলেন। সালাম তো আমরা অনেকেই দিই, তবে কিছু কণ্ঠস্বর এবং কিছু উচ্চারণ অন্তরকে স্পর্শ করে। ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন; কয়েক মুহূর্ত তাকিয়েই থাকলেন। বোঝা যায়, অনেক দিন সালাম শুনেননি, আর এমন সালাম তো নিশ্চয় শুনেননি! অত্যন্ত উদ্ভাসিত মুখে সালামের জওয়াব দিলেন, উচ্চারণে অনভ্যস্ততার ছাপ থাকলেও ভালো লাগলো। একসময় তো, শুনেছি, তুর্কীরা ভয়ে কেউ কাউকে সালাম দিতো না। হাঁ, শুধু সালামবিনিময়ও বিপ্লব-বিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিযুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।

***

বিমানবন্দরকে বলা হয় একটি দেশের প্রবেশপথ। তাই যদি হয় তাহলে বলবো, একটি সুন্দর, কোমল ও মোলায়েম অনুভূতি নিয়ে আমরা বিমানবন্দরের প্রবেশপথ দিয়ে তুরস্কে প্রবেশ করলাম।

আমাদের ইস্তিকবালের জন্য কেউ আছে বলে মনে হলো না। থাকার তো কথা ছিলো! অনিবার্য কারণে আমাদের যে একদিন বিলম্ব হচ্ছে তা আয়োজকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে ই-মেইলে। কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। এবং আশ্চর্য, আমাদের অবস্থাটা যেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশভদ্রলোক বুঝতে পারলেন। এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘এ্যানি প্রোব্লেম?

ভাষা ইংরেজি, উচ্চারণটা তুর্কী; ভালোই লাগলো। আমরা শুধু বললাম, ‘ওয়াও’!

পাঠক ভাবছেন, এটা আবার কী! না, অন্য কিছু না, এ হচ্ছে,  ইস্তাম্বুলে আমাদের যে হোটেলে ওঠার কথা তার নাম। পুলিশ-ভদ্রলোকটি অবশ্য সহজেই বুঝে নিলেন। টেক্সি ডেকে আমাদের তুলে দিলেন। চালককে মনে হলো তাকীদ করে দিলেন, যেন ঠিক মত পৌঁছে দেয়।

পাঠক নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন যে, পুলিশও এমন হয়! জি, ইস্তাম্বুলে বিমান বন্দর থেকে বের হয়ে প্রথম যে পুলিশটির সঙ্গে দেখা হলো তার কাছ থেকে পুলিশের এ পরিচয়ই আমরা পেলাম। আরো দু’একবার দেখা হয়েছে পুলিশের সঙ্গে। একই আচরণ পেয়েছি। স্থানীয় দু’একজনকে জিজ্ঞাসাও করেছি, তারা প্রশংসাই করেছেন, আর বলেছেন, এখানে পুলিশ শান্তিরক্ষা করে, শান্তিভঙ্গ করে না।

আমাদের দেশে পুলিশ কী রক্ষা করে, আর কী ভঙ্গ করে তা তো প্রতিদিন আমরা সবাই দেখি, শুনি এবং পত্রিকার পাতায় পড়ি।

প্রিয় পাঠক, এবার আপনিই বলুন, পুলিশ-এর সঙ্গে ভদ্রলোক শব্দটি ব্যবহার করে আমি কি ভুল করেছি?!

টেক্সি বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে মূল সড়কে ওঠবে, এমন সময় দেখি হৃদয় কেড়ে নেয়া এক দৃশ্য। সম্ভবত প্রাকৃতিক টিলা নয়, মাটি জড়ো করে তৈরী করা হয়েছে। দশ বারো হাত উঁচু, কিছুটা পিরামিড-আকৃতির, সবটুকু সবুজে ঢাকা। বিভিন্ন রঙের ফুলগাছ ‘সাজানো হয়েছে’[1] পরিকল্পিতভাবে। তাতে অজস্র ফুল ফুটেছে, আর তাতে ইংরেজি অক্ষরে ‘ওয়েলকাম’ এবং তুর্কী ভাষায় hosh geldiniz শব্দটি ফুটে উঠেছে। দৃশ্যের সৌন্দর্যটুকু আমার বিবরণে, বুঝতে পারছি, কিছুই ফুটে উঠলো না। পাঠক, আপনার কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে কিছুটা অনুভব করে নিন। সম্ভবত রাতের বেলা আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে ‘ওয়েলকাম’ জানানো হয়, তেমন ব্যবস্থাই দেখতে পেলাম। তবে ফুলের লেখা দিয়ে ফুলেল স্বাগতম জানানোর যে অপূর্ব শৈল্পিক রুচিবোধ, সত্যি তার তুলনা হয় না। তুর্কীভাষা আগে যে বর্ণমালায় লেখা হতো তাতে শব্দটি এমন হওয়ার কথা ছিলো-

هش غلدينيز

কোনটা দেখতে কেমন, পাঠক, যদি আপনার বিচারবোধ থাকে,  নিজেই বিচার করুন। বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত যেতে দশমিনিটের মত লাগলো, সারাটা পথে দু’পাশে, বরং চারপাশে শুধু ফুল আর ফুল! যেন ফুল দিয়ে বিভিন্ন রকম আল্পনা তৈরী করা হয়েছে, সত্যি চোখজুড়ানো দৃশ্য! একটি দৃশ্য, এখনো যেন চোখের তারায় তার ছবিটি রয়ে গেছে! যেখানে বাঁক নিয়ে আমাদের গাড়ী হোটেলের দিকে যাবে, হোটেলের নামটি দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছি; ঠিক রাস্তার মোড়ে চারটি গাছ, সমপরিমাণ দূরত্বে। প্রতিটি গাছে তিনটি শাখা, প্রতিটি শাখায় তিনটি ফুল। হলুদের মাঝে লাল রেখা, ফুলগুলো মৃদু মৃদু দুলছে, যেন আমাদেরই দিকে তাকিয়ে; ভাবতে দোষ কী, হয়ত আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছে!

পর্যটকরা বলেন, তুর্কীরা ফুল ভালোবাসে, আমার বলতে ইচ্ছে করে, ফুল তুর্কীদের ভালোবাসে! নইলে গাছে এমন সুন্দর করে ফোটবে কেন ফুল!!

আল্লামা তাকী ওছমানী ইস্তাম্বুল সম্পর্কে এত কথা লিখেছেন, ফুলের কথা কেন লিখলেন না, প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, পরে চিন্তা করে দেখলাম, কারণ এই যে, তিনি এসেছিলেন মার্চ মাসে।

***

ওয়াও নামের পনেরো তলা বিশাল হোটেল। প্রবশেপথের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে সংলগ্ন ডানপাশে সুপরিসর সম্মেলনকক্ষ। আমরা যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন সকালের অধিবেশন মাত্র সমাপ্ত হয়েছে। আমন্ত্রিত মেহমানগণ সম্মেলনকক্ষ থেকে বের হয়ে আসছেন।

হোটেলের দরজায় অভ্যর্থনাকারী উপস্থিত ছিলেন। পরিচয় পেয়ে স্বাগত জানালেন, আর তখনই জানা গেলো, বাংলাদেশী প্রতিনিধিদলকে ‘ওয়েলকাম’ করে আনার জন্য কিছুক্ষণ আগে একজন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমাদের বিমান নির্ধারিত সময়ের বেশ আগে পৌঁছার কারণে এই বিপত্তি।

আয়োজক মজলিসের প্রধান মুহিউদ্দীন আওয়ামা-এর সঙ্গে সহজেই দেখা হয়ে গেলো। উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে করমর্দন করলেন। উদ্যমী ও প্রাণবন্ত যুবক। কল্পনায় যেমন ছবি এঁকেছি তার চেয়ে অনেক সুদর্শন এবং নূরানি চেহারা। নিজে নিজেই ভাবলেন, অভ্যর্থনাকারীর অনুপস্থিতে বিমানবন্দরে আমাদের যথেষ্ট পেরেশানি হয়েছে, সেজন্য আরবীয় আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে বারবার দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলেন, যদিও আমরা জোর দিয়েই বললাম, কোন কষ্ট হয়নি। সৌজন্য-বিনিময়ের পর প্রথম যে কথাটি বললেন তা হলো, ‘শায়খ আব্দুল মালিকের আসতে না পারাটা আমাদের জন্য বড় আফসোসের বিষয়।’

এই ‘ছোটখাটো’ মানুষটি আরবের বিদ্বান মহলে আমাদের অগোচরেই যে ‘শায়খ’-এর মর্যাদা লাভ করে বসে আছেন তা শুনে আনন্দিত হলাম। আরো কয়েকবার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। যাক, অল্প সময়ের মধ্যে হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ে গেলো। আমাদেরকে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী মেহমান-এর পরিচয়পত্র এবং হোটেলের নির্ধারিত কক্ষের চাবি দেয়া হলো। মেহমান হিসাবে কোন হোটেলে বাস করা, এটা আমার জীবনে প্রথম নয়, দ্বিতীয়। তবে এখানে যে চাবিটা হাতে পেলাম সেটার সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়। হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. ঊনিশ শ’ বিরাশিতে হজ্বের পরে যে ইরাক সফর করেছিলেন তাতে তাঁর অনুগামী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। ইরাকের অভিজাত-তম হোটেল মেরিডিয়ানে ছিলাম। তখন হোটেলকক্ষের চাবিটা আমার ঘরের দরজার চাবি থেকে ভিন্ন কিছু ছিলো না। কিন্তু এখানে যে চাবি পেলাম সে বড় অদ্ভুত! আমীর ছাহেব জানালেন, এটা হলো  ইলেক্ট্রোনিক চাবি! তিনি জানেন কীভাবে এটা ব্যবহার করতে হয়। আমি ও মাওলানা আব্দুল মতীন তাঁর কাছ থেকেই ব্যবহারটা শিখে নিলাম। তারপরো মাঝে মধ্যে তাঁর সাহায্য নিতে হয়েছে। বেশ মজাই লাগতো এটা ব্যবহার করতে। দেখতে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের চেয়ে আকারে একটু বড় একটা কার্ড। তালার মাঝ বরাবর একটা ফাঁক আছে। কার্ডটা তাতে ঢুকালে সবুজ আলো জ্বলে ওঠে এবং দরজা খুলে যায়। কোন কারণে আলো যদি না জ্বলে, দরজা আর খোলে না। ব্যবস্থাটা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। আসলে প্রযুক্তির মোড়কে এটা হচ্ছে ইউরোপীয় কূটকৌশল। বলা ভালো, ইহুদী কূটকৌশল। বড় বড় মিডিয়া যেমন ইহুদীদের দখলে তেমনি হোটেল ব্যবসাটাও ওদেরই একচেটিয়া। তা কূটকৌশল হলো কীভাবে?! কারণ তোমার হাতে চাবি দেয়া হলো; তুমি তো খুশী, কিন্তু ‘চাবিকাঠি’টা রয়ে গেলো ওদেরই হাতে। ইচ্ছে করলেই তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে পারে। তোমার হাতে চাবি, অথচ তুমি দরজা খুলতে পারছো না! ভাবো দেখি, অনুভূতিটা তখন কেমন হয়!

যেদিন আমাদের হোটেল ছেড়ে আসার কথা সেদিন একারণে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলো। এমনকি আমীর ছাহেবও রহস্যটা বুঝতে পারেননি। সে কথা পরে আসছে।

তিনজনের জন্য পাশাপাশি দু’টি কক্ষ, সম্ভবত নয় তলায়। আমীর ছাহেব পীড়াপীড়ি করলেন, আমাকে আলাদা কক্ষ দেয়ার জন্য। আমি কিছুতেই রাজী হলাম না, বললাম, কাফেলার আমীর হিসাবে এটা আপনার প্রাপ্য। আমি ও মাওলানা আব্দুল মতিন এক কামরায় উঠলাম। অভিজাত হোটেল, সুসজ্জিত কামরা। আরাম-আয়েশের আধুনিকতম সব ব্যবস্থা দেখে রীতমত খারাপই লাগলো। কারণ আমরা তো এগুলোতে অভ্যস্ত নই, হওয়া উচিতও নয়। ফোমের বিছানা এত নরম যে, ঘুমোতেই কষ্ট হয়, পিঠ ব্যথা করে। আধুনিকতা ও বিলাসিতার আশ্চর্য বিড়ম্বনা! তার চেয়ে আমার ঘরে শক্ত কাঠের চৌকি অনেক আরামদায়ক! থাক এসব অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ। তবে একটা কথা বলা দরকার। সম্মেলনের আয়োজকগণ অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনদিনের জন্য পুরো হোটেল ভাড়া নিয়ে নিয়েছিলেন। তাই হোটেলে সাধারণত যে সব অনাচার অনিচ্ছা সত্ত্বেও চক্ষুপীড়ার কারণ হয় সেসবের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়নি। প্রথমত মদের উপস্থিতি ছিলো না, কারণ ঐ বস্তুটির সমঝদার কোন প্রাণী ঐ তিনদিন সেখানে ছিলো না। গানের আওয়ায ছিলো না, বরং হোটেলের প্রত্যেক কামরায় লাউডস্পীকারেই আযান শোনা যেতো এবং তৃতীয় তলায় বিরাট হলঘরে জামাতের সঙ্গে নামায হতো, যা আমরা জানতে পেরেছিলাম রাত্রে।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর যোহরের আযান হলো। আমরা তিনজন কামরায় জামাত করলাম। তারপর নীচে নেমে এলাম আজকের অবশিষ্ট কর্মসূচী জানার জন্য, যার প্রথমটা ছিলো দুপুরের আহার, তবে যেভাবে সেটা সম্পন্ন হলো তার জন্য উপযুক্ত শব্দ হলো ‘মধ্যাহ্ন ভোজ’। মেহমানদারির এ আজব পদ্ধতির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো না। চিরদিনের ঘরকুণো মানুষের এসব জানবার কথাও নয়। নীচের তলায় লিফট থেকে নেমে হাতের ডান দিকে ‘ডাইনিং হল’। সাজসজ্জা ও আয়োজন সবই রাজকীয়। ধারণা ছিলো, খুব বেশী হলে চেয়ার-টেবিল এবং ছুরি-কাটাচামচ থাকবে, আর হোটেলের পক্ষ হতে নিযুক্ত পরিবেশক খাবার পরিবেশন করবে। কিন্তু না, হলে প্রবেশ করে ঠিক ডানপাশে থরে থরে ‘হাজার’ পদের খাবার সাজানো। মাছ-গোশতই যে কত কিসিমের! এমনকি গুঁড়ো মাছও বাদ যায়নি। সবজীও কয়েক প্রকার। ভাত-টিও তিন-চার রকম। কোনটা সাদা, কোনটা পোলাও জাতীয়; কোনটা রুটি, পাওরুটি, কোনটা তন্দুরজাতীয়।

একটু সামনে এগুলে বিভিন্ন প্রকার সালাদ এবং আঙুর, সেব, তরমুজ থেকে শুরু করে জানা-অজানা হরকিসিমের ফল। এর পর হলো মিষ্টির এলাকা। বিভিন্ন আকারের এবং অসংখ্য প্রকারের। একটাকে মনে হলো বিরাট মধুর চাক, সবাই ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নিচ্ছে। কৌতূহলবশত আমিও নিলাম। আসলে এটাও একপ্রকার মিষ্টি, যার স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি। তিনদিনে একবারও মনে পড়েনি, আমি ডায়াবেটিসের রোগী।

যাক, শুরুর দিকে ফিরে আসি। প্রথমে হাতে নিতে হবে ‘বাসন-বাটি’; নিলাম। তারপর দাঁড়াতে হবে লাইনে; তাও দাঁড়ালাম, বিশপঁচিশ-জনের পরে। এখানে এই একটা বিষয় শুধু ছিলো, যার সঙ্গে পরিচয় ছিলো মাদরাসা-জীবনে। ছাত্ররা থালা-বাসন নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতো, যা আমার খুবই খারাপ লাগতো। তাই মাদরাসাতুল মাদীনায় ‘দস্তরখান ও পরিবেশন’ ব্যবস্থার প্রচলন করেছি।

লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করার দৃশ্যটা মাদরাসায় দেখেছি, তবে নিজেকে কখনো লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। আজ এত বড় আন্তর্জাতিক হোটেলে এসে কিনা সেটাই করতে হলো!

দেখতে দেখতে আমাদের পিছনেও দীর্ঘ লাইন হয়ে গেলো। প্রত্যেকে বেশ সময় নিয়ে যথেষ্ট সমঝদারির সঙ্গে খাবার তুলে নিচ্ছেন। এখানে মনে হলো, খাছ মানুষও বুঝি সময়বিশেষে আম মানুষ হয়ে যায়! আমরা তিনজন এবং আরো দু’চারজন পরিমিত পরিমাণে খাবার নিলাম। অনেকেই দেখলাম, যা নিলেন তার অর্ধেকও ব্যবহার করতে পারলেন না; টেবিলেই পড়ে থাকলো এবং নষ্ট হলো। পদ্ধতিটা আমার কাছে না অভিজাত মনে হলো, না অপচয়-মুক্ত; ঝামেলামুক্ত অবশ্য বলা যায়।

খাবার নিয়ে কোণের এক টেবিলে গিয়ে বসলাম। পুরো হল মেহমানে পরিপূর্ণ। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার। কালো আছে, সাদা আছে, আছে আমাদের মত, না কালো, না সাদা। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মেহমানদের সহজেই আলাদা করা যায়। খুব ভালো লাগলো যে, সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন তা নয়; খাচ্ছেন, আবার নিজেদের মধ্যে কথাও বলছেন, তবে নীচু স্বরে; কোন রকম শোরগোল নেই। আমার পাশে যিনি বসেছেন তিনি তিউনিসিয়ার মেহমান। তিউনিসিয়া থেকে সাতজন এসেছেন, তিনি সর্বকনিষ্ঠ। মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছেন। এখন এক শায়খের সান্নিধ্যে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করছেন, সঙ্গে আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করছেন। তার কথা বলার ধরন খুব ভালো লাগলো। যথেষ্ট বিনয়ী। জিজ্ঞাসা করলেন, শায়খ ইয়াসির আব্দুল বাসিত আব্দুস্-সামাদ-এর ক্বিরাত কেমন লেগেছে?

বললাম, দুঃখিত, আমরা গতকাল ছিলাম না, আজ ঘণ্টা দুয়েক আগে এসে পৌঁছেছি। তিনি খুব আফসোসের সঙ্গে বললেন, ‘হায়, তোমার সৌভাগ্য যদি তোমাকে একদিন আগে পৌঁছে দিতো! অনেক বড় কিছু তোমার হাতছাড়া হয়ে গেলো। এমন তিলাওয়াত হয়ত তুমি জীবনে কখনো শুনোনি। ওয়াল্লাহিল আযীম, হৃদয় বিগলিতকারী, চক্ষু সিক্তকারী এবং রূহকে শীতলকারী তিলাওয়াত! আল্লাহ করুন, তিনি যেন আবার তিলাওয়াত করেন, আর তুমি তা শুনতে পাও।তার উচ্ছ্বাস যখন শেষ হলো, জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তার বাবা আব্দুল্ বাসিত-এর তিলওয়াত শুনেছো? বললেন-

 

سمعته على الشريط ولم أسمعه حيا كما هو الظاهر

 ‘ফিতা’ থেকে শুনেছি, কিন্তু জানা কথা, জীবিত অবস্থায় শুনতে পাইনি।

বললাম, আমার সৌভাগ্য হয়েছে, তরুণ বয়সে তার তিলাওয়াত শুনেছি, যখন তিনি পাকিস্তান সফর করেছেন, আর বাংলাদেশ ছিলো পাকিস্তানের অংশ।

তিনি এমন মুগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে তাকালেন যেন স্বয়ং ক্বারী আব্দুল বাসিত-এর যিয়ারাত করে ফেলছেন!

ক্বারী আব্দুল বাসিত-এর তিলাওয়াতে তখন মুগ্ধ ছিলো সারা মুসলিম জাহান। এমনকি কোন পত্রিকায় দেখেছি, সোভিয়াত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভও নাকি তার তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু হয়ত স্বভাবগত কারণেই হারামের ইমামদের সহজ সরল তিলাওয়াতই আমার অন্তরে অধিক আবেদন সৃষ্টি করে। ইচ্ছে হয়, শুনতে থাকি, শুনতেই থাকি।

তিউনিসীয় যুবক মনে হলো কথা বলতে ভালোবাসেন, নিজে থেকে আবার বললেন, তাহলে তো জামে আবী আইয়ূব আনছারী রা.ও তোমার দেখা হলো না! গতকাল সেখানে জুমু‘আ পড়ার প্রোগ্রাম ছিলো। বড় আত্মিক প্রশামিত্ম লাভ হয়েছে সেখানে। হাজার হাজার তুর্কী ভাই জুমু‘আয় সমবেত হয়েছিলো মেহমানদের এক নযর দেখার জন্য। এমন মুহববতের নমুনা আমার এ চোখদু’টো আর কখনো দেখেনি-

إن في هذا القوم لبقيـة من الخير

এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো কল্যাণ অবশিষ্ট রয়েছে।

ইতিমধ্যে তার খাওয়া হয়ে গেলো এবং ‘আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ’ বলে তিনি উঠে গেলেন।

খেয়াল করিনি, আমীর ছাহেব কখন উঠে গিয়ে শরবত নিয়ে এসেছেন, শুধু নিজের জন্য নয়, আমারও জন্য। বললেন, আপনার পছনদ জিজ্ঞাসা না করেই নিয়ে এলাম।

অবাক হয়ে বললাম, এ আবার কোত্থেকে এলো। ইশারা করে দেখালেন, ঐ যে শরবতের এলাকা। আমের শরবত আছে, কমলা, আঙুর, যা ইচ্ছা নিতে পারেন, নীচে পাত্র ধরে আলাদা আলাদা বোতামে টিপ দিন। গরম গরম চা-কফিও আছে, দুধসহ এবং দুধ ছাড়া, বোতাম টিপলেই হলো!

অবাক হওয়ারই কথা, এ দেখি রীতিমত আলিফলায়লার ভোজসভা!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 



[1] লাগানো হয়েছে, কথাটা ইচ্ছে করেই বলা হলো না।

 

 

advertisement