যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

ইসলামের নিরাপত্তানীতি এবং নাগরিকের প্রাণরক্ষার দায়িত্ব

শরীফ মুহাম্মদ

আল্লাহ তাআলা সূরায়ে মায়েদায় যে ইরশাদ করেছেন তাতে খেতাব যদিও বনী ইসরাঈলকে করা হয়েছে, কিন্তু সে এরশাদে বর্ণিত নির্দেশনা ও হেদায়েতগুলো মূলত গোটা মানবজাতির জন্যই প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) ‘কেউ যদি কাউকে হত্যার বদলা ব্যতীত অথবা যমীনে ফাসাদ ছড়িয়ে দেওয়ার শাস্তি ব্যতিত হত্যা করে তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ বাঁচালো সে যেন সব মানুষের প্রাণ বাঁচালো।’ -সূরা মায়েদা ৫ : ৩২

  ইসলাম নাগরিকদের প্রাণরক্ষার অধিকারের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে। এখানে নাগরিক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো রাষ্ট্র অথবা রাজ্যে বসবাসরত এমন মানুষ, যার ওই দেশে অবস্থানের আইনগত অধিকার রয়েছে। যদিও নাগরিক শব্দের শাব্দিক অর্থের মধ্যে ‘নগরের বাসিন্দা’ বা শহর কিংবা নগরসংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান, কিন্তু পরিভাষায় কোনো দেশে বসবাসরত যে কোনো মানুষকেই নাগরিক বলা হয়; চাই তিনি নগরের বাসিন্দা হন অথবা হন মফস্বল কিংবা গাঁয়ের বাসিন্দা, অথবা গৃহহীন। সব অবস্থাতেই তিনি নাগরিক। এতে বর্ণ ও গোষ্ঠীর কোনো পার্থক্য নেই। নেই ধর্ম ও বিশ্বাসের কোনো বিভাজন। বরং কোনো দেশ বা রাজ্যের সীমানায় বসবাসরত এবং ওই রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতি অনুগত মানুষ মাত্রই ওই দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এই স্পষ্টতা এজন্য আনতে হয়েছে যে, ইসলাম নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা করেছে কথাটি বলা হলে আবার এ প্রশ্ন না তৈরি হয়ে যায় যে, তাহলে গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকার সুরক্ষার কথা নেই কেন? তাই নাগরিক শব্দটির মর্ম এ আলোচনায় স্পষ্ট থাকা দরকার। ইসলাম প্রত্যেক নাগরিকের সব রকমের অধিকারের সুরক্ষা দিয়েছে।

  সাধারণত নাগরিকদের অধিকারগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।

     ১. ধর্মীয় অধিকার ২. রাজনৈতিক অধিকার ৩. অর্থনৈতিক অধিকার ৪. সামাজিক অধিকার।

  এখানে আমরা যে অধিকার নিয়ে আলোচনা করছি সেটি হচ্ছে নাগরিকের প্রাণরক্ষার অধিকার। এটি মূলত বর্ণিত চারভাগের অধিকারের মধ্যে চতুর্থভাগ- সামাজিক অধিকার-এর অন্তর্ভুক্ত। বরং প্রাণরক্ষার অধিকার হচ্ছে সামাজিক অধিকারসমূহের মাঝে সবচেয়ে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। একটি ইসলামী প্রশাসন এবং ইসলামী রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের জীবন রক্ষার যিম্মাদার। প্রাণ বাঁচানো প্রত্যেক নাগরিকেরই অধিকার। তাই মানুষ তথা নাগরিকের প্রাণ বাঁচাতে ইসলাম নিয়মিত আইন বানিয়েছে এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এ বিষয়টি তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শুধু আইন-কানুন আর শস্তি নির্ধারণের মধ্য দিয়ে প্রাণের সুরক্ষা হয় না। বরং কঠোরভাবে সেইসব আইন ও শাস্তি বাসত্মবায়নের মাধ্যমেই জান-প্রাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেতে পারে। অপর দিকে এ কথাও সত্য যে, নাগরিক-প্রাণের সুরক্ষার দায়িত্ব কেবলমাত্র রাষ্ট্রেরই নয়, বরং এ বিষয়ক কিছু দায়িত্ব ইসলাম দিয়েছে নাগরিকদেরও। ইসলাম চায় নাগরিকরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাবেন এবং সুরক্ষা দিবেন অপর নাগরিকের জান-প্রাণেরও। কোনো নাগরিক যদি নিজের প্রাণ নিজে না রক্ষা করে ইসলামী শিক্ষা ও বিধানের আলোকে সে-ও মারাত্মক গোনাহগার হবে।

  সহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজে নিজে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে মারা যায় দোযখেও তার এ শাস্তি (গড়িয়ে পড়া) হতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ খেয়ে তার জীবন খতম করবে দোযখেও তার হাতে বিষের পেয়ালা থাকবে এবং সে বিষ পান করতে থাকবে। যে ব্যক্তি কোনো অস্ত্রের সাহায্যে নিজেকে হত্যা করবে দোযখেও সে অস্ত্র তার হাতে থাকবে এবং ধারালো অস্ত্র সে নিজেই নিজের পেটে ঢুকাতে থাকবে।’ সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৭৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯

  সেজন্যই প্রত্যেক নাগরিকের নিজের প্রাণের সুরক্ষা নিজে করাও অতি জরুরি। এ বিষয়ে বাস্তব অবস্থা থেকে কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা জানি, সড়কপথে বিভিন্ন রকম ট্রাফিক সিগন্যাল বা চিহ্ন রয়েছে। ট্রাফিকের এ জাতীয় আইন-কানুন ও চিহ্নমালা বানানো হয়েছে নাগরিকদের প্রাণের সুরক্ষার জন্য। এভাবে দ্রুতগতির নিয়ন্ত্রণও করা হয় জীবনের সুরক্ষার জন্য। এ ক্ষেত্রে কোনো নাগরিক যদি ট্রাফিক-বিধি লংঘন করে তাহলে সে যেন জীবনের সুরক্ষা রহিত করলো। এভাবে সে আল্লাহ তাআলার কাছেও অপরাধী সাব্যস্ত হলো। তেমনিভাবে রাষ্ট্রের যেসব আইন-কানুন ও বিধি-বিধান নাগরিকদের জীবন রক্ষার জন্য বানানো হয়েছে সেসব আইন ও বিধি মেনে চলাও নাগরিকদের জন্য আবশ্যকীয়।

  একইভাবে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব অপর নাগরিকের প্রাণ রক্ষায় ভূমিকা রাখা। ইসলামের শিক্ষা এমনই। অপর নাগরিকের মামুলি কোনো ক্ষতিও যেন না হয়- ইসলাম তো সে শিক্ষাই দেয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রা. নবীজীর ইরশাদ বর্ণনা করেছেন। নবীজী ছোট ছোট পাথরকণা নিক্ষেপ করতেও নিষেধ করে বলেছেন, কখনো এতে দাঁত ভেঙে যায়, কখনো এতে চোখ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৪৭৯

হযরত আবু মূসা রা. রেওয়ায়েত করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমাদের মসজিদ কিংবা বাজারে যায় এবং তার হাতে তীর থাকে তবে সে যেন তীরের ধারালো অংশে হাত দিয়ে ঢেকে রাখে, যেন কোনো মুসলমান আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।’ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৭৭৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৫৮৭

  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো নাগরিকের প্রতি অস্ত্র দিয়ে ইঙ্গিত করতেও মানা করেছেন এবং বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্য হতে কেউ যেন কোনো মুসলমান ভাইয়ের প্রতি অস্ত্র দিয়ে ইশারা না করে। কেননা ইশারাকারীর তো জানা নেই যে, হয়তো শয়তান তার হাত থেকে অস্ত্র টেনে নেবে এবং (সে অস্ত্র তার ভাইয়ের গায়ে লাগাবে।) তখন এই অস্ত্রধারী ব্যক্তি জাহান্নামের গর্তে গিয়ে পড়বে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৭২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬১৭

  সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের প্রতি ধারালো অস্ত্র দিয়ে ইশারা করে তার প্রতি ফিরিশতারা অভিশাপ দিতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ওই অস্ত্রটি রেখে দেয়; যদিও ইশারাকৃত ব্যক্তি ইশারাকারীর আপন ভাই হয়ে থাকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬১৬

নবীজী অপর মুসলমানের ওপর হাতিয়ার উত্তোলনকারীকে মুসলমানদের সীমানা বহির্ভূত ঘোষণা দিয়ে ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের উপর হাতিয়ার উঠায় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০৭০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০

  ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানের জান অপর মুসলমানের জন্য সম্মানীয় সাব্যস্ত করেছে এবং অপরের জীবনে ক্ষতি পৌঁছানোকে হারাম ঘোষণা করেছে। নবীজী ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় তোমাদের এক মুসলমানের জন্য হারাম হচ্ছে অপর মুসলমানের রক্ত (জীবন), সম্পদ ও সম্মান। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭

  এখানে এ প্রসঙ্গটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে যে, কেবল হত্যা বা মারামারির ক্ষেত্রেই প্রাণ রক্ষার অধিকারের বিষয়টি সীমাবদ্ধ নয়। বরং যানবাহন, লঞ্চ-বিমান ও কলকারখানায় পর্যন্ত জীবনরক্ষাকারী নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রাখাও দায়িত্বশীলদের কর্তব্য। অন্যথায় ত্রুটিপূর্ণ কিংবা অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার কারণে নাগরিকদের প্রাণ ক্ষয়ের ঘটনা ঘটলে সেটিও ইসলাম নির্দেশিত প্রাণরক্ষার অধিকার-বিরোধী ঘটনা হিসেবে গণ্য হবে, যা মূলত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হওয়ার নামান্তর। অথচ এ ক্ষেত্রটির প্রতি সমাজের অনেকেই যথাযথ নযর দিচ্ছেন না।

  আল্লাহ তাআলা প্রাণরক্ষার জন্য আইন ও শাস্তির বিধান দিয়েছেন। রয়েছে প্রাণের বদলে প্রাণদণ্ডের কিসাসের বিধান। আবার নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদের সম্মতিতে (দিয়াতের মাধ্যমে) প্রাণদণ্ড থেকে রেহাইয়ের সুযোগও দিয়েছেন। তবে মনে রাখার মতো বিষয় হচ্ছে, প্রাণরক্ষারক্ষ্যে প্রাণদণ্ডের বিধানের ক্ষেত্রে ইসলামের যে নির্দেশনা রয়েছে তা যে কোনো মানুষ নিজের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করতে পারে না। পারে না কেউ প্রতিশোধের জযবা ও ক্রোধে কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আইন হাতে তুলে নিতে। বরং সেসব দণ্ড বাস্তবায়ন করতে পারবে কেবল রাষ্ট্র এবং ন্যায়ানুগ বিচারব্যবস্থা। কিংবা তাদের নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ সে দণ্ড কার্যকর করতে পারে। তবে নিজের ও পরিবারের মানুষের জীবন রক্ষার জন্য লড়াই করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের। তিরমিযী ও আবু দাউদে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ এবং যে নিজের পরিবারের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে-ও শহীদ। -তিরমিযী, হাদীস ১৪২১; আবু দাউদ, হাদীস ৪৭৭২

     ইসলাম নাগরিকদের জীবন ও প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে রাষ্ট্রের ওপর। একই সঙ্গে অন্য নাগরিকদের উপর। প্রাণরক্ষার অধিকারের সুনিশ্চয়তার জন্য একটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, এ বিষয়ক ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা বা চালু করার উদ্যোগ এবং প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বিশেষত যেসব অপরাধের ক্ষেত্রে ইসলামী হদের বিধান রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো রকম সুপারিশ, ছাড় বা নমনীয়তার অবকাশ না রাখা চাই। বরং সেসব ক্ষেত্রে প্রমাণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় কঠোরতা বজায় রাখাই কাম্য হওয়া উচিত। তবেই কেবল ‘কেসাস’-এর বিধানে ‘জীবনের সুরক্ষা’ থাকার কুরআনী দর্শন বাস্তবায়িত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা সব রকম ধ্বংসাত্মক ও বিনাশী উপকরণ ও উপলক্ষ থেকে নাগরিকদের জীবন ও প্রাণের সুরক্ষা রুন। আমীন।

 

 

advertisement